নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আমার এই পথ চাওয়াতেই আনন্দ

ফাহমিদা বারী

আমার ব্লগ মানে গল্প। গল্প পড়ার আমন্ত্রণ জানাই :)

ফাহমিদা বারী › বিস্তারিত পোস্টঃ

রৌদ্দুর খুঁজে ফিরি (১ম পর্ব)

১৯ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৭ সকাল ১১:৩৩


এক
সাবেরের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে কনক একা একা কিছুক্ষণ বিভ্রান্তের মতো ঘুরে বেড়ালো।
এলোমেলো লক্ষ্যহীন পদক্ষেপ, যেন শরীরের কোনো নিয়ন্ত্রণই নেই পায়ের ওপর।
ভর দুপুর। রাস্তায় মানুষের আনাগোনাও কমে এসেছে। মাঝে মাঝে বাস, রিকশার ভেঁপু আর ক্রিং ক্রিং আওয়াজ। বাসের হেল্পারের ঝুঁকে দাঁড়িয়ে যাত্রির উদ্দেশ্যে হাঁকডাক। পায়ে চলা পথচারী তেমন নেই বললেই চলে।
মাথার ওপরে গনগন করছে গ্রীষ্মের খরখরে সূর্য। বেশিক্ষণ রাস্তায় রাস্তায় হেঁটে বেড়ানোও সম্ভব নয়। পিপাসা পেয়ে যায়। দরদর করে ঝরতে থাকে ঘাম। পরনের শার্ট ঘেমে নেয়ে একাকার। ক্লান্ত শরীর আর এগুতে চায় না। বিশ্রাম খোঁজে।
কনকের পরনে ফেড নীল জিন্স, সাদা ফুলহাতা শার্ট। শার্টের হাতা কনুই পর্যন্ত গুটিয়ে রাখা। পরনে বাটার সাড়ে নয়শো টাকা দামের লেদারের স্যাণ্ডেল। মাথার চুল এলোমেলো, কিন্তু রূক্ষ্ণ নয় মোটেই। চেহারাতে একটা অপ্রয়োজনীয় আভিজাত্য আর বংশধারায় পাওয়া বিনে পয়সার সৌন্দর্য, যা না থাকলেই ওর জীবনের সাথে বেশি মানানসই হতো। এই যে পথচলতি দু’চারজন মানুষ চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ওকে দেখছে, আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করে ওর সম্পর্কে অজানা কৌতুহল পোষণ করছে...এটার আদৌ ওর কোনো প্রয়োজন ছিল না। বরং রূক্ষ্ণ, অনাকর্ষণীয় কোন চেহারার একজন সাদামাটা যুবক হলেই আজ সে ঠিকমত জনারণ্যে মিশে যেতে পারতো। নিজের অস্তিত্ব নিয়ে অহেতুক মাথা ঘামাতে হতো না।
কিছুক্ষণের হাঁটাহাঁটিতেই কনক ক্ষুধা বোধ করতে লাগলো। বেলা এগারোটার দিকে সাবের ওকে শাহবাগের মোড়ের দোকান থেকে তিনটি কলিজির সিঙ্গারা খাইয়েছে। এতক্ষণের হাঁটাহাঁটিতে সেগুলো হজম হয়ে শরীরের পুষ্টি প্রক্রিয়ায় অংশ নিয়ে ফেলেছে। সিঙ্গারা খেয়ে দু’বন্ধু গিয়ে বসেছিল রমনার সিমেন্টের বেঞ্চিতে।
গ্রীষ্মের এই সময়টাতে পার্কের বেঞ্চিগুলো বেশ ফাঁকা ফাঁকা থাকে! বিশেষ করে যে বেঞ্চিগুলোর ওপরে গাছের ছায়া নেই, সেগুলোতে কাউকে বসতে দেখা যায় না। স্বাস্থ্য পিপাসুদের আনাগোনাও অনেক আগেই শেষ হয়ে যায়। শীতকালে যেমন সারা দিন ব্যাপিই পার্কে তাদের বিচরণ থাকে, গ্রীষ্ককালে সেটা বেলা চড়ার আগেই শেষ। বেশ দূরত্বে ইতিউতি দু’একজন কপোত কপোতিকে শুকনো মুখে বসে থাকতে দেখা যায়। মিইয়ে যাওয়া মুড়ির মতো তারাও চিমড়ানো মুখে গল্প করতে থাকে। নিজেদের মধ্যে খুনসুঁটি বাদ দিয়ে আকাশের পানে তাকিয়ে থাকে। হয়তো ভবিষ্যতের দূর্ভাবনা পেয়ে বসে তাদেরকেও। চা আর বাদাম ওয়ালাদের হাঁকডাক থাকে না। বেচাকেনা বাদ রেখে তারা গাছের ছায়ায় বসে রোজগারপাতি গুনতে থাকে।
আশেপাশের এইসব নানা রঙের মানুষ আর তাদের নানা রঙে আঁকা জীবনছবি দেখার একটা আলাদা আকর্ষণ আছে। কনক মাঝে মাঝে একা এসে পার্কে বসে থাকে। কাজ কর্ম নাই, কিছু নাই। শুয়ে বসে থাকাই জীবন। তাই পার্কে এসেই সময়টা কাটিয়ে যায়। পেটে সুঁচো দৌঁড়ালে দু’টাকার বাদাম কিনে খায়। বাদাম খেয়ে দু’ঢোক পানি। ব্যস, খিদের বাপের সাধ্যি নেই আর বিরক্ত করার।
দু’দশ টাকা ইদানীং পকেট হাতড়ালে খুঁজে পাওয়া যায়। শৈলীটা মনে হয় একফাঁকে গুঁজে দেয়। পরনের এই কেতাদুরস্ত পোশাক আশাকও ঐ কিনে আনে, লুকিয়ে লুকিয়ে। কনক না করেছে বহুবার। বলেছে, তার এতো বাবুয়ানির দরকার নেই। ফুটপাত থেকে জামা প্যাণ্ট আর স্যাণ্ডেল কিনেই দিব্যি চালিয়ে দিতে পারবে। বেকারের আবার কীসের এতো ফুটানি! শৈলী কানে তোলেনি। শুধু শুধু ঝামেলা বাড়ানো আর কী! খচ্চরটা জানতে পারলে তো আবার সেই বাপ মা তুলে গালি দেবে!
শুনতে শুনতে এখন অবশ্য বেশ সয়ে গেছে। তাছাড়া একেক সময় মনে হয়, যে বাপ-মা ওর আর শৈলীর কপালে জুটেছে গালি দিলেই হয়তো তাদের দু’চারটা পাপ খণ্ডন হবে। হাজার হোক, নিজের বাপ-মা! ওরা তো আর নিজেরা সেটা করতে পারে না। তাই অন্যরা যদি সেই গালিগালাজের ভার নেয়, তাহলে তাদের প্রতিই বরং কৃতজ্ঞ থাকাই উচিত।
সাবের আজ অনেকক্ষণ কানের কাছে ঘ্যান ঘ্যান করেছে। ঘ্যানঘ্যানানি শুনতে শুনতে মাথা ধরে গেছে কনকের। একে তো অশান্তির জীবন, বন্ধুর কাছে আসা দুদণ্ড শান্তি পাওয়ার জন্য। সেই বন্ধুই যদি এমন প্যারা দেয় তাহলে কেমন লাগে? ঐ এক জাবর কাটা চলতে থাকে,
‘কনক, এভাবে তো আর চলে না রে দোস্ত! কিছু একটা তো করা দরকার।’
‘কী করবি? বুদ্ধি আছে কিছু? থাকলে বল। পকেটে যে বিদ্যা আছে তা দিয়ে এই শহরে ইজ্জতের চাকরি জুটবে না। বাপের হোটেল নাই যে বসে বসে খাবি। পাত্তি নাই, যে ব্যবসা করবি। করবি টা কী?’
‘তা জানিনা দোস্ত! কিন্তু একটা কিছু করতে হবে। এভাবে বসে থাকতে থাকতে ইজ্জতের ফালুদা হয়ে গেল! ঘরে ঢুকতে পারি না। বাপে পারলে ঘাড় ধইরা খেঁদাইয়া দেয়। পাড়ার লোকে আইতে যাইতে এমন একটা লুক দেয় যেন আমি গুন্ডা বদমাস। শালা, আইজতক একটা মাইয়ারেও পটাইতে পারলাম না যে, ঘাড় ভাইঙ্গা খামু।’
সাবেরের মুখ খুব খারাপ। টেনশনে মুখ দিয়ে সমানে খিস্তি ছুটতে থাকে। কনক আর যাই করুক, খিস্তিটা করে না। কিছু একটা অদৃশ্য টানে এখনো সাধ মিটিয়ে খারাপ হতে পারে না কনক। টানের উৎসটাও সে জানে... শৈলী।
ঐ একটা জায়গাতেই সে এখনো আটকা পরে আছে। নইলে কবে সবকিছু ছেড়ে ছুড়ে যেদিকে দুচোখ যায় চলে যেত! অসভ্য অভদ্র দুনিয়াদারীর মুখে থাপ্পড় মেরে এতদিনে ঠিকই প্রমাণ করে দিত যে, সেও বাপের ব্যাটা।
কিন্তু শৈলী যেন কালো বিড়ালের মতোই বারে বারে তার পথ আটকাতে আসে। দুলাভাই নামের কসাইটার দিকে চোখের একটা কড়া চাউনি দিলেও শৈলী করুণ চোখে তাকায়। নিঃশব্দে মিনতি করে। কিচ্ছু করতে পারে না কনক, কিচ্ছু না।
কিন্তু বেশ অনেকদিন যাবত শয়তানটা যা শুরু করেছে, কিছু একটা করা আসলেই দরকার। রাস্তার এক মেয়েছেলের কাছে ইদানীং যাওয়া আসা শুরু করেছে। শুনতে পাচ্ছে, তাকে নাকি বিয়েও করার মতলব এঁটেছে। এতদিন বজ্জাতটার সব অকথা কুকথা সে এক কান দিয়ে শুনে আরেক কান দিয়ে বের করে দিয়েছে।
ইচ্ছেয় হোক বা অনিচ্ছায় এতদিন কনকের বোঝাও তো সে’ই বহন করেই চলেছে। কনককে যা বলে বলুক ক্ষতি নেই, কিন্তু তার বোনের জীবন নিয়ে কিছুতেই তাকে ছিনিমিনি খেলতে দেবে না কনক।
সাবেরের সাথে বসে সেটারই ফন্দি ফিকির করতে চেয়েছিল কনক। কিন্তু সে তো আজ নিজের নেশাতেই চুর হয়ে বসে আছে!
সাবেরের কথা শুনতে শুনতে বিরক্ত হয়েই একসময় কনক বলে উঠলো,
‘এই, তুই বাড়ি যা। আমি একটু একা থাকবো। বাড়ি গিয়ে চিন্তা ভাবনা কর গা কী করবি। তারপরে আমারে জানাইস।’
সাবেরকে বিদায় করে দিয়ে কনক শিশুপার্কের দিকটাতে গেল। ভরদুপুর। এখন কারো শিশুপার্কে আসার কোনো প্রশ্নই আসে না। কনক পাঁচটাকা খরচ করে টিকিট কেটে একা একা শিশুপার্কে ঘুরতে লাগলো। এই কাজটা সে মাঝে মাঝেই করে। তবে গোপনে। ওর সবচেয়ে কাছের বন্ধু সাবেরও কোনদিন জানতে পারেনি ওর এই অদ্ভুত শখের কথা।
কখনো কখনো বিকেলেও আসে। যখন শিশুপার্ক ভরা থাকে বিচিত্র রঙের মানুষে। ছোট ছোট বাচ্চাগুলো আসে বাবা-মা’র হাত ধরে। হাওয়াই মিঠাই দেখে বায়না করে কিনে দেবার জন্য। বাচ্চাকে রাইডে চড়িয়ে বাবা-মা ছবি তোলে আর বলে, ‘একটু হাসো তো মনি!’ কখনো কখনো বাচ্চার সাথে নিজেরাও চড়ে বসে কোনো রাইডে। নিজেদের ছেলেমানুষি আহলাদে নিজেরাই হেসে কুটিকুটি হয়। কনক ঘুরে ঘুরে দেখে।
ওর দেখতেই ভালো লাগে। মানুষগুলোকে দেখে মনে হয় যেন কারো জীবনেই কোনো দুঃখ ব্যথার অস্তিত্ত নেই। জীবনটা শুধু আনন্দের এক মিলনমেলা। এদের অনেকের বাড়িতেই হয়তো চব্বিশ ঘণ্টা স্বামী-স্ত্রী তে খ্যাঁচ খ্যাঁচ লেগে থাকে। কারো হয়তো উঠতি বয়সী ছেলেটা ড্রাগে আসক্ত। কারো কম বয়সী মেয়েকে নিয়ে নিত্য অশান্তি লেগে আছে। কেউ হয়তো পরকীয়ায় আক্রান্ত। হাজার সমস্যায় জর্জরিত জীবন। অথচ বাইরে সবাই কত ফিটফাট, নিখুঁত! মানুষকে ওপরের পেলব অংশটা দেখাতে হয়। ভেতরের দ্গদগে পোড়া ক্ষত অন্যকে দেখাতে নেই।
শিশুপার্কে এলে মনে পড়ে যায়, প্রায় কুড়ি বছর আগের সেই জীবনটার কথা। কখনো কখনো কেমন যেন ঘোর লাগে মনে। মনে হয় যেন এই জীবনের অংশই নয় সেই জীবনটা। সেটা বুঝি ছিল অন্য কোনো জীবন, এই পৃথিবীর বাইরের অন্য কোনো ভুবন।
ছয় বছরের কনক আর তের বছরের শৈলীকে নিয়ে বেড়াতে আসা ওদের সুখী সুখী চেহারার বাবা-মা, যাদের জীবনে তখনো কোনো অবাঞ্ছিতের অনুপ্রবেশ ঘটেনি। কনক আর শৈলীকে নিয়ে নিটোল, হাসিখুশি একটি পরিবার। যে পরিবারে শীতল মেঘের ছায়া ঘনাতো, রৌদ্রোজ্জল দিনে আলো আঁধারেরা খেলা করতো।
আস্তে আস্তে সব কেমন বদলে গেল! সেই দাগহীন পরিবারটিতে একদিন নিখুঁতভাবে ঘুনপোকারা বাসা বানিয়ে ফেললো। এমন নিঃশব্দে পাকা হাতে তারা তাদের কাজ করে ফেললো যে, ওদের এতোদিনের শক্তপোক্ত ঘরটা যেন একটা ঝড়ের আঘাতেই উপড়ে পড়া গাছের মতো ঝুর ঝুর করে পড়ে গেল। আর সব কিছু ঘটে গেল কত দ্রুত! ছিটকে গেল ওরা সবাই। তবু ভাসতে ভাসতেই শৈলী ওর দুর্বল হাতটা বাড়িয়ে দিলো ভাইয়ের দিকে।
ভাইকে সে ভেসে যেতে দিলো না। টেনে আনলো নিজের কাছে।
কিন্তু এতো চেষ্টা করেও বাঁচাতে পারলো কী নিজের ভাইকে!
অথবা নিজেই কী বাঁচতে পারলো! (চলবে)

মন্তব্য ৮ টি রেটিং +৪/-০

মন্তব্য (৮) মন্তব্য লিখুন

১| ১৯ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৭ দুপুর ২:৩৪

শাহরিয়ার কবীর বলেছেন:
গল্প ভাল লাগল....

তবে বাকী পব না, পড়ে বোঝা মুশকিল !

(গল্প চলুক গল্পের মত) :)

১৯ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৭ দুপুর ২:৪৬

ফাহমিদা বারী বলেছেন: সাথে থাকবেন আশাকরি। :)

২| ২০ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৭ রাত ১:২২

জাহিদ অনিক বলেছেন: আচ্ছা বেশ।

কনক আর শৈলী ভাই-বোন। গোড়ায় তো ভেবেছিলাম প্রেমিক-প্রেমিকা। মধ্যবিত্ত প্রেমে যেমন হয়। এখানে ঠিক তা নয়ে ভাই-বোন হয়ে গল্পটা আগচ্ছে। আগাক। পরের পর্বে দেখা যাবে ওল্ড ওয়াইন ইন অ্যা নিউ বটল নাকি সত্যি সত্যি নতুন ওয়াইন।

২০ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৭ দুপুর ১২:৫১

ফাহমিদা বারী বলেছেন: হাহ হা.।দেখা যাক। পোস্ট করছি পরের পর্ব।

৩| ২১ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৭ রাত ১২:২৬

ভ্রমরের ডানা বলেছেন:


এই পর্বের বর্ননা অসাধারণ... শুরুটা মন মাতানো... মনে হল গ্রীষ্মে কে যেন পার্ক এ ছেড়ে দিয়েছে.... এত ভাল লিখেন কি করে.....

২১ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৭ রাত ৩:১৯

ফাহমিদা বারী বলেছেন: বাপ রে! অনেক প্রশংসা করলেন! কৃতজ্ঞতা!

৪| ২১ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৭ রাত ১২:৩৯

আবু তালেব শেখ বলেছেন: Click This Link পড়ে দেখতে পারেন

২১ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৭ রাত ৩:২২

ফাহমিদা বারী বলেছেন: জি, পড়ে আসলাম। :)

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.