![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
এই ব্লগের সকল মৌলিক লেখার স্বত্ত্ব লেখকের।এখান থেকে কোনো লেখা লেখকের অনুমতি ছাড়া অন্য কোথাও প্রকাশ, ছাপা, অনুলিপি করা গ্রহনযোগ্যনয়। তা সৃজনশীল কাজের পরিপন্থী। লেখা অন্য কোথাওপ্রকাশ, ছাপা করতে চাইলে লেখকের সম্মতি নিতে হবে। লেখকের ইমেল - [email protected]
রতন বড়ুয়া : একজন মানবতাবাদী নেতার মহাপ্রয়াণ
ফকির ইলিয়াস
___________________________________________
তাকে আমি পেয়েছিলাম আমার সহযোদ্ধা হিসেবে। আমার পাশে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি- রতন বড়ুয়া। সময় ১৯৯২-১৯৯৩ সাল। আমরা তখন শহীদ জননী জাহানারা ইমামের ডাকে উত্তর আমেরিকায় ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল জাতীয় সমন্বয় কমিটি’ গঠন করেছি। ঐ কমিটির যৌথ আহ্বায়ক ডা. নুরুন নবী ও কাজী জাকারিয়া। প্রকৌশলী ফরাসত আলী সচিব। আর আমি সহকারী সচিব।
আমাদের অন্যতম সমন্বয়কারী ছিলেন রতন বড়ুয়া। প্রতিটি সভায় যার উপস্থিতি ছিল অনিবার্য। রতনদা ১ এপ্রিল ২০১৪ মঙ্গলবার সকাল ছটার দিকে নিউইয়র্কের একটি হাসপাতালে হেরে গেলেন তার নিঃশ্বাসের কাছে। তিনি চলে গেলেন পরপারে। বীর মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন তিনি। আমার প্রিয় অগ্রজ ছিলেন তিনি। এমন ভালোমানুষ আমার জীবনে আমি খুব কমই দেখেছি। অকৃতদার এই মানুষটি জীবন বিলিয়ে গেছেন মানুষের কল্যাণে।
তিনি ছিলেন আমার প্রতিবেশী। আমরা একই এলাকায় থাকতাম। নিউইয়র্কের উডহ্যাভেনে। তিনি এই এলাকার পুরনো বাসিন্দা। আমি এসেছি ছয় বছর হতে চললো। এই এলাকায় মুভ করার পর বাসের জন্য উডহ্যাভেন আর জ্যামাইকা এভিন্যুর কর্নারে দাঁড়িয়ে আছি। হঠাৎ দেখি রতনদাও আসছেন। আরে ফকির ইলিয়াস! আপনি এদিকে! বললাম- আমি এই এলাকায় মুভ করেছি রতনদা। কী খুশি তিনি! তিনি এই এলাকায় দীর্ঘদিন আছেন বলে, আমাকে সবকিছু বুঝিয়ে দিলেন, একজন প্রাজ্ঞ অভিভাবকের মতো। তিনি তো দেবেনই। তিনি আমার অগ্রজ। একে অপরকে চিনি তিন দশকের কাছাকাছি সময়। বললেন- ইফ ইউ নিড এনিথিং, কল মি প্লিজ। শ্রদ্ধায় আমার মাথা নত হয়ে গেল।
মনে পড়ছে, যেদিন একাত্তরের ঘাতক গোলাম আযমকে নিয়ে মৌলবাদীরা ব্রুকলিনে সভা করে সেদিন আমাদের সাথে রাস্তায় দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ সমাবেশে উপস্থিত ছিলেন সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক। আমার ডানপাশে হাতের কব্জি ধরে দাঁড়িয়েছিলেন রতনদা। চোখে মুখে তার আগুন। সেøাগান দিচ্ছেন যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক এম এ সালাম। দীর্ঘ দুঘণ্টা সড়ক অবরোধ করে দাঁড়িয়েছিলাম আমরা। এই পরবাসে মানবকল্যাণমূলক কাজের অগ্রদূত ছিলেন রতন বড়ুয়া। ছিলেন বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৃত। স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন, দেশে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার, মৌলবাদীদের আস্ফালন, সামাজিক বৈষম্য কিংবা সংখ্যালঘুদের উপর আক্রমণ এলেই গর্জে উঠেছেন তিনি। ছুটেছেন আমেরিকার বিভিন্ন দপ্তরে। বলেছেনÑ আমার মানুষ আক্রান্ত। আমার দেশ আক্রান্ত। মানুষ বলতে কোনো ভেদাভেদ ছিল না তার কাছে। কেউ সাহায্য চেয়ে খালি হাতে ফিরেছে এমন কোনো নজির ছিল না উত্তর আমেরিকায়। যেভাবে পেরেছেন সামান্য হলেও হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন।
তার মানবতাবাদী মন, সবসময়ই ছিল কল্যাণব্রত। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, গৌতম বুদ্ধের দুটি বাণী বিশ্ববাসীকে বিশেষভাবে আকৃষ্ট ও অনুপ্রাণিত করেছিল। সে দুটি বাণীর মধ্যে একটি হচ্ছে সৎচিন্তা ও সৎকর্ম সম্পর্কিতÑ শীল, সমাধি ও প্রজ্ঞাময় জীবন গঠন করা। আর অন্যটি হলো আত্মনির্ভরশীল হওয়া। বুদ্ধ সব সময় তার শিষ্যদের বলতেন, ‘হে ভিক্ষুগণ, তোমরা মুক্তির জন্য পরনির্ভরশীল হয়ো না, অন্যের মুখাপেক্ষী হয়ে থেকো না, নিজেই নিজের প্রদীপ হও, নিজে নিজের শরণ গ্রহণ করো।’ জগতে এর চেয়ে নিজেকে তৈরি করার ইচ্ছা ও কর্ম স্বাধীনতার মহৎ বাণী আর কী থাকতে পারে? বুদ্ধের এ বাণীর মধ্যেই রয়েছে মহামানবতাবাদ ও সুন্দর স্বাবলম্বী সমাজ গঠনের উত্তম শিক্ষা। রতন বড়ুয়া এই দীক্ষা গ্রহণ করেছিলেন মনে প্রাণে।
বুদ্ধের দৃষ্টিতে ন্যায়তন্ত্র হচ্ছে সকল মানুষের সমান অধিকার। সকল মানুষের পূর্ণ গণতন্ত্র এবং সকল মানুষের কর্মশক্তির প্রতিফলন ও মূল্যায়ন। অন্যদিকে বৌদ্ধধর্মের অন্যতম মূল বাণী হচ্ছে অহিংসা এবং শান্তি, মৈত্রী ও প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে সহ-অবস্থান করা। তাই বৌদ্ধসমাজ দর্শনে সাম্যবাদ, গণতন্ত্র এবং সকল মানুষের ধর্মীয় অধিকার লাভ প্রভৃতি বিষয় বিশেষভাবে স্থান পেয়েছে। এখানে কোনো প্রকার বৈষম্য থাকবে না। শ্রেণিস্বার্থ, বৈষযয়িক স্বার্থ, এমনকি পদমর্যাদার স্বার্থও থাকবে না। এগুলো হবে এখানে গৌণ। ধনী-দরিদ্র, ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয় এবং সকল পেশার মানুষের মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্ব হবে মুখ্য। এখানে সকল মানুষ তার নিজের অভিব্যক্তি স্বাধীনভাবে প্রকাশ করতে পারবে। সুতরাং সাম্য, ন্যায্যতা, পরমতসহিষ্ণুতা, সহমর্মিতা এবং সৎ নীতি-আদর্শই হবে এখানে মুখ্য। রতন বড়ুয়া নিজ ধর্মে অবিচল থেকে এই সত্য আমাদের অভিবাসী সমাজে প্রতিষ্ঠা করে গেছেন।
মনে পড়ছে, তার কর্কট রোগ ধরা পড়ার পর প্রথম দেখা হওয়ার দিনটির কথা। কিউ৫৩ বাস ধরে জ্যাকসন হাইটসের দিকে যাচ্ছি। পথেই বাসে উঠলেন রতনদা। তখন খবরের কাগজে এই সংবাদ জেনে গেছি। বললাম- আপনি এই সংবাদটি আমাদেরকে জানালেন না রতনদা! হো হো করে হেসে উঠলেন। বললেন, আমি নিজেও তো জানতাম না। এই তো সেদিনই ডাক্তার বললেন। মনটা কান্নায় হু হু করে উঠলো। তার হাত ধরে কিছুক্ষণ নীরব বসে রইলাম পাশে। তিনি চলে যাবেন চিরতরে! ডাক্তার সময় বেঁধে দিয়েছেন! কথা পাল্টে দিলেন রতনদা। সমাজ-রাজনীতি-বাংলাদেশ-বিশ্বঅর্থনীতি স্থান পেলো তার আলোচনায়। ভাবখানা ছিল তার- কিছুই হয়নি। কিছুই হবে না। বাস থেকে বেরিয়ে যাবার সময় বললেন- আশীর্বাদ আপনাদের সকলের জন্য। আমিও হাতজোড় করে প্রণাম জানালাম তাকে।
নিজে মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। ছিলেন সাহসী মানুষ। তাই মৃত্যুকে পরোয়া করেননি। যেতে হবে- যাবো। এমন মানসিকতা গড়ে উঠেছিল তার। এর পরে যতোবার দেখা পেয়েছি, বলেছেন মানুষের কল্যাণেই শেষ মুহুর্তটুকুও ব্যয় করতে চাই। কোনো দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছিল না তার মাননে। মানবসেবায় বিশেষ অবদান রাখার জন্য রতন বড়ুয়া ইউনাইটেড ফর হিউম্যান রাইটের ‘পিস অ্যান্ড টলারেন্স-২০০৯ অ্যাওয়ার্ড’, এবিআই ইউএসএ’র ‘একম্পিøস লিডার, ইউনাইটেড কালচারাল কনভেনশনের ‘ইন্টারন্যাশনাল পিস প্রাইজ-২০০৭’, ‘গোল্ড মেডেল অব দ্য টোয়েন্টিফার্স্ট সেঞ্চুরি’, আমেরিকান বায়োগ্রাফিক্যাল ইনস্টটিউটের ‘ডিগনিটি অব অনার্স’, ইন্টার রিলিজিয়াস অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন ফর ওয়ার্ল্ড পিসের ‘অ্যাম্বাসেডর ফর পিস অ্যাওয়ার্ড’ প্রভৃতি সম্মাননা লাভ করেন।
তিনি একটি হাসপাতালে তার দেহ দান করে গেছেন। এটিও তার সর্বশেষ মানবতাবাদের উদাহরণ। কে না জানে- নিজেকে মরতে হবে। কিন্তু সাহসের সাথে মৃত্যুকে বরণ করতে পারে কজন? না- রতনদা, আমি আপনাকে বিদায় বলবো না। অন্তত আমি সেটা পারবো না। কারণ আমার অভিবাসী জীবনের এই পরিবেশে, এই প্রতিবেশে আপনার ছায়া সঙ্গে থাকবে আমাদের- আজীবন। আন্দোলনের মিছিলে ছায়া হয়ে থাকবেন আপনি। অধিকার আদায়ের মানববন্ধনে দ্বীপ হয়ে থাকবেন আপনি। প্রবাসী প্রজন্মের পরিশুদ্ধ জীবন গঠনে প্রেরণা হয়ে থাকবেন আপনি। আপনার মৃত্যু হয়েছে তা আমি মেনে নেবো না। আমি আপনার ব্যক্তিগত অনেক দুঃখানুভূতির কথা জানতাম। কিন্তু সেগুলো কি আপনাকে দমিয়ে রাখতে পেরেছিল? না, পারেনি। আর পারেনি বলেই আপনি হয়ে উঠেছিলেন আমাদের নেতৃত্বের প্রতীক।
উত্তর আমেরিকার বিভিন্ন ফোরাম থেকে আপনি অনেকগুলো পুরস্কার পেয়েছিলেন। আপনার কাজের তুলনায় সেগুলো ছিল খুবই সামান্য। মানুষের শ্রদ্ধা-ভালোবাসা পেয়েছেন। এটাই ছিল আপনার বড় পাওনা। আপনি দেহত্যাগ করেছেন। লোকান্তরিত হয়েছেন। এর বেশি কিছু নয়। আপনার আত্মা চিরশান্তি লাভ করুক। আপনি আজীবন মানুষের জন্য কঠোর পরিশ্রম করেছেন। আপনি ঘুমান রতনদা। আমরা জেগে আছি- আপনার রেখে যাওয়া মানবতাবাদের ঝাণ্ডা উড্ডীন করে।
______________________________________________________
দৈনিক ভোরের কাগজ // ঢাকা // : ১৩/এপ্রিল/২০১৪ রোববার
©somewhere in net ltd.