![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
এই ব্লগের সকল মৌলিক লেখার স্বত্ত্ব লেখকের।এখান থেকে কোনো লেখা লেখকের অনুমতি ছাড়া অন্য কোথাও প্রকাশ, ছাপা, অনুলিপি করা গ্রহনযোগ্যনয়। তা সৃজনশীল কাজের পরিপন্থী। লেখা অন্য কোথাওপ্রকাশ, ছাপা করতে চাইলে লেখকের সম্মতি নিতে হবে। লেখকের ইমেল - [email protected]
বিবেক বিক্রির অপরাধ ও মেধাবৃত্তিক প্রজন্ম
ফকির ইলিয়াস
__________________________________________________
পবিত্র রমজান মাস চলছে। রমজান সিয়াম সাধনার মাস। ত্যাগের মাস। অথচ বাংলাদেশে এক শ্রেণীর ব্যবসায়ী চালাচ্ছে তুঘলকি কান্ড। তারা কিছুই মানছে না। নিয়মনীতি তাদের কাছে খুবই তুচ্ছ বিষয়। তারা মনে করছে এটাই মুখ্য সময় অতিরিক্ত মুনাফা অর্জনের। এমন মানসিকতা, মানবতা বিবর্জিত। মানুষের এই মনটির পরিবর্তন কে করবে? সরকার পারবে? না পারবে না। কারণ তারা তো সরকারি নির্দেশ পর্যন্ত মানছে না।
বাংলাদেশে ‘ফরমালিন’ এখন এক অশুভ আতঙ্কের নাম। ইফতারি আইটেম, শাক-সবজি, ফলমূলÑ সবকিছুতেই এখন ফরমালিনের অস্তিত্ব। মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ এই দেশে ধর্মীয় মূল্যবোধের চাইতে আর্থিক ফায়দাই অনেকের কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। অথচ মুখে ধর্মীয় তমদ্দুনের কথা বলার লোকের অভাব নেই। কি বিচিত্র এক দেশ! এই যে চরম সামাজিক অবক্ষয়Ñ তা থেকে মুক্তির উপায় কি? ক’দিন আগে ঢাকার একজন খ্যাতিমান সমাজবিদের সঙ্গে ফোনে কথা হচ্ছিল। তিনি খুব দুঃখ করে বললেন, যে দেশের কোটি কোটি টাকার কাছে শীর্ষ রাজনীতিকরা নিজেদের বিকিয়ে দেন, সে দেশে ন্যায়নীতি তো সুদূরপরাহত। তিনি খুব ব্যথিত চিত্তে বললেন, আমরা এই বলয় থেকে বেরিয়ে আসার জন্য প্রায় দিনই তো কথা বলছি। দেশের জাতীয় দৈনিকগুলোতে প্রতিদিনই নানারকম প্রবন্ধ, নিবন্ধ, কলাম লেখা হচ্ছে। কিন্তু কেউ কারো কথা শুনছে বলে তো মনে হয় না।
আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, সামাজিক-রাজনৈতিক সংস্কৃতি পরিবর্তনে বুদ্ধিজীবীরা জোরালো ভূমিকা রাখতে পারছেন কি? অথবা রাখছেন না কেন? তিনি বললেন, কারণ বুদ্ধিজীবীরা তাদের কর্ম ও বিশ্বাসের সমন্বয় রাখতে পারছেন না। কেউ কেউ ধর্ম ও সংস্কৃতিকে গুলিয়ে ফেলেছেন। ফলে মৌলবাদী তস্কর শ্রেণী তাদের কাঁধে বন্দুক রেখে শিকার করার সাহস পেয়েছে।
তার কথাগুলো আমার বেশ যুক্তিযুক্ত বলেই মনে হলো। মনে পড়ে গেলো বছর কয়েক আগে ‘পেন’-এর একটি সেমিনারে মার্কিন কবি ডব্লিউ এস মারউইন প্রায় একই কথা বলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘ধর্মীয় বিশ্বাসই হচ্ছে মানুষের অত্যন্ত অনুভূতিশীল বিষয়। চালাক বুদ্ধিজীবীরা গোঁড়া সমাজগুলোতে মানুষের ব্রেনওয়াশ করতে সেই শক্তিটিকেই কাজে লাগায়। তারা সংস্কৃতির বিবর্তনকে বিক্রি করে দেয় মুনাফাখোর রাজনীতিকদের কাছে এবং তারা নিজেরাও এর ফল ভোগ করে।’
বাংলাদেশের ক্ষেত্রে কথাগুলো খুবই যৌক্তিকভাবে প্রযোজ্য। এ দেশে সামরিক শাসকরা বুদ্ধিজীবীদের বিবেক কিনে নিয়েছিল অর্থ কিংবা ক্ষমতা মূল্যের বিনিময়ে। দেশের বেশ কিছু রাজনীতিক-বুদ্ধিজীবী তাদের বিবেক বন্ধক রেখেছেন কালো টাকার কাছে। ফলে একপক্ষ মৌলবাদীরাও এ সুযোগ কাঁধে নিয়ে তাদের পক্ষকেও মজবুত করেছে অর্থমূল্যের বিনিময়ে। আর খুব স্বল্পসংখ্যক বুদ্ধিজীবী অত্যন্ত অসহায় জীবনযাপন করে তাদের কালাতিপাত করেছেন। এসব বিবেকবান বুদ্ধিজীবীর কথা সরকারপক্ষ কখনই শোনেনি।
বাংলাদেশে একটি সাংস্কৃতিক বিপ্লব প্রয়োজন। হ্যাঁ, এই বিপ্লব অবশ্যই হতে হবে রক্তপাতবিহীন। এই বিপ্লব হতে হবে মেধাবৃত্তিক। সুকুমার মনোবৃত্তির মানুষদের দাঁড়াতে হবে সব অপরাজনীতি, অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধে। আমরা জানি এবং দেখেছি, ইউরোপ-আমেরিকায় বুদ্ধিজীবীরা কখনই সরকারের মুখাপেক্ষী নন। তারা সরকারের লাউড স্পিকার হিসেবে কাজ করেন না। তারা কাজ করেন সরকারের সৃজনশীল প্রতিনিধি হিসেবে। সরকারও বিনাস্বার্থে এসব বুদ্ধিজীবীর পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশে এমনটি রাতারাতি হবে, তেমন প্রত্যাশা করা যায় না। তবে এর বীজ বুনতে হবে। স্বার্থ পরিহার করে রাষ্ট্রের কল্যাণে বুদ্ধিজীবীদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। কারণ রাজনীতির দুষ্ট গ্রহ রাজনীতিকদের আচ্ছন্ন করে রাখে, বুদ্ধিজীবীদের নয়। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সমুন্নত রেখে কিছু মানুষও যদি সমস্বরে তীব্র অন্যায়ের প্রতিবাদ করেন তবে শ্রেণীস্বার্থ রক্ষাকারীরা ক্রমে পালাবেই। আর প্রজন্ম তখনই প্রকৃত অর্জনের মুখ দেখবে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার চুয়াল্লিশ বছরে এ দেশে যেসব রাজনৈতিক আগাছা তৈরি করেছে তা চিহ্নিত করতে হবে সৃজনশীল মানুষদেরই। রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ ভূখ- ও পতাকা দিয়েছে। রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিপুষ্ট মাঠ তৈরি করতে না পারলে কোনো মানুষেরই মুক্তি নেই এ দেশে।
এই প্রজন্মকে মানতে হবে, রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন ছাড়া গণতান্ত্রিক স্থিতিশীলতা সম্ভব নয়। সহনশীলতা ছাড়া রাজনৈতিক সমঝোতা সম্ভব নয়Ñ এমন কথা আমরা বারবার শুনে আসছি। কিন্তু বাংলাদেশে রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন হয়নি। বরং দেখা যায়, যারা রাষ্ট্রক্ষমতায় যায় তারা মহাপরাক্রমশালী হয়ে ওঠে। নানা ধরনের অপকর্মের ম“ দেয়। আবার যখন রাষ্ট্রক্ষমতা তাদের হাত থেকে চলে যায় তখন তারা জনগণের অধিকারের প্রতিভূ হওয়ার চেষ্টা করে। তাদের অতীত ভোলানোর জন্য নানা ধরনের ছলনার আশ্রয় নেয়।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে যারা অপশক্তি; প্রধান দলগুলোর শীর্ষ নেতারাও তাদের চেনেন, জানেন। তারপরও তারা নিজ নিজ দলের আগাছা পরিষ্কারে তৎপর নন, বরং জিইয়ে রাখেন। এরা অভ্যন্তরীণ কোন্দলও করে। দেশে-বিদেশেও মুখোমুখি হয় পরস্পরের। সাদা-কালো পতাকা দেখায়। অথচ গোটা বাংলাদেশটিই আঁধারের কালো পতাকায় ঢেকে যাচ্ছে। রাহুগ্রাসের কালো চাদর ঢেকে দিচ্ছে বাংলার মাটি। সেদিকে শীর্ষ রাজনীতিকদের নজর খুবই কম। আর থাকলেও তারা দলীয় স্বার্থের বাইরে বেরোতে পারছেন না।
অন্যদিকে স্বাধীনতাবিরোধী একটি চক্র সবসময়ই বলে বেড়াচ্ছে, বিজয়ের মূল লক্ষ্যÑ অর্থনৈতিক মুক্তি সাধিত হয়নি। যদি এর পেছনে ফিরে তাকানো যায় তবে দেখা যাবে, অর্থনৈতিক মুক্তির প্রধান অন্তরায় হয়েছে বাংলাদেশে সামরিক জান্তাদের শাসন। যা ক্রমশ ঘাতক দালালদের রাজনীতিকে পুনর্বাসিত করেছে। দেশে মৌলবাদের প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছে। ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য ধর্মের দোহাইয়ের নামে জঙ্গিবাদী তৈরি করেছে। সন্ত্রাসীদের প্রত্যক্ষ মদত দিয়েছে। এই অপতৎপরতা বাঁচিয়ে রাখতে এখনো তারা কাজ করে যাচ্ছে নিরন্তর। তাদের স্বপ্ন বাংলাদেশেও ‘তালেবানি শাসন’ কায়েম হবে।
বাংলাদেশে একটি ভয়ঙ্কর আতঙ্কের নাম ‘মধ্যপন্থী’। মধ্যপন্থীরা, বাংলাদেশে বিভ্রান্তির ঘর দরজা তৈরি করতে চাইছে খুব কৌশলে। এজন্য তারা স্যুট-টাই পরা কিছু এজেন্টও নিয়োগ করেছে মোটা অঙ্কের মাসোয়ারা দিয়ে। যেসব তাত্ত্বিকরা সময়ে-সুযোগে জাতীয় সঙ্গীত, রাষ্ট্রীয় ভাষ্কর্য, মহান মুক্তিযুদ্ধ, বাঙালির জাতিসত্তার চেতনা, বাঙালি সংস্কৃতির শিকড় প্রভৃতির বিরুদ্ধে নানা অপপ্রচার চালিয়েছেÑ চালাচ্ছে। নগ্ন মিথ্যাচার করছে। তারা প্রজন্মকে উপদেশ বাণী শোনাচ্ছেÑ ‘নিরপেক্ষ’ ব্যক্তিদের কাছ থেকে সঠিক ইতিহাস জানার। এই ‘নিরপেক্ষ’ ব্যক্তিরা কারা? একাত্তরে কোনো দেশপ্রেমিক বাঙালিই নিরপেক্ষ ছিলেন না। ছিলেন জন্মমাটির পক্ষে। আর বিপক্ষে ছিল আল-বদর, রাজাকার ও আল-শামসরা। এই নিরপেক্ষতার ধুয়া যারা তুলতে চায় এরাও রাজাকারের উত্তরসূরি, বিষয়টি প্রজন্মকে মনে রাখতে হবে।
রাষ্ট্র পরিচালনায় ভুলের কর্তৃত্ব সবসময়ই গণমানুষের জন্য অশান্তি বয়ে আনে। আর তা যদি হয় ভোগবাদীদের দ্বারা তৈরি, তবে তো কথাই নেই। একটি রাষ্ট্রে, স্বার্থপর ভোগবাদীদের সম্মিলিত একটি চক্র সব সময়ই তৎপর থাকে। তারা মানুষের স্বার্থ শুধু হরণই করে না, উচ্চ পর্যায়ে নিজেদের একটি সিঁড়িও তৈরি করে রাখে। সেই সিঁড়ি ব্যবহার করে তারা শাসকদের কারো কারো আনুকূল্য পায়। ফলে দুর্নীতি চরম আকার ধারণ করে এবং তা একটি রাষ্ট্রকে ক্রমশ দেউলিয়া করে তোলে। বাংলাদেশে এখন ব্যবসায়ী সমাজের একটি অংশ, বিবেক বিক্রির নেতৃত্ব দিচ্ছে। এরা ক্ষমতাবানদের আনুকূল্য পাচ্ছে। এদের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হবে মেধাবী প্রজন্মকে। কারণ মনে রাখতে হবে- এ দেশটিকে পরিশুদ্ধ বসবাসযোগ্য করে গড়ে তোলার দায়িত্ব কাউকে তো নিতেই হবে।
------------------------------------------------
দৈনিক ভোরের কাগজ ॥ ঢাকা ॥ : ১২/ জুলাই /২০১৪ শনিবার
©somewhere in net ltd.