![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
মা চুলার উপর কড়াই বসিয়েছেন। সেখানে টগবগে ফুটন্ত তেলে কিসমিস দেয়া হয়েছে। কিসমিসগুলো ফুলে উঠছে আস্তে আস্তে। আমার বড় ভাই রান্না ঘরের পাশেই নারিকেল ভাঙছে। বড় ভাই কানের কাছে নারিকেল ঝুঁকিয়ে বলল-পানি নাইরে কামাল। শাঁস আছে হইছে বোধ হয়।
আমি দাঁড়িয়ে আছি চুলার পাশে।
ফোলা কিসমিসটা কড়াই থেকে নামানো হলেই কয়েকটা নিবো। বেশি নেয়া যাবে না। লাচ্চা রান্না করতে হবে তো। অন্যদিন হলে মা অবশ্য নিতেই দিতো না। ঈদের দিনে মা কাউকে বকেন না। কিসমিস নামানো হইছে। বাটি থেকে কয়েকটা নিয়ে আমি বড় ভাইয়ের পাশে এসে দাঁড়ালাম।
নারিকেলের পানির চেয়ে শাঁস খেতে আমার বেশি ভালো লাগে। বড় ভাই শাঁস কেটে দু ভাগ করে দিল। এক ভাগ আমার আর এক ভাগ আমার বড় আপুর। আমার আপুর নাম রিনা। এবার এস এস সি পরীক্ষা দেবে। আর আমি এইবার ক্লাস ফাইভে। যাহোক আমারই তো গল্প। আগে আপুর কথা বলে নিই।
এই রোজার ঈদে ওর পছন্দ মতো থ্রি পিচ বাবা নিয়ে দিতে পারেন নি বলে সকাল থেকে রুম থেকে বের হয় নি। বলেছে সামনে পরীক্ষা, তার কাছে ঈদ টিদ বলে কিছু নেই।
আমি নারিকেল নিয়ে আপুর রুমে ঢুকলাম। আপু বসে পড়ছে বা পড়ার একটা ভাণ করছে। যাই হোক এই ঈদের দিনে নিজেকে সবকিছু থেকে বিরত রাখা কঠিন ব্যাপার।
--আপু, নারিকেল নাও।
আপু কান্না কান্না গলায় বলল—কামাল এখান থেকে যা তো। আমি নারিকেল খাবো না। তুই খা। সামনে আমার পরীক্ষা আমাকে জ্বালাবি না। যা ভাগ।
আমি আপুকে ভয় পাই। শুধু আপুকে না আসলে আমি সবাইকেই ভয় পায়। অপমানটা আমার খুব লাগে। রেগে গিয়ে কেউ যদি কোন বেফাস কথা বলে ফেলে। ভয়টা আমার ঐ খানে।
আমাদের ঈদগাহে জামাত হবে সাড়ে ৯টায়। একটাই জামাত। ছাড়লেই শেষ।
তাই আপুকে আর অনুরোধ করা হলনা। বের হয়ে এলাম। গোসল করতে হবে। সারা বছর আমরা কাপড় কাঁচা সাবান দিয়েই গোসলের কাজ সারি। শুধু আপুর জন্য আলাদা সাবান। ওত আর ওর সাবানে আমাদের হাত দিতে দেয়না। কোথায় কোথায় লুকিয়ে রাখে। ঈদ উপলক্ষে বাবা একটা লাক্স সাবান এনেছেন। ঈদের দিনে আমরা এটা দিয়েই গোসল করবো। পরদিন থেকে সাবানটা আপুর দখলে চলে যাবে। তাই দুই তিন বার সাবান দিয়ে ঘসে মেজে গোসল করলাম। গা থেকে বের হচ্ছিলো ফুরফুরে অদ্ভুত এক সুবাস।
টিভি দেখে এবং স্কুলে যেদিন ছুটি হল সেদিন স্যারের বক্তব্যে এতোটুকু আশ্বস্ত হয়েছিলাম যে ঈদের দিনে সালাম দিলে টাকা প্রাপ্তির একটা বিশেষ সম্ভাবনা থাকে। আমাদের পরিবারে আবার এসব সালাম কালামের রীতি নেই। একটা ভয় ছিল আব্বা আম্মাকে কোনদিন সালাম দেয়নি। হঠাৎ ঈদের দিনে কিরে করে দেয়া যায়। এটা আমার জন্য ছিল বিরাট লজ্জার ব্যাপার।
তখন মনে হয়েছিল পারবো। বাবা মার সামনে এতো লজ্জা কিসের। তারপর এই অলীক অর্থপ্রাপ্তিকে কেন্দ্র করে আমি আমাদের মোড়ের দোকান থেকে বাঁকিতে কিছু চাটনি, লজেন্স, লাঠি বিস্কুট খেয়েছিলাম। দোকানদারের সাথে আমার কথা হয়েছে, ঈদের দিন তার সব পাওনা মিটিয়ে দেয়া হবে। ঈদ পরবির টাকা তো পাচ্ছি। চিন্তা কিসের?
আজ তবু আমার চিন্তা হচ্ছে। দোকানদারকে টাকা না দিতে পারলে বিরাট কেলেঙ্কারি হবে। অপমানের চূড়ান্ত হবে। বাবা যে কি করবেন। মনে হচ্ছে বাঁকিটা খাওয়ার কি দরকার ছিল। কেন ভেবে কাজটা করলাম না।
বাবার গোসল শেষ। মা আমার চোখে সুরমা দিয়ে দিলেন। আর পাঞ্জাবিতে একটু আতর আমি নিজেই লাগায়ে নিলাম। তারপর একটা শপের বিছানা আর আগর বাতির প্যাকেট হাতে নিয়ে বাবার সাথে রওনা হলাম। নামাযের আর বেশি দেরি নেই। মসজিদ থেকে বারবার সবাইকে মসজিদে হাজির হবার জন্য তাগাদা দেয়া হচ্ছে।
নামাযে আমার মন বসলো না।
ইমাম সাহেব যখন সূরা পাঠ করছিলেন তখন আমি ভাবছিলাম, কাকে কাকে সালাম দিবো, তারা কত পরবি দিতে পারে এইসব হাবিজাবি। হঠাৎ আমি দেখলাম সবাই রুকুতে চলে গেছে আর আমি থ মেরে দাঁড়িয়ে আছি। যা লজ্জা পেলাম। কে কি ভাবল কে জানে।
বাড়ি ফিরে জীবনে প্রথম বারের মতো মাকে সালাম দিলাম। লজ্জা লাগছিল খুব। ঘেমেটেমে অস্থির। মা প্রথমে থতমত খেলেন। এরকম ঘটনার সাথে তিনিও তো পরিচিত নন। তারপর মা আমার কপালে চুমু খেয়ে আদর করলেন। অন্যদিন হলে মায়ের আদর খুব ভালো লাগতো। কিন্তু আজ আমি পরবির জন্য অপেক্ষা করে আছি। চাওয়া পাওয়ার একটা বিষয় এর মধ্যে জড়িয়ে গেছে।
আপু তখনও ঘরের ভেতর ঠমক ধরে বসে ছিল। আমি বললাম—আপু আসসালামু আলাইকুম।
আপু রেগে উঠে বললেন—আমার সাথে ফাজলামি করছিস? যা ভাগ।
বাবা বারান্দায় বসে আমাদের প্রতিবেশি কয়েকজন চাচার সাথে গল্প করছিলেন। আমি এক এক করে সবাইকে সালাম দিলাম। এরা নিম্নবিত্ত মানুষ। সালাম দিতে দিতে এদের জীবন শেষ হয়ে যায়। আজ হঠাৎ করে সালাম পাওয়াতে তারা বেশ আনন্দ পেলো। কেউ কেউ মুখ চাওয়া চাওয়ি করতে লাগলো। তারা আমার জন্য প্রাণভরে দুয়া করলেন—বেঁচে থাকো বাবা, অনেক বড় হও ইত্যাদি।
আমার প্রচণ্ড রাগ হচ্ছিলো। আমি আজ দোয়া নিয়ে কি করবো? আমার দরকার টাকা। ঈদ পরবি।
আমার বড় চাচাদের অবস্থা একটু ভালো। ভাবলাম ওদিকে গেলে কিছু পাওয়া যেতে পারে। বড় চাচাকে লম্বা একটা সালাম দিলাম। চাচা চিৎকার করে চাচিকে বললেন—কই গো, কামাল ছোড়াটা আসছে। ওকে লাচ্চা সেমাই কিছু দেও।
আমার মনটাই খারাপ হয়ে গেল। বুঝতে পারলাম ঈদ পরবি বিষয়টাই এরা কেউ জানে না। তবু আমার মন মানতে চাইল না। এরকম দেনায় পড়ে থাকলে কার মন মানবে? রাস্তা ঘাটে যাকে পেলাম তাকেই সালাম দিতে শুরু করলাম। যদি কেউ দেয়। সবাই সালাম নিলো। হাসি মুখে আমার দিকে তাকাল। কেউ কেউ আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। কিন্তু ঈদ পরবির দেখা আমি পেলাম না।
বিকেল হয়ে এসেছে। সূর্য পশ্চিম দিকে হেলে পড়েছে। সালাম করতে করতে আমি ভুলেই গেছি দুপুরে আমার খাওয়া হয়নি। হাত তখনো খালি। ভাবলাম বাড়ি ফিরে কিছু খাবো। তারপর মনে হল মোড়ের দোকানদারের কথা। আজ যদি টাকা না দিতে পারি তাহলে তিনি বাবাকে সব বলে দেবেন। এসব শুনলে বাবা আমাকে মেরেই ফেলবেন। ভয়ে আমার ক্ষুধা হারিয়ে গেল।
আমি হাঁটতে লাগলাম নদীর দিকে। বাড়ি গিয়ে আর কাজ নেই।
আমি সারা বিকেল ধরে নদীর ধারে বসে ছিলাম। এতক্ষণ বোধ হয় বাবা চেঁচিয়ে বাড়ি মাথায় তুলেছেন। একটু পরেই সন্ধ্যা নামবে। বাড়ি ফিরতে ইচ্ছে করছে না। অনেক গুরুগম্ভীর চিন্তা ভাবনা মাথায় আসছে। ঈদ পরবি যেমন কারো ঈদের আনন্দ আকাশ প্রমাণ করে দিতে পারে আবার কারো আনন্দ মাটির সাথে মিশিয়ে দিতেও পারে। যেমন আমার টা।
মাগরিবের আযান হচ্ছে। কয়েক মশা আমাকে ঘিরে ধরেছে। পালা করে তারা আমার গায়ে বসছে। তাড়ানোর চেষ্টা করছি তবু নড়ার নাম নেই। মশা তো। হঠাৎ করেই দেখলাম দুরে কে যেন এদিকেই আসছে। হাঁটা দেখে আমার মনে হল বাবা। একটু কাছে এলে বুঝলাম হ্যাঁ বাবা। আমি একবার ভাবলাম ঝেড়ে দৌড় দেবো। কিন্তু পারলাম না। নিশ্চয়ই বাবা এসে তাকে কানে ধরে বাড়ি নিয়ে যাবেন। তারপর শুরু হবে মারধর।
কিন্তু বাবা আমাকে অবাক করে দিয়ে আমার দিকে একটা একটা একশো টাকার নোট এগিয়ে দিলেন।
তারপর বাবা যা বললেন তার সারমর্ম হল—আমি যখন বাবাকে সালাম করেছিলাম তখন তার কাছে টাকা ছিল না। ঈদের বাজার করতে সব শেষ হয়ে গিয়েছিলো। বিকেলে তিনি ভ্যান নিয়ে বাজারে গিয়েছিলেন। যদিও ঈদের দিনটাতে তিনি ভ্যান চালান না।
বাবা বলে যাচ্ছেন—আজ বেশি ভাড়া হয়নিরে ব্যাটা। এর জন্য এতো রাগ করে মানুষ। সারাদিন কিছু খাস নি। চল আব্বা বাড়ি চল।
আমি থ মেরে দাঁড়িয়ে রইলাম। চারদিকে অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে। আশেপাশে ঝি ঝি পোকা ডাকছে। আমি বাবার সাথে বাড়ি ফিরছি। বাবা আমার কাঁধে হাত দিয়ে আছেন।
আমি ঈদ পরবি পেয়েছি। কেন যানি আমার আনন্দ হচ্ছে না। বারবার আমার চোখ দুটো ভিজে উঠছে।
©somewhere in net ltd.