![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
রাসেলের শখ বলতে ঐ একটাই। ছবি তোলা।
এই ছবি তোলা ব্যাপারটা তার কাছে স্বপ্নের মতো। তখনো গ্রামে মোবাইল ফোন হাতে হাতে পৌঁছে নি। অতি গণ্যমান্য ব্যক্তিরা কেবল ব্যবহার করতে শুরু করেছেন। এখানে ছবি তোলার একমাত্র মাধ্যম মল্লিকপুরের রেসমা স্টুডিও। অতি প্রয়োজন ছাড়া গ্রামের মানুষের ছবি তোলার দরকার হয়না। তাই ক্যামেরা নামক বস্তু সচারাচর গ্রামে ঢোকে না। একমাত্র বিয়ে বাদিতে যাদের আহ্লাদ আকাশ ছোঁয়া তারা ক্যামেরা ভাড়া করে নিয়ে আসে। সেবার ভোটের ছবি তোলার জন্য বরকত হাজির বাড়িতে এক লোক এসেছিল। সেখানেই ক্যামেরার সাথে রাসেলের প্রথম আলাপ।
প্রথম দেখা। এবং প্রথম দেখাতেই প্রেম।
কিন্তু তার দুর্ভাগ্য তখন তার বয়স আঠারো হয়নি, ক্যামেরার সামনে বসে প্রেম মাখানো দৃষ্টিতে আর তাকানো হয়নি। এখন রাসেলের বয়স এগারো। অফিশিয়াল কাজের জন্য এখনও তার ছবির দরকার পড়েনি। তাই রেসমা স্টুডিওতেও তার পদচিহ্ন পড়েনি। আর রাসেলের মা বাবাও এতো সৌখিন না যে পরিবারের সবাই মিলে স্টুডিওতে গিয়ে ছবি তুলবে। অতএব নচিকেতার ঐ গানটার মতো তার মন শুধু স্বপ্নই দেখতে থাকল।
ইদানিং মানুষের আহ্লাদের সীমা বাড়ছে। বিয়ে, মুখে ভাত, খৎনাতে প্রায়ই ক্যামেরা ভাড়া করে আনা হচ্ছে। রাসেল খোজ রাখে কবে কার বাড়িতে অনুষ্ঠান। সুযোগ পেলেই দাঁড়িয়ে যায় ক্যামেরার সামনে। ক্যামেরাম্যান এই অযাচিত বালককে দেখে কুকুরের মতো ঘেউ ঘেউ করে উঠে—এই ছোড়া, থাপ্পড় খাবি, যা দুরে যা।
সে একপাও নড়ে না অবশেষে ক্যামেরাম্যান তেড়ে আসে মারতে, কান ধরে তাকে ফ্রেমের বাইরে রেখে আসে। ফিল্মের ক্যামেরা। দুইটা মাত্র ফিল্ম আনা হইছে। আজগুবি ছবি তুলে ফিল্ম নষ্ট করার কোন মানে নেই। তাছাড়া বিয়ে বাড়ির পক্ষ থেকেও বলে দেয়া থাকে দুইটা ফিল্মের মধ্যে পুরো বিয়ে সারতে হবে। তাই ক্যামেরাম্যানকে অনেক হিসাব নিকাশ করে ছবি তুলতে হয়। রাসেল এক পা দু পা করে আবার ক্যামেরার দিকে এগিয়ে যায়। ক্যামেরাম্যান বিষাক্ত দৃষ্টিতে তাকায়। দাঁত কটমট করে। মারতে তেড়ে আসে। ছেলে নাছোড়বান্দা। অবশেষে বিশেষ কৌশলে বালককে ক্যামেরার বাইরে রেখে ছবি তোলা হয়।
মন খারাপ করে রাসেল বাড়ি ফেরে। বাড়ি এসে শোনে মামা এসেছিল। দাওয়াত দিতে। ফরহাদ ভাইয়ের বিয়ে। মুহূর্তেই তার মন ভালো হয়ে যায়। আর একটা সুযোগ এবং তা সুবর্ণ।
বিয়ে। বিয়ে।
সেখানে নিশ্চয়ই ক্যামেরা আনা হবে। উত্তেজনায় সে লাফাতে থাকে। সে ঠিক করল এবার সে একশটা ছবি তুলবে। তার মামাতো ভাইয়ের বিয়ে। সে ছবি তুলবে না তো কে তুলবে। দিন যায়। কিন্তু রাসেলের অপেক্ষার প্রহর যেন কাটেনা।
বিয়ের আগের দিন। বাড়ি সাজানো হচ্ছে। ফুল, বেলুন রঙিন কাগজে ভরে গেছে সারা বাড়ি। রাসেল দেখল তার বয়সী অনেকগুলো মেয়ে বেলুন ফুলাচ্ছে। সে এদের চেনে না হয়তো মামির দিকের আত্মীয় হবে। মামা বাড়ির সাথে রাসেলদের যে খুব যোগাযোগ আছে তা না। তার মা পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করেছিল তার দরিদ্র বাবাকে। এদের আত্মীয় বলে পরিচয় করিয়ে দিতেই এরা বোধ হয় লজ্জা পায়। নিতান্তই বিয়ে বলে দাওয়াত করেছে।
রাসেল এগিয়ে গিয়ে বেলুন হাতে নিল ফুলাবার জন্য। এক তরুণী মেয়ে যে বেলুন ঝুলাচ্ছিল সে সাপের মতো ফোঁস করে উঠল-এই ছেলে বেলুন রাখ, রাখ বলছি। কিছুতে হাত দিবে না, এখান থেকে যাও। সাজানো হোক পরে দেখবা। যাও যাও।
রাসেলের কাপড় চোপড় চেহারা বিন্যাস দেখে মেয়েটি হয়তো ভেবেছে সে হয়তো কোন কাজের লোকের ছেলে বা প্রতিবেশি কেউ হবে।
মেয়েগুলি বেলুন ফুলাতে পারছে না, একটা বেলুন ফুলাতে তিন বছর লাগাচ্ছে।
রাসেল ভাবল- কি হতো তাকে বেলুন ফুলাতে দিলে, সে এক ফুঁতে বেলুন ফুলিয়ে দিত। পারবে ওরা কেউ...
রাতে বরকে মিষ্টিমুখ করানোর একটা ঘরোয়া আয়োজন হবে। বর যেখানে বসবে সেখানে সুন্দর করে সাজানো হয়েছে। রঙিন কাগজের ফাঁকে ফাঁকে লাল নীল বাতির ব্যবস্থা করা হয়েছে।
সাধারণত এই খাঞ্চা অনুষ্ঠানে বরের পাশে রাসেলদের বয়সী ছেলেমেয়েরা বসে থাকে। আর সামনে দুই পাশে কিছু জায়গা ফাঁকা থাকে যারা মিষ্টি মুখ করাতে আসবে তাদের জন্য। বরের সামনে খাঞ্চায় শত রকমের খাবার থাকে। আত্মীয় স্বজনেরা এক এক করে আসে বরকে মুখে প্রথমে কিছু একটা ধরে ছবি তোলে তারপর খাইয়ে উপহার দেয়। উপহার হয় বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই হয় টাকা। অনেক রসিক ভাবিরা এসে বরকে বোকা বানান। খাওয়ার জন্য বর মুখ এগিয়ে দিলেই তারা দ্রুত খাবারটা সরিয়ে নিজের মুখে পুরে দেয়। তারপর হাসির একটা রোল ওঠে।
ক্যামেরা চলে এলো সন্ধ্যার আগেই। রাসেল পোষা কুকুরের মতো ক্যামেরাম্যানের পিছনে পিছনে ঘুরছিল। বারবার জিজ্ঞেস করছিল- মামা, ও মামা ছবি কখন তুলবেন?
লোকটা তার উপর খুবই বিরক্ত- কারণ তাকেও বারবার এক কথা বলতে হচ্ছিল- রাতে অনুষ্ঠানের সময়।
রাত তখন বাজে সাড়ে আটটা। অনুষ্ঠান সবে শুরু হয়েছে। মরিচ বাতির বর্ণিল আলোর লুকোচুরি খেলায় ঝলমল করছিল সারা বাড়ি। রাসেল দাঁড়িয়েছিল রঙ্গমঞ্চের সামনে। সেখানে প্রচুর ভিড়। ভিড়ের লোকজনের মধ্যে বেশীরভাগই প্রতিবেশি। তার মামাতো ভাইয়ের বিয়ে অথচ সে কি না দাঁড়িয়ে আছে প্রতিবেশি ছেলেমেয়েদের সাথে। লজ্জার ব্যাপার। কিন্তু কি আর করা উপায় নেই। বরের পাশে বসার সুযোগ তার হয়নি।
মামির মাবাপের দিকের আত্মীয়দের ছেলেমেয়েরা আগে আগে থেকেই জায়গা দখল করে বসে ছিল। ওদের কত ছবি যে উঠছে। যতজন খাঞ্চা খাওয়াতে এসেছে সব ছবিতে তারা কমন। রাসেল যে এতক্ষণ ধরে খাঞ্চা মঞ্চের আশে আশে ঘুরঘুর করছে কেউ তাকে বসতে পর্যন্ত বলেনি।
একের পর ছবি উঠছে। কেউ বরের মুখে আপেল, কেউ মিষ্টি, কেউ পায়েশ ধরে ছবি উঠাচ্ছিল। সবার মুখে হাসি। এই হাসি মুখ গুলোর উপর ছলছল করুণ একটা দৃষ্টি পড়ছিল। যে মনে ছবি উঠাবার জন্য ভিক্ষুকের মতো ব্যাকুল এক আকুতি নিয়ে বসে ছিল। যদি কেউ এসে বলে— রাসেল তুমি এখানে দাঁড়িয়ে আছো কেন, যাও তোমার ফরহাদ ভাইয়ের পাশে গিয়ে বস।
এতো অপেক্ষার পর ফটো উঠানোর এমন সুযোগ হাতের কাছে পেয়েও হারাতে হবে। একথা রাসেল নামক বালকটি ভাবতেই পারলো না। যেমন করেই হোক ছবি তুলতেই হবে। বরের পাশে যায়গা নেই তো কি হয়েছে। যারা বরকে খাওয়াতে আসছে তাদের তো ছবি উঠছে। সেও খাঞ্চায় খাওয়াতে বসবে। বরের মুখে একটা আপেল ধরে থাকবে আর মিষ্টি করে হাসবে। তখনই ক্লিক করে ছবি উঠে যাবে।
তার মন আনন্দে নেচে উঠল। পরক্ষনেই মনে হল- বরকে খাওয়ানোর পর তো কিছু দিতে হয়। সে ভিড় ঠেলে বাইরে চলে এলো। মার কাছ থেকে টাকা নিতে হবে। মা রান্নাঘরে কাজ করছিল। মাকে টাকার কথা বললে মা রেগে বললেন- তুই ছেলে মানুষ তোকে খাওয়াতে হবে না। আমার কাছে টাকা নেই, এখন যা তো।
এরপর শুরু হল রাসেলের বিরতিহীন কান্না। কান্নার বন্যা থামাতে মা কোথা থেকে যেন একটা আধা ছেড়া, ময়লা দশ টাকার নোট এনে দিল। কান্না থামল। রাসেল টাকার দিকে তাকিয়ে ভাবল—এটা বরের হাতের মধ্যে লুকিয়ে দিতে হবে। কেউ যেন টের না পায় আধাছেড়া নোট টা সে দিয়েছে।
হাসলেই রাসেলের উচু দাঁত টা বের হয়ে যায়। সে প্রাণপণে চেষ্টা করল কোন মতেই যেন দাঁত বের না হয়ে যায়। দাঁতাল ছবি দেখলে বন্ধুরা হাসাহাসি করবে। একটা আপেল বরের মুখের সামনে ধরে সে ক্যামেরার দিকে তাকাল। তার দৃষ্টি ছিল পলকহীন। চোখের পলক যখন সে ফেলবে তখন যদি ছবি উঠে যায়। তাহলে তো ছবিতে তাকে অন্ধ দেখাবে। এই ভয়ে সে চোখের পলক ফেলছিল না। অনেক ক্ষণ এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকার জন্য তার চোখে পানি চলে আসছিল। ঠিক তখনই ফ্ল্যাশের আলো রাসেলের চোখে ঝলকানির মতো লাগে। তার মনের মধ্যে অদ্ভুত একটা শিহরণ দোলা দিয়ে যায়।
বিয়ে শেষ হয়। শুরু হয় রাসেলের ছবির জন্য অপেক্ষা। সে ছবি তুলেছে এই খবর প্রায় বাজার হয়ে গেছে। বন্ধুদের কাছে ভাব নিয়ে বলে-জানিস আমি ছবি তুলছি। তোদের দেখাবো।
মাঝে মাঝে তার সন্দেহ হয়, ক্যামেরার আলোর ঝলকানিতে তার চোখ কি বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো? যদি চোখ বন্ধ ছবি আসে তাহলে মাসুম রনিরা তো সারাক্ষণ ক্ষেপাবে। সে ভয়ে ভয়ে থাকে। এরকম যেন না হয় আল্লাহ।
অবশেষে একদিন বিয়ের সব ছবি তার হাতে আসে। চরম উত্তেজনা ও আনন্দ নিয়ে সে শত শত ছবির মধ্যে নিজের মুখটি খোঁজে। প্রথম থেকে শেষ। শেষ থেকে প্রথম।
হ্যাঁ পাওয়া গেছে। সে তার হাত দেখে ছবি সনাক্ত করল। একটা হাত ফরহাদ ভাইয়ের মুখে আপেল ধরে আছে। এটাই তার হাত। নিজের হাত চিনতে তার ভুল হয়না।
এই ছবিতেই সে ছিল। এই যে ওর হাত। কব্জির কাছে একটা কাটা দাগ আছে। কে অবিশ্বাস করবে যে এটা তার হাত নয়।
কি সুন্দর লাগছে ফরহাদ ভাইকে আর তার পাশে বসা তরুণীকে।
এতো সুন্দর ছবি তবু রাসেলের কান্না পাচ্ছে। চোখে জমতে শুরু করেছে জল।
©somewhere in net ltd.