![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
বিভিন্ন ইতিহাসে প্রাচীনকাল থেকে বরিশালের বিভিন্ন বিষয়ের উল্লেখ থাকলেও এ জনপদের উৎপত্তি প্রাগৈতিহাসিক যুগে। বরিশাল অঞ্চলের প্রাচীন নাম বাকলা-চন্দ্রদ্বীপ। তবে বাকলা-চন্দ্রদ্বীপ নামের আগে এটি বাঙ্গালা নামেও পরিচিত ছিল। ধারণা করা হয়, বাঙ্গালা নামটি পরিবর্তিত হয়ে বাকলা হয়েছে। চতুর্দশ শতকে রাজা দনুজমর্দন চন্দ্রদ্বীপ রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। তখন চন্দ্রদ্বীপের রাজধানী ছিল বাকলা। মুঘল আমলে বাকলায় সুবে বাংলার একটি সমৃদ্ধশালী সরকারের শাসন ছিল। ঐতিহাসিক তথ্যে জানা যায়, ১৭৯৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এ অঞ্চল বাকলা-চন্দ্রদ্বীপ নামে পরিচিত ছিল। ১৭৯৭ খ্রিস্টাব্দে বাকলা-চন্দ্রদ্বীপ নিয়ে বাকেরগঞ্জ নামে নতুন জেলা সৃষ্টি করা হয়। ১৮০১ খ্রিস্টাব্দে বাকেরগঞ্জ জেলার সদর দপ্তর বাকেরগঞ্জ থেকে বরিশালে স্থানান্তরিত করা হয়। আর বরিশাল নামটি একেবারেই হাল আমলের।
প্রাগৈতিহাসিক ও ঐতিহাসিক কালের ভৌগোলিক বিবরণ
বিভিন্ন পৌরাণিক কাহিনীতে বাংলাদেশের ভৌগোলিক বিবরণের পাশাপাশি চন্দ্রদ্বীপের ভৌগোলিক বিবরণ রয়েছে । মহাভারতে উল্লেখ রয়েছে কৌরব-পাণ্ডবদের যুদ্ধের পর ভগবান বলরাম গঙ্গার মোহনায় স্নান করেছিলেন এবং রাজসূয়া যজ্ঞের জন্য সাগর তীরের ম্লেচ্ছদেরকে পরাজিত করে ভীম প্রচুর সম্পদ আহরণ করেছিলেন। ওই পৌরাণিক গ্রন্থে (মহাভারত) বাঙালীদের (বাংলাদেশের অধিবাসী) ম্লেচ্ছ ও দস্যু বলে অভিহিত করা হয়। রামায়ণে গঙ্গা দেবীর পাতাল প্রবেশের কাহিনী বর্ণিত হয়েছে। এ সকল পৌরাণিক কাহিনী বাংলা ও বাকলা-চন্দ্রদ্বীপের প্রাচীন ভূ-তত্ত্ব সম্পর্কে ইঙ্গিত করে। (রোহিণী রায় চৌধূরী, বাকলা, পৃষ্ঠা- ৪১,৪২)। উল্লেখ্য, মহাভারত রচিত হয় প্রায় সাড়ে তিন হাজার বছর আগে।
রাজা চন্দ্রবর্মণ চতুর্থ শতকে কোটালীপাড়ায় দুর্গ নির্মাণ করেন। বরিশালের গৌরনদী থানার সীমান্ত থেকে কোটালীপাড়ার দূরত্ব নয় কিলোমিটারের মত। ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত কোটালীপাড়া থানা বাকেরগঞ্জ জেলার অধীনে ছিল। ষষ্ঠ শতকে কোটালীপাড়ায় প্রাপ্ত পাঁচটি তাম্রশাসন প্রমাণ করে মৌর্য ও গুপ্ত আমলে চন্দ্রদ্বীপ উন্নত জনপদ ছিল। ভূ-তাত্ত্বিকদের মতে বরিশালের উত্তরাঞ্চল অর্থাৎ গৌরনদী, উজিরপুর, হিজলা ও মুলাদি থানার অধিকাংশ ভূ-গঠন প্রাগৈতিহাসিক যুগের।
সিরাজ উদ্দীন আহ্মেদ তাঁর বরিশাল বিভাগের ইতিহাস গ্রন্থে উল্লেখ করেন, বাকলা-চন্দ্রদ্বীপ এক সময় পূর্ব সাগর বা লবণ সাগরে নিমজ্জিত ছিল। কোনো এক অজানাকালে গঙ্গা নদীর পলি জমে সুগন্ধা সুগন্ধা নদীর বুকে সৃষ্টি হয় একটি ত্রিকোণাকার ব-দ্বীপ। ওই দ্বীপের নাম স্ত্রীকর দ্বীপ। প্রাচীন স্ত্রীকর দ্বীপ বর্তমান শিকারপুর, উজিরপুর, গৌরনদী নামে পরিচিত। মৌর্য আমলে সুগন্ধার মোহনায় বর্তমান গলাচিপা, কাঁঠালিয়া, আমতলী, এবং গুপ্ত আমলে বরগুনা, বামনা, মঠবাড়িয়া ও পাথরঘাটা নিয়ে আলাদা কয়েকটি দ্বীপের সৃষ্টি হয়। স্ত্রীকর, শঙ্খকোট, পিরোজপুর দ্বীপের সৃষ্টি হয় প্রাগেতিহাসিক যুগে। পরবর্তীতে ওইসকল দ্বীপের মিলিত নাম হয় বাঙ্গালা। পাল ও সেন আমলে এ দ্বীপগুলো বাঙ্গালা ও চন্দ্রদ্বীপ নামে পরিচিত ছিল।
চন্দ্রদ্বীপ রাজ্য প্রতিষ্ঠা
রাজা রামনাথ দনুজমর্দনদেব চন্দ্রদ্বীপে স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু দনুজমর্দনদেব কখন রাজত্ব করেছিলেন তার কোনো সঠিক তথ্য পাওয়া যায়নি। কোনো কোনো ঐতিহামিক ধারণা করে চতুর্দশ শতকে তিনি রাজত্ব করেন। তবে চন্দ্রদ্বীপ রাজবংশের সপ্তম রাজা পরমানন্দ বসু ১৫৫৯ খ্রিস্টাব্দে জীবিত ছিলেন। ইতিহাস থেকে জানা যায়, রাজা পরমানন্দ বসু ১৫২৭ খ্রিস্টাব্দে কোটালীপাড়ায় শ্রী চৈতন্যদেবের সঙ্গে দেখা করেন। এ সময়কে ধরে এক হিসাবে ঐতিহাসিকগণ ধারণা করেন, রাজা রামনাথ দনুজমর্দনদেব ১৩২০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত জীবিত ছিলেন।
দনুজমর্দন বর্তমান বাউফল থানার কচুয়াতে রাজধানী নির্মাণ করেন। বাজধানীর নাম ছিল ‘বাঙ্গালা’। তিনি রাজ্যের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য বাঙ্গালায় বন্দর নির্মাণ করেন। ওই বন্দরে আরব ও পারস্যের বনিকেরা বাণিজ্য করতে আসত।
চন্দ্রদ্বীপের প্রাচীন কীর্তি
বাকলা-চন্দ্রদ্বীপে প্রাগৈতিহাসিককালের কোনো কীর্তির নিদর্শন পাওয়া যায়নি। চতুর্থ শতক হতে এ অঞ্চলের প্রাচীন কীর্তির সন্ধান পাওয়া যায়। এগুলোর মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন দেব-দেবীর মূর্তি, দীঘি, দুর্গ, তাম্রলিপি ও মুদ্রা। তবে লবণাক্ত পরিবেশ, ঘূর্ণিঝড় ও নদী ভাঙ্গনে এ এলাকার অনেক কীর্র্তি বিলীন হয়ে গেছে বলে ধারণা করা হয়।
তেরো শতকের প্রথম ভাগের সেন বংশীয় রাজা বিশ্বরূপ সেনের একটি তাম্রশাসন পাওয়া যায় কোটলীপাড়ায়। ওই তাম্রশাসনে গৌরনদী থানার রামসিদ্ধি, বাঙ্গালা, ঝালকাঠি থানার নৈকাঠি ও চন্দ্রদ্বীপ নামের উল্লেখ আছে। হিজলা-মুলাদি থানার ইদিলপুরে কেশব সেনের একটি তাম্রলিপি পাওয়া যায়। তেরো শতকের ওই তাম্রলিপিতে ব্রাহ্মণকে ভূমি দান, চন্দ্রভণ্ড্র জাতি শাসন ও মন্দির নির্মাণের কথা উল্লেখ আছে। এ অঞ্চলে প্রাপ্ত মূর্তিগুলোর মধ্যে বাকেরগঞ্জের মাধবপাশা জমিদার বাড়ির কত্যায়নী মূর্তি, শিকারপুরের তারামূর্তি ভারতবর্ষে বিখ্যাত। গৌরনদীর লক্ষণকাঠির বিষ্ণুমূর্তি বাংলার ভাস্কর্য শিল্পের শ্রেষ্ঠ নিদর্শন।
সুলতানী, মুঘল ও অন্যান্য আমলের প্রাচীন কীর্তি
চন্দ্রদ্বীপের দক্ষিণাঞ্চলে মুসলিম স্থাপত্য শিল্প প্রতিষ্ঠিত হয় সুলতানী আমলে বিশেষ করে রুকনউদ্দীন বরবক শাহ এর শাসন আমলে (১৪৫৯-৭৪খ্রিস্টাব্দ)। এ পর্যন্ত বরবক শাহের ১৫টি শিলালিপি আবিষকৃত হয়েছে। তাঁর নামাঙ্কিত একটি শিলালিপি পাওয়া যায় পটুয়াখালীর মির্জাগঞ্জ থানার মসজিদবাড়িতে। মির্জাগঞ্জের মসজিদবাড়ির মসজিদ নির্মিত হয় ১৪৬৫ খ্রিস্টাব্দে। পটুয়াখালীর গলাচিপা উপজেলা সদর থেকে আট কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে গুরিন্দা গ্রামে রয়েছে গুরিন্দা জামে মসজিদ। এ মসজিদটিও বরবক শাহের আমলে নির্মিত হয়েছে।
মুঘল আমলের একটি উন্নত জনপদ হিসাবে পরিচিত ছিল গৌরনদীর কসবা। ওই আমলে কসবা ও পাশ্ববর্তী এলাকায় অনেক মসজিদ নির্মিত হয়। কসবা কাজীবাড়ির সামনে একটি এক গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদ রয়েছে। কসবা হাটের দক্ষিণ পাশে একটি, কাহারবাড়ির কাছে একটি এবং খলিফাবাড়ির কাছে একটি মসজিদের ধংসস্তুপ রয়েছে। কমলাপুর গ্রামে তিন গম্বুজ ও তিন দরজা বিশিষ্ট একটি মসজিদ রয়েছে।
গুরিন্দা জামে মসজিদ
পটুয়াখালীর গলাচিপা উপজেলা সদর থেকে আট কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে গলাচিপা উলানিয়া সড়কের পূর্ব পাশে গুরিন্দা খাল। ওই খালেরপশ্চিম পাড় ঘেঁষে কালের স্বাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে গুরিন্দা জামে মসজিদ। ৩৬১ বর্গফুট ক্ষেত্রফল বিশিষ্ট বর্গাকৃতির মূল মসজিদ ভবনের উচ্চতা ১৬ ফুট। এক গম্বুজ বিশিষ্ট এ মসজিদটি মাটি থেকে তিন ফুট উঁচু ভিটির ওপর। এত রয়েছে একই মাপের তিনটি খিরান দরজা। মসজিদটির কয়েক ফুট দক্ষিণে ভিন্ন আরেকটি ভিটির ওপর ১৬ ফুট দৈর্ঘ্য ও ১১ ফুট প্রস্থ বিশিষ্ট একটি বৈঠকখানা।
ধারণা করা হয় ১৪৬৫ খ্রিস্টাব্দে সুলতান বরবকশাহের রাজত্বকালে নির্মিত হয় গুরিন্দা জামে মসজিদ। অবশ্য বরবকশাহের চন্দ্রদ্বীপ বিজয়ের আগেই মুসলমানদের আগমন ঘটে এ অঞ্চলে। দীর্ঘ দিন ধরে লোকচক্ষুর আঁড়ালে ঘন জঙ্গলের মধ্যে ঢাকা পড়েছিল গুরিন্দা জামে মসজিদ। গত শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় বাহাদুরপুরের পীর সাহেব বাদশা মিয় এ এলাকায় সফরে এস মসজিদ এলাকা আবাদ করে ওই মসজিদে জুমা নামাজ আদায় করার জন্য এলাকাবাসীকে বলে যান।
দীঘি
বিভিন্ন আমলে বাকলা-চন্দ্রদ্বীপে প্রায় দুই হাজার দীঘি খনন করা হয়। এগুলোর মধ্যে মাধবপাশার দুর্গাসাগর দীঘি, পটুয়াখালীর কারখানা, বাকেরগঞ্জের কবিরাজের দীঘি, বানারীপাড়ার লস্করপুরের দীঘি, উজিরপুরের শোলকের মলুয়ার দীঘি, গৌরনদীর ছবিখাঁর পার, হিজলা থানার জমাদার বাড়ির দীঘি উল্লেখযোগ্য।
দুর্গাসাগর দীঘি
চন্দ্রদ্বীপের রাজা শিবনারায়ণের মৃত্যুর পর তার পুত্র লক্ষ্মীনারায়ণ রাজত্ব লাভ করেন (১৭৭৭ খ্রিঃ)। অল্পকাল পরে লক্ষ্মীনারায়ণের মৃত্যু হয়। রানী দুর্গাবতী তখন গর্ভবতী ছিলেন। ১৭৭৮ খ্রিস্টাব্দে রানী দুর্গাবতী চন্দ্রদ্বীপ রাজ্যের সাত লাখ টাকা রাজস্ব পরিশোধ করে রাজ্যের সনদ নবায়ন করান। ওই সময়ও তাঁর সন্তানের জন্ম না হওয়ায় দুর্গাক্রোড় নারায়ণের নামে সনদ নেওয়া হয়। এ কারণে পরবর্তীকালে রানীর ছেলে রাজা জয়নারায়ণের আরেক নাম রাখা হয় দুর্গকুর নারায়ণ। জয়নারায়ণ শিশু থাকায় রানী দুর্গাবতী রাজ্য পরিচালনা করতেন। রানী দুর্গাবতী এক জন বুদ্ধিমতী ও প্রজাবৎসল মহিলা ছিলেন। তিনি ১৭৮০ খ্রিস্টাব্দে রাজধানী শ্রীনগরে (মাধবপাশা) দুর্গাসাগর দীঘি খনন করান। কথিত আছে ১৩ দ্রোণ বা ৬১ কানি ভুমির ওপর ওই দীঘিটি খনন করা হয়।দীঘির পশ্চিমে শ্রীপুর, পূর্বে কলাডেমা, উত্তরে পাংশা এবং দক্ষিণে শোলনা ও ফুলতলা গ্রাম। চন্দ্রদ্বীপ রাজ্যের বিভিন্ন গ্রামের লোকজন দীঘি খননে অংশ নেয়। দীঘিটির খননকাজ শেষ করতে ছয় মাস সময় লাগে। শ্রমিকরা সারা দিনের কাজের শেষে পশ্চিম পাশে আরেকটি দীঘিতে কোদাল পরিস্কার করত। ওই দীঘির নাম হয় কোদাল-ধোয়া দীঘি। দুর্গাসাগর দীঘিটি খননে খরচ হয় তিন লাখ টাকা। উজিরপুরের কর্মকাররা এ দীঘি খননের জন্য কোদাল তৈরি করে। দীঘির চার পাড়ে ৫০ ফুট বিসতৃত চারটি পাকা ঘাট নির্মাণ করা হয়। ১৯৭৫ সালে তৎকালীন মন্ত্রী আবদুর রব সেরনিয়াবাত ওই দীঘিটি পুনরুদ্ধার ও সংস্কার করান।
প্রসঙ্গ : কবি বিজয় গুপ্ত, মনসা-মঙ্গল বা পদ্মপুরাণ
হুসেন শাহী আমলে বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নিদর্শন পদ্মপুরাণ বা মনসা-মঙ্গল। বাংলার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি বিজয় গুপ্ত ওই আমলে রচনা করেন মনসা-মঙ্গল বা পদ্মপুরাণ। বিজয় গুপ্ত ১৪৫০ খ্রিস্টাব্দে বাকলা-চন্দ্রদ্বীপের ফুল্লশ্রী গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর পিতা সনাতন কোটালীপাড়ার অধিবাসী ছিলেন।
বাকলা অঞ্চলে সেন আমল হতে মনসার পূজা প্রচলিত ছিল। কবি বিজয় গুপ্ত দেবী মনসার ভক্ত ছিলেন। মনাসা-মঙ্গল কাব্যের স্বপ্নাধ্যায়ে তিনি উল্লেখ করেন, মনসা দেবী কর্তৃক স্বপ্নে আদিষ্ট হয়ে তিনি মনসা-মঙ্গল বা পদ্মপুরাণ কাব্য রচনা করেন। কথিত আছে ওই কাব্য রচনার আগে তিনি স্বপ্নে আদিষ্ট হয়ে গৈলার মনসাবাড়ির দীঘি হতে মনসা পূজার ঘট ও কোষা উদ্ধার করেন।
মনসা-মঙ্গলের কাহিনী
মনসা-মঙ্গলের মূল কাহিনী হল পদ্মাবতী দেবী ও চাঁদ সওদাগরকে নিয়ে। মহাদেবের কন্যা পদ্মাবতীর জন্ম পদ্মপাতায় । পদ্মাবতী বিষহরি, গৌরী ও মনসা নামে পরিচিত। জন্মের পর থেকে পাতালপুরীর নাগরাজ্যে পদ্মা বড় হয়। ঘটনা চক্রে মহাদেব এক সময় পদ্মাকে নিজ ঘরে নিয়ে যায়। পদ্মার সৎ মা চণ্ডী এক দিন আঘাত করে তার একটি চোখ নষ্ট করে দেয়। পদ্মা সাপের রূপ ধারণ করে সৎ মাকে দংশন করলে চণ্ডী মারা যায়। পরে পিতা মহাদেবের অনুরোধে পদ্মা চণ্ডীকে জীবিত করে। কিন্তু মা- মেয়ের দ্বন্দ্ব চলতে থাকে। মহাদেব পদ্মাকে জড়ৎকারু মুনির সঙ্গে বিয়ে দেয়। বিয়ের রাতে জড়ৎকারু মুনি পদ্মাবতীকে গঙ্গার তীর হতে কুশা আনার নির্দেশ দিলে পদ্মা সাপের রূপ ধরে স্বামীকে দংশন করে। পিতা মহাদেবের অনুরোধে পদ্মা তার স্বামীর প্রাণ ফিরিয়ে আনে। তবে তার স্বামী আর তাকে গ্রহন করল না। ওই সময় জড়ৎকারু মুনি পদ্মাকে অভিশাপে পরবর্তীতে পদ্মা অষ্টনাগ-পুত্রের মা হন।
সৎমা চণ্ডীর সঙ্গে পদ্মার দ্বন্দ্বের এক পর্যায়ে মহাদেব পদ্মা, তার অষ্টনাগ পুত্র ও পদ্মার বোন নেতাকে বনবাসে নির্বাসনে পাঠয়। তারা জয়ন্তী নগরে বাস করতে থাকে। এক সময় পদ্মা অনেক দৈবশক্তির অধিকারী হয়। এর পর তার বাসনা জাগে পৃথিবীর মানুষ তার পূজা করুক। আর মনসার এ পূজার প্রচলনজনিত ঘটনা নিয়েই লিখিত হয় মনসা-মঙ্গল কাব্য।
মনসা-মঙ্গলে বরিশালের আঞ্চলিকতা
কবি বিজয় গুপ্তের অনবদ্য সৃষ্টি মনসা-মঙ্গল কাব্যে রয়েছে বরিশালের প্রচুর আঞ্চলিক শব্দের সম্ভার। এগুলোর মধ্যে মোগো, মোর, থুইয়া, কাহার, আইল,থুকথুক, লবা, বাওয়াইয়া, ভুর, চড়াইল, ছেচিয়া, বান্দে, মোড়ায়, হইয়া, খাইলে, গাইলাম ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
বাকলার ঐতিহ্য আর লৌকিক কাহিনী একই সূতায় গাঁথা -
বাকলা-চন্দ্রদ্বীপের অপুত্রক রাজা জয়দেব ১৪৯০ খ্রিস্টাব্দে মারা যাওয়ার পর সিংহাসনে আরোহ করেন তাঁর বড় বোন কমলা। রানী কমলার স্বামীর নাম ছিল বলভদ্র বসু। কথিত আছে, বলভদ্র বসু দেখতে কালো ছিলেন। তাই প্রজারা তাকে কালারাজা বলতো। গলাচিপার কালারাজার বিল তার নামেই হয়েছে। কালারাজার বিল বর্তমানে কালারাজা গ্রাম হিসেবে পরিচিত। তবে কালারাজা গ্রামের নামকরণ নিয়ে রয়েছে লৌকিক কাহিনী।
রাজা জয়দেবের দুই মেয়ে, কমলা সুন্দরী ও বিদ্যা সুন্দরী। রাজা তাঁর দুই মেয়েকেই উপযুক্ত শিক্ষায় শিক্ষিত করেন। দুই বোনের মধ্যে কমলা ছিলেন প্রতিভাময়ী। বাবার নির্দেশে তিনি রাজ্য পরিচালনা ও অস্ত্র চালনা শিক্ষা লাভ করেন। রাজ্যের শ্রেষ্ঠ পণ্ডিতদের নিকট তিনি সংস্কৃত ও বাংলা ভাষায় জ্ঞান লাভ করেন। বিভিন্ন শাস্ত্রেও অভিজ্ঞতা অর্জন করেন তিনি। রাজা জয়দেব কমলা সুন্দরীকে বাবুগঞ্জ থানার দেহেরগতি গ্রামের উষাপতির পুত্র বলভদ্র বসুর সঙ্গে বিয়ে দেন।
দেহেরগতির বসু পরিবার কৌলিন্য ও শিক্ষায় অগ্রগামী ছিল। বিদ্যোৎসাহী বলভদ্র বসু বিভিন্ন শাস্ত্রে পণ্ডিত ছিলেন। যুদ্ধবিদ্যায় তিনি ছিলেন বাকলা রাজ্যের মধ্যে অতুলনীয়। বলভদ্র বসুর গুণে মুগ্ধ হয়ে রাজা জয়দেব তাকে জামাতা হিসেবে গ্রহন করেন।
বিয়ের পর রাজকুমারী কমলা দেহেরগতি চলেন যান। সেখানে কিছু দিন থাকার পর স্বামী বলভদ্র বসুসহ বাকলার রাজধানীতে ফিরে আসেন। বাবা রাজা জয়দেবের নির্দেশে তাদের জন্য নির্মিত বাড়িতে বসবাস করেন। তাদের দিনগুলো ছিল সুখকর। মৃত্যুর আগে রাজা জয়দেব কমলাকে সিংহাসনের উত্তরাধীকারী ঘোষণা করেন।
১৪৯০ খ্রিস্টাব্দে রাজকুমারী কমলা বাকলার সিংহাসনে আরোহণ করেন। স্বামী বলভদ্র বসু তাকে রাজকার্যে সহায়তা করতেন। রাজ্য শাসন ও প্রজা পালনে কমলা অসামান্য কৃতিত্বের পরিচয় দেন। ওই সময় গৌড়ের সুলতান ছিলেন আলাউদ্দিন হুসেন শাহ্।
প্রজাদের পানির কষ্ট দূর করার জন্য রানী কমলা রাজ্যে অনেক বড় বড় দীঘি খনন করেন। দীঘিগুলোর মধ্যে কমলার দীঘি, বিদ্যা সুন্দরীরর দীঘি অন্যতম।
রানী কমলা নিজের নামে রাজ্যে বৃহত্তম দীঘি খনন করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। তিন দরুন ১৩ কানি অর্থাৎ একশ একর ভূমি নিয়ে দীঘি খনন করার জন্য সভাসদদের নির্দেশ দেন রানী কমলা। এক সময় দীঘি কাটা শেষ হল। বিরাট উঁচু পাড়। এত বড় দীঘি বাকলা রাজ্যে কেউ কোনো দিন খনন করেননি। দীঘি খননে খরচ হল নয় লাখ টাকা। তেঁতুলিয়া নদীর পশ্চিম পাড়ে বাউফলের কালাইয়া গ্রামে খনন করা হয় রানী কমলার নামে ‘কমলার দীঘি’। তখন তেঁতুলিয়া নদী ছিল একটি খালের মতো।
কমলার দীঘি খনন করা হলো। কিন্তু সমস্যা আরেকটি। এত বড় দীঘি, কিন্তু তাতে পানি উঠছে না। রানী কমলা ব্যাকুল হয়ে পড়লেন। ব্রাহ্মণ দিয়ে পুজা করালেন। কাঙ্গালী ভোজ দিলেন। কিছুতেই কিছু না। দীঘিতে পানি উঠছেই না। এদিকে প্রজারা রানীকে দোষারোপ করতে শুরু করলেন- দেবতা রানীর ওপর অসন্তুষ্ট। রানী অত্যন্ত চিন্তিত হয়ে পড়লেন। কথিত আছে, এক রাতে রানী স্বপ্নে দেখেন, তিনি যদি দীঘিতে নেমে গঙ্গা দেবীকে পূজা করেন এবং এক পাড় থেকে আরেক পাড় হেঁটে যান তাহলে দীঘি পানিতে ভরে যাবে।
রানী দীঘিতে নেমে গঙ্গাদেবীকে পূজা দিয়ে এক পাড় থেকে আরেক পাড়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন। ব্রাহ্মণকূল, সভাসদ ও প্রজারা একদৃষ্টিতে কমলার দিকে চেয়ে আছেন। রানী যখন দীঘির মাঝখানে তখন দীঘির চারদিক থেকে পানি আসছে। পানি দেখে রানী নিশ্চল দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি জলমগ্ন হয়ে যাচ্ছেন দেখে সবাই তাঁকে ওপরে উঠে আসার জন্য বার বার অনুরোধ করলেন। কিন্তু রানী উঠতে পারছিলেন না। কমলা সবাইকে বললেন, তিনি গঙ্গাদেবীর সঙ্গে নিরাপদ আশ্রয়ে যাচ্ছেন। তাঁর শিশুপুত্র পরমানান্দকে যেন প্রতিদিন একবার দীঘির ঘাটে রাখা হয়। সেখানে তিনি শিশুপুত্রকে দুগ্ধপান করাবেন। এই বলে রানী ধীরে ধীরে দীঘির পানিতে ডুবে গেলেন।
রানী কমলার মর্মান্তিক মৃত্যুর সময় তাঁর স্বামী বলভদ্র বসু দেহেরগতিতে ছিলেন। শ্রাবণ মাস। অঝোরে ঝরছে বৃষ্টি। অমাবস্যার জোয়ারে নদী-নালা, খাল-বিল পানিতে টইটুম্বুর। পশ্চিমের বাতাসে হাজারি পাল তুলে তর-তর করে এগিয়ে যাচ্ছিল বজরা। বজরার ভেতরে অনুচরসহ বসে আছেন বলভদ্র বসু। দেহেরগতি থেকে নৌকায় বাকলার রাজধানীতে যাচ্ছিলেন তিনি। সন্ধ্যা নেমে আসায় মাঝি-মাল্লারা বজরা ঘোরালেন লোকালয়ের দিকে। এরই মধ্যে অনুচরদের মধ্য থেকে কেউ এক জন বলভদ্র বসুকে জানালেন, রানী কমলা পানিতে ডুবে মারা গেছেন। এ কথা শুনে নিজেকে সংবরণ করতে পারলেন না তিনি। শোক সামলাতে না পেরে ঝাঁপ দিলেন বিলের পানিতে। অনেক খোঁজাখুঁজির পরও পাওয়া গেল না তাঁকে। বিলের পানিতে ডুবে মারা যান বলভদ্র বসু।
বলভদ্র বসুর এই মৃত্যুকে আত্মহত্যা বলেই প্রচার করা হয়। রাজ্যের সবাই জানলেন, স্ত্রী কমলার মৃত্যুর শোক সইতে না পেরে বলভদ্র বসু পানিতে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন। তিনি যে জায়গায় পানিতে ঝাঁপ দেন সে জায়গাটি কালারাজার বিল নামে পরিচিতি পায়। আর কালারাজার বিলই বর্তমান কালারাজা গ্রাম।
কালারাজার আত্মহত্যার কাহিনী নিয়েও বিতর্ক আছে। কারণ কমলার মৃত্যুর পর তিনি পুত্র পরমানন্দ বসুর অভিভাবক হিসাবে অনেকদিন রাজ্য শাসন করেন বলে ইতিহাস থেকে জানা যায়।
রানী কমলার মৃত্যু কাহিনীও বিশ্বাস যোগ্য নয়। তবে এ কথা ঠিক যে, তিনি ওই দীঘিতে ডুবেই মারা যান। ধারণা করা হয় রানী কমলা সেদিনের ব্রাহ্মণ ও জ্যোতিষীদের অন্ধ বিশ্বাসের শিকার হয়েছিলেন। তাদের পরামর্শেই সরলমতি কমলা দীঘির মাঝখানে গিয়ে পূজা দিয়েছিলেন। খুব সম্ভব একদল দুষ্ট কর্মচারী ওই সময় দীঘির এক পাড় কেটে দেয় এবং সে স্থান দিয়ে তেঁতুলিয়া নদীর জোয়ারের স্রোত দীঘিতে ঢুকে পড়ে। এসময় রানী কমলাকে উদ্ধারের জন্য কেউ কোনো চেষ্টা করেনি। কমলা পানিতে ডুবে মৃত্যুবরণ করেন।
রানী কমলার করুণ মৃত্যু কাহিনী বাকলা রাজ্যে ছড়িয়ে পড়ে। সবাই তাঁর মৃত্যুতে হতভম্ব হয়ে যায়। পরবর্তীকালে কমলার করুণ মৃত্যুকাহিনী নিয়ে রচিত হয় সাহিত্যকর্ম, গীত। শত বছর ধরে কমলার বিয়োগান্তক ঘটনা নিয়ে তৈরি গান এ অঞ্চলে গীত হচ্ছে।
ধারণা করা হয় রাজা বলভদ্র বসুরও মৃত্যু হয় পানিতে ডুবে। তার মৃত্যুর ঘটনায়ও দুষ্টু কর্মচারী ও সভাসদদের ষড়যন্ত্র ছিল। তাদের ষড়যন্ত্রেই বলভদ্র বসুকে গলাচিপার কালারাজার বিলের পানিতে ডুবিয়ে মারা হয়।
চন্দ্রদ্বীপ রাজবংশের পতন
রাজা জয়নারায়ণকে (দুর্গাকুর) চন্দ্রদ্বীপ রাজবংশের শেষ রাজা বলা হয়। তবে ১৮১৩ খ্রিস্টাব্দে জয়নারায়ণের মৃত্যুর পর রাজা নৃসিংহ নারায়ণ রাজ ক্ষমতায় আসেন। তখন চলছিল রাজপরিবারের অর্থনৈতিক ভগ্নদশা। নৃসিংহ নারায়ণের মা করুণাময়ী নৃসিংহকে অল্প বয়সেই দুটি বিয়ে করান। তার প্রথম স্ত্রীর নাম অন্নপূর্ণা ও দ্বিতীয় স্ত্রীর নাম রাজেশ্বরী। নৃসিংহ নারায়ণের দুই স্ত্রীর কারোই কোনো সন্তান হয়নি। যদিও তারা একাধিক দত্তক গ্রহন করেছিল।
রাজা নৃসিংহ নারায়ণই চন্দ্রদ্বীপ রাজবংশের শেষ কর্ণধার। তার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে চারশ বছরের প্রাচীন রাজপরিবারের দীর্ঘ ইতিহাসের পরিসমাপ্তি ঘটে। এক দিন যারা মগ-পর্তুগীজ ও মুঘলদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরেছিল, আজ তাদের ঐতিহাসিক কীর্তিগুলোও নেই। শুধুমাত্র রানী দুর্গাবতীর স্মৃতিবিজড়িত দুর্গাসাগর দীঘিটি রাজপরিবারের wPý বহন করছে।
তথ্যসূত্র
01. বরিশাল বিভাগের ইতিহাস -সিরাজ উদ্দীন আহ্মেদ
02. বিজয় গুপ্তের পদ্মপুরাণ বা মনসা মঙ্গল- সম্পাদনা : প্যারিমোহন দাশ
03. বাঙ্গালীর ইতিহাস, আদি পর্ব -নীহার রঞ্জন রায়।
04. বাকলা - রোহিনী রায় চৌধুরী।
05. দি হিস্ট্রি অব বাকেরগঞ্জ -এইচ. বেভারিজ
06. বাখরগঞ্জের ইতিহাস -শ্রী খোসাল চন্দ্র রায়
07. ডিস্ট্রিক্ট অব বাকেরগঞ্জ -এইচ. বেভারিজ
08. টাকার বাদশার নাম ছবি খাঁ -অধ্যাপক আব্দুল হাকিম
09. হিস্ট্রি অব বেঙ্গল -স্যার যদুনাথ সরকার
10. বাংলার ইতিহাস -আবদুল করিম
11. চন্দ্রদ্বীপের ইতিহাস -শ্রী বৃন্দাবন পুতপুণ্ড
12. চন্দ্রদ্বীপ রাজবংশ -ব্রজ সুন্দর মিত্র
13. বাংলাদেশের ইতিহাস -ড. সুশীলা মণ্ডল
14. বাংলা সাহিত্যের কথা -ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ
15. এশিয়াটিক জার্নাল -মি. প্রতাব চন্দ্র ঘোষ
16. ঈশ্বরগুপ্তের রচনাবলী, প্রথম খণ্ড -শান্তি কুমার দাশগুপ্ত এবং শ্রীহরিবন্ধু মুখুর্যি সম্পাদিত
17. সাক্ষাৎকার -মরহুম অধ্যাপক মো. মোস্তাফিজুর রহমান, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, গলাচিপা ডিগ্রি কলেজ, পটুয়াখালী
©somewhere in net ltd.
১|
০৫ ই মার্চ, ২০১৬ সকাল ১১:২১
কিশোর মাস্টার বলেছেন: চমৎকার লেখা। অনেক কিছু জানতে পারলাম।কমলার কাহিনী আগেই জানতাম।সুতাবাড়িয়ার দয়াময়ীর ইতিহাস বাদ গেল বোধ হয়।সুযোগ করে লিখবেন।ধন্যবাদ।