![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের কুমিল্লা জেলা প্রশাসকের প্রধান সহকারী (বর্তমানে এই পদবীর নাম জেলা প্রশাসকের ব্যক্তিগত সহকারী) পদে কর্মরত থাকাকালে, ৭১’র ২৫ শে মার্চ কালো রাত্রে পাকবাহিনী এদেশে হত্যাযজ্ঞ শুরু করে। শুরু হয়ে যায় প্রতিরোধ, স্বাধীন বাংলাদেশের জন্যে মুক্তিযুদ্ধ। আমার বাবা আমাকে আমার মায়ের পেটে রেখেই কুমিল্লার সোনামুড়া সীমান্ত হয়ে ভারতে পালিয়ে যান।
বাবার কাছে জেনেছি, ভারতে স্বল্পকালীন যুদ্ধ প্রশিক্ষণ শেষে ৪ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সাথে তিনি বাংলাদেশে প্রবেশ করেন এবং ভৈরব সেতু ডেমোলিশনের আগে রাজাকার বাহিনীর হাতে ধরা পড়েন। রাজাকার বাহিনী ধৃত মুক্তিযোদ্ধাদেরকে অমানবিক নির্যাতন করে তাঁর চোখের সামনে হত্যা করে। বাবা কৌশলে রাজাকারদের হাত থেকে পালিয়ে বেঁচে আসেন, কিন্তু রাজাকারদের নারকীয় নির্যাতনে হারিয়ে ফেলেন তাঁর স্মৃতিশক্তি।
দেশ স্বাধীন হবার পর বেশ কিছুদিন বাবার সন্ধান পাওয়া না গেলেও, ৭২ এর এপ্রিলে তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আমাদের গ্রামে ফিরে আসেন। অনেকটা সুস্থ হবার পর তিনি কুমিল্লায় আমার নানার বাড়ীতে যান। তখন আমি মায়ের কোলে, ৬ মাস বয়সী একটি শিশু। নানীর কাছে শুনেছি, বাবা সেদিন আমাকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে তাঁর মুষ্টিবদ্ধ ডান হাত উঁচিয়ে চিৎকার করে বলেছিলেন “জয় বাংলা...”!!!
সরকারী চাকুরীতে আর ফেরা হয়নি তাঁর। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নিজ গ্রামে একজন সাধারণ কৃষকের জীবন শুরু করেন তিনি। চাষাবাদের মৌসুম ছাড়া বছরের বাকী সময়জুড়ে স্বাধীনতার স্বাদ উপভোগ করতেন তিনি বাংলাদেশের এপ্রান্ত ওপ্রান্ত ঘুরে, যাযবরের মতো। ৭৪ এ জন্ম হয় আমার ছোট ভাইটির। আমাদের পড়াশোনার সুবিধার্থে আমরা থেকে যাই কুমিল্লায়, আমার নানার বাড়ীতে।
আমার স্কুলে যাওয়া শুরু হয়েছে ১৯৭৫ সালে। ঐ বছরের ১৫ ই আগস্ট জাতির জনককে সপরিবারে হত্যার খবরে ভয়ানকভাবে বিচলিত হয়ে পড়েন বাবা! কষ্টার্জিত স্বাধীনতা অন্ধকারে আবার হারিয়ে যাবার ভয়েই, হয়তোবা, মানসিকভাবে বিপর্যস্ত মানুষটি আরো অসুস্থ হয়ে পড়েন! প্রায় বিকারবিহীন একাকী জীবন অতিক্রম করতে থাকেন তিনি! নিজেকে গুটিয়ে ফেলেন নিজেরই ভিতরে, আমৃত্যু।
১৯৮১ সালে জেনারেল জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর, অনেকটা উজ্জীবিত বাবার হাত ধরে প্রথম আমি চাতলপাড় বাজারে যাই। এর আগেও কয়েকবার আমি গ্রামে গেছি, কিন্তু বাবার সাথে ঐদিনের যাওয়াকে আমার কাছে মনে হয়েছে সত্যিকারের গ্রামে যাওয়া, সত্যিকারের আনন্দের যাত্রা।
লঞ্চ থেকে নেমে সাধু কাকুর মিষ্টির দোকানে ঢুকে বাবা আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, “কি খাবা?”
আমার প্রিয় মিষ্টি জিলাপী। আমি বললাম, “জিলাপী”।
আমাকে একটা টেবিলে বসতে বলে বাবা এগিয়ে গেলেন মিষ্টির দোকানের গদির (দোকানী যে টেবিলে বসে বিল নেয় এবং বড় বড় ডালায় মিষ্টি সাজিয়ে রাখে) দিকে। অকস্মাৎ সাজিয়ে রাখা জিলাপীর বড় ডালাটা বাবা একটানে তাঁর মাথায় তুলে নিয়ে বয়ে আনলেন ঠিক আমার সামনে, রাখলেন টেবিলের উপর এবং বললেন, “খাও...”!
সাধু কাকু বাবার এই কাণ্ড দেখে চেঁচামেচি শুরু করলেন।
বাবা তাঁকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, “দাদা, ডালার সব জিলাপীর দাম কত?”
“এক ছেলেকে এতো জিলাপী খাওয়াবা নাকি?” সাধু কাকু বাবাকে উল্টা প্রশ্ন করলেন।
বাবা হাসতে হাসতে বললেন, “আমার ছেলে এই বাজারে আজ প্রথম জিলাপী খাবে, তোমার দোকানের সব মিষ্টি আমি কিনে নিলাম।”
সাধন কাকু বাবার দিকে অবাক হয়ে তাকানোর পরপরই হেসে উঠে জড়িয়ে ধরলেন তাঁকে, তাঁর সব মিষ্টি বিক্রি হয়ে গেছে এজন্যে নয়, সন্তানের প্রতি বাবার ভালোবাসার বিশালতা দেখে। হাসি মুখে সাধু কাকু আমাকে বললেন, “খাও ভাতিজা, যতো মনে চায় খাও। তোমার বাবা অনেক বড় মনের মানুষ।”
আমি কয়টি জিলাপী ঐদিন খেয়েছিলাম ঠিক মনে নেই, তবে গোটা দশেকের কম নয়।
এরপর অনেক নামীদামী রেস্টুরেন্ট থেকে আমি জিলাপী কিনেছি, খেয়েছি, বাচ্চাদেরকে খাইয়েছি, কিন্তু বাবার দেয়া ঐ জিলাপীর স্বাদ কোথাও পাইনি।
পাইনি সন্তানকে খেতে দিয়ে উল্লসিত বাবার ঐ তৃপ্ত হাসিটুকুও...।
আমার জিলাপী খাওয়া শেষ হলে বাবা সাধু কাকুর দোকানের সব মিষ্টির দাম দিয়ে দিলেন এবং মিষ্টিগুলোকে বিশালাকৃতির হাঁড়ি ও ঝুড়িতে ভরে নৌকায় তুলে বাড়ীতে নিয়ে এলেন।
আমাদের গোষ্ঠীর জনশক্তি বিশাল। সব মিষ্টিই বাবা ঐদিন বিলিয়ে দিয়েছিলেন বাচ্চাদেরকে।
মাঝে মাঝে বাবা আমাকে একটু আধটু মুক্তিযুদ্ধের গল্প শোনাতেন। বেশীরভাগ সময়েই এড়িয়ে যেতেন এই প্রসঙ্গটি। এ বিষয়ে কোন প্রশ্নের উত্তর জানতে চাইলে তিনি হয়ে যেতেন নিরুত্তর, উদাসীন ও অন্যমনস্ক...।
বাবা “মুক্তিযোদ্ধা সনদ” পাননি বা পাবার চেষ্টা করেননি, আসলে ঐ সনদ তাঁর দরকারও হয়নি কখনো। ছোট্ট ও সাদামাটা সংসারে বড় হয়ে ২০ বছর বয়সেই আমি সেনাবাহিনীতে যোগদান করি। বাবার জীবনের আদর্শ লালন করা ছাড়া তাঁর মুক্তিযুদ্ধের সনদ বিক্রি করে কোন সুবিধা নেবার প্রয়োজন বোধ করিনি আমি কোনদিন।
বাবা আমার আদর্শ। আমি গর্বিত একজন নির্লোভ ও অনানুষ্ঠানিক মানসিকতার মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হতে পেরে।
তাঁর জীবদ্দশায় তিনি ভালো ছিলেন সমাজে ও সংসারে, বেঁচে আছেন আমাদের অন্তরে, শপথের শক্তিতে...।
মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বাবা আমার সঙ্গে সকল সেনানিবাসেই থেকেছেন। বিয়ের পর আমি প্রথম সরকারী বাসা বরাদ্দ পাই ঢাকা সেনানিনাসে, বনানী অফিসার’স কোয়ার্টারে। বাসায় উঠার পরই বাবাকে নিয়ে আসি আমার সরকারী বাসায়। মা থেকে যান কুমিল্লায়, আমার ছোট ভাইয়ের কাছে।
জানিনা কেন, আমাদের দুই ভাইয়ের মধ্যে বাবা আমাকেই ভালবাসতেন বেশী। বাবার সাথে নৌকায় চড়ে শাপলা তোলা, মাছ ধরা, ধান কাটা, পাট তোলা যেমন আমার কাছে ছোটবেলার অমূল্য স্মৃতি, তেমনি অত্যন্ত নম্র ও সহাস্য দাদার কোলে চড়া, তাঁর হাত ধরে হাটা আমার সন্তানদের কাছে থাকবে আনন্দের স্মৃতি হয়ে।
আমার স্ত্রীর হাতে বানানো লাল চা ছিল তাঁর অতি প্রিয় পানীয়। কখনো কখনো আমি ভুলে গেলেও আমার স্ত্রী বাবার জন্যে তাঁর প্রিয় ‘স্টার’ সিগারেট আনিয়ে রাখতে ভুল করতোনা। আমার বাবার ‘পুত্রবধূ ভাগ্য’ ছিল ঈর্ষনীয় রকমের ভালো।
৪ বছর আগে তিনি চলে গেছেন না ফেরার দেশে।
বাবার মৃত্যু আমাকে পীড়া দেয়না, কারন মৃত্যুই প্রাকৃতিক। কিন্তু তাঁর অনুপস্থিতি কখনো কখনো আমার মনে ভীষণ আক্ষেপ সৃষ্টি করে।
আরো কিছু দিন, কিছু মাস, কিছু বছর বাবা আমাদের মাঝে থাকলে কি এমন অসুবিধা হতো প্রকৃতির...!?
©somewhere in net ltd.