![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আবদুল্লাহ আল আমিন
১৯৪৭ সালের দেশভাগ তো কেবল ভূখ-ের বিভাজন নয়, এ যেন ভিটেমাটি থেকে উৎখাত হওয়া ছিন্নমূল মানুষের হৃদয়ের রক্ত ক্ষরণ- কোথায় যাবো, কী করবো এমন দ্বিধাদীর্ণ মনের বিভাজন। এই বিভাজনের মাধ্যমে দু’বাংলার জনমানস পতিত হয় এক অপরিসীম দুঃখদহনে। দীর্ঘদিনের লালিত সুখস্বপ্নের ওপর অপ্রত্যাশিত আঘাত, খুব স্বাভাবিকভাবেই এটি সংবেদনশীলচিত্তে গভীরতর রক্তক্ষরণ ও স্বপ্নভঙ্গের কারণ হয়ে ওঠে। দেশভাগের পর পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানদের অনেকেই পূর্ববঙ্গ অভিমুখে পাড়ি দিয়েছিলেন, তেমনই পূর্ববঙ্গের হিন্দুরা দেশ নামক বস্তুটির জন্য ভিটে-বাড়ি, ব্যবসায়-প্রতিষ্ঠান, চাকুরিস্থল ছেড়েছিলেন বা ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন দলে দলে। সাতচল্লিশের দেশভাগ কেবল ভূখ-কে বিভক্ত করেনি, বিভক্ত করেছে বাংলা ভাষা-সাহিত্যেও ভূগোলকে, অনেকের আবেগ ও শৈশব স্মৃতিকে করেছে ক্ষত-বিক্ষত, রক্তাক্ত- যেমন করেছে কেতকী কুশারীর। পশ্চিমবঙ্গ ছেড়ে আসা বাঙালি মুসলমানের জীবনের সমীকরণটি যেমন জটিল মনে হয়, তেমনি পূর্ববঙ্গ ছেড়ে যাওয়া বাঙালি হিন্দুর গল্পটিও কম জটিল ও বেদনার নয়। কেতকী কুশারীর জীবনের কাহিনীটাও বেদনার ও বেশ জটিলতর। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর, তিনি পূর্বপুরুষের ভিটে এবং বাবার কর্মস্থল ছাড়েন বাধ্য হয়ে, অথচ তার বাবা ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের এককালের কৃতী ছাত্র এবং ডাকসাইটে সিভিলিয়ান । দেশভাগের পর মাঝে কিছু সময় কলকাতায়, তারপর ১৯৬৪ সাল থেকে বলতে গেলে, স্থায়ীভাবে যুক্তরাজ্যে। শৈশবের স্মৃতিবিজড়িত মেহেরপুর ও নীলফামারী ছেড়েছেন ১৯৪৭ এ, জন্মভূমি কলকাতার পাট চুকিয়ে দেন ১৯৬৪ তে। তারপর ৬৪ বছর পর ২০১১ সালের ডিসেম্বর মাসে, রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যার আমন্ত্রণে বাংলাদেশে এসেছিলেন রবীন্দ্রনাথের সার্ধশত জন্মবর্ষ উদযাপন করতে। এসেই রবীন্দ্র স্মৃতিধন্য শিলাইদহ কুঠিবাড়ি, ফকির লালন শাহের মাজার দেখতে গিয়েছিলেন আবুল আহসান চৌধুরীকে সঙ্গে নিয়ে। কুষ্টিয়া থেকে ফিরে এসেই বৈকালিক চা-আড্ডায় মেতে ওঠেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খানের অফিসকক্ষে। সৌভাগ্যক্রমে সেদিনের সেই বৈকালিক আড্ডায় আমিও উপস্থিত ছিলাম। সেদিন শিল্প-সাহিত্য, দর্শনের নানা দিক নিয়ে কেতকী কথা বলছিলেন পবিত্র সরকার, গোলাম মুরশিদ, শামসুজ্জামান খান, আবুল আহসান চৌধুরী, রফিকুর রশীদের সঙ্গে। আমি মেহেরপুরের মানুষ জেনে, আমার সঙ্গেও আলাপ জমিয়ে ফেললেন তিনি। কথা বললেন, তার স্মৃতির শহর মেহেরপুর, শহরের গা ঘেঁষে বয়ে যাওয়া ভৈরব নদ, মহকুমা প্রশাসকের লাল দালানসহ আরো কত কী নিয়ে! গত শতকের চল্লিশের দশকে মেহেরপুরের গ্রাম-গঞ্জের রূপ কেমন ছিল সে সম্পর্কে কত অজানা কথা বললেন তিনি! তেতাল্লিশের মন্বন্তরের সময় তিনি মেহেরপুরে বাবার বাংলোয় থাকতেন তাও আমাদের জানালেন। আমার সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে আবেগ-আপ্লুত ও স্মৃতিকাতর হয়ে তিনি ফিরে যাচ্ছিলেন সাতচল্লিশ-পূর্ব মেহেরপুরে।
সাহিত্যিক ও গবেষক কেতকী কুশারী ডাইসনের জন্ম ১৯৪০ সালে মহানগর কলকাতায়, শৈশব কেটেছে তৎকালীন পূর্ববঙ্গের মেহেরপুরে। বড় হয়েছেন সাহিত্যিক পরিম-লে; বুদ্ধদেব বসু, অজিত দত্ত , সুধীন্দ্রনাথ, বিষ্ণু দে ছিলেন তার বাবার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। বাবা অবনী মোহন কুশারী ছিলেন অবিভক্ত নদীয়া জেলার মেহেরপুরের মহকুমা প্রশাসক । তিনি ১৯৪২-১৯৪৫ মেহেরপুরের মহকুমা প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন,পরবর্তীতে স্বল্প সময়ের জন্য নীলফামারীতে। কেতকীর পৈতৃক ভিটে ঢাকার বিক্রমপুরে এবং মাতুলালয় ফরিদপুরে।
ছাত্রী হিসেবে কিংবদন্তিতুল্য প্রতিভার অধিকারী কেতকী কুশারী; কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন এন্ট্রাস থেকে এমএ পর্যন্ত। ১৯৫৮ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে রেকর্ড মার্ক পেয়ে গ্র্যাজুয়েট ডিগ্রি লাভ করেন তিনি। মাত্র ঊনিশ বছর বয়সে তার চোখে বিপর্যয় ঘটে। ১৯৬০ সালে স্কলারশিপ পেয়ে অক্সফোর্ডে চলে আসেন এবং সেখানে ১৯৬৩ সালে পুনরায় গ্র্যাজুয়েশন ডিগ্রি অর্জন করেন । তারপর কলকাতায় ফিরে যান, সেখানে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে এক বছর অধ্যাপনা করেন। ১৯৬৪ সালে কলকাতায় রবার্টস ডেভিড ডাইসনের সঙ্গে তার বিয়ে হয়; এরপর থেকে যুক্তরাজ্যের কিডিলিংটনে স্থিত হয়েছেন। অক্সফোর্ডের একেবারে গা ঘেঁষে ছোট গ্রাম কিডলিংটন ছাড়িয়ে সোজা এগিয়ে চলেছে যে পথ, সে পথের নাম ব্যানবেরি রোড। পোস্টঅফিস, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির দোকান,ব্যাংক আর চৌমাথা ছাড়িয়ে যেখানে পথটি বাঁক নিয়েছে, সেখানে একটি ছিমছাম বাড়ি রয়েছে। এ বাড়িতে কেতকী কুশারী ডায়সন বাস করছেন। বিয়ের পর বছর দেড়েকের জন্য কানাডায় ছিলেন। ১৯৬৮ সালের শেষদিকে বিলেতে ফিরে আসেন এবং ১৯৬৯ এর শেষে অক্সফোর্ডে ¯œাতকোত্তর পড়াশুনা আরম্ভ করেন। পাঁচ-ছয় বছর গবেষণাকর্মের পর ১৯৭৫ সালে ডি ফিল ডিগ্রি অর্জন করেন। তার গবেষণার বিষয় ছিল: এ ভ্যারিয়াস য়ুনিভার্স: এ স্টাডি অব দ্য জার্নাল এন্ড মেমোরিস অব ব্রিটিশ মেন এন্ড উইমেন,১৭৬৫-১৮৫৬। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, দিল্লী অভিসন্দর্ভটি ১৯৭৮ সালে গ্রন্থাকারে বের করে। তিনি প্রথম ভারতীয় নারী যিনি অক্সফোর্ডে ইংরেজি সাহিত্যে প্রথম শ্রেণি পান। ইংরেজি সাহিত্যের এই মেধাবী, মনস্বী ছাত্রীটি বাংলা ও ইংরেজি দু’ভাষাতেই সমান স্বচ্ছন্দ। প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে এই অভিবাসী লেখিকা তার সৃষ্টিশীলতা দিয়ে পাঠককূলকে আবিষ্ট করে রেখেছেন। কবিতা, নাটক, উপন্যাস, প্রবন্ধ এবং অনুবাদ সৃষ্টিশীলতা ও মননশীলতার সর্বক্ষেত্রে তার অবাধ ও অনায়াস বিচরণ। তিনি সেই স্বল্প সংখ্যক কবিদের একজন, যিনি বাংলা ও ইংরেজিতে মৌলিক কবিতা রচনা করেছেন এবং দু’ভাষাই কবিতা অনুবাদের কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। তার নাটক ভারত ও ব্রিটেনের বিভিন্ন মঞ্চে অভিনীত হয়েছে। কাজের স্বীকৃতি হিসেবে পেয়েছেন একাধিক পুরস্কার। দু’বার আনন্দ পুরস্কার, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভুবনমোহিনী স্বর্ণপদক ছাড়াও সম্মানিত হয়েছেন ২০০৯ সালের সেরা বাঙালি হিসেবে। তাঁর ‘রবীন্দ্রনাথ ও ওকাম্পোর সন্ধানে’(১৯৮৫), ইন ইয়োর ব্লোসমিং ফ্লাওয়ার গার্ডেন বা রঙের রবীন্দ্রনাথ (১৯৯৭) ইত্যাদি গ্রন্থ তাকে রবীন্দ্র গবেষণার ক্ষেত্রে আলোচনা ও বিতর্কের শীর্ষে নিয়ে গেছে। তার অনুবাদকর্মের মাধ্যমে প্রতীচ্যের সাহিত্য-সমালোচকরা জেনেছেন রবীন্দ্রনাথ কেবল রোম্যান্টিক কবি নন, তিনি আধুনিক কবিদের মধ্যে অগ্রগণ্য; তারা আরোও জেনেছেন যে, আধুনিকতার সব লক্ষণ রয়েছে রবীন্দ্রনাথে। বল্কল (১৯৭৭), সবীজ পৃথিবী (১৯৮০), জলের করিডর ধরে (১৯৮১) প্রভৃতি কবিতাগ্রন্থ তাকে কবি খ্যাতি এনে দেয়। গত জুন ২০১৫ তিনি পঁচাত্তর বছরের হীরকরেখা স্পর্শ করলেন। তাঁর প্রথম পুত্র ভার্জিল পূজারী ডাইসন ১৯৬৭ সালে এবং কনিষ্ঠ পুত্র ইগোর নীলাদ্রি ডাইসন ১৯৬৯ সালে জন্ম গ্রহণ করেন। দু’পুত্রের একজন গ্রাফিক ডিজাইনার ও অন্যজন প্রকৌশলী।
কেতকী মৌলিক রচনার ক্ষেত্রে যেমন, অনুবাদের ক্ষেত্রেও তেমন। বাংলা ও ইরেজি দুটো ভাষাই সমানভাবে ব্যবহার করতে পারদর্শী তিনি। তিনি যেমন বাঙালি সংস্কৃতিকে বিশ্বে ছড়িয়ে দিতে চেয়েছেন, তেমনি বিশ্বকেও বাংলায় ধরতে চেয়েছেন গভীরভাবে।‘ রাতের রোদ (১৯৯৭), মোৎসার্ট চকোলেট ( সেপ্টেম্বর ১৯৯৮) নাটক দুটি তিনি নিজেই অনুবাদ করেছেন। রবীন্দ্রনাথ ও বুদ্ধদেব বসুর কবিতার অনুবাদ করেন নিষ্ঠার সাথে। ইংরেজিতে অনূদিত চারখ-ের কবিতা গ্রন্থ তাকে ভারতের ইংরেজি জানা পাঠকদের কাছাকাছি নিয়ে আসে। তার বিখ্যাত অনুবাদ গ্রন্থের মধ্যে ‘দ্য সিলেক্টেড পয়েমস অব রবীন্দ্রনাথ ট্যাগোর’ (১৯৯১),‘ দ্য সিলেক্টেড পয়েমস অব বুদ্ধদেব বোস’ (২০০৩), ‘অ্যাংলো স্যাক্সন কবিতা (১৯৮৭)’ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
দুই.
ইংরেজিতে উপন্যাস লিখে সাম্প্রতিককালে যারা খ্যাতি অর্জন করেছেন তাদের মধ্যে বাঙালি ও ভারতীয় লেখকদের সংখ্যাই বেশি। কেবল সংখ্যার দিক দিয়ে নয়, উৎকর্ষের দিক থেকেও এদের লেখা বিশ্বমানের। এদের অনেকেই ব্রিটেন ও আমেরিকায় ইংরেজিতে লিখে পুরস্কৃতও হয়েছেন, কেউ কেউ বুকার পেয়েছেন। এই উপমহাদেশের যারা ইংরেজিতে লিখছেন তাদের অধিকাংশই প্রবাসী, কেউ কেউ ভারতে অবস্থান করে মাঝে মাঝে বিদেশে যাতায়াত করেন। ভারতীয় লেখকদের যারা অভিবাসিত সাহিত্যে প্রতিনিধিত্ব করছেন তাদের মধ্যে নীরদ সি চৌধুরী,সালমান রুশদী, বিক্রম শেঠ,অমিতাভ ঘোষ, ঝুম্পা লাহিড়ী, কিরণ দেশাই, অমিতাভ ঘোষ, মিরা নায়ার, সাগরিকা ঘোষ এবং কেতকী কুশারী ডাইসন অন্যতম। বাংলাদেশের যে কজন লেখক ইংরেজিতে লিখছেন তাদের মধ্যে মনিকা আলী, মঞ্জুরুল ইসলাম ও তাহমিমা আনামের নাম উল্লেখ করা যেতে পারে, এদের লেখার পটভূমি, বিষয় ও চরিত্র সবই বংলাদেশের। এরা সবাই প্রবাসী। একটি বিষয় এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, ভাগ্যচক্রে অনেক বাঙালি ও ভারতীয় লেখককে প্রবাস জীবন বেছে নিতে হয়েছে। কেউ কর্মসূত্রে, কেউ স্থায়ীভাবে অভিবাসী হিসেবে দীর্ঘদিন প্রবাসে আছেন। ভিন্ন ভূগোল ও সংস্কৃতির জল হাওয়া তাদের মনস্তত্ত্বের ওপর প্রভাব ফেলেছে। এই লেখকদের শরীর বিদেশে পড়ে থাকলেও মন পড়ে দেশে, স্বদেশের মাটি-মানুষ-নিসর্গ থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করতে পারেন না। স্বদেশ-সংস্কৃতির সঙ্গে এ ধরনের নিবিড়তার কারণে তাদের ভাষাভঙ্গিতে ভিন্নতা লক্ষ করা যায়- তারা হয়ে ওঠেন ডায়াস্পোরা লেখক। আমেরিকা প্রবাসী ভারতীয় লেখক ঝুম্পা লাহিড়ীর ইন্টারপ্রেটার অব ম্যালাডিজ সম্পর্কে লিখতে গিয়ে সমালোচক মন্তব্য করেন, ঝুম্পা লাহিড়ীর জীবনটাই অভিবাসিত সাহিত্যের নমুনা। ত্রিশ বছর ধরে আমেরিকায় বসবাস করেও তিনি নিজেকে ‘ একটু বহিরাগত’ (এ বিট অব অ্যান আউটসাইডার ) ভাবেন । তিনি স্বীকার করেন যে, ভারতবর্ষে অতিবাহিত সময়টাতে তিনি সেখানে খুব একটা জড়িত ছিলেন না, তারপরও এ কথা অনস্বীকার্য় যে তিনি মনেপ্রাণে ভারতীয়। তার গল্পসংগ্রহ আত্মপরিচয়ের প্রশ্ন তোলে.. সব প্রবাসী ভারতীয়রাই এক ধরনের ক্লেশে ভোগে যে তারা বহিরাগত ( এ সেন্স অব এক্সাইল )। সতিই তাই। এ প্রসঙ্গে অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী লেখক আবু সাঈদ ওবাইদুল্লাহ বলেন,‘ আজ আমরা মুখেমুখে যতই জিও পলিটিক্স বা জিও লিটারেচারের কথা বলিনা কেন, বাঙালি কবি-লেখক মানসিকভাবে নিজ দেশের ভাষা, মানুষ, প্রকৃতি ও ঐতিহ্যনির্ভর। তার চিন্তা-প্রক্রিয়া কেবল স্বদেশ বিচ্ছিন্ন হয়ে ব্যক্তিগত চকিত অভিজ্ঞতা, একান্ত বস্তুঘন সত্তার চূর্ণপ্রভা প্রকাশ মাধ্যম হয়ে উঠতে পারেনি। তার চিন্তার সঙ্গে তার দেশ সব সময়ই অবিচ্ছিন্নভাবে একটি অদৃশ্য রক্তবন্ধন গড়ে তুলেছে। সে সব সময়ই স্বদেশমুখী , তার সজ্ঞায় তার মাতৃমূর্তি তথা মাতৃভাষা কখনো দুগ্ধফোঁটা কখনো সমুদ্রের উত্তাল ¯্রােতের মতো হানা দেয়।’ ( প্রবাসে দৈবের বশে: ‘আহা বিদেশি বাতাস!’ প্রথম আলো, ৬ জুন ২০১৪। ) যুক্তরাজ্যে বসবাসকারী কেতকী কুশারীর ক্ষেত্রেও ওই একই কথা প্রযোজ্য। তিনি ষাটের দশক থেকে বিলেতে বসবাস করছেন, তারপরও দেশি চরিত্র ও পটভূমি বেছে নিয়ে লিখছেন। কবিতাটা ইংরেজ লিখলেও উপন্যাস তিনি বাংলাতে লিখে থাকেন। ঝুম্পা লাহিড়ীর প্রথম উপন্যাস ‘ দ্য নেমসেক ’ ও ‘ লো ল্যান্ড ’ এ যেমন আমেরিকা প্রবাসী ভারতীয়দের জীবনযাপনের চালচিত্র উঠে এসেছে, ঠিক তেমনি কেতকী কুশারীর কবিতা-উপন্যাস-স্মৃতিকথনে বিলেত প্রবাসী বাঙালি ও ভারতীয়দের জীবনচিত্র ফুটে উঠেছে। দেশ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত (১৯৮১- ৮২ ) প্রথম দিকের উপন্যাস ‘ নোটন নোটন পায়রাগুলো’য় তিনি বিলেতে বসবাসকারী বাঙালিদের জীবনচিত্র তুলে ধরেছেন। ‘ প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের অপূর্ব মেলবন্ধন ঘটেছে এই উপন্যাসে , বাংলা উপন্যাসে এমনটা ইতোপূর্বে লক্ষ করা যায়নি। সত্যিকারের আন্তর্জাতিক মানের উপন্যাস বলতে যা বোঝায় তা-ই এটা। এর ভাষাশৈলী, প্রকরণ , উপস্থাপনা সবই অসাধারণ। আমরা তার কাছে নতুন নতুন উপন্যাস প্রত্যাশা করছি।’ ( উত্তরাধিকার, বাংলা একাডেমি, ঢাকা, ১৯৮৩)। কলকাতার আনন্দবাজার লেখিকাকে অভিনন্দন জানাই তার ঈর্ষণীয় সাফল্যের জন্যে। তার এই উপন্যাসে যেমন বাঙালি পরিবার আছে, তেমনি রয়েছে আলজেরিয়ান, উত্তর আইরিশ, দক্ষিণ আইরিশ, ক্যারাবিয়ান চরিত্র। তিনি মূলত বাঙালি নারীর দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে বিদেশি নারীদের জবানবন্দিটা তৈরি করতে চেয়েছেন। তিনি তার চারপাশের যেসব বিদেশি মেয়েদের দেখেছেন, তাদের তিনি বাঙালি পাঠকের কাছে আনতে চেয়েছেন। তারপর ২০০৩ সালে বের হয় উপন্যাস ‘জল ফুঁড়ে আগুন’, এখানে তিনি বাঙালি ও ইংরেজদের অসবর্ণ বিবাহের বিষয়টি সামনে নিয়ে আসেন। এখানে না বলে পারছি না যে, কেতকীর বাবা-মার অসবর্ণ বিবাহটাও তখনকার দিনে ‘অমৃতবাজার’ ও ‘যুগান্তর’ ইত্যাদি সংবাদপত্রে স্থান পাওয়ার মতো ঘটনা।
কেতকীর বেড়ে ওঠা থেকে পূর্ণতা প্রাপ্তির পর্যায়ে দেখা যায় যে, পারিবারিক দিক ও পৈতৃক অবস্থান থেকে তিনি বিশ্ব নাগরিক দৃষ্টিভঙ্গি যেমন পেয়েছেন, তেমনি রবার্টস ডাইসনকে বিবাহ করার সূত্রেও পেয়েছেন। আন্তর্জাতিকতা ও বিশ্বমুখিন দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় পাওয়া যাবে তার ‘রবীন্দ্রনাথ ও ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর সন্ধানে’ উপন্যাসে । এটি বাংলা সাহিত্যের অনবদ্য সৃষ্টি। এই উপন্যাসে সেফার্দিক ইহুদি চরিত্র আছে, সেফার্দিক গানের অনুবাদও রয়েছে। কেতকী পাঁচ-ছ ধরে রবীন্দ্রনাথের বর্ণদৃষ্টি নিয়ে কাজ করেছেন। এটা একটি বড় মাপের কাজ এবং পশ্চিমবঙ্গের চক্ষু বিশেষজ্ঞরা এটি গুরুত্বের সঙ্গে মূল্যায়ন করেছেন। এক সময়ে অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন রবীন্দ্রনাথ কেন তার গানে-কবিতায় হেমন্তের বর্ণনা দেননি। বিষয়টি তখন কেউ পরিষ্কারভাবে বুঝতে পারেননি, কেতকী তার ‘ রঙের রবীন্দ্রনাথ’ এ বিষয়টি খোলসা করে জানান যে , রবীন্দ্রনাথ আসলে হেমন্তের লাল-গেরুয়া রঙটা দেখতে পেতেননা, তাই তার লেখায় তেমন হেমন্তের পাতা ঝরার কথা নেই।
তিন.
‘কবিসত্তাই হলো আমার সব লেখার মূল চালিকাশক্তি’ এ কথা এক সাক্ষাৎকারে কেতকী দৃঢ়তা ও আন্তরিকতার সাথে বলেছিলেন। তিনি আরোও বলেছিলেন, আমি উপন্যাস বা নাটক যা-ই লিখি না কেন, কিংবা গবেষণায় নিয়োজিত থাকিনা কেন, সব সময়ই আমার ভেতরে কবিসত্তা কাজ করে। সাহিত্যের একাধিক শাখায় কাজ করার পরও তার কবি-পরিচয়টি নিস্প্রভ হয়ে যায়নি। তিন-চার বছর বয়স থেকেই তিনি কবিতা লেখেন। তিনি মনে করেন, লেখক হিসেবেই তার জন্ম, তাই তাকে লিখতে হবেই। লেখাই তার কাজ, লেখাই তার জীবন। তাই ক্রমাগতভাবে তিনি লিখে চলেছেন। নতুন অভিজ্ঞতাকে কীভাবে বাংলা ভাষায় মেলে ধরা যায়, সেটাকে তিনি নিজের ভেতর চ্যালেঞ্জ হিসেবে গ্রহণ করেছেন অনেক আগে থেকে এবং সেই চ্যালেঞ্জেই মগ্ন আছেন দীর্ঘ দিবস-রজনী। তার ‘বল্কল’, ‘জলের করিডর ধরে’, ‘সবীজ পৃথিবী’ কবিতাগুলো পাঠ করলে স্বচ্ছভাবে বোঝা যাবে যে, এসব কবিতায় তিনি ভিন্ন ভূগোল ও ঋতুচক্রের বয়ানের মাধ্যমে পরমনিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সঙ্গে নতুন ভাষাশৈলী নির্মাণ করেছেন । হয়তো সাহিত্যের সমালোচকরা এটা সেইভাবে খেয়াল করেনি। তার ‘শীতের শরৎ’ কবিতায় রয়েছে শীতের মধ্যে শরৎ খুঁজে পাওয়ার বিষয়টি। ‘ব্রাইটনে গ্রীস্মশেষ’ কবিতাটি বিদগ্ধ পাঠককূলের সমাদর পেয়েছে। পূবেই উল্লেখ করেছি যে, কেতকী কুশারী ডাইসন ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্রী হিসেবে বিদ্যা ও বৈদগ্ধে ছিলেন অনন্য। কবি হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন প্রথম যৌবনেই। সাপ্তাহিক দেশ পত্রিকায় যখন তার কবিতা মুদ্রিত হতো,তরুণ পাঠকরা আগ্রহ ভরে তা পড়তো। দীর্ঘকাল ভারতবর্ষের বাইরে যুক্তরাজ্যে বসবাস করছেন তিনি, ফলে তার কবিতায় লেগেছে বিশ্বমুখিন ও কসমোপলিটান ভাব-ভাবুকতার প্রলেপ। তিনি প্রাচ্য-প্রতীচ্য দুটোই নিয়েছেন, কোনটাই উপেক্ষা করেননি, তা সে যতই তুচ্ছ হোক। বাঙালির গ্রামীণ গানে-পালায়,সুফি-সহজিয়া-মরমি দর্শনে যে বিশ্বমুখিনতা রয়েছে, তার অনেক কিছুই তিনি নিয়েছেন অকাতরে। লালনের গানের সহজিয়া ভাবধারা তাকে মুগ্ধ করেছে গভীরবাবে, লালন কিংবা অন্যান্য মরমি ভাবুকদের কাছ থেকেও তিনি তার কবিতার রসদ সংগ্রহ করেন। তার বারবারই মনে হয়েছে, শাক্ত, বৈষ্ণব, সহজিয়া ভাবধারা- এসব তত্ত্ব যদি আমরা সঠিকভাবে আমাদের চিন্তন-মনন ও জীবনচর্যায় ব্যবহার করতে পারতাম , তাহলে হয়তো আমরা অনেক দূর যেতে পারতাম। কিন্তু ফান্ডামেন্টালিজম সব বিগড়ে দিয়েছে, আগে বাঙালির নিজস্ব মানবতন্ত্র ছিল, এখন আর সেটা নেই বললেই চলে।
কেতকীর শৈশব কেটেছে বর্তমান বাংলাদেশের মেহেরপুর শহরে। সেই কবে তিনি মেহেরপুর ছেড়েছেন কিন্তু তার স্মৃতির শহরটিকে আজও বুকের মধ্যে আগলে রেখেছেন। মহকুমা প্রশাসকের বাংলোয় খুব ভোরে তার ঘুম ভাঙতো। পাখির ডাক শুনতে শুনতে জেগে উঠে দেখতেন, - ‘ প্রতি সকালে উঠে আমার মনে হতো যে জগৎটা পুনর্জন্ম লাভ করেছে।’ সম্প্রতি প্রকাশিত প্রবন্ধ সংকলন ‘কাছে দূরের কক্ষপথে’র বিভিন্ন নিবন্ধেও তিনি মেহেরপুরের স্মৃতিচারণ করেছেন। সব কবিই নিজস্ব স্বপ্ন, কল্পনা, আবেগ, চৈতন্য, মনের মাধুরী মিশিয়ে কবিতার শরীর নির্মাণ করেন, কেতকীও তাই করেছেন। ১৯৭৭ সালে প্রকাশিত প্রথম কবিতা গ্রন্থ ‘বল্কল’ এ তিনি পরিশীলিত রুচি, বোধের সঙ্গে আবেগের মিলন ঘটিয়েছেন দক্ষতার সঙ্গে। বলা বাহুল্য হবে না যে, তিরিশি কবিদের আধুনিকতাকে মর্মমূলে ধারণ করে আধুনিক বাংলা কবিতার যাত্রা শুরু। পঞ্চকবিদের মধ্যে জীবনানন্দের পর সবচেয়ে প্রভাবশালী ও বহুমাত্রিকতার অধিকারী ছিলেন বুদ্ধদেব বসু। এরপর যার নাম আসে , তিনি হলেন সুধীন্দ্রনাথ দত্ত। বুদ্ধদেবের সচ্ছল, স্মার্ট কাব্যভাষা এবং সুধীনের ভারি শব্দের নিরাবেগ প্রকাশ,মিথকথন আধুনিক কবিদের টেনেছিল দারুণভাবে। কেতকীর কবিতা পাঠ করলে বুদ্ধদেব ও সুধীন্দ্রনাথের সঙ্গে বিস্ময়কর মিল খুঁজে পাওয়া যায়। তার কবিতায় হৃদয় নয়,উদ্দীপ্ত হয় বোধ। ‘অ্যাকসিলরেশন’ কবিতায় কেতকী লিখেছেন, ‘আজ চক্রবৃদ্ধিহারে পূর্ণতম হলো জাগরণ / শ্বেত ময়ূরের মতো জ্যোৎ¯œা নেমে এসেছে মাটিতে।’ এ কবিতায় তিনি আধুনিক মানুষের আবেগ ও দৃষ্টিভঙ্গি, দুটোই নিয়েছেন। অক্সফোর্ড কিংবা কিডলিংটনের কোনো এক বাংলোয় বসে দিবস-রজনী তিনি স্মৃতির যমুনায় হাবুডুবু খান। বকুলের গন্ধেভরা ঋতুতে তিনি দেখতে পান, তুষারকণা জানালার কাচে জ্যামিতিক চিত্র আঁকছে। ‘নববর্ষ’ কবিতায় তার হৃদয় উৎসারিত প্রেমের তুলিতে আঁকা প্রেমিকের মনোহরণ রূপটি বড় মধুর, বড় আকর্ষণীয়।‘ মদের মতো পাগল করা ছেলে, / পদাবলীর সখার মতো কালো’, সব উজাড় করে দিয়ে কেতকী কুশারী তাঁকে ভালবেসেছিলেন। ১৯৮০সালে প্রকাশিত ‘ সবীজ পৃথিবী’তে কবির ভাবোচ্ছ্বাস আর আবেগময়তার সঙ্গে বিদেশের গাছপালা, পত্র-পুষ্প-পল্লবের রূপ-রঙ-গন্ধ ও গঠন মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে। ‘হানিসাকল’ কবিতায় কবি ছেলেবেলার মতো মিষ্টি ছড়া কেটে বলেছেন,‘ বাপের বাড়ি লেবুপাতা, / শ্বশুরবাড়ির দই, / আমের বনে হাওয়ার আমেজ, / গন্ধ-আতপ কই ?’ চাঁদের আলোয় আকাশ, নদী, সমুদ্রসৈকত মোহনীয় হয়ে ওঠে সব কবির কাছে, একদিন সমুদ্রসৈকত অপরূপ রূপে ধরা দেয় কেতকীর কাছে, তিনি লেখেন, ‘ দেখেছি ভাস্বর / অনন্তশয়নে বিষ্ণু, ব্রহ্মা--আংটির একটি নীলা।’ ( শীতে শরৎ)।
কেম্পটাউনে হেরিং মাছ কিনতে গিয়ে কবির মনে পড়ে যায় বাঙালির চিরায়ত রন্ধন ঐতিহ্যের কথা, তার মায়ের রান্নাঘরের স্মৃতি। স্মৃতিকাতর কবি লেখেন : ‘ মা গো , তোমার শিলনোড়া বেয়ে এখনও হলুদজল পড়ে, / উনুনে উথলে-উঠা ডালের ছোপ, / খুরিতে পাঁফোড়ন, কালো জিরে’। কবিতায় আঁকা ছবিটি শিলনোড়া, খুরিতে পাঁচফোড়ন, ডালের ছোপের মতো একবারেই আটপৌরে, সাদামাটা কিংবা সদ্য গাছ থেকে তোলা কাঁচামরিচের মতোই সতেজ ও সজীব। ১৯৮১ সালে প্রকাশিত হয় কেতকী কুশারী ডাইসনের তৃতীয় কবিতা-গ্রন্থ ‘জলের করিডর ধরে’। ‘ যদি হাজার কিলোমিটার হাঁটতে হয়, কবিতায় কবি গভীর অরণ্যে দীর্ঘপথ হাঁটবার জন্য সহযাত্রী বন্ধুদের উৎসাহিত ও অনুপ্রাণিত করেছেন। তিনি লিখেছেন : ‘ লাল ফুটবলের মতো যে-অস্তসূর্যটাকে / লাফাতে লাফাতে তালবনে নেমে যেতে দেখেছি, / উলটো দিকের মাঠে দৌড়তে দৌড়তে / আবার বর্তুল তাকেই খপ করে ধরে ফেলবো’। তার বিশ্বাস অরণ্যের শেষপ্রান্তে পৌছুতে পারলে আছে সব প্রতিকারহীন অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। কবি মাঝে মাঝে চিরচেনা প্রতিবেশেও খুঁজে পেয়েছেন অচেনা-অজানা দেশের খনি, অজ্ঞাত ভাবনার সূত্র। তারপর অনেক পথ হেঁটে সম্ভবত পশ্চিমবঙ্গের কোন এক ছায়াঢাঁকা গ্রামের কাছে তিনি ও তার সঙ্গীরা পৌঁছলেন। হঠাৎ তার খেয়াল হলো জলের বোতল খালি। সে গ্রামে তিনি দেখলেন শৈবদের আড্ডার পাশাপাশি বৈষ্ণবদের আশ্রম। সেই আশ্রমে এক শীর্ণ, হাস্যোজ্জ্বল , তাম্বুলরাঙা এক বৈষ্ণবীর সাক্ষাৎ পেলেন তারা। নদীর জল পানযোগ্য নয় জেনে, তিনি বৈষ্ণবীকে জল ফুটিয়ে দিতে বললেন। বৈষ্ণবী শুকনো ডালপালা জ্বেলে জল ফুটিয়ে দিলেন এবং ব্যাখ্যা করে শোনালেন দেহাত্মবাদের নিগূঢ় তত্ত্ব যা রসিকচিত্তে ভাবরসের জন্ম দেয়। বোষ্টমির ভাষায় কেতকী বলছেন, ‘এতক্ষণে জীবগুলো নাশ হইলো, /চক্ষে যাদের যায় না দেখন, / জলের দেহে বিলীন ছিলেন আত্মাগুলি, / ভবে যেমন অরূপরতন।’ ( অরূপরতন) এ কবিতাটি কবি বৈরাগ্যের ধূপছায়ায় মগ্ন, প্রান্তিক ও সামাজিকভাবে দীর্ণ মানুষগুলির উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করেন। ১৯৯২ সালে প্রকাশিত ‘ কথা বলতে দাও’ কবিতা-গ্রন্থে কেতকী কুশারীর যাপিতজীবনের প্রসন্নতা ও হার্দিক অনুভূতি মিশে আছে গভীরভাবে। ‘ গল্প নয়’ কবিতায় কবি বারাণসীর এক মাতৃহারা কিশোরীর জীবনচিত্র এঁকেছেন গভীর মমতায় ও ¯িœগ্ধ দরদে। উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, কেতকীর মা বেড়ে ওঠেন বারাণসীতে এবং সেখানে তিনি তাঁন কাজিনদের সঙ্গে হিন্দি মিডিয়াম শিক্ষায়তনে পড়াশুনা করেন। সেতার, ভজন ও গান্ধীবাদ ভালবাসতে শিখেছিলেন তারা বারাণসীতেই।
১৯৯৯ সালে প্রকাশিত হয় কেতকী কুশারীর ‘ জাদুকর প্রেম, জাদুকর মৃত্যু’, এ কবিতাগ্রন্থে এমন এক কবিকে আমরা পাই যিনি নিরন্তর সাধনা, অধ্যবসায়, নিষ্ঠার মধ্য দিয়ে আয়ত্ত করে নেন মহৎ কবির অভিধা। সবল, সতেজ ও স্বতন্ত্র কাব্যভাষায় নির্মাণ করেন গ্রন্থভুক্ত কবিতাসমূহের শরীর। এ কাব্যে তার যে-স্বাতন্ত্র্য তা কোনো আকস্মিক নয়, ১৯৭৭ সালে প্রকাশিত ‘বল্কলেই সেই বার্তা পৌছে দিয়েছেন প্রবলভাবে। কবিমাত্রই এক নিঃসঙ্গ পরিব্রাজক, যাকে একলব্যের মতোই দৃঢ় সংকল্প ও গভীর আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে নিঃসঙ্গতার শরে রক্তাক্ত হয়ে পথ চলতে হয়। শুরু থেকেই কেতকী একলব্যের মতো কঠিন পথটিই বেছে নিয়েছেন। ‘ জাদুকর প্রেম, জাদুকর মৃত্যু’তে বহতা নদীর মতোই স্বচ্ছন্দ, স্বতঃস্ফূর্ত ও অকুণ্ঠ কবির চেতনা, ভাব-ভাষা, বিশ্বাস, আবেগের গতিবেগ। জ্যোৎ¯œায় ভেসে যাওয়া রাতে এক গায়কের গান শুনে কবি চাঁদকে বলছেন,‘ সুরের জাল পাতো, নামাও, নাচাও। / মানুষের জালে যারা মরতে বসেছে তোমার জালে তারা দুদ- বাচুক।’ তার মনে হয়েছে, গানের সুরে পাথর গলে,গান শুনে বর্বর ঘাসে ধরে বীজ। ‘সূর্য চলেছে দক্ষিণায়নে’ কবিতায় সূর্যদেব কবিকে পরামর্শ দিয়ে বলছেন, ‘ থতমত খাবিনা, ভয় পাবি না পৃথিবীতে কাউকে, / যে কটা দিন পারিস ¯্রফে জ্বলে যাবি।’ কবির প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী, তিন-চার বছর বয়স থেকে তিনি কবিতা লিখছেন। সেই হিসেবে ধরে নেয়া যায় যে, কেতকী কুশারীর কাব্যযাত্রা শুরু গত শতকের চল্লিশের দশকের শেষার্ধ থেকে। তারপর থেকে সারাক্ষণ লিখছেন আর লিখছেন। সাত দশকের সাহিত্য-পরিক্রমায় বহুমাত্রিক সৃজন কুশলতা দিয়ে সাহিত্যের সব শাখা ঋদ্ধ করেছেন তিনি,তারপরও কবিতার সঙ্গে তার নিবিড় সম্পর্ক।
বিলেতে এস্টাবলিশমেন্টের জন্য লেখালেখি তিনি করেন না, পেশা ও ব্রত হিসেবে বেছে নিয়েছেন লেখকজীবন। কেবলমাত্র বই লেখার জন্য তিনি ১৯৮৫ সালে আর্জেন্টিনায় গিয়েছেন, গবেষণা করেছেন এবং ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর ওপর দুটো বই লিখেছেন। তার লেখা ‘ইন ইয়োর ব্লোসোমিং ফ্লাওয়ার- গার্ডেন: রবীন্দ্রনাথ টেগোর এন্ড ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো’ ল্যাটিন আমেরিকার প্রচুর পাঠক পড়েছে। এটি স্পেনিশ ভাষায় অনূদিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তিনি সারাক্ষণ কেবল লিখছেন আর লিখছেন, লেখার শেষ নেই তার, কাজেরও শেষ নেই। ভেবে বিস্মিত হতে হয় যে, এত বড়মাপের লেখক হয়েও তিনি কী-না কোলকাতার লিটলম্যাগের জন্যও লেখা পাঠাচ্ছেন। বিভিন্ন ভাষার কবিতা অনুবাদের কাজও করছেন তিনি। রবীন্দ্রনাথ ও বুদ্ধদেব বসুর কবিতা ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন, আবার অ্যাংলো-স্যাক্সন কবিতা বাংলায় রূপান্তর করেছেন। অনুবাদ করেছেন বাংলা থেকে ইংরেজিতে, ইংরেজি থেকে বাংলায় এবং স্পেনিশ থেকেও কিছু করেছেন। ব্রিটিশ কবিদের মধ্যে ডি এম টোমাস, ডেভিড কন্সটান্টাইন, আর্জেন্টাইন কবি কিম ট্যাপলিন ,রাফায়েল ফেলিপে ওতেরিনিয়োসহ বেশ কজন কবির কবিতা অনুবাদ করেছেন।স্লোভেনিয়ায় এক পোয়েট্রি ওয়ার্কশপে ফিনল্যান্ডের কবিদের ইংরেজিতে অনুবাদ করা কবিতা তাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে বুঝে নিয়ে কেতকী পুনরায় ইংরেজিতে অনুবাদ করেন।
১৯৬০ সালে মাত্র কুড়ি বছর বয়সে দেশ ছাড়ার সময় বাংলা ভাষা-সংস্কৃতির বুনিয়াদটা সঙ্গে করে নিয়ে যান তিনি, আর এ কারণে ব্যস্ততার মধ্যেও ভুলে যাননি বাঙালি, বাংলাদেশ ও বাংলা সাহিত্য । আমাকে লেখা এক চিঠিতে জানিয়েছেন, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে তিনি লন্ডনে অনুষ্ঠিত এক সমাবেশে যোগদান করেন ১৯৭১ এ। সে সময় তিনি অক্সফোর্ডে পোস্ট গ্র্যাজুয়েট করছিলেন। তিনি পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি লেখকদের যেমন জেনেেেছন ও পড়েছেন, তেমনই বাংলাদেশের আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, শওকত আলীও পড়েছেন। গভীর সম্পর্ক ও যোগাযোগ ছিল শামসুর রাহমান, রফিক আজাদের সঙ্গে, আজও নিবিড় যোগাযোগ রয়েছে বদরুদ্দীন উমর, হাসান আজিজুল হক, গোলাম মুরশিদ, নির্মলেন্দু গুণ, সেলিনা হোসেন, মহাদেব সাহা, বেলাল চৌধুরী, দিলারা হাসেম, তসলিমা নাসরিনের সঙ্গে। বাংলাদেশের আধুনিক কবিতা সম্পর্কেও তার বেশ জানাশুনা রয়েছে। তিনি মনে করেন, বাংলাদেশের কবিতায় দেশপ্রেম ও আবেগের প্রাবল্য বেশি এবং এ প্রবণতাকে তিনি কবিতার জন্য কিছুটা বিপজ্জনক মনে করেন। কেতকী কুশারী ডাইসনের শেকড় দুটো সংস্কৃতির গভীরে প্রোথিত, একারণে তিনি বাংলার মাটি ও জলহাওয়া যেমন বোঝেন, তেমনই উপলব্ধি করতে পারেন বিলেতের হিম-তুষার আবহাওয়া। তিনি মনে করেন সংস্কৃতির আদান-প্রদান ও মিশ্রণের মধ্য দিয়ে একজন লেখকের লেখা সধ হয়, ভাষার মধ্যে শেকড় না থাকলে কবিতা লেখা হয় না বা যায় না, তিনি নিজেকে একজন শেকড়বদ্ধ লেখক বলে মনে করেন। শেকড়বদ্ধ লেখক বলেই তো তিনি আমার মতো এক ব্রাত্য লেখকের সঙ্গেও যোগাযোগ রেখেছেন চিঠিপত্রের মাধ্যমে।
©somewhere in net ltd.
১|
০৩ রা সেপ্টেম্বর, ২০১৬ বিকাল ৪:৩০
নীলপরি বলেছেন: ভালো লাগলো ।