![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
এই ব্লগের সকল মৌলিক লেখার স্বত্ত্ব লেখকের।এখান থেকে কোনো লেখা লেখকের অনুমতি ছাড়া অন্য কোথাও প্রকাশ, ছাপা, অনুলিপি করা গ্রহনযোগ্যনয়। তা সৃজনশীল কাজের পরিপন্থী। লেখা অন্য কোথাওপ্রকাশ, ছাপা করতে চাইলে লেখকের সম্মতি নিতে হবে। লেখকের ইমেল - [email protected]
সরদার ফজলুল করিমের স্বপ্নের বাংলাদেশ ও বাস্তবতা
ফকির ইলিয়াস
______________________________________________
চলে গেলেন সরদার ফজলুল করিম। আমার একটি প্রবন্ধের বই ‘কবিতার বিভাসূত্র’ উৎসর্গ করেছিলাম তাঁকে। মনে পড়ছে, তাঁর লেখা ‘শহীদ রুমীর আম্মা ও অন্যান্য প্রবন্ধ’ গ্রন্থটি পড়েই আমি তার একান্ত অনুরাগী হয়ে উঠেছিলাম। একজন নির্মোহ মানুষের প্রতিকৃতি ছিলেন তিনি। জীবনদ্দশায় আমাদের সমাজ, জাতি, প্রজন্ম নিয়ে অনেক কথা বলেছেন তিনি।
তিনি সাক্ষাৎকারে বলেছেনÑ ‘একজন মানুষকে, উত্তম মানুষকে সম্মান করতে হবে। আর সক্রেটিস প্লেটো টিচার এবং তা দিয়ে আর একজন মানুষকে সে শিক্ষিত করার চেষ্টা করবে। এখানকার একজন শিক্ষক যৌন নিপীড়ক হবে, সেটা হওয়া উচিত না। এখানে তো একজন ভিসি সেও নিপীড়ক হয়ে দেখা দিয়েছে, সিন্ডিকেটÑ তারাও নিপীড়ক হয়ে দেখা দিয়েছে। কারণ তারা অপরাধীকে আশ্রয় দিয়েছে, তারা তাকে ছেড়ে দিয়েছে। তাকে বলছে, না সে কোনো অপরাধী না আর কি। কাজে ব্যবস্থা হিসেবে শিক্ষা ব্যবস্থা অকার্যকর।’
সরদার ফজলুল করিম আজীবন ছিলেন সত্যনিষ্ঠ মানুষ। বাংলাদেশ তিনি তিনি ভাবিত ছিলেন। তিনি তাগিদ দিয়েছেন এই প্রজন্ম যেন পঠন-পাঠন করে আলোকিত হয়। বলেছেনÑ “আমি বইয়ের বলদ। জীবন ভরে বইয়ের শরীর স্পর্শ করে আনন্দ পেয়েছি। বইকে ভালোবেসে বইয়ের বনে রয়ে গেলাম। আমার আর আছে কী। বইতো আমার সম্পদ। কোনো কর্তৃপক্ষ আমার সঙ্গে যোগাযোগ করলে আমার গড়া গ্রন্থাগারটি না হয় পাঠকদের জন্য দান করে দিতাম। যে বাসায় ভাড়া থাকি সেখানে তো পাবলিক এসে পড়তে পারছে না। তেমন পরিসর নেই, সুযোগও নেই। অনেক ডায়েরি লিখেছি। ভালো প্রকাশক পেলে সেগুলো প্রকাশের জন্য দিতে চাই। গুপ্তধনের মতো এগুলো আর পাহারা দিয়ে রাখতে চাই না। এ ডায়েরিতে আছে বাংলাদেশের তথ্যপঞ্জি, ঘটনার পটভূমি, কালের চিত্র।”
সরদার ফজলুল করিমের ভাবনায় জীবনবাদ ছিল খুবই প্রবল। তিনি নিজের মৃত্যুভাবনা নিয়ে বলতে গিয়ে বলেছেনÑ “অনেক আগে আমার এক বন্ধু হাত দেখে বলেছিল; তোমার মৃত্যুতে দুর্ভোগ আছে। মানে সহজে আমার মরণ হবে না। সেই বন্ধু আমার আগেই এ পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন। ভাবছি এতো মানুষ পৃথিবী ছেড়ে চলে গেল আর আমি বার্ধক্যের যন্ত্রণা নিয়ে বেঁচে আছি। আমি নিজে এখন একটি প্রশ্নে পরিণত হয়েছি। নিজের প্রতি বিস্ময় আমার বেড়েছে। কী থেকে কী হচ্ছে আজো বুঝতে পারছি না, মেলাতে পারছি না। কীভাবে আজো বেঁচে আছি, তা আমারও প্রশ্ন। মৃত্যুর সম্ভাবনা ছিল আমার কয়েকবার। একবার পাক হানাদারদের হাতে, আরেকবার বন্দী অবস্থায় কারাগারে।
বার্ধক্যে এসে আমার পা ভেঙেছে, দীর্ঘদিন ঘরে ছিলাম। আমার হাত ভেঙেছিল, অনেকদিন ঘর থেকে বের হইনি। কিছুদিন আগে আমার অপারেশন হলো। হাসপাতালে থাকলাম অনেকদিন। এখন ঘরবন্দী হয়ে বেঁচে আছি। চিকিৎসক মেয়ে, মেয়ের জামাইর চেষ্টা আর তোমাদের ভালোবাসা আমাকে সহজে মরতে দিচ্ছে না। যতোই চেষ্টা করো তোমরা, মৃত্যু একদিন আমাকে নিতে আসবেই। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, প্রফেসর আব্দুর রাজ্জাক, কবি শামসুর রাহমান আমাকে ভালোবাসতেন। তারা চলে গেছেন পৃথিবী ছেড়ে। আমি কোন ঘোড়ার ডিম! আমাকেও যেতে হবে। আমি মৃত্যু নিয়ে দুঃশ্চিন্তিত নই। মরার সাহস আমার আছে। মরবো তোমাদের ভালোবাসা নিয়েই। আমি আমৃত্যু ভালোবাসার ভৃত্য।”
সরদার ফজলুল করিম ছিলেন জাতির এমনই এক সন্তান যার শূন্যতা কখনই পূরণ হওয়ার নয়। তিনি ছিলেন একাধারে শিক্ষক, লেখক, রাজনীতিক এবং জাতির যে কোনো সংকটে এক প্রজ্ঞাবান পথপ্রদর্শক। রাজনীতির জন্য বিদেশে উচ্চতর শিক্ষার সুযোগ বিসর্জন দিয়েছেন, ত্যাগ করেছেন দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠের শিক্ষকতার পেশা। গণমানুষের মুক্তি ও শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম করতে গিয়ে বিভিন্ন মেয়াদে জীবনের স্বর্ণালী ১১টি বছর কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে কাটিয়েছেন। কারারুদ্ধ অবস্থাতেই ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনে ফ্রন্টের প্রার্থী হিসেবে তৎকালীন পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন।
বাম ঘরানার রাজনৈতিক দর্শন তার মধ্যে তৈরি করেছিল জ্ঞান ও প্রজ্ঞার স্পৃহা। তাই রাজনীতির মাঠে যেমন সফল ও তাত্ত্বিক দর্শনের চর্চা করেছেন তেমনি করে লেখালেখির বিষয় হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন দর্শন, ইতিহাস ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের নানাবিধ বিষয়কে। তার প্রকাশিত গ্রন্থাবলীর তালিকার দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই সেখানে গভীর মনন ও অধ্যয়নের একটি ধারাবাহিক প্রকাশ আছে সাবলীল ভঙ্গিতে। তিনি অনুবাদ করেছেন প্লেটো, অ্যারিস্টটল, রুশো, ফ্রেডরিক এ্যাঙ্গেলসের ক্লাসিক গ্রন্থাবলী। দর্শন তার প্রিয় বিষয় হওয়াতে তিনি বাংলায় রচনা করেছিলেন দর্শনের এক অসাধারণ গ্রন্থ। এ ছাড়া ‘নানা কথার পরের কথা’, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যলয় ও অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক’, ‘চল্লিশের দশকের ঢাকা’, ‘নূহের কিস্তি’, ‘রুমীর আম্মা’, ‘সেই সে কাল’।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে যখন দুর্বৃত্তায়ন ঘটেছে, রাজনীতির সঙ্গে জ্ঞান ও সংস্কৃতির যখন বিচ্যুতি ঘটেছে সে সময় থেকে ধীরে ধীরে তিনি রাজনীতি থেকে নিজেকে নিষ্ক্রিয় করে তুলেছেন। তবে রাজনীতি বিমুখ হননি কখনো। দেশের যেকোনো ক্রান্তিলগ্নে তার শক্তিশালী অবস্থান দেশের মানুষকে সাহস জুগিয়েছে।
মনে পড়ছে ২০০২ সালে ঢাকায় তার সঙ্গে দেখা হয়েছিল আমার। বলেছিলেনÑ “যে দেশে চোরের সরদার, ডাকাতের সরদার, খুনির সরদার, শোষকের সরদাররা অবলীলায় পার পেয়ে যায়, সেদেশে আমার মতো সরদারের বেঁচে লাভ কি?”
তার এই কথার আবেদন ও গুরুত্ব শেষ হয়ে যায়নি বাংলাদেশ থেকে। বরং বেড়েছে। আমাদের চারপাশে এখন লুটপাটের মহড়া। সবকিছুতেই দখলের রাজত্ব। আমাদের রাজনীতিকরা প্রায়ই একটি কথা বলেন, আমাদের জনশক্তিকে মানবসম্পদে রূপান্তরিত করতে হবে। কথাটি বলা খুবই সোজা। কিন্তু এর বাস্তবায়ন খুবই কঠিন কাজ। এটিকে আরো কঠিনতর করে তুলেছেন এ রাজনীতিবিদরাই। যারা জনগণের মুক্তির লক্ষ্যে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে আগ্রহী নয় মোটেও।
দেশের মানুষ অনেক কিছুই পারছেন না। কিন্তু তাদের পারতে হবে। একটি বিষয়ে সব পথ ও মতের মানুষকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে এই বলে যে, সব অশুভ কাজ থেকে বিরত থাকা। এই রাষ্ট্রের বয়স এখন ৪৪ বছর। খুবই দুঃখজনক এই চার দশকেরও বেশি সময়ে রাষ্ট্রীয় অবকাঠামো একটি শক্তিশালী রূপ ধারণ করতে পারেনি। এর প্রধান কারণ, শোষিত জনগণ তাদের অধিকারের ন্যায্য হিস্যা পায়নি। তাই কারা জনগণের রাজনৈতিক শক্র, কারা সামাজিক শত্রু তা চিহ্নিত করা খুবই জরুরি। আমি জানি, আমাদের পূর্বপুরুষরা অনেক কিছুই পারেননি। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে, এ প্রজন্ম পারবে না। এ প্রজন্মকে তা পারতেই হবে। আর এজন্য চাই পরিশুদ্ধ মনন।
সরদার ফজলুল করিমের মতো প্রাজ্ঞ ব্যক্তিরা যে স্বপ্ন নিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন করেছিলেন, সেই চেতনা এই প্রজন্মকে সমুন্নত রাখতে হবে। তিনি তার দেয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেনÑ “আমাদের সমস্ত মহৎ ঐতিহ্য নষ্ট করে দিচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধের অর্জন প্রায় শেষ করে দিয়েছে। আমাদের ক্রাইসিস অস্তিত্বের ক্রাইসিস, আমরা সাংঘাতিক ক্রাইসিসের মধ্যে আছি। এখন সেক্রিফাইজ করতে হবে। দৃষ্টান্তের কোনো বিকল্প নেই, সেক্রিফাইজের কোনো বিকল্প নেই। তুমি দৃষ্টান্ত না দেখালে আর একজন মানুষ কেন সেক্রিফাইজ করবে?..”
আমাদের বাংলাদেশ সরদার ফজলুল করিমের চিন্তা-চেতনার উর্বর ভূমি হোক, সেটাই মনেপ্রাণে কামনা। তিনি বেঁচে থাকবেন আমাদের মাঝে চিরউজ্জ্বল হয়ে।
------------------------------------------------------------------
দৈনিক ভোরের কাগজ ॥ ঢাকা ॥ : ২১/জুন/২০১৪ শনিবার
২| ২১ শে জুন, ২০১৪ রাত ৯:৪৫
স্বপ্নচারী গ্রানমা বলেছেন:
বলেছেনÑ “আমি বইয়ের বলদ। জীবন ভরে বইয়ের শরীর স্পর্শ করে আনন্দ পেয়েছি। বইকে ভালোবেসে বইয়ের বনে রয়ে গেলাম। আমার আর আছে কী। বইতো আমার সম্পদ। কোনো কর্তৃপক্ষ আমার সঙ্গে যোগাযোগ করলে আমার গড়া গ্রন্থাগারটি না হয় পাঠকদের জন্য দান করে দিতাম।
এমন মানুষের জন্য বিনম্র শ্রদ্ধা ও সালাম !
চলে গেলেন আমাদের এক নির্মোহ বাতিঘর ।
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে ।
৩| ২২ শে জুন, ২০১৪ দুপুর ২:৪৬
আহসানের ব্লগ বলেছেন: ভাইয়া সামুতেও পেলাম আপনাকে
©somewhere in net ltd.
১|
২১ শে জুন, ২০১৪ সন্ধ্যা ৬:৫৯
বেপরোয়া বেদুঈন বলেছেন: সত্যি বলতে এ জাতি একজন বড় অবিভাবক হারালো । এখন, তাঁর আদর্শ ও সৃষ্ট কর্মগুলোকে এগিয়ে নেওয়ায় হোক আমাদের প্রত্যয় ।