নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আমি কেউ নই, আমি আমার নই, আমি তোমার নই, আমি তুমিও নই

বেচারা

Walid

বেচারা › বিস্তারিত পোস্টঃ

প্রশ্ন ফাঁস, গলার ফাঁস (দ্বিতীয় ও তৃতীয় পর্ব)

২০ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ রাত ১১:০১

।।--।। (পর্ব-২)
---------চার;
এক গ্রামে এক লজিং মাস্টার থাকত যার বেতন, খানাপিনা গ্রামবাসী চাঁদা তুলে দিত। একবার নতুন চেয়ারম্যান হলেন একজন। তিনি ভাবলেন, ব্যাটা সামান্য যায়গীর মাস্টারকে এত সুবিধা দেবার দরকার কী? তিনি মাস্টারের ফ্রি খানা বন্ধ করে দিলেন। মাস্টার তবু গ্রামের স্কুলে পড়ানো বন্ধ করলেন না। চেয়ারম্যান ভাবল, খানা বন্ধ করেও ব্যাটা যায়নি তাহলে বেতনও বন্ধ করা যাক। তো তাই করা হলেও মাস্টার তবু চাকরী না ছেড়ে গ্রামে রয়ে গেল আর পড়ানো চালু রাখল।

মাতবর ভাবে ভালইতো, বিনা পয়সায় বেশ খাটিয়ে নেয়া যাচ্ছে। ব্যাটার নিশ্চই ঠ্যাকা আছে। নাহলে এভাবে কেউ খাটে এত অপমান করার পরেও। এভাবে এক বছর গেল। হঠাৎ একদিন দেখা গেল মাস্টার লাপাত্তা।সারাগ্রাম খুঁজেও তাকে পাওয়া গেল না। মাতবর সাহেব গ্রামবাসীকে কথা দিলেন অতিসত্বর নতুন মাস্টার নিয়োগে দেবেন। এমন মাস্টার পয়সা দিলে কত মিলবে। তিনি পরদিন দলবল নিয়ে স্কুল গেলেন বাচ্চারা কেমন পড়াশোনা করে তা দেখতে।

বাচ্চাদের তিনি কিছু একটা লিখতে দেয়ার পর সবাই দেখল সবগুলো বাচ্চা সব অক্ষর লিখছে উল্টোভাবে আর ডানদিক হতে। গ্রামবাসী বুঝল মাস্টার মশাই গোস্যা করে দীর্ঘমেয়াদে তাদের কি সর্বনাশ করে দিয়ে গেছে। আমার মাঝে মাঝে মনে হয় কী জানেন? বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থাটা ঠিক ওইরকম ধীরে ও নিরবে ধ্বংস হচ্ছে নানা কারনে। স্লো পয়জনের মতো এই দেশের প্রজন্ম, শিশু, শিক্ষাব্যবস্থার সর্বনাশ ঘটে যাচ্ছে ভেতরে ভেতরে, সবার অগোচরে। বোধ, সৃষ্টিশীলতা, চিন্তাশক্তি-এই তিনটি অতি আবশ্যক শিক্ষা ছাড়াই বেড়ে উঠছে বিশাল শিক্ষিত (!) জনগোষ্ঠী।

-------পাঁচ;
প্রশ্ন কিভাবে ফাঁস হয় সেই প্রশ্নের উত্তর আমি দিতে যাব না। সেটা যদি আমার জানাই থাকত, তাহলে বিশ্বাস করুন, আমি এতবড় লম্বা প্রবন্ধ ফেঁদে সময় নষ্ট না করে সোজা পুলিশের কাছে যেতাম আর রাস্তাটা ওদের বলে দিতাম। যাতে আর কেউ প্রশ্ন ফাঁস করতে না পারে। শিক্ষাগ্রহন নিয়ে আমার নিজস্ব কিছু বঞ্চনা ও ফ্রাস্ট্রেশন থাকলেও আমি মন হতে বিশ্বাস করি, একটি দেশকে শেষ করে দিতে হলে তার শিক্ষাব্যবস্থাকে শেষ করে দেয়াই যথেষ্ট। আমি বরং তার চেয়ে আপনাদের বলি, কেন ফাঁস হয় প্রশ্ন।

উত্তরটা সোজা।

শর্টকাটে পরীক্ষায় ভাল ফল করা। আর এটা যে শুধু ফাঁকিবাজ শিক্ষার্থী/পরীক্ষার্থীরাই করে, তা না। সারাবছর যারা পড়াশোনা করে এমন ছেলেমেয়েরাও এখন ফাঁস হওয়া প্রশ্ন পেতে চায়। নিজের প্রস্তুতিতে আস্থার অভাব, প্রস্তুতিকে আরেকটু হেল্প করা, প্রস্তুতির ঘাঁটতি পোষানো কিংবা স্রেফ পড়াশোনা না করেই প্রশ্ন জেনে উত্তর লিখে রাতারাতি পাশ (আসলে পড়ুন জিপিএ ৫) পাবার দুরাশাতেই শিক্ষার্থী ও পরীক্ষার্থী (আর এখন বাবা-মা ও শিক্ষক)রা প্রশ্ন ফাঁসের সুযোগ নিতে উদগ্রীব। শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকদের তীব্র চাহিদা ও আকাঙ্খার কারনেই ফাঁস হওয়া প্রশ্নের বিশাল সরবরাহ চ্যানেল গড়ে উঠেছে। ভেবে দেখুনতো, বাজারে যদি আলুর চাহিদা না থাকে তবে কি কেউ আলু চাষ করত?

ব্যাপক (বলা ভাল, মড়কের মতো) চাহিদা থাকাই প্রশ্নপত্র ফাঁস বন্ধ না হবার মূল কারন। আর এখনতো প্রশ্ন ফাঁস ও তার বেচাকেনা একটি বিশাল বিজনেস। যুগের সাথে তাল মিলিয়ে প্রশ্নপত্রের আগাম বিকিকিনি রীতিমতো ডিজিটাল ও সিস্টেমেটিক হয়ে গেছে। আপনার যদি ইচ্ছা আর টাকা থাকে, তবে যেকোনো বোর্ড পরীক্ষা, নিয়োগ পরীক্ষা, যোগ্যতা বা নিবন্ধন পরীক্ষা, মূল্যায়ন পরীক্ষা, বোর্ড বা স্কুলের পরীক্ষা-কোনো পরীক্ষার প্রশ্নই আর অধরা নয়। হাত বাড়ালেই আসল প্রশ্ন। তবে ঠিক কেন প্রশ্নগুলো পরীক্ষার আগের রাতে বা ২ ঘন্টা আগে ফাঁস হয় (৫/৭ দিন আগে না হয়ে) সেটি একটি দ্রষ্টব্য প্রশ্ন রইল সবার কাছে।

-----ছয়;
একটা গোটা সমাজ যখন শিক্ষার আসল উদ্দেশ্য ভুলে স্রেফ সার্টিফিকেট অর্জন আর চাকরী বাগানোর উপায় হিসেবে ডিগ্রী হাসিল করতে চায়, নিজের যোগ্যতার বদলে শর্টকাট পথে যখন চাকরী পেতে চায়, যোগ্যতা না থাকা স্বত্ত্বেও যখন সফলতার চুড়ান্তে যেতে চায়, যে সমাজে কাগজ তথা সার্টিফিকেটকে কাবেলিয়াত বলে মানা হয়, যে সমাজে ডিগ্রি থাকাকেই শিক্ষা বলে মনে করা হয়, যে সমাজে জিপিএ-৫ পাওয়াকেই উন্নত শিক্ষা বলে মানা হয়, যে দেশে উচ্চহারে (বা গণহারে) সর্বোচ্চ রেজাল্ট পেলে তাতে কারো সন্দেহ জাগে না, যে দেশে গণহারে পরীক্ষায় পাশ করলে কেউ তাকে অস্বাভাবিক মনে করে না, যে দেশে ওই তথাকথিত রেজাল্টধারীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে না পারলে উল্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশ্নের মানকে প্রশ্নবিদ্ধ হতে হয় বিভিন্ন পর্যায় হতে, যেনতেন প্রকারে রেজাল্ট ভাল করার কোনো বিকল্প তো সে দেশে কেউই ভাববেই না।

ছোটবেলায় মা-বাবা আমাদের আশির্বাদ করতেন এই বলে, “মানুষের মতো মানুষ হও।” আর আজকালকার বাবা-মা তাদের সন্তানের কাছে একটা জিনিসই চান, “জিপিএ-৫”। বাবা-মা যখন নিজে অশিক্ষিত হয়েও সন্তানকে বাধ্য করেন নিজেদের অপ্রাপ্ত স্বপ্ন সন্তানের মধ্যে দিয়ে পেতে, সন্তানকে যেকোনো মূল্যে জিপিএ-৫ পেতে, একটা গোটা রাষ্ট্রের একটা পুরো জেনারেশন যখন বই, খাতা, কলম, পরীক্ষা বাদ দিয়ে মোবাইল, ইন্টারনেট, ফেসবুক ও ইউটিউবে বেশি ব্যস্ত থাকে সারাবছর, সেদেশে শিক্ষার্থী ও পরীক্ষার্থীরা তো প্রশ্ন ফাঁসের অপেক্ষাতেই থাকবেন।

------সাত;
নকলের অস্তিত্ব আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় বরাবরই ছিল। এমনকি সেই সত্যযুগেও। তবে এখনকার নকল বা প্রশ্নফাঁসের মড়কের সাথে তার কিছুটা তফাত ছিল, আর তা হল, সবসময়ই নকল করা ছিল ঘৃনিত ও নিম্নশ্রেনীর কাজ। যারা নকল বা শিক্ষকের সাথে যোগসাজশ করে পরীক্ষায় ভাল ফল করার চেষ্টা করতে, ধরা পড়লে তাদের সামাজিক বয়কটের মুখে পড়তে হত। কিন্তু নব্বইয়ের দশকের পরের দিকে নকল রীতিমতো মড়কে পরিনত হয়। নকলকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে যায় এদেশের সুযোগ্য (!) নকলবাজ, সরবরাহকারী, ক্রেতা ও কারবারিরা। নকলকে কেন্দ্র করে শিক্ষককে খুন করে ফেলার নজিরও তৈরী হয়। কেন্দ্রের শিক্ষকদের যোগসাজসে তাদের ছাত্রদের নকল করাতে প্রাতিষ্ঠানিক উপায় অবলম্বনের মতো অবনমন ঘটে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায়। পৃথিবীর নিয়ম হল এক্সট্রিম না হলে কোনো অন্যায়, অনিয়ম অবসান হয় না। একটা সময়ে কোনো এক ঘটনার প্রেক্ষিতে নকলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষিত হয়। আর তারপরে বছরের পর বছর ধরে শিক্ষক, সরকার, পুলিশ, ছাত্র, সুধীসমাজের ঐকান্তিক আর সাড়াশি চাপে নকল নেমে গেছে সেই সত্যযুগের পরিমানে। প্রশ্নফাঁসের বিদায় ঘন্টাও হয়তো বাজবে এবার। কারন একটা গোটা বাস, তাতে ভরা এসএসসি শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও অভিভাবকরা ফাঁস হওয়া প্রশ্নসহ ধরা পড়ে জেলে যাবার মতো দুঃসহ ঘটনাটা ঘটবার জন্যই হয়তো অপেক্ষা করছিল গোটা দেশ। এর আগে দীর্ঘকাল ধরে এদেশের এখনো বেঁচে থাকা কিছু ভাল মানুষ প্রশ্ন ফাঁস নিয়ে কথা বলে আসছিল। তাতে কেউ কান দেয়নি। এবারের এই ঘটনাটার পরে মনে হচেছ দেশটা একটু নড়েচড়ে বসছে। কোর্ট এ রীট হয়েছে আর তাতে দুটো কমিটি ফর্ম হয়েছে। যদিও আমি সন্দিহান এতে সত্যিকারের পরিবর্তন কতটা হবে তা নিয়ে। কারন ওই কমিটি করেছে কোর্ট। কিন্তু প্রশ্নফাঁসের এই মহামারি থামানোর মূল কারিগর সরকারী মেকানিজম। খেয়াল করুন। সরকার মানে কোনো বিশেষ সময়কালের বা বিশেষ সরকার নয়। সরকার মানে হল সরকার as a whole। তো, সরকারী মেকানিজম যতক্ষন রাজনৈতিক অঙ্গিকার হিসেবে প্রশ্নফাঁস রোধকে না নেবে, ততক্ষণ কোনো উদ্যোগই আলোর মুখ দেখবে না। আমি বিশ্বাস করি, সেই অঙ্গিকারের অভাব হবে না। সেটা বলার জোরদার লজিক আছে

পর্ব-৩:

--------আট;
কেন ফাঁস হওয়া প্রশ্নের এত চাহিদা? কেন প্রশ্ন ফাঁস হওয়াটা এত আকাঙ্খিত? আসুন দেখি কয়েকটি না বলা কারন:-

ক.আমাদের স্কুল, কলেজ ও ইউনিভার্সিটি হতে মৌলিক পড়াশোনা বহু আগেই উঠে গেছে। এখন শিক্ষার্থীদের শিক্ষা নিতে হয় বিদ্যায়তনের বাইরে। ফলে তাদেরকে প্রস্তুতি ও জানার ঘাটতির বিপরীতে রেজাল্ট ধরে রাখতে প্রশ্ন ফাঁসের অপেক্ষায় থাকতেই হয়।

খ.প্রশ্নফাঁসের মড়ক শুরু হবার পর হতে আজ পর্যন্ত এটি বন্ধ করতে বা জড়িতদের শাস্তি দিতে তেমন কোনো কড়া উদ্যোগ চোখে পড়েনি। নকল বা ফাঁসের বিরুদ্ধে মিডিয়াতে হুঙ্কার ছাড়াটা কোনো কাজেই দেয় না।

গ.বেড়া নিজেই যখন বাগান খেয়ে ফেলে তখন আর কোন বুদ্ধি কাজে আসে? শিক্ষকরা ও অভিভাবকরাই এখন প্রশ্ন ফাঁসের সুযোগ নেন। তারাই শিক্ষার্থীদের প্রশ্ন সাপ্লাই করেন। যাদের কথা ছিল বিবেক হয়ে ওদের রক্ষা করার।

ঘ.ফাঁস হওয়া প্রশ্ন পাওয়া একেবারে দোকানে গিয়ে এক প্যাকেট প্যারাসিটামল কেনার মতোই সহজ হয়ে গেছে। প্রশ্ন যদি এত বিনা আয়াসে পাওয়া যায়, তবে তো স্বয়ং যুধিষ্ঠিরেরও মতি টলতে বাধ্য।

ঙ.চাকরীর বাজারে তীব্র প্রতিযোগীতা (২৬ লক্ষ বেকার), চাকরীর বাজারের তীব্র সংকোচন, তীব্র দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি, ভুলনীতি, বেকারত্ব, দীর্ঘসূত্রীতা চাকরীপ্রার্থীদের হতাশায় নিমজ্জিত করে রাখছে। নিরুপায় মানুষ যেকোনো প্রকারে বিপদ উদ্ধারে বেপরোয়া কাজ করবে এটাইতো স্বাভাবিক।

চ.সার্বিকভাবেই গোটা দেশেই লোভ, উচ্চাশা, বেপরোয়া অর্জন, অসুস্থ্য প্রতিযোগীতার এক মহামারি চলছে। সৎ-অসৎ যেকোনো প্রকারে উদ্দেশ্য হাসিল করা, লক্ষ্য অর্জন, উপরে যাওয়া, সফল হওয়ার ইঁদুর দৌড়ে মানুষ বুভুক্ষুর মতো প্রতিনিয়ত উপরে যাবার রাস্তা খুঁজতে গিয়ে নৈতিকতা ও সততার কোনো তোয়াক্কা করার আর দরকার মনে করছে না। আর আমাদের যতই খারাপ লাগুক, এই বঙ্গদেশের সমাজে একসময় অসতততা আর দূর্নীতির বিরুদ্ধে যে সোশ্যাল ট্যাবু ছিল, আজ সেটা বিলীন হয়ে গেছে সমাজ পরিবর্তনের বন্যায়। ফলে এখানে কোনো অন্যায়ই এখন আর অন্যায় বলে তেমন পরিগনিত হয় না। ভাবুনতো, ফাঁস হওয়া প্রশ্নে পরীক্ষা দিতে আদৌ কেউ কোনো লজ্জা অনুভব করে কিনা আজকাল?

ছ.প্রশ্নফাঁস একটি অত্যন্ত লাভজনক ব্যবসা আজকাল। সারাবছরব্যাপী চলা বোর্ড পরীক্ষা, নিয়োগ পরীক্ষা, নিবন্ধন পরীক্ষা, ভর্তি পরীক্ষায় ফাঁস হওয়া প্রশ্ন বিক্রী করেই জীবিকা চলে একটি বড় সংখ্যক মানুষের। ব্যবসার নিজস্ব গতি থাকে। যে জিনিসেরই মার্কেট তৈরী হয়, সেটাই পন্য হিসেবে কারবারী বাড়বে। আর যখন পণ্যের চাহিদা তীব্র, তখন স্রেফ দেশপ্রেমের দোহাই দিয়ে সেই মড়ক ঠেকানো যায়না।

জ.একজন সৎ শিক্ষার্থী বা পরীক্ষার্থী যখন দেখে, সে সারাবছর পড়েও জিপিএ ৫ পায় না, আর সারাবছর না পড়ে ফাঁস হওয়া প্রশ্ন কিনে পরীক্ষা দিয়ে কেউ পায় গোল্ডেন জিপিএ, আর এটা বারবার ঘটতে থাকে, তখন নীতির আপ্তবাক্য কোনো কাজে আসবে না-এটাই তো স্বাভাবিক।

ঝ.প্রশ্ন প্রণয়ন ও তার বিতরনের যে মান্ধাত্যার আমলের সিস্টেম আমাদের দেশে অনুসরন করা হয়, তার পরও প্রশ্ন ফাঁস হবেনা-এমন আশা করাটাই হাস্যকর। দুয়ার খুলে ঘুমাব আর আশা করব চোর তার নৈতিকতাবোধ হতে চুরি করতে আসবে না-এটা পাগলের প্রলাপ।

ঞ.প্রশ্ন ফাঁস হয়না কিংবা প্রশ্ন ফাঁস হলে কঠিন ব্যবস্থা-এমন আত্মপ্রসাদ বা ফাঁকাবুলি আওড়ানোটাই আমার মনে হয় সবচেয়ে বড় কারন আরো বেশি করে প্রশ্ন ফাঁস হবার।

ট.শিক্ষার মান নিয়ে বহুদিন থেকেই বোদ্ধারা কথা তুলে আসছেন। পাশের হার দেখে শিক্ষার হার মাপার যে আত্মঘাতি চর্চা আমরা অনুসরন করছি বিগত অনেক বছর ধরে তার অবশ্যম্ভাবি পরিণতি হিসেবে স্রেফ পাশ করা বা একখানা ভাল ফলের সার্টিফিকেট থাকার বাইরে শিক্ষার মান, গভীরতা, মূল্য ওসব রীতিমতো অপাংক্তেয় বস্তুতে পরিণত হয়েছে সবমহলে। একটি গোটা কমিউনিটির বা জেনারেশনের মধ্যে যখন এই ভুল বোধ কাজ করে যে, ভাল রেজাল্ট বা ভাল চাকরী বাগাতে পারাই সাফল্য, তখন সেই মাকাল ফলকে অর্জন করতে ভুল রাস্তা অবলম্বন করা হতে কে কাকে ফেরাতে যাবে?

ঠ.পরীক্ষা ও প্রশ্নপত্র নিজেই দায়ী ফাঁস হবার পেছনে। বিশ্বের শ্রেষ্ঠ কতগুলো শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে আছে জাপান ও ফিনল্যান্ড। মোটামুটি ৮-১০ ক্লাস পর্যন্ত তাদের কোনো ফর্মাল পরীক্ষাই নেয়া হয় না। আমাদের এখানে সেই ডায়াপার পড়ার বয়স হতেই শুরু হয় একটি শিশুর পরীক্ষা দেয়া। আর সেই হতে প্রতি বছর কমপক্ষে ৩টি টার্ম পরীক্ষা, ক্লাস টেষ্ট, মক টেষ্ট, পিএসসি, জেএসসি, এসএসসি, এইচএসসি, অনার্স, টিউটোরিয়াল, ইন কোর্স, মাস্টার্স-হাজারে হাজারে পরীক্ষার ভারে জর্জরিত আমাদের পরীক্ষার্থীরা।

তারপরতো আছেই ভর্তি পরীক্ষা আর চাকরী পাবার জন্য শত শত পরীক্ষা। এত এত পরীক্ষা দিতে গিয়ে মানুষের ধৈর্যচ্যুতি ঘটতে বাধ্য। আর এত এত পরীক্ষায় কাবেলিয়াত পেতে চুরির আশ্রয় নেয়াটাতো সম্ভবই।

কারন নয়, একটি ভিন্ন বিষয় বলব। এত এত ফাঁসের মড়কের মধ্যে কখনো পিএসসি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বা বুয়েটের প্রশ্ন ফাঁস হবার কথা শুনিনি। বিষয়টা ভাববার মতো।

---নয়;
কীভাবে প্রশ্ন ফাঁস আমাদের সর্বনাশ করছে তার কিছু নমুনা সরাসরি শুনুন।

ক.একটি গোটা জেনারেশন চৌর্যবৃত্তিকে সঠিক জেনে বড় হচ্ছে। নৈতিকতা, সততা, পরিশ্রম, অধ্যবসায়, অধ্যয়ন, আত্মসম্মানবোধ, দায়বদ্ধতা-এই কয়টি অতি আবশ্যক মানবীয় ব্যাপার না নিয়েই বড় হচ্ছে আমাদের সন্তানেরা। আমাদের প্রজন্ম।

খ.অভিভাবকরা হারাচ্ছেন সন্তানদের কাছে সম্মানের আসন। যেই অভিভাবক নিজে তার সন্তানের জন্য ফাঁস হওয়া প্রশ্নের জোগাড়ে নামেন, সন্তানের কাছে তার অবস্থান কী হতে পারে?

গ.বুদ্ধিবৃত্তি, শিক্ষার মান, সৃষ্টিশীলতা, সৌন্দর্যবোধ, ন্যায়ানুগতা, প্রতিযোগীতা, উপযুক্ততা, নৈতিক শিক্ষা হারিয়ে যাচ্ছে শিক্ষার গোড়া হতে।

ঘ.সহজ কথায় বলতে গেলে শিক্ষার্থীরা শিখছে না কিছুই-প্রত্যক্ষ একাডেমিকসও না, শিক্ষার আলোরতো প্রশ্নই ওঠে না।

ঙ.ফাঁস হওয়া প্রশ্নে চাকরী পাওয়ায় অযোগ্য, অদক্ষ, অকর্মন্য, অসৎ, ধান্দাবাজ, নিম্নমানের কর্মীতে ছেয়ে যাচ্ছে সরকারী ও বেসরকারী প্রতিষ্ঠান। তাদের কাছ থেকে দেশ বা প্রতিষ্ঠান কী সেবা পাবে? কোন মানের পাবে? আর সবচেয়ে বড় বিপদ হল, নকল করা প্রশ্নে শিক্ষক পর্যন্ত হচ্ছে স্কুল হতে ইউনিভার্সিটিতে। ওইসব শিক্ষকরা তাদের শিক্ষার্থীদের নিশ্চই গোবিন্দচন্দ্র দেব, ড. আলিম., ড. শহিদুল্লাহ কিংবা প্রফেসর জগদীশ চন্দ্রের ন্যায় মানসম্পন্ন ও মানবীয় শিক্ষাদান করবেন না? বরং তারা ক্ষমতা পেয়ে যে পথে তারা এসেছেন, সেটার পালে আরো বাতাস দেবেন। এর ডোমিনো এফেক্ট পড়বে গোটা দেশে।

চ.নকল আর প্রশ্নফাঁসের এই চলমান মড়ক কয়েক প্রজন্ম যদি চলতে দেয়া হয়, তবে একটা গোটা জাতির অকর্মন্য ও নিম্নশ্রেনীর বুদ্ধিবৃত্তিতে নেমে যেতে কোনো বাঁধা রইবে না।

ছ.একদিকে এমনিতেই অত্যন্ত মানহীন, অনুপযোগী, পুরোনো, সেঁকেলে, গতানুগতিক, থিওরিটিক্যাল ও বিশ্বের সাথে সঙ্গতিহীন শিক্ষা কারিক্যুলাম ও শিক্ষা ব্যবস্থা প্রচলিত আছে এদেশে। তার উপর সেই সামান্য শিক্ষাও যদি পড়াশোনা ছাড়া স্রেফ প্রশ্ন পেয়ে পরীক্ষা দিয়ে সার্টিফিকেট দিয়ে দিতে থাকে তবে আজ হতে বছর কুড়ি পড়ে দেশের কোনো সরকারী বা বেসরকারী প্রতিষ্ঠান এমনকি সরকার চালানোর জন্য বিদেশ হতে লোক ভাড়া করতে হবে।

জ.আমাদের অতি উন্নত (!) শিক্ষার মানের কারনেই দিনকে দিন বিভিন্ন ইউনিভার্সিটি ও সরকার আমাদের দেয়া সার্টিফিকেটকে অগ্রাহ্য করার নির্দেশ জারি করছে। আমাদের ডাক্তারীর সার্টিফিকেট, ইঞ্জিনিয়ারদের সার্টিফিকেট, ইউনিভার্সিটির সার্টিফিকেট বিশ্বের যেকোনো উন্নত দেশে অগ্রহনযোগ্য হিসেবে ঘোষনা ইতোমধ্যেই হওয়া শুরু করেছে। যেই সার্টিফিকেট দেশের বাইরে আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহনযোগ্যতা পাবে না, সেই জিপিএ-৫ কিংবা ১০০ ভাগ পাশ দিয়ে আমরা কী করব?

ঝ.প্রশ্নফাঁস একটি অসম প্রতিযোগীতা সৃষ্টি করে শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রে। ফলে মেধাবী ও পড়ুয়া মানুষদের বিপরীতে অমেধাবী ও ফাঁকিবাজরা পয়সা বা ধূর্ততার বদৌলতে ভাল ভাল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কিংবা বড় বড় চাকরী বাগাতে থাকলে দেশ মেধাবীদের সেবা হতে বঞ্চিত হতে থাকবে। যতসব ভাঁড় আর গাধাদের হাতে পড়বে গোটা দেশ। পাশাপাশি মেধাবীরাও মুখ ফিরিয়ে নেবে গোটা সিস্টেমের ওপর হতে। যার পরিণতি হবে ডোমিনো এফেক্টের মতো।

আমি আগেই বলেছি, প্রশ্নফাঁস বলতে শুধু স্কুল কলেজের প্রশ্নফাঁস নয়, যেকোনো পাবলিক পরীক্ষা, নিয়োগ নিবন্ধন পরীক্ষা, ভর্তি পরীক্ষা, প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানের পরীক্ষা সবকিছুর প্রশ্নপত্র ফাঁসকেই বোঝাচ্ছি। আর প্রশ্নপত্র ঠিক কীভাবে ফাঁস হয় সেটা একটি টেকনিক্যাল বিষয়, আর আমার সেই বিশেষজ্ঞ জ্ঞান যদি থাকত তবে কী করতাম সেটা আগেই বলেছি।
তাছাড়া প্রশ্নপত্র কীভাবে ফাঁস হচ্ছে আর তা আটকাতে কী করতে হবে সেটা শিক্ষা সংশ্লিষ্ট সরকারী বেসরকারী প্রতিষ্ঠানগুলো বেশ ভালভাবেই জানে বলে আমার বিশ্বাস। তাই ওই সম্পর্কে খুব একটা কথা বললাম না।
শুধু এতটুকুই বলতে পারি, গোটা সমাজে ব্যাপকহারে অসুস্থ্য প্রতিযোগীতা, পলিটিক্যাল কমিটমেন্টের অভাব, গা ছাড়া দৃষ্টিভঙ্গি, নৈতিকতার মড়ক আর অন্যায়কে প্রশ্রয় দেয়াই প্রশ্নফাঁসের ননটেকনিক্যাল কারন। হয়তো আসল কারনও।

কারন যাই হোক, ওভারঅল শিক্ষার মানেরতো বারোটা বেজেই গেছে। প্রশ্নফাঁস সেই পতনের কফিনে শেষ পেরেকটি ঠুকে দিচ্ছে। প্রশ্নফাঁস করে এই জাতি নিজেই নিজের গলায় ফাঁস পড়িয়ে যাচ্ছে।

আর বাবা-মায়েরা যারা সন্তানকে ফাঁস হওয়া প্রশ্ন জোগাড় করে দিচ্ছেন, তাদের বলি, নিজে দায়িত্ব নিয়ে যখন সন্তানকে চৌর্যবৃত্তি আর অসততা শিখাচ্ছেন, তখন বুড়ো বয়সে তারা আপনাকে দেখভাল করার মতো নৈতিক মানবিক শিক্ষা কিছুতেই পাবে না। আর আপনাকে কষ্ট করে বৃদ্ধাশ্রমেও আর রেখে আসবে না।

স্রেফ রাস্তায় নিয়ে ছেড়ে আসতে অমন শিক্ষিত সন্তানদের একটুও বুক কাঁপবে না।

প্রথম পর্বের লিংক: Click This Link

মন্তব্য ২ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ২১ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ রাত ১২:০৬

দয়িতা সরকার বলেছেন: আপনি অনেক সুন্দর করে গুছিয়ে বলেছেন। এক দম আমার মনের কথা। আমি ভাবছি এখন কার জেনারেশনের বাবা মায়েরা কিন্তু ৯০ বা তার কিছূ পরের। তাঁরাই যদি তাদের বাচ্চাদের হাতে প্রশ্নপত্র তুলে দেয় ।তাদের পরের বাবা-মা কি করবে।

২৫ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ দুপুর ১:০৩

বেচারা বলেছেন: তারপরের ব্যবস্থাও তৈরী। বাবা-মায়েরা বাচ্চাদের আর স্কুলে পাঠাবেন না। তারা বাজার হতে শিক্ষা ক্যাপসুল কিনে খাইয়ে দেবেন। তারও পরের দিকে গর্ভবতি মাকে ডিরেক্ট ক্যাপসুল খাইয়ে দেয়া হবে।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.