![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
-তাহলে আপনি বলতে চাইছেন আইনস্টাইনের চাঁদ আর রবীন্দ্রনাথের গোলাপফুল বিষয়ক জটিলতা আপনার জীবনে ঘটছে?
কথাটা বলে ডাক্তার সাহেব ভ্রু কুঁচকালেন। তিনি আমার দিকে একটু ঝুঁকে বসে আছেন। কথা বলছেন চশমার উপর দিয়ে তাকিয়ে। ভদ্রলোকের দৃষ্টি অসম্ভব স্থির। মানুষ হিসেবেও গম্ভীর মনে হচ্ছে।
আমার কেসটা শুনে তিনি একটুও অবাক হননি বা না হওয়ার ভান করেছেন। হয়তো তার এটা তার পেশাগত স্ট্র্যাটেজি। তার কথা বার্তা খুব স্বাভাবিক যেন এরকম দুচারটা কেস তিনি প্রতিদিনই হ্যান্ডেল করেন।
আমি হ্যাঁ বা না এর জবাব না দিয়ে তাকে পাল্টা প্রশ্ন করলাম-
-আমার কথা গুলো কি আপনার খুব একটা বিশ্বাস হচ্ছে না, ডাক্তার সাহেব।
আমার প্রশ্ন শুনে তিনি বিরক্ত হয়েছেন বুঝতে পারছি। তবু তিনি হাসি মুখে কথা বলার চেষ্টা করছেন।
-দেখুন এখানে বিশ্বাস অবিশ্বাস এই ব্যাপারগুলো কোন সমাধান নিয়ে আসবে না। এখন আপনার দরকার প্রপার ট্রিটমেন্ট। এবার যা যা বলছি তার ঠিক ঠিক উত্তর দিন। আইনস্টাইনের যে এরকম একটা ধারণা ছিল সেটা কি আপনি অনেক আগে থেকে জানতেন?
-আসলে ডাক্তার সাহেব, এই ব্যাপারটা যখন প্রথম প্রথম শুরু হয় তখন আমি এক ফিজিক্সের অধ্যাপকের সাথে কথা বলেছিলাম। তার কাছ থেকেই শুনি আইনস্টাইনের ব্যাপারটা। তিনি আমার সমস্যাটা শুনে বেশ অবাক হয়েছিলেন। পরে তার সাথে দেখা করতে বলেছিলেন।
--গিয়েছিলেন?
--না যাইনি। কারণ আমার মনে হয়েছিল ফিজিক্সের তত্ত্বটত্ত কিছু না, মাথা বোধ হয় খারাপ হওয়ার পথে। এই মুহূর্তে সাইকিয়াট্রিস্টের পরামর্শ জরুরী। আমার এক পরিচিত...
আমি কথার মাঝখানে থামলাম। দেখলাম ডাক্তার মনোযোগ দিয়ে আমার কথা শুনছেন না। তার কপালে ভাজ পড়েছে। প্যাডের উপর অযথায় দাগাদাগি করছেন। তার দৃষ্টি সিলিং ফ্যানের দিকে। এতক্ষণ পর তার চেহারায় একটা চিন্তিত ভাব লক্ষ করছি। তিনি বোধ দুয়ে দুয়ে চার ব্যাপারটা মেলাতে পারছেন না।
--ডাক্তার সাহেব, আমি কি পাগল হয়ে যাচ্ছি। প্লিজ কিছু লুকোবেন না। আমার কথা বিশ্বাস করুন। আমি একবিন্দুও বানিয়ে বলছি না। প্লিজ হেল্প মি।
--ভাই আপনি শান্ত হয়ে বসুন। এটা খুব সিম্পল কেস। কিচ্ছু...
ঠিক এই মুহূর্তে আমি চোখ বন্ধ করে ফেললাম। ডাক্তার সাহেব কি খেয়াল করেছেন? আমি তলিয়ে যাচ্ছি শূন্যতার অতল গহ্বরে। আমার সামনে ডাক্তার সাহেব কথা বলছিলেন।
আমি তার কোন কথায় শুনতে পাচ্ছি না, আমার সামনে টেবিল ছিল, পাশে চেয়ার ছিল। হাতড়ে হাতড়ে দেখলাম। কোথাও কিচ্ছু নেই। অসীম শূন্যতার মধ্যে ডুবে গেছি। আমি ছাড়া যেন কেউ নেই পৃথিবীতে।
আমি চোখ খুললাম। ডাক্তার সাহেবের কথা শুনতে পাচ্ছি। সবকিছু সেই আগের মতই।
ডাক্তার সাহেব বলছেন--হবেনা। আমি সিওর, আই ক্যান হেল্প ইউ।
আমি ডাক্তার সাহেবকে বললাম—আপনি কি লক্ষ করেছেন? আমি চোখ বন্ধ করে ছিলাম। একটা পুরো বাক্য আপনি বলেছেন “কিচ্ছু হবেনা” যার কিচ্ছু শব্দটা আমি চোখ বন্ধ করার আগে শুনেছি আর হবেনা শব্দটি শুনলাম চোখ খোলার পর। মাঝখানে অনেক সময় কেটেছে। এর মানে কি দাঁড়ায় না আমি তাকিয়ে আছি বলেই আপনি, এই চেয়ার, টেবিল ফ্যান সবকিছু আছে। আমার জন্যই সব। সবকিছু এই পৃথিবীর।
--না না এইসব আপনার কল্পনা। আপনি একটা ঘোরের ভেতর আছেন আনিস সাহেব। যে সময়টা এক সেকেন্ডেরও কম তা আপনি অনেক বেশি কল্পনা করছেন। এটা জাস্ট একটা ঘোর।
ডাক্তার সাহেব স্বাভাবিক ভাবে কথা বলছেন ঠিকই তার চিন্তা ভাবটা তখনো কাটেনি। অনিচ্ছা সত্ত্বেও তিনি কথাগুলো আমাকে বলছেন। এটা বলতে হয়।
--কিছু ওষুধ লিখে দিলাম। এতেই কাজ হবে। রাত জেগে পড়াশুনা করবেন না। চিন্তা ভাবনা থেকে ১০০ গজ দুরে থাকতে হবে। একা একা থাকবেন না। সবসময় মন ভালো রাখার চেষ্টা করবেন।
--ডাক্তার সাহেব আমার মন বেশির ভাগ সময় ভালো থাকে, ভ্রমণে আমার খুব শখ। আমার ইচ্ছে সারাজীবন শুধু পৃথিবীর রূপ দেখেই কাটিয়ে দেবো। যতদিন বেঁচে থাকি বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরবো। বিয়ে করারও খুব একটা ইচ্ছে নেই। আর কোন মেয়েই সন্ন্যাস টাইপ একজনকে বিয়ে করতে চাইবে না। তাই একা থাকা ছাড়া আমার উপায় নেই।
--আপনজনের সাথে থাকলে ভালো হতো। ঠিক আছে, তবু মানুষ জনের ভেতর থাকার চেষ্টা করুন। এটার প্রয়োজন আছে। নেক্সট।
আর কথা বলার সুযোগ নেই। পরের রোগী ঢুকে পড়েছে। আমি চেম্বার থেকে বের হয়ে এলাম।
প্রেসক্রিপশন খুব বেশি কাজে লাগবে বলে মনে হচ্ছেনা। মাথা ব্যথা আর ঘুমের ওষুধ। কিছুদিন ধরে ঘুমের ওষুধ ছাড়া আমার ঘুম আসেনা।
স্লিপিং পিলের রাতে প্রচণ্ড ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসে। চোখ বুজলেই আমি চলে যাই শুন্য জগতে।
মাথার নিচে বালিশ নাই। পিঠের নিচে নাই তোশক। এমন অস্বস্তি নিয়ে ঘুমানো যায়না স্বাভাবিক ভাবে। ঘুমের ওষুধ খেয়ে মরার মতো ঘুমিয়ে থাকি। ঘুম থেকে উঠে দেখবো সেই মাছিটা এখনও বসে আছে এঁটো বাসনে, ঘড়িতে তখনো বাজে বিকাল সোয়া পাঁচটা।
আমার পাশের রুমের সিদ্দিককে ডেকে বলি-- কয়টা বাজে ভাই, বলতো?
সিদ্দিক বলে—সোয়া পাঁচটা।
আমি বলি—আমার ঘড়িটা একটু দেখত কটা বাজে?
সিদ্দিক এলারম ঘড়িটা হাতে নিয়ে দেখে বলে—ভাই টাইম ঠিক আছে। সোয়া পাঁচটা।
তাকে বলা হয়না যে আমি সোয়া পাঁচটার দিকে ঘুমিয়ে ছিলাম। সে চলে যায়। আমি ঝিম মেরে বসে থাকি। এই ব্যাপার প্রতিদিন ঘটছে। ভয়ঙ্কর অবস্থা।
প্রথম দিকে খুব ভয় লাগতো। কিন্তু আস্তে আস্তে এটা সয়ে যেতে শুরু করলো। আমি এটা থেকে অ্যাটভান্টেজ নিতে লাগলাম। হয়তো কারো কথাবার্তা খুব বিরক্ত লাগছে, যে কথা আমি শুনতে চাচ্ছিনা বা আমি কাউকে এড়িয়ে যেতে চাইছি তখন আমি সাথে সাথে চোখটা বন্ধ করে ফেলি। কোথাও কেউ থাকেনা। আমি তলিয়ে যায় শূন্যতার অতল গহ্বরে।
একদিন ভেবেছিলাম এই পাওয়ার দিয়ে দুই নম্বরি করবো। মাছের বাজারে গিয়ে বিশাল একটা মাছ দরদাম করলাম। রুই মাছ। সাড়ে সাতশো টাকা দাম।
মাছওয়ালা আমার কাছ থেকে টাকা চাওয়া মাত্রই আমি চোখ বন্ধ করে ফেললাম। ভেবেছিলাম চোখ বন্ধ করে হেটে চলে যাবো কারণ। আমার জন্যই তো ঐ মাছ বিক্রেতা। শুধু আমার জন্যই সে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে মাছ ধরেছে। আমি তাকিয়ে আছি বলেই সব। সবকিছু।
হ্যাঁ মাছের বাজারের কোলাহল থেমে গেছে। কোথাও কেউ নেই। কেউ আর মাছের দাম চাইছে না। আমার হাতে মাছ ছিল কিন্তু নাই। এখানে শুধু মনে হয় আমার হাত পা মাথা আছে কিন্তু কিছুই স্পর্শ করা যায় না। আমি চিন্তা করেছিলাম হয়তো চোখ বন্ধ করে দুরে কোথাও গিয়ে চোখ খুললে তখন হাতে মাছ থাকবে। এমনই হবার কথা। কিন্তু আমি হাঁটতে পারলাম না।
কারণ আমার পায়ের নিচে মাটি নেই। আমি ভেসে আছি অসীম শূন্যতার উপর। আমি অনেক চেষ্টা করেও হাঁটতে পারলাম না। অসম্ভব। আমি চোখ খুললাম। আমার ডান হাতে বিশাল একটা রুই মাছ। মাছওয়ালা বলছে—ভাই দামটা দিয়েন।
কিছুদিন পর ডাক্তার সাহেবের সাথে সকালে পার্কে দেখা হয়েছিল। লোকটি নিতান্তই ভালো মানুষ। তিনি আমাকে চিনতে পারলেন। এতোটা আমি আশা করিনি।
--কেমন আছেন আনিস সাহেব?
--জি ভালো।
--আপনাকে আর তো দেখা করলেন না? সমস্যাটার সমাধান হয়েছে?
--জি না। এটা ভালো হবেনা ডাক্তার সাহেব। আমি হাল ছেড়ে দিয়েছি।
--চিন্তা করবেন না। ঠিক হয়ে যাবে। আর একদিন চেম্বারে আসুন।
আমি ঠিক আছে বলে চলে এলাম।
কিছুদিন পরের কথা। হাতে কিছু টাকা এসেছে। চলে এসেছি সিলেটে চা বাগান দেখতে। ডাক্তারের চেম্বারে আর যাওয়া হয়নি। টিলায় টিলায় সাজানো চা বাগান। গাছে গাছে পাখি ডাকছে। রাস্তার দুই পাশে ছোট ছোট টিলা। সবুজ শুধু সবুজ। চোখ ধাধিয়ে যায়। অপূর্ব। অপূর্ব।
চা বাগানের কাছাকাছি এসে বাস থেকে আমি রাস্তার মধ্যে নেমে গেলাম। রাস্তাটা ক্রস করলেই চা বাগান। মেয়েরা পিঠে ঝুড়ি নিয়ে কাজ করছে।
ছোট বেলায় টিভিতে ঠিক এরকম দৃশ্যই তো দেখতাম। আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাকিয়ে আছি চা বাগানের দিকে। আমার পা চলছে। রাস্তাটা ক্রস করলেই ছুঁতে পারবো সবুজ পাতার ঘ্রাণ। কিচ্ছু খেয়াল ছিল না আমার। আমি আনমনে রাস্তা ক্রস করছি। চায়ের পাতাগুলো কে একটিবার স্পর্শ করতেই হবে।
এই মুহূর্তে আমি রাস্তার মাঝখানে। খেয়াল করলাম একটা ট্রাক আমার দিকে প্রচণ্ড গতিতে ছুটে আসছে। কিন্তু কিছুই করার নেই আমার ট্রাকটা খুব কাছে। আমি ভয়ে বিকট একটা চিৎকার দিয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলেছি।
প্রচণ্ড গতি সম্পন্ন একটা ট্রাক আমার কাছ থেকে মাত্র একহাত দুরে। চোখটা আপনা আপনি বন্ধ হয়ে গেছে। এখন সব অন্ধকার। আমার আশেপাশে কোন ট্রাক নেই। হয়তোবা কোন চা বাগানও নেই। আমি চোখের পাতা চেপে আছি শক্ত করে। কোন মতেই যেন চোখের পাতা না খোলে। বুক ধক ধক করছে তখনো।
আমি অনেকক্ষণ যাবোৎ ভেসে আছি নিকষ কালো অন্ধকার শুন্য জগতে। যেন বহুকাল। সামনে প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য হাতছানি দিয়ে ডাকছে। কিন্তু পাশে অপেক্ষা করছে মৃত্যুর করাল গ্রাস। আমি ডুবে আছি অন্ধকারে, ভয়ঙ্কর একাকী এক জগতে।
এই পৃথিবীর সৌন্দর্য দেখার জন্য যার জন্ম হয়েছে তাকে এই অন্ধকার নিশুতি জগতে মানায় না। একাকী শুন্য বৈচিত্র্যহীন জগতে ধুকে ধুকে মরার কোন মানে নেই।
আমি চোখ খুললাম। চা বাগান থেকে যে আলোক রশ্মি আমার চোখে আসবে তাকে আমি আর ফিরিয়ে দিতে পারবো না। ফিরিয়ে দিতে পারবো না সে সবুজ পাতার ঘ্রাণ।
মৃত্যু তুমি ট্রাকের চাকার সাথে গড়িয়ে গড়িয়ে এগিয়ে এসো। আমি দেখবো। আমি তাকাবো। কারণ আমি আছি বলেই তুমি, তোমরা, সবকিছু.........মৃত্যু তুমি এসো...
পরিশিষ্ট-
এই গল্প লেখার প্রায় তিনবছর পর আমি ক্রিস্টোফার নোলানের মেমেন্টো দেখলাম। শেষের দিকে একটা কথা আছে- ‘আমাকে বিশ্বাস করাতে হবে যে আমি চোখ বন্ধ করলেই পৃথিবী অদৃশ্য হয়ে যায় না। পৃথিবী তার মতই থাকে। আমি কি বিশ্বাস করি আমার বাইরের পৃথিবীকে?’
বেশ অবাক হলাম।
এই গল্পটা লেখার আগে অবশ্য কালের কণ্ঠে কবি গুরু রবি ঠাকুর আর মহান বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের এই বিষয়ে একটা লেখা পড়েছিলাম।
©somewhere in net ltd.