![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
বন্যেরা বনেই সুন্দর, শিশুরা মাতৃ ক্রোড়ে। যে যুগে এ প্রবাদটি প্রথম আওড়ানো হয়, তখন হয়তো আজকের মত কর্মজীবী মা’র অস্তিত্বই ছিল না। থাকলে সামঞ্জস্যপূর্ণ অন্য কোন অপশনও হয়তো থাকতো। না, না প্রবাদটির ব্যাপকতা বা মর্মার্থ নিয়ে তর্কাতর্কিতে জড়াতে চাই না। বলছি শিশুর নিরাপদ আশ্রয় স্থল নিয়ে। আজকের শহরের কর্মজীবী মায়েরা এত ব্যাস্ত থাকেন, কার কাছে থাকে বাচ্চাটা? নানী-দাদী! সে সুযোগও নেই। এক সময়ের ঐতিহ্যের যৌথ পরিবার এখন যেন রূপকথার গল্প। একান্নবর্তী পরিবার এখন আর চোখে পড়ে না। সময়ের আবর্তে, কালের পরিক্রমায় পরিবর্তিত সমাজ ব্যবস্থায় ভেঙে গেছে যৌথ পরিবার প্রথা। ফলে নানাবিদ সংকটে পড়েছে ছোট পরিবারগুলো, বিশেষ করে সবচে ছোট সদস্যরা!!
একটা সময় ছিলো যখন বাড়ির পুরুষরা শুধুই বাইরের কাজ করতেন, আর নারীরা শুধুই বাড়ির। কিন্তু বর্তমান চিত্রটা অনেকটাই বদলেছে। জীবনমান উন্নয়নের তাগিদে পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও অংশিদার হচ্ছেন সংসারের ব্যায় নির্বাহে। বর্তমানে নারী-পুরুষ দুইজনই সমান ভাবে ঘরে-বাইরের কাজে অবদান রাখছেন। এতে নারীরা যেমন সাবলম্বী হচ্ছেন, তেমনি পরিবারের সচ্ছলতায়ও হচ্ছেন অংশিদার। মূদ্রার উল্টো পিঠেই আছে সমস্যা, প্রধানত সন্তান লালন-পালনে।
বিকল্পও তৈরী করে ফেলেছি আমরা। বুয়া-বাই-মেড। যে নামেই ডাকি না কেন, একবার ভাবুন তো আপনার জীবনের অমূল্য সম্পদটা গৃহপরিচারিকার হাতে তুলে দিয়েছেন কমপক্ষে ৮ ঘন্টা...!!
আপনাকে বলছি, আপনার হাতের দামী এনরয়েডটা তাকে ধরতে দিয়েছেন কখনও? কখনও বলেছেন আপনার পার্টস্ থেকে নিজ হাতে মাসের বেতনটা নিয়ে নিতে? আমি নিশ্চিত, বলেন নি।
জ্বি, যার কাছে আপনার সিন্দুকের চাবিটা ৮ মিনিটের জন্য দিয়ে বাড়ির বাইরে যাবেন না। তার কাছে আপনার সন্তান দিয়ে ৮ ঘন্টা অফিস করছেন...!! এসময় আপনার সন্তান কি খাচ্ছে? কিভাবে ঘুমাচ্ছে? কেমন আছে? কেউ তাকে ধমকাচ্ছেনা তো? কেউ তাকে মারছে না তো?
ইট কাঠের শহরে এমন চিন্তা নিয়েই আমরা দিনের পর দিন পার করছি। সন্তানের সুন্দর ভবিষ্যতের আশায় এমন অনেক চিন্তা বিসর্জন দিয়েই চলেছে কর্মজীবী নারীদের জীবন। যার সুন্দর ভবিষ্যতের আশায় আপনি-আমি কাজ করছি বাইরে। তার বর্তমানটাই তো হুমকির মুখে পড়তে পারে।
সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে একটি ছবি সম্প্রতি ছড়িয়ে পড়েছে, যেখানে ভারতের এক নারী ব্যাংক কর্মকর্তা অফিসের চেয়ার-টেবিলে বসে কাজ করে চলেছেন, পেছনে মেঝেতে দুধের বোতলমুখে শুয়ে আছে তার ছোট্ট জ্বরে আক্রান্ত শিশু সন্তানটি। এটি একজন কমর্জীবী মায়েরই ছবি।
নিয়তির কাছে বন্দি কর্মজীবী মা তার ছোট্ট সন্তানকে রাখার জন্য পাননি কোন সুরক্ষিত স্থান। স্থিরচিত্রটি চুপ থেকেও অনেক কিছু বুঝিয়ে দিয়েছে। যদিও ছবিটি ভারতের এক মায়ের কাহিনী। বাংলাদেশের অবস্থাও খুব বেশি অনুকুল না, কর্মজীবী মায়ের সন্তান লালন-পালনে।
সরকারি আইন অনুসারে সরকারি চাকরিজীবী মায়েরা মাতৃত্বকালীন ছুটি উপভোগ করেন ৬ মাস। এখন অবশ্য অনেক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানেও মায়েদের এই অধিকার দেওয়া হচ্ছে। অন্যদিকে বেসরকারি চাকরিজীবীদের জন্য সরকারের কোনও নির্দিষ্ট নীতিমালা না থাকার কারণে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত মায়েদের মাতৃত্বকালীন ছুটি মালিকপক্ষের মজুরি অনুসারে ৪ থেকে ৬ মাসের মধ্যে ঘোরাফেরা করে। সুতরাং আমাদের আইন প্রণয়নকারীদের অদূরদর্শিতার কারণে মায়েরাও ভাগ হয়ে যাচ্ছেন সরকারি আর বেসরকারি এই দুই ভাগে।
সমাজ পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে শহুরে নাগরিক জীবনে যখন নিউক্লিয়ার ফ্যামিলি বা একক পরিবারের সংখ্যা বেড়ে চলেছে, তখন পিতৃত্বকালীন ছুটির অভাবে সন্তান জন্মের পর নতুন মাকে একাই হিমশিম খেতে হচ্ছে সন্তানের দেখাশোনার জন্য। ইউরোপের দেশগুলোতে মাতৃত্বকালীন ও পিতৃত্বকালীন ছুটির আইনকানুন বেশ পোক্ত। যুক্তরাজ্যের নতুন মায়েরা পুরো বেতনে ২৬ সপ্তাহ এবং বিনা বেতনে আরও ২৬ সপ্তাহ, মোট ৫২ সপ্তাহ বা এক বছর মাতৃত্বকালীন ছুটি উপভোগ করেন। নতুন বাবাদের জন্য পিতৃত্বকালীন ছুটি পুরো বেতনে ২ সপ্তাহ এবং বেতন ছাড়া আরও ২ সপ্তাহ, মোট ৪ সপ্তাহ। বিভিন্ন জরিপের ফলাফলে স্ক্যান্ডিনেভিয়ার দেশগুলোকে মানব উন্নয়নের সূচকে প্রগতিপন্থী ও সুখী সমাজের তকমা দেওয়া হয় তাদের পারিবারিক আর পরিবেশগত আইন কানুনের জন্য। স্ক্যান্ডিনেভিয়ার দেশ সুইডেনে মাতৃত্ব ও পিতৃত্বকালীন ছুটি মোট ১৬ মাস, মা-বাবা এই ছুটি ভাগাভাগি করে নিতে পারেন। যার মধ্যে ন্যূনতম ৩ মাসের বাধ্যতামূলক ছুটি বাবাকে নিতে হবে সন্তানের বয়স ৮ হওয়ার আগেই। সুতরাং শুধু সন্তান জন্মের পরই বাবার ছুটি নয় বরং সন্তানের বেড়ে ওঠার সময়েও বাবাকে ছুটি দেওয়ার বিধান করছে উন্নতবিশ্বের দেশগুলো। এদিকে আমাদের দেশে পিতৃত্বকালীন ছুটি নিয়ে কথা বললেই লোকে হাসাহাসি শুরু করে। অফিসগুলোতে তো বড় কর্তারা তেড়ে আসেন। আজও লোকেরা প্রশ্ন করেন- আঁতুড় ঘরে আবার বাবার কী কাজ ? অথচ হয়তো তিনিও বাবা হয়েছেন কিংবা কখনও বাবা হবেন।
অনেকের ধারণা, এই মাতৃত্বকালীন ছুটি যেন কর্মজীবী নারীর অধিকার নয়, কুড়িয়ে পাওয়া সহানুভূতি মাত্র।
কিন্তু আমাদের সংবিধান অনুযায়ী চাকরিতে প্রবেশে নারীর সম-অধিকারের বিধান রয়েছে।
২৮(১) অনুচ্ছেদে রয়েছে, ‘কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষভেদে বা জন্মস্থানের কারণে কোনও নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করিবেন না।’
২৮(২) অনুচ্ছেদে আছে, ‘রাষ্ট্র ও গণজীবনের সর্বস্তরে নারী পুরুষের সমান অধিকার লাভ করিবেন।’
২৮(৪)-এ উল্লেখ আছে, ‘নারী বা শিশুদের অনুকূলে কিংবা নাগরিকদের যেকোনও অনগ্রসর অংশের অগ্রগতির জন্য বিশেষ বিধান প্রণয়ন হইতে এই অনুচ্ছেদের কোনও কিছুই রাষ্ট্রকে নিবৃত্ত করিবে না।’
২৯(১)-এ অনুচ্ছেদে বলা আছে, ‘প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োগ বা পদ লাভের ক্ষেত্রে সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা থাকিবে।’
কর্মজীবী এই নারীরা সন্তান প্রসবের পর নবজাতকের লালন-পালনে পাচ্ছেন না প্রাতিষ্ঠানিক সহযোগিতা। যেসব নারীর সন্তান দেখাশোনার জন্য পরিবারে কেউ নেই তাদের অনেকেই সন্তানের জন্য কাজ ছেড়ে দিতে বাধ্য হচ্ছেন। আর যারা কষ্ট করে চাকরি করছেন ও সন্তান পালন করছেন তারা দুটি একসঙ্গে সামলাতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন। মা হওয়া এখন হুমকির মুখে, মা এবং সন্তান উভয়ের জন্য।
সরকারের রাজস্ব বাজেটের আওতায় ঢাকা শহরে ৭টি এবং ঢাকার বাইরে বিভাগীয় শহর রাজশাহী, চট্টগ্রাম, সিলেট, বরিশাল, খুলনাসহ মোট ১২টি ডে-কেয়ার সেন্টার নিম্নবিত্ত শ্রেণির কর্মজীবী-শ্রমজীবী মহিলাদের শিশুদের জন্য পরিচালিত হচ্ছে। এর বাইরে মধ্যবিত্ত শ্রেণির কর্মজীবী নারীদের জন্য ঢাকায় ৬টি ডে-কেয়ার সেন্টার মহিলা বিষয়ক অধিদফতরের আওতায় পরিচালিত হচ্ছে। কিন্তু এসব ডে-কেয়ার সর্বস্তরের কর্মজীবী নারীদের চাহিদা পূরণ করতে সক্ষম হচ্ছে না। এ কারণে শিশুসন্তান ও কর্মস্থল নিয়ে অনেককেই উভয় সংকটের মুখোমুখি হতে হচ্ছে।
সন্তান জন্মের পর প্রথম ৬ মাস শিশুর সুষ্ঠুভাবে বেড়ে ওঠার জন্য শিশুকে মায়ের বুকের দুধ খাওয়ানোর কথা। কিন্তু কর্মজীবী মায়েরা এ সুযোগ পাচ্ছেন না। ‘কর্মজীবী নারী’র পরিচালিত এক জরিপে দেখা যায়, ৫১ দশমিক ৩৫ ভাগ অফিস বা কারখানায় ডে-কেয়ার সেন্টারের অস্তিত্ব নেই। অথচ বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬ অনুযায়ী, যে প্রতিষ্ঠানে ৪০-এর অধিক নারী শ্রমিক আছেন সেখানে ৬ বছর বয়স পর্যন্ত শিশু সন্তানের জন্য শিশুকক্ষ বা শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্রের জায়গা থাকতে হবে। কিন্তু এ আইন বাস্তবে মানা হচ্ছে না, যার ফলে সন্তান পালনের জন্য বহু নারী শ্রমিককে কাজ ছেড়ে দিতে হচ্ছে।
পর্যাপ্ত ডে-কেয়ার সেন্টারের অভাব ও কর্মস্থলে ব্রেস্ট ফিডিং কর্নার না থাকায় তারা একদিকে সন্তানের যথাযথ যত্ন নিতে পারছেন না, অন্যদিকে কাজেও মনোযোগ কমছে। ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে প্রতিষ্ঠান ও রাষ্ট্র।
ভিডিওটি উগান্ডার। যদি সাহসে কুলোয়, তবেই ভিডিওটি দেখবেন..!!
©somewhere in net ltd.