![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
এই ব্লগের সকল মৌলিক লেখার স্বত্ত্ব লেখকের।এখান থেকে কোনো লেখা লেখকের অনুমতি ছাড়া অন্য কোথাও প্রকাশ, ছাপা, অনুলিপি করা গ্রহনযোগ্যনয়। তা সৃজনশীল কাজের পরিপন্থী। লেখা অন্য কোথাওপ্রকাশ, ছাপা করতে চাইলে লেখকের সম্মতি নিতে হবে। লেখকের ইমেল - [email protected]
পাকিস্তানের পুরোনো জখম ও বাংলার জাগ্রত বিবেক
ফকির ইলিয়াস
===========================================
কথাটি আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছেন পাক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী চৌধুরী নিসার আলী খান। তিনি বলেছেন, ‘বাংলাদেশ হওয়ার আগ পর্যন্ত এক ঐক্যবদ্ধ পাকিস্তানের একজন অকুণ্ঠ সমর্থক ছিলেন কাদের মোল্লা। তার মৃৃত্যুতে প্রতিটি পাকিস্তানি শোকার্ত ও মর্মাহত।’ তিনি আরো বলেছেন, আমাদের পুরোনো জখমে আঘাত করেছে বাংলাদেশ। কেয়া বাত! এই কথার মাধ্যমে দুটো বিষয় পরিষ্কার হয়ে গেলো। এক- পাকিস্তান এখনো মনেপ্রাণে বাংলাদেশকে মেনে নিতে পারেনি। দুই- এই কাদের মোল্লাই সেই কসাই কাদের মোল্লা যিনি মিরপুরের কসাই বলে কুখ্যাতি পেয়েছিলেন একাত্তরে। বিষয়টি গোটা বাঙালি জাতিকে নাড়া দিয়েছে। কি বলছে পাকিস্তান? কি চায় তারা? গেলো সোমবার ছিল বাংলাদেশের মহান বিজয় দিবস। ঐ দিনেই পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে কাদের মোল্লার মৃত্যুদন্ড কার্যকরের নিন্দা জানিয়ে একটি প্রস্তাব পাস করা হয়। পাকিস্তান জামাতের সাংসদ শের আকবর খান এই প্রস্তাব উত্থাপন করলে তাতে সমর্থন জানায় সরকারি দল মুসলিম লীগ। এ ছাড়া ইমরান খানের তেহরিক-ই-ইনসাফ, আওয়ামী মুসলিম লীগ, পাকিস্তান মুসলিম লীগ (কায়েদে আজম) ও জমিয়তে ওলামা ইসলাম এ প্রস্তাবে সমর্থন জানায়। প্রস্তাবটিতে বলা হয়- বাংলাদেশের উচিত হবে না ৪২ বছর আগের পুরোনো ক্ষতকে নতুন করে জাগিয়ে তোলা। এতে বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধ সংক্রান্ত সব ধরনের মামলা ‘পারস্পরিক সমঝোতা’র ভিত্তিতে প্রত্যাহার করে নেয়ার আহ্বান জানানো হয়।
পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে আনা এ প্রস্তাবে অবশ্য সমর্থন দেয়নি পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি)। পিপিপির সাংসদ আবদুল সাত্তার বাচানি পরিষদকে এ ধরনের প্রস্তাব গ্রহণ না করার আহ্বান জানিয়ে বলেন, পুরো বিষয়টিই বাংলাদেশের একান্ত অভ্যন্তরীণ বিষয়। আমাদের উচিত হবে না একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে এ ধরনের প্রস্তাব পাস করা।
আমরা এর আগেই দেখেছি, একাত্তরে হত্যা-ধর্ষণের দায়ে বাংলাদেশ জামাতে ইসলামীর নেতা কাদের মোল্লার মৃত্যুদ- কার্যকরের পর পাকিস্তান জামাতে ইসলামী রাজপথে নেমে এর প্রতিবাদ জানায়। আর পরে পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী চৌধুরী নিসার আলী খান মৃত্যুদন্ডে দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, বাংলাদেশ হওয়ার আগ পর্যন্ত ঐক্যবদ্ধ পাকিস্তানের একজন অকুণ্ঠ সমর্থক ছিলেন কাদের মোল্লা। তার মৃত্যুতে প্রতিটি পাকিস্তানি শোকার্ত ও মর্মাহত। ‘ঐক্যবদ্ধ পাকিস্তানের’ সমর্থক হিসেবে কাদের মোল্লার মৃত্যুদ-ে উদ্বেগ প্রকাশ করে পাকিস্তানের পার্লামেন্টে প্রস্তাব উত্থাপনের প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশের তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু বলেছেন, বিবৃতির মাধ্যমে বোঝা যাচ্ছে- পাকিস্তান এখনো ’৭১-এর নীতি ধারণ করে চলেছে। যে কারণে কাদের মোল্লার রায় বাস্তবায়ন হওয়ায় তারা উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। এর প্রতিক্রিয়ায় সচিবালয়ে অনির্ধারিত এক সংবাদ সম্মেলনে মুক্তিযোদ্ধা ইনু বলেন, ‘কাদের মোল্লার পক্ষে কথা বলে পাকিস্তান প্রমাণ করলো, তারা এখনো শোধরায়নি, একাত্তরের নীতি থেকে সরে আসেনি।’ তিনি বলেন, ‘তারা ভুল স্বীকার করেনি। আশা করি, তারা ভুল পথ থেকে সরে আসবে, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলানোর চেষ্টা করবে না।’ তথ্যমন্ত্রী আরো বলেন, ‘আমাদের অবশ্যই বলতে হবে, সার্বভৌম বাংলাদেশের শক্তিশালী স্বাধীন বিচার ব্যবস্থা এ রায় দিয়েছে। এ ব্যাপারে অন্য কোনো দেশের পার্লামেন্টের সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকার নেই। আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এর প্রতিবাদ করা উচিত।’ তিনি বলেছেন, ‘সমস্ত বিশ্বে আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জানিয়ে দেয়া উচিত, দীর্ঘ শুনানি শেষে, সব বিচারিক প্রক্রিয়া মেনে আপিল বিভাগের মাধ্যমে এই রায় কার্যকর হয়েছে। টোকিও ট্রায়াল এবং ন্যুরেমবার্গ ট্রায়ালের কনভেনশন অনুযায়ী আইসিটি আইন করা হয়েছে।’
বাংলাদেশ সরকার এই ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণের তীব্র প্রতিবাদ করেছে। আব্দুল কাদের মোল্লার মৃত্যুদন্ডে উদ্বেগ প্রকাশ করে পাকিস্তান পার্লামেন্টে প্রস্তাব গ্রহণের পর গেলো মঙ্গলবার বিকেলে ঢাকায় দেশটির হাইকমিশনার মিয়া আফরাসিয়াব মেহেদী হাশমি কোরেশিকে তলব করে সরকার। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে সে দেশের সরকারের ভূমিকার বিষয়ে ব্যাখ্যা চাওয়া হয়েছে। এর প্রতিবাদে ঢাকার পাকিস্তানি দূতাবাস অভিমুখে পদযাত্রা, ঘেরাওয়ের ডাক দেয় গণজাগরণ মঞ্চ। মিছিলে সম্মুখে অংশ নিয়েছেন একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে শহীদ পরিবারের সদস্যরা এবং পাকিস্তানি ও তাদের দোসর রাজাকার-আল বদরদের হাতে নির্যাতিত নারীরা। তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছেন দেশের বুদ্ধিজীবীবৃন্দ। তারা বলেছেন -‘বিদেশী যে কোনো রাষ্ট্র, সরকার, প্রতিষ্ঠান, মন্ত্রী কিংবা বাংলাদেশে কর্মরত কূটনীতিকদের এ কথা ভুলে গেলে চলবে না যে, বাংলাদেশ একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র, যা তার নিজস্ব সংবিধান ও আইন দিয়ে পরিচালিত হয়।’
যে কথাটি বলা দরকার, বাঙালি জাতি পাকিজাতদের সবসময়ই গোঁয়ার এবং গাদ্দার বলেই জেনে এসেছে। আমরা যারা পাকিস্তানি শাসন দেখেছি, আমরা যারা মহান মুক্তিযুদ্ধ দেখেছি, তারা ভালো করেই জানি মুক্তিসংগ্রাম কতোটা অপরিহার্য ছিল। কারণ জোঁকের মতো রক্তচোষা পাকিস্তানিরা সবসময়ই বাঙালিদের দমিয়ে রাখতে চেয়েছে। এটা কে না জানে।
সেই পাকিস্তানিদেরই পা-চাটা দালাল, আলবদর, রাজাকার, আলশামস বাহিনী হামলে পড়েছিল নিরীহ বাঙালি জাতির ওপর। এইসব স্বদেশী হায়েনারা ছিল পশ্চিমা খানসেনাদের চেয়েও কোনো কোনো ক্ষেত্রে বেশি হিংস্র। এদেরই একজন এই কাদের মোল্লা। কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর করার পর ‘আসল’ ‘নকল’ নিয়ে ঘোলাজলে মাছ শিকারের চেষ্টা করেছে একটি মহল। তারা বলেছে, এই কাদের মোল্লা কসাই কাদের নয়। এই বিতর্কে নতুন বাণী জোগান দিয়েছে আওয়ামী লীগেরই এক এমপি গোলাম মাওলা রনি। তথাকথিত একটি চিঠি নাকি আছে তার কাছে। পরে দেখা গেছে ঐ চিঠিও ভুয়া।
এখানে যে দুটি প্রশ্ন করা দরকার তা হলো- এই কাদের মোল্লা যদি কসাই কাদের না হয়ে থাকে, তাহলে আসল কসাই কাদের কে? কি তার পরিচয়? সে কোথায় আছে? কেমন আছে? আর দ্বিতীয় প্রশ্নটি হলো, ধরে নেয়া যাক কাদের মোল্লা কিংবা তার আইনজীবীদের কথা বলতে দেয়া হয়নি। আমরা জানি বাংলাদেশে জামাতিদের অনেক মিডিয়া আছে। তারা ঐ মিডিয়ায় প্রকৃত ‘কসাই কাদের মোল্লা’র পরিচয় তুলে ধরেনি কেন? কেন ধারাবাহিক রিপোর্ট লিখে তারা দেশবাসীকে প্রকৃত তথ্য জানায়নি? মৌলবাদী ঐ মাথামোটা বুদ্ধিওয়ালারা কোথায় ছিল?
এটা দুঃখজনক সত্য, অনেক নাৎসিও মৃত্যুদ- কার্যকরের আগ মুহূর্ত পর্যন্ত নিজেকে নির্দোষ দাবি করেছে। আর বাংলাদেশের ঘৃণ্য রাজাকার সর্দারেরা তা করবে, তা অস্বাভাবিক কিছু নয়। কারণ হীন মানসিকতার মানুষেরা মরার আগেও ভাবে- একটা গোল বাধিয়ে যাওয়া যায় কিনা। কাদের মোল্লাকে চিনে, জেনেই সাক্ষী দিয়েছেন মুক্তিযোদ্ধা শহীদুল হক মামা। সাক্ষী দিয়েছেন বীরাঙ্গনা মোমেনা। তার পরেও এই ঘাতককে শনাক্ত করতে জাতিকে ভুল করতে হবে?
আর সর্বশেষ সাফাই সাক্ষী এসেছে পাকিস্তান থেকে। পাকিস্তানের জামাতে ইসলামী, মুসলিম লীগের হোতারা বলেই দিয়েছেন- এই কাদের মোল্লাই সেই কাদের মোল্লা। যার ভূমিকা ছিল ‘পাক তমদ্দুন’ এর পক্ষে। তেহরিক-ই-ইনসাফের চেয়ারম্যান ও পাকিস্তানের সাবেক ক্রিকেটার ইমরান খান বলেছেন, জামাত নেতা আব্দুল কাদের ছিল সম্পূর্ণ নির্দোষ এবং তার বিরুদ্ধে আনীত সব অভিযোগ ছিল মিথ্যা। ইমরান খান বলেন, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার কমিশনের আইনজীবীর মতে জামাত নেতা আব্দুল কাদের মোল্লা ছিল নির্দোষ এবং তাকে অভিযুক্ত করার মতো কিছুই পাওয়া যায়নি। ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলিতে তিনি এসব বলেন। এটা বাংলাদেশের মানুষ খুব ভালো করে জানেন, কাদের মোল্লাকে বাঁচাবার যদি কোনো পথ খোলা থাকতো তার সবই করতো তার নিজের রাজনৈতিক দল। কিন্তু সে উপায় ছিল না। কারণ এমন দাগি অপরাধীকে আর আড়ালে সরিয়ে নেয়া যায় না। দেশে কিছু করতে না পেরেই সেই পুরোনো বন্ধু পাকিস্তানের শরণাপন্ন হয়েছে একাত্তরের পরাজিত রাজাকাররা।
মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশে বর্বরতা চালানোর অন্যতম হোতা আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজীর স্বজন ইমরান খান আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন ‘রিপ্রাইভ’-এর আইনজীবীকে কাদের মোল্লার মৃত্যুদ-ের বিষয়ে প্রতিক্রিয়া দেন বলে রেডিও পাকিস্তান জানিয়েছে। যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার মৃত্যুদন্ডের বিরুদ্ধে যে কয়টি মানবাধিকার সংগঠন কথা বলে আসছে, তার মধ্যে রিপ্রাইভ একটি। এর আগে, কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর হওয়ার পর নিন্দায় ফেটে পড়ে পাকিস্তানের জামাতে ইসলামী। পরদিন জুমার নামাজের পর পাকিস্তানজুড়ে বিক্ষোভের ডাক দেয় দলটি। পাকিস্তান জামাতের মতে, কাদের মোল্লার ফাঁসির মাধ্যমে ন্যায়বিচারকে হত্যা করা হয়েছে। কাদের মোল্লাকে শহীদ আখ্যা দিয়ে পাকিস্তান জামাত জানায়, তাদের বাংলাদেশ শাখার একজন মহান নেতাকে ফাঁসি দেয়া হয়েছে। এ সময় বাংলাদেশে আক্রমণ করতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রতিও দলটির পক্ষ থেকে আহ্বান জানানো হয়। সেই সঙ্গে এ ঘটনায় নীরব ভূমিকার জন্য দেশটির সেনাবাহিনীর সমালোচনা করে পাকিস্তান জামাত।
কী ভয়াবহ কথা! এখনো পাকিস্তানকেই প্রভু মনে করে সেই আলবদররা। পাকিস্তানের পুরোনো জখম থাকতেই পারে। যারা টিভিতে চৌধুরী নিসারের বক্তব্য শুনেছেন তাদের কানে ঐ ‘জখম’ শব্দটি বারবার বেজেছে। ঐ দগদগে ঘা নিয়ে বাংলাদেশের কোনো মাথাব্যথা নেই। থাকার কথাও নয়। কারণ বাঙালি জিতেছে। আর বিজয়ের মূলধারায়ই গড়তে চাইছে বাংলাদেশ। জাগ্রত বিবেক থেকেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকাজ চলছে বাংলাদেশে। এখানে পাকিজাতদের মাথাব্যথার কোনো কারণ থাকার কথা নয়। তাই সময় এসেছে, যারা এখনো ঐ রাও ফরমান আলী খাঁর আওলাদ হিসেবে এই বাংলায় পেখম মেলতে চাইছে তাদের চিহ্নিত করার।
যারা গেলো দেড় মাস যাবৎ বাংলাদেশে একাত্তরের কায়দায় জ্বালাও পুড়াও করছে, তারা কি আদৌ বাংলাদেশকে স্বীকার করে? এই প্রশ্নটি আবারো উসকে দিয়েছে পাকি রাজনীতিকরা। এর জবাব দিতে হবে। এই প্রজন্মকে সেই সাহস সঞ্চয় করতে হবে। না করতে পারলে আমাদের মহান বিজয় শুধুই কঙ্কালসার হয়ে পড়তে পারে।
----------------------------------------------------
দৈনিক ভোরের কাগজ : শনিবার, ২১ ডিসেম্বর ২০১৩
©somewhere in net ltd.