নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

DISHI123#$%

নাহিদ হাসান

DISHI123#$% › বিস্তারিত পোস্টঃ

কবুল

০৯ ই মার্চ, ২০১৫ রাত ১:১৫

আজ হাফিজার বিয়ে। খাওয়া দাওয়ার পর্ব শেষ। এখন বিয়ে পড়ানো হবে। কাজী সাহেব নামাযে গেছেন। তিনি নামায থেকে ফিরলেই বিয়ের মূলকাজ শুরু হবে। বেলা পড়ে যাচ্ছে। এখন আরও অনেক আনুষ্ঠানিকতা বাঁকি। কন্যা পক্ষের সবার মুখেই একটা দুশ্চিন্তার ছাপ। কালমা না হওয়া পর্যন্ত এই ছাপ যাবে না।

আঙিনাতে বিশাল সাইজের একটা বিছানা পাতা হয়েছে। সেখানে ভাবি,মামী, চাচি, দুঃসম্পর্কের আত্মীয়, প্রতিবেশী জাতীয় মাঝবয়সী মহিলারা জায়গা দখল করে বসে আছে। শুধু বসে না ঝিম মেরে বসে আছে। উঠলেই তো জায়গা হারিয়ে যাবে। প্রতিবেশীরা জায়গা পেয়েছে বিছানার প্রান্তের দিকে আর নিকট আত্মীয়েরা আছে মাঝখানে।

বিছানার কেন্দ্রে সবার মধ্যমণি হয়ে বসে আছে হাফিজা। তার গায়ে হলুদ সন্ধ্যার শাড়ি। কপাল থেকে এক হাত ঘোমটা নেমে গেছে নিচে। সে স্বাভাবিক ভাবেই ছিল। এতো বড় ঘোমটা দেয়ার মতো লজ্জা তার লাগেনি। তবে গতকাল হলুদ সন্ধ্যার গোসলে আগে কোলে ওঠার ব্যাপারটায় খানিকটা লজ্জা পেয়েছিল। পাশে হাফিজার ছোট চাচি বসে আছেন। তিনিই একহাত ঘোমটা টেনে তাকে আবৃত করলেন। একটু পর বর পক্ষের লোক আসবে বিয়ে পড়াতে। কোন ভাবেই যেন মেয়ের এক চুল পরিমাণ ওরা না দেখতে পারে। এটা খুব অসম্মানের ব্যাপার।

ঘেমে জবজবে হয়ে গেছে সে। এতো মানুষ চারদিকে। মাথা নিচু করে চুপ করে বসে থাকতে হচ্ছে। ফ্যান পাওয়া গেলে ভালো হতো। এদের মাল্টিপ্লাগটা আবার নষ্ট। এখন সে উঠে যদি ফ্যান চায়। কে কি ভাববে। তার এখন প্রধান কাজ মাথায় ঘোমটা দিয়ে মুখে তালা মেরে ঝিম মেরে বসে থাকা। বিয়ের কন্যা বলে কথা। ভদ্রতার চূড়ান্ত পরীক্ষা দিতে হবে।

একটু আগে ইয়া সাইজের একটা লেদার কন্যা পক্ষের হাতে হস্তান্তর করেছে বরপক্ষ। কন্যা যেমনি হোক এই লেদার দিয়ে তাকে সুন্দরী করে তোলা হবে। সবাই লেদার বাক্সের উপর ঝুকে পড়েছে। হাফিজারও দেখতে ইচ্ছে করছিল। এতো আগ্রহ নিয়ে সবাই কি দেখছে। কিন্তু এটা সম্ভব না। সে বিয়ের কন্যা না? নির্লজ্জ হয়ে যাবে তো...


সে মাথা নিচু করে বসে ছিল। তার ঘোমটা পায়ে গিয়ে ঠেকেছে। ছোট চাচির নাকি স্যান্ডেল পছন্দ হয়নি। কে যেন বলল-মেকাপ বক্সটা ভালো না। শাড়িটা সবার পছন্দ হয়েছে। শাড়ি নাকি তিনটা। ঘোমটার ভেতর থেকে যা শুনল হাফিজা। একটা বিয়ের জন্য স্পেশাল আর দুইটা আলুঘাতা(নর্মাল)। গয়না নিয়েও কোন প্রশ্ন উঠল না।


হঠাৎ হাফিজা বুঝল সবাই নড়ে চড়ে বসছে। কিছু দেখতে পাচ্ছে নাতো। অনুমান করা ছাড়া উপায় নেই। বোধ হয় বিয়ে পড়াতে কাজীসহ অন্যান্য লোকজন আসছে। লোকজন এসে দাঁড়িয়ে পড়েছে বিছানার চারদিকে। কারণ হঠাৎ করেই সারা বাড়ি অসম্ভব নিরব হয়ে গেল। হাফিজা যেন সবকিছু হৃদয় দিয়ে অনুভব করতে পারছে।
তার হঠাৎ করেই ভয় করতে লাগলো। হৃৎপিণ্ডের শব্দ সে শুনতে পাচ্ছে। তার সারা গা কেঁপে কেঁপে উঠছে। দরদর করে ঘামছে তার সারা শরীর। কাজী সাহেব বিয়ে পড়ানোর অনুমতি চাইলেন। কার অনুমতি হাফিজা বুঝল না। কন্যা পক্ষের সবাই সমস্বরে বলে উঠল- শুরু করেন হুজুর, শুরু করেন।


হুজুর কিছু দেখে পড়ছেন মনে হল। মাঝে মাঝে আটকে যাচ্ছেন। সব কথা হাফিজার কানে আসছে না অবশ্য। যদিও সবকিছু সুনসান। সে কি তার অন্য জগতে চলে যাচ্ছে।

নাজিরপুর নিবাসী আব্দুর রসিদের একমাত্র পুত্র মোঃ কামাল হোসেনের সাথে রুপনগর গ্রামের জসীম উদ্দিনের তৃতীয় কন্যা মোছাঃ হাফিজা খাতুনের বিয়ে উশুল ত্রিশ হাজার টাকা এবং বাঁকি পঞ্চাশ হাজার পাঁচশো এক টাকা সর্ব সাকুল্যে আশি হাজার পাঁচশো এক টাকা দেন মোহরে মোছাঃ হাফিজা খাতুন আপনি কি মোঃ কামাল হোসেন কে স্বামী হিসেবে কবুল করলেন?

হাফিজার মনে হল, স্বামী শব্দটার জায়গায় অন্য কোন শব্দ বললে ভালো হতো। সে বেশ সাহসী মেয়ে। ইচ্ছে করলে দাঁড়িয়ে বলতে পারে—কাজী সাহেব, স্বামীর জায়গায় জীবনসঙ্গী শব্দটা বলুন।

তার ভেতর থেকে কে যেন বলে উঠল কথাটা বলিস না হাফিজা। সবাই তার কবুল শোনার জন্য অপেক্ষা করছে। কাজী আব্দুল ওয়াদুদ তার কোন একটা বইয়ে যেন লিখেছিলেন—শীঘ্র শীঘ্র কবুল লইয়া গেলে মেয়ের নামে লজ্জাহীনতার বদনাম রটিয়ে যায়।

হাফিজা ব্যাপারটা জানত। তাছাড়া তার আত্মীয়স্বজন, বান্ধবি সবাই বলে দিয়েছে প্রথমবার যেন ভুলেও কবুল বলিস না। এটা আসলে যে বিয়ে পড়ায় সেও জানে। কমপক্ষে পাঁচ ছয়বার পড়তে হয়। প্রথমবার পড়ার পর কন্যাকে তেমন টাইম না দিয়ে দ্বিতীয়বার শুরু করা হয়। এটা সবাই জানে মেয়ে প্রথমবার কবুল বলবে না। কাজী সাহেব দ্বিতীয়বার পড়ছেন।

হাফিজার মনে হল মাথাটা ধরেছে বোধ হয়। ভারি ভারি লাগছিল। সে কি তার চিন্তার জগতে ঢুকে যাচ্ছে। এরকম তার হয়। প্রচণ্ড মানুষিক চাপে সে যেন অন্য এক জগতে চলে যায়। সে জগতটা একান্তই তার। সেখানে সে চিন্তা করে। সেখানে সবকিছু হৃদয় দিয়ে অনুভব করা যায়। আজ চিন্তার বিষয় কবুল।

এইতো সে এখন এই আশ্চর্য শব্দটা বলার সাথে সাথে নতুন একটা পৃথিবী তৈরি হবে, চিন্তা ভাবনার ধরণ পাল্টে যাবে, কাজের ধরণ পাল্টে যাবে। তৈরি হবে নতুন নতুন সম্পর্ক। বাবা, মা, দাদা, মামা, খালা। কবুল বলার পর পরই সে অন্য জনের সম্পদ। অন্য একটা পরিবারের সদস্য। যে বাড়িতে বিশটি বছর ধরে তিলে তিলে গড়ে উঠল। তার সেই প্রিয় বাড়ি, তার ফুলের টব, তার বিছানা, রান্নাঘরে মার চুলার পাশে শুধু তার রান্নার জন্য ছোট্ট চুলাটি। সব ছেড়ে এই একটি অতি আযব একটা শব্দ তাকে নিয়ে যাবে নতুন একটা জীবনে। একটা জীবন থেকে অন্য জীবনে কনভার্ট হবার একটা মধ্যবর্তী অবস্থায় সে দাঁড়িয়ে আছে।

একটা জীবনের ধ্বংস আর একটা জীবনের উত্থান একসাথে দেখছে সে। কবুল বলার সাথে সাথে একটা ধ্বংস হবে অন্যটার উত্থান ঘটবে। কি অদ্ভুত একটা মুহূর্ত। কেমন একটা অনুভূতি। সব মেয়েই কি এই মুহূর্তটা এভাবে অনুভব করে। এভাবে কি ভাবনা গুলো তাদের তাড়িয়ে বেড়ায়। এই চরম কঠিন মুহূর্তে একই সাথে আনন্দ বেদনার কাব্য কিভাবে সবাই লেখে। মেয়েরা প্রচণ্ড জীবনীশক্তির অধিকারী হয়। তাদের সারা জীবনে যত বৈচিত্র্যময় কঠিন সব মুহূর্তের মধ্যে দিয়ে যেতে হয় ছেলেদের ততটা নয়।

শফিক আজ কি করছে কে জানে। যখন কবুল বলবে ঠিক সে সময় সে কি করবে খুব জানতে ইচ্ছে করছে হাফিজার। সে কি আজ দোকানে বসবে। নাকি নদীর পাড়ে গিয়ে অযথায় পানিতে ঢিল ছুঁড়বে। এদের জন্য কষ্ট হয় তার। বাবার বাড়ির এই বিশ বছরে মেয়েরা প্রেমে পড়ে বা ভালো লাগে অনেককেই। আবেগ থাকে বেশি। সিনেমার মতো তারা ডায়ালগ দেয়—তোমার সাথে গাছ তলায় ঘর বাঁধতেও আমি রাজি আছি।


ছেলে হয়তো মুদিখানার দোকানি, হয়তো কামলা, হয়তো ডিশ, গ্যাস লাইনের কর্মী, প্রাইভেট টিউটর, লেদের হাতে মুখে কালি মাখা ছেলেটা। এক সময় চাকুরে সব রাজকুমার যে কোথা থেকে আসে। ছোঁ মেরে নিয়ে যায় ভালোলাগা সেই মেয়েটিকে। একসময় ছেলেবেলার সেই প্রেম সবাই ভুলে যায়। আবেগ কমে যায়। বাস্তবতায় ফিরে যায় সবাই। মেয়েটি সুখে সংসার করে। ছেলেটি কাজ করে লেদে। সত্যি সবকিছু ভুলে যায় সে। রাঞ্ঝানার কুন্দনের মতো কেউ কেউ হতো থাকে। সেটার খোঁজ কেউ রাখেনা।

হাফিজার ডান পাশ থেকে কেউ একজন তাকে ধাক্কা দেয়। বোধ হয় তার ছোট চাচী। বেশ জোরে। বাম পাশে কেউ না থাকলে কাত হয়ে পড়ে যেত সে।
চাচি কথা বলছেন, দাঁতে দাঁত চেপে—কবুল বল হাফিজা, কবুল বল। সবাই রাগ করছে।

হাফিজা সম্বিত ফিরে পেলো। এর মধ্যে নাকি কাজী সাতবার পড়েছেন। সে তো কিচ্ছু শুনেনি। কোন কথা তার কানে ঢোকে নি। কোন আবোলতাবোল চিন্তার জগতে হারিয়ে গিয়েছিল সে। সেখানে অন্য কারো ঢোকার অধিকার নেই। তাই কাজীর কথাগুলো সেখানে প্রবেশ করেনি। হাফিজা এখন বাস্তবে। বিয়ের কন্যা। তার উপর টিকে আছে মা বাবার সম্মান। এই ছেলে ছাড়া যাবে না। ব্যাঙ্কে চাকুরী করে। সোনালি ব্যাঙ্কে চাকুরী করা সোনার ছেলে। অতএব অবাস্তব আচরণ করলে হবে না।
চাচী দাঁতে দাঁত চেপে আবারো বলছেন—কবুল বল হাফিজা। সবাই খুব বিরক্ত। এরা কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবে।
হাফিজা কোন কিছু না ভেবে বলে ফেলল—কবুল।


বুকের ভেতরটা ধড়ফড় করে উঠল। অন্য রকম একটা অনুভূতি তাকে ঘিরে ধরল। মনে হচ্ছে কি একটা নেমে গেছে বুক থেকে। না সুখ, না দুঃখ। তার সত্যিই কি বিয়ে হয়ে গেল। এতক্ষণ পর তার লজ্জা পেলো।
কত জোরে সে কবুল বলেছে সেটা তার মনে নেই। তার ঘোমটা ভেদ করে শব্দ কত দূর গেল সে সম্পর্কে তার কোন ধারণা নেই। সবাই বলে দিয়েছিল যেন কবুল ধীরে বলা হয়। জোরে কবুল বলাটা নির্লজ্জতার লক্ষণ।
আশে পাশে যেসব মহিলা বসে ছিল তারা সমস্বরে বলে উঠল—কবুল বলছে তো। শোনেন নি আপনারা। আমরা শুনছি কবুল বলছে।

বরপক্ষের যে সাক্ষী এসেছিল—সে বলল আমরা শুনিনি। তিনি তাদের পক্ষের আরও কয়েকজনকে জিজ্ঞেস করলেন—এই তোমরা কি শুনেছ?

বরপক্ষের লোকরা সমস্বরে বলল—না, আমরা শুনিনি। জোরে বলতে হবে।

এমন সময় ওদের মধ্যে একজন বলে উঠল—আটবার কালমা পড়ানো হল। মেয়ের কোন উত্তর নাই। মেয়ের কি বিয়েতে মত নাই। মেয়ের কি লাইন ছিল। কবুল বলতে এতো ঢঙ ক্যান? কাজী সাহেব আর একবার পড়ান। এই শেষ।

হাফিজা আর ঘোমটা দিয়ে বসে থাকতে পারলাম না। তখন বাবার করুণ মুখটি তার মনে আসেনি। তাহলে সে বোধ হয় উঠত না। সে ঘোমটা ফেলে দাঁড়িয়ে পড়ল। বিছানার কেন্দ্র থেকে—আমি বিশ্ব ছাড়ায়ে উঠিয়াছি একা চির উন্নত শির! ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়ায়েছে সে।

সবাই তার দিকে এমন করে তাকাচ্ছে যেন তারা ভূত দেখছে। চাচী তার হাত ধরে টানছেন বসাবার জন্য। এমন ঘটনা সাধারণত ঘটেনা। বিয়ের কালমা পড়াতে গিয়ে এই বিব্রতকর অবস্থায় কেউ বোধ পড়েন নি। তাদের চোখ ছানাবড়া হয়ে গেছে। বিয়ের কন্যা কবুল মঞ্চে কবুল না বলে দাঁড়িয়ে পড়েছে এটা কি করে বিশ্বাস করবে এরা।
হাফিজা কঠিন গলায় বলল—কাজী সাহেব আপনাকে আর পড়তে হবে না। আমি জানি আমি কবুল বলেছি। আমার বিশ্বাস বরপক্ষের লোকেরাও শুনেছে।

সে বরপক্ষের লোকদের উদ্দেশ্য করে বলল—আপনারা এক কাজ করেন, মাইক ভাড়া করে নিয়ে আসেন। আমি মাইকে কবুল বলব। আপনারা কি মনে করেন। যা বলবেন তাই হবে।

কথা গুলো বলার সময় মনে হচ্ছিলো—অনেক ক্ষণ পর সে নিজের মতো করে কথা বলছে, অভিনয় করাটা আসলেই বিরক্তিকর ব্যাপার। তাকে থামতে বলছেন আমার বাড়ির লোকেরা। কিন্তু তার কথা শেষ হয় নি। আরও কিছু কথা বাঁকি ছিল—
হাফিজা চাচা মামাদের ধমক উপেক্ষা করে কথা বলে যাচ্ছে--আমি তো এতো গুলো লোকের সামনে বার বার কবুল কবুল বলে চিৎকার করতে পারবো না। আমি একবার কবুল বলেছি। কিন্তু আপনাদের কথায় আমি কথা বলতে বাধ্য হলাম। চিৎকার করে যদি কবুল বলতেই হয় তবে আমি তাকেই বলব যাকে আমি জীবনসঙ্গী হিসেবে অলরেডি মেনে নিয়েছি। তাকে ডাকুন। তার সামনেই কবুল বলব। তার কবুলও আমি শুনবো।


এমন সময় হাফিজার বড় চাচা দৌড়ে এসে তাকে খুব জোরে একটা চড় বসিয়ে দিল। তার কথা শুনে সবাই মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগলো। গ্রামের অতি বৃদ্ধরা ভেবে বসেছে আমাকে বোধ হয় জীনে ধরেছে।
কাজী সাহেব বললেন—মা দেখ, সাক্ষীদের তো শুনতে হবে। বিয়ের নিয়ম আছে তো। তুমি ঠাণ্ডা হয়ে বস। আমি আবার পড়ছি।

এমন সময় বরপক্ষের একজন বলে উঠল—আর পড়তে হবে না, কাজী সাহেব। এই মেয়ের সাথে আমাদের ছেলের বিয়ে দেবো না। অভদ্র মেয়ে কোথাকার। দুকলম পড়ে আকাশে উড়তে চায়।


বরপক্ষের লোকজন বের হয়ে চলে গেল। ঠিক সেই মুহূর্তে হাফিজার প্রথম বারের মতো মনে হল কাজটা ঠিক হল তো। আত্মীয়স্বজনেরা তাকে শাসাচ্ছেন। অনেকে কটু কথাও বলছেন। আম্মা বারান্দায় খুঁটি ধরে কাঁদছেন। আব্বা ঘরের ভেতর অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছেন। হাফিজা ভেবে পেলো না সে কোন মুখে তার সামনে গিয়ে দাঁড়াবে। কান্নায় ভেঙ্গে আসছে তার দুচোখ। এই সময় কোন যুক্তি থাকেনা। বার বার মনে হচ্ছিলো কি চরম অপমানই করল সে আব্বা আম্মাকে। এখন কি করবে সে? সে কি বরপক্ষের লোকদের কাছে গিয়ে ক্ষমা চাইবে। এটা কি তার পক্ষে সম্ভব হবে?


বিকেল হয়ে আসছে। হাফিজা তখন থেকে আঙ্গিনায় দাঁড়িয়ে ছিল। সেই বিছানায়। অনেকে তাকে ভেতরে আনার চেষ্টা করেছে। সে যায়নি। বিয়ে বাড়ির আনন্দটা নিমিষেই কান্নায় পরিণত হল। টেবিল চেয়ার গুছিয়ে ফেলা হচ্ছে। চাঁদোয়া খুলতে গাছে উঠছে ডেকোরেটারের ছেলেটা।

একসময় হাফিজা অনুভব করল—কেউ তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল—কামাল।
তাকে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে সে বলল—আমি শুধু একটি কথা জানতে ফিরে এলাম, তুমি কেন এমন করলে? তোমার কারো সাথে সম্পর্ক যদি থাকে তাহলে আগে বলতে, এভাবে আমাদের অপমান করলে কেন?

কামাল কে আসতে দেখে আবার আঙিনায় মানুষ জমতে শুরু করেছে।

হাফিজা বলল—আপনারা একটু দুরে যান। ওর সাথে আমার কিছু কথা আছে। দয়া করে বাইরে যান।
তার কথা বলতে কষ্ট হচ্ছিলো তবু কথা বলতে হবে। এতো দোষের ভার সে একা বইতে পারবে না। সে শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখ মুছল। গলা দিয়ে কথা বের হতে চাচ্ছে না। সে কথা বলছে ভাঙ্গা ভাঙ্গা গলায়...

--বিয়ের আগে একটা মেয়ের কাউকে ভালো লাগতেই পারে কিছু হয়তো ব্যতিক্রম থাকতে পারে। আমি খুবই সাধারণ। তাই আমারও একজনকে ভালো লাগতো। কিন্তু এই ভালো লাগা আজকের এই বিব্রতকর অবস্থার জন্য দায়ী নয়। সেসব অধ্যায় বন্ধ করে আমি তোমার সাথে বিয়েতে বসেছিলাম।
আমি বিশ্বাস করি মানুষ অনেকবার প্রেমে পড়তে পারে। বিয়ের পর হয়তো তোমার প্রেমে পড়ে যেতাম। কিন্তু এখন তোমাকে আমি চিনি না, জানিনা। তোমার জন্য আমার কোন আবেগ নেই। তাই কবুল বলার সময় আমার মনের মধ্যে কোন শিহরণ বয়ে যায়নি। নতুন একেবারে অচেনা একটা মানুষের সাথে সারা জীবন কাটাতে হবে কবুল শব্দটা তা ঠিক করে দেবে। এই কঠিন মুহূর্তে আমাকে একশোবার ভাবতে হয়েছে। হাজারো চিন্তা ভাবনারা আমাকে ঘিরে ধরেছে। আমি হৃদয় দিয়ে অনুভব করছিলাম সেই কঠিন মুহূর্তটি।
তখন যদি কেউ বলে ওঠে আমি ঢঙ করছি। তাহলে কার মাথা ঠিক থাকবে বল। অন্য কোন মেয়ে হলে অবশ্য অপমানটা হজম করে ওদের ইচ্ছে মতো মাইক লাগিয়ে কবুল বলত। কিন্তু এতটা নির্লজ্জ হওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়।

কামাল বলল—তুমি ঐ সময় এতো কিছু ভাবছিলে? কেন? আমাকে তোমার কি পছন্দ হয় নি?

আমি বললাম—কিভাবে হবে বল। তোমার সাথে এক রাস্তায় পাশাপাশি চললাম না একটা দিনও। তোমার নামটা ছাড়া আমি আর কি জানি বল। তাছাড়া তুমি তো এমন কোন রাজপুত্র না যে তোমাকে এক পলকে দেখেই আমি তোমার প্রেমে পড়ে যাবো।

কামালের মুখটা অন্ধকার হয়ে গেল।
সে মাথা নেড়ে বলল—তা ঠিক। তোমাকেও তো চিনি না জানিনা তবু কেন জানি মনে হচ্ছে তোমাকে কবুল করার সময় আমি এতবার ভাবতাম না।

আমি কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললাম—তোমাদের ছেলেদের পছন্দটা ভিন্ন ব্যাপার। আমার মনে হচ্ছে আমাকে তোমার খুবই পছন্দ হয়েছে। সেটা চেহারার কারণেই হতে পারে। সেটাই তো তোমরা বেশি প্রাধান্য দাও। এখন আমার কি মনে হচ্ছে জান কামাল, এমন না করলেও বোধ হয় হতো। বাবা মায়ের জন্য একটু অপমান না হয় সইলাম। কি হল তাতে। আমার উপর তাদের দাবি আছে। তোমরা চলে যাওয়ার পর বাবা বারবার ফিট হয়ে যাচ্ছেন। লজ্জায় আমি বাবার সামনে যেতে পারিনি। মা কেঁদে যাচ্ছেন বিরতিহীন ভাবে। বিয়ে ভেঙ্গে যাওয়া কত বড় অপমানের ব্যাপার সেটা বুঝবে কি না জানি না। সেটা যদি মেয়ের বিয়ে হয়। তুমি বুঝবে এসব? আমি তোমাকে এতো কিছু বলছি কারণ একটা কবুল আমাকে এই অধিকারটা দিয়েছে। কবুল শব্দটার শক্তি আসলেই অনেক বেশি মনের অজান্তেই মনে হচ্ছে—তোমার উপর আমার অধিকার আছে। তুমি আমার অতি আপনজন কেউ। কবুল বলার আগে বিশ্বাস করো আমার এরকম ভাবনা আসেনি। আমি তোমাকে সত্যিই আমি জীবন সঙ্গী হিসেবে মেনে নিয়েছি। কারণ আমি জানি, কে শুনল আর কে শুনল না জানি না তবে আমি কবুল বলেছি। তুমি কি বিশ্বাস করবে আমার কথা?


হাফিজা আর শক্ত গলায় কথা বলতে পারছিল না। কথা গুলো গলায় আটকে যাচ্ছিলো। শব্দ গুলো ভেঙ্গে ভেঙ্গে যাচ্ছিলো। কিন্তু তাকে কথা বলতে হবে। এতো দোষের ভার সে একা বইতে পারবেনা।

--এতোটুকু বিশ্বাস যদি না থাকে তাহলে একসাথে চলা যায় না। আর যদি কবুল বলতে হয় তবে তোমার সামনে বলব। আমি তোমাকে জীবনসঙ্গী হিসেবে মেনে নিয়েছি কি না সেটা তোমার নিজ কানে শোনা উচিত। অন্য কারো কাছ থেকে নয়।

সে চোখের পানি আর ধরে রাখতে পারল না।
ওর গাল বেয়ে একফোঁটা জল নেমে যাচ্ছে। কামাল তাকিয়ে ছিল ওর চোখের দিকে। মুহূর্তের মধ্যেই তার মনে হল—এই বুদ্ধিমতি,সাহসী,আবেগি এই মেয়ের প্রেমে পড়ে গেছে সে। মেয়েটির অশ্রু থুঁতনি থেকে মাটিতে পড়ে নি।
কারণ ছেলেটি পড়তে দেয়নি। মেয়েটিকে অবাক করে দিয়ে ছেলেটি বলেছে—তোমার চোখের জলটা মুছে দিতে পারি?

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.