নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আমার এই পথ চাওয়াতেই আনন্দ

ফাহমিদা বারী

আমার ব্লগ মানে গল্প। গল্প পড়ার আমন্ত্রণ জানাই :)

ফাহমিদা বারী › বিস্তারিত পোস্টঃ

আত্মজৈবনিক স্মৃতিকথন- ল্যাভেণ্ডারের সুবাস

১৪ ই সেপ্টেম্বর, ২০২১ রাত ১০:৪২


#পর্ব_৫
আনিসের ইউকে যাওয়ার দিন ঘনিয়ে আসতে লাগল।
২০১৬ এর জানুয়ারি থেকে ইউনিভার্সিটি অফ লীডসের সাথে তার রিসার্চ ফেলো হিসেবে কাজ শুরু করার কথা। আর আমার ক্লাস শুরু হবে ২০১৬ এর সেপ্টেম্বরে। মাঝখানের এই এতগুলো মাস আমি আমার ছেলে তাহসিনকে নিয়ে একা একা ঢাকার বাসায় থাকব। তারচেয়েও বড় কথা হচ্ছে এই...যদি কোনো কারণে আমার স্কলারশীপ মিস হয়ে যায়, তাহলে ইউকে যাওয়ার অনুমতি পাওয়াও আমার পক্ষে কঠিন হয়ে পড়বে। কারণ বিদেশে পড়তে যাওয়ার জন্য শিক্ষা ছুটির আবেদন করতে হলেও একটা ফান্ডিং এর উৎস দেখানো জরুরি। আর ফাণ্ডিং তো বললেই পাওয়া সম্ভব নয়। অর্থাৎ সেক্ষেত্রে পুরো বিষয়টাই কঠিন হয়ে যাবে।

আমার সামনে অকূল সমুদ্র, যার চারপাশে শুধুই ধূ ধূ বিস্তীর্ণতা।
আনিসের ফেলোশীপ হয়ে গেছে, সে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত। যদিও আমাদের বিষয়টা নিয়ে সে একই সাথে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। আমরা সময়মত না যেতে পারলে বুয়েটে বাসা রাখতে পারব না। পিডব্লিউডি আমাকে বাসা দিলেও কাছাকাছিই যে বাসা পাবো তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। তাহলে ছেলের স্কুলের কী হবে? ছেলে তো পড়ে বুয়েট স্কুলে! এদিকে গোঁদের ওপরে বিষফোঁড়ার মতো ২০১৬ সালে আবার তাহসিনের পিএসসি (প্রাইমারী স্কুল সার্টিফিকেট) পরীক্ষা; যে পরীক্ষায় অংশ না নিলে পরবর্তীতে দেশে ফিরে স্কুলে এডমিশন পাওয়াও কঠিন হতে পারে।
পরিস্থিতি মোটেও আমার নিয়ন্ত্রণে নেই। সবকিছুর যিনি নির্ধারক, তিনি বুঝি অলক্ষ্যে বসে মুচকি হাসলেন। যে ভাবনাতে আমি আমার সময়টাকে ব্যস্ত রাখছি প্রতিনিয়ত, তার বিপরীতে অন্য কিছু সত্যও যে কঠোর নিয়তি হয়ে সামনে এসে দাঁড়াতে যাচ্ছে, তা কি বুঝতে পেরেছিলাম তখন? জীবনের অনির্বার্য পরিণতির কাছে মানুষ যে কতখানি অসহায়, সেই সত্যটাকে মাত্র অল্প কয়েকমাস পরেই আবার নতুন করে অনুধাবন করলাম।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের চিঠি পেয়ে গিয়েছি। তারা আমাকে ভাইভার জন্য ডেকেছে। আমাদের পিডব্লিউডি’র আরেকজন ছেলেও আমার সাথেই এই স্কলারশীপের জন্য আবেদন করেছে, ২৭ বিসিএস এর কুতুব। ২০১৬ সালের জনপ্রশাসনের স্কলারশীপের জন্য আমাদের ডিপার্টমেন্ট থেকে আমরা এই দু’জনই আবেদন করেছি।
কুতুব আবেদন করেছে অস্ট্রেলিয়ার ‘ম্যাককুরি’ (Macquarie) ইউনিভার্সিটির জন্য। ওর পোস্টিং ঢাকার বাইরে এবং কুতুবও বুয়েট থেকেই পাশ করেছে। হাসিখুশি প্রাণোচ্ছল স্বভাবের ছেলে। আমার সাথে যোগাযোগ করে নিজের পরিচয় দিয়ে বললো, ‘স্যার, স্কলারশীপ পাওয়ার তো মনে হয় সম্ভাবনা নাই! সব এডমিনদের জন্য শিকেয় তুলে রেখে দিয়েছে! আমাদের দয়া করে দু’চারটা ভিক্ষা যদি দেয় এই আশাতেই যাবো স্যার! ভিক্ষা পাওয়ার আশায় ঝুলি নিয়ে যাব।’ বলেই আবার সেই সঙ্গে যোগ করলো, ‘স্যার, আপনার হয়ে যাবে। চিন্তা কইরেন না!’

আমি মজা করে বললাম, ‘কেন আমার হয়ে যাবে? আমি মহিলা বলে?’
‘হে হে...জি না স্যার। আপনি সিনিয়র আছেন। তার ওপরে আপনার একটা ভালো গ্রাউণ্ড হচ্ছে যে, আপনার হাজবেণ্ডও একই সাথে যাবে। সেখানে আপনার থাকা খাওয়ার জন্য যে আলাদা টাকা লাগবে না, এটা আপনি ব্যাখ্যা করতে পারবেন।’
কুতুব নিজের মতো করে আমাকে নিশ্চিন্ত করে দিতে চাইল। আমি মোটেও নিশ্চিন্ত হলাম না। উল্টা আমার মনে হলো, কুতুবের হবে...আমার হবে না। কেন এ’কথা মনে হয়েছিল সেটা আর এতদিন পরে মনে নেই।

ভাইভার দিনে শাড়ি পরে অফিসে এলাম। আমরা অফিসে ঝটপট থ্রিপিস পরেই হুটহাট চলে আসি। কিন্তু সুন্দর মার্জিতভাবে শাড়ি পরে এলে অফিসিয়াল ভাবগাম্ভীর্যটা হয়ত আরো ভালোভাবে প্রকাশ পায়। সুন্দর নয়, বরং স্মার্ট আর চটপটে একটা এপ্রোচ ফুটিয়ে তোলাই আমার উদ্দেশ্য ছিল। যা কিছুই হোক, আমার এপ্রোচটা যাতে পজিটিভ থাকে। ভাইভা বোর্ডের অপরপক্ষে বসে থাকা সদস্যরা যাতে বুঝতে পারেন যে আমি বিষয়টাকে হাল্কাভাবে দেখছি না; বরং যথেষ্ট সিরিয়াস।
কুতুব ভাইভায় যাওয়ার আগে আমার অফিসে চলে এলো। ও যেহেতু ঢাকার বাইরে থেকে এসেছে, সাথে গাড়ি নেই। আমিও যেহেতু যাবো, একসাথেই যাওয়া যাবে এই ভেবে আমিই ওকে আমার অফিসে আসতে বলেছি। যাওয়ার পথে আলাপ আলোচনা করতে করতে গেলাম। আমি ‘এনভায়ার্নমেন্টাল ইঞ্জিনিয়ারিং এণ্ড প্রজেক্ট ম্যানেজমেন্ট’ এ অফার লেটার পেয়েছি। সেই বিষয়ের গুরুত্ব জাতীয় কিছু একটা নোট করে নিয়েছিলাম। গাড়িতে বসে বসে চোখ বুলাচ্ছিলাম। কুতুবের সাথে একটা ফাইল ছাড়া আর কিছু নাই। সে হাসি হাসি মুখ করে আমার হাতে ধরা কাগজটার দিকে তাকাচ্ছে।

একসময় বলেই ফেললো, ‘স্যার, পড়তে হবে না। কিচ্ছু জিগেস করবে না।’
আমি বললাম, ‘কিছু জিগেস না করলে কি ওদের সময় কাটবে? আমার বাসা কই? ছেলেমেয়ে ক’জন? হাজবেণ্ড কী করে...কিছু না কিছু তো জিজ্ঞেস করবেই!’
কুতুব মজা পেয়ে হে হে করে কিছুক্ষণ হাসলো। তারপরে বলল, ‘এসবই জিজ্ঞেস করবে স্যার। আর তাছাড়া ওদের তো হিসাবনিকাশ করাই আছে। এই ধরেন...পুলিশ থেকে হয়ত ২জন, ফরেন সার্ভিস থেকে ৩ জন, মৎস্য লাইভস্টক মিলায়ে আরো ২ জন...’

আমি কান পেতে আছি পিডব্লিউডি থেকে কয়জন বলে সেটা শোনার জন্য। সেটা সরাসরি না বললেও কুতুবের ধারণা পিডব্লিউডি থেকে নিলে আমাকেই নিবে। আর আমি ভাবছি বিপরীতটা। নিলে হয়ত পুরুষ ক্যাণ্ডিডেটকেই নিবে। কারণ মহিলা মানেই হচ্ছে ঝামেলা। এরা পড়তে যাওয়ার নাম করে ঘুরাঘুরি করে আসবে। গাট্টি গাট্টি শপিং করবে। নামকরা কোম্পানির কসমেটিক্স কিনে ব্যাগ ভারি করবে। এভাবে সরকারের টাকার হ্যস্তন্যস্ত করে নামছাম কিছু পড়ে যাতামাতা একটা সার্টফিকেট নিয়ে আসবে। অতএব এদের পাঠায়ে কাজ নাই!

ভাইভা দিতে গিয়ে দেখি মহাপ্রস্তুতি! আমাদের একবার এখানে বসায়...একবার ওখানে। অবস্থা দেখে মনে হতে লাগল, কয়েক স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা অতিক্রম করছি। দেড়শো জনের মধ্যে আমাদের সিরিয়াল ছিল প্রায় শেষের দিকে। এডমিন ক্যাডারদের আগেই ভাইভা নেওয়া হয়ে গেছে। আমরা একটা রুমে বেশ কয়েকজন পুলিশ, ফরেন সার্ভিস আর অন্য দু’একটা ক্যাডারের ক্যাণ্ডিডেট বসে ছিলাম। ফরেন সার্ভিস ক্যাডারের পাঁচ ছয়জন ক্যাণ্ডিডেট ছিল। তাদের মধ্যে তিনজন ছিল মেয়ে। একটা মেয়েকে দেখে চোখ সরছিল না আমার। ঝকঝকে স্মার্ট সুন্দরী, শাড়ি পরিহিতা। কথাবার্তাতে দারুণ চটপটে। মেয়েটা অত্যন্ত আকর্ষণীয়। অন্য মেয়েগুলোও যথেষ্ট স্মার্ট।
আমি ফরেন সার্ভিসের মেয়েগুলোর সাথে গল্প জুড়লাম। এই ক্যাডারটি আমার কাছে বিশেষ আগ্রহের একটা ক্ষেত্র। এডমিন ক্যাডারের শুনলে অনেকেই বেশ আহ্লাদিত হয়। আর আমার ক্ষেত্রে এই ‘ফরেন সার্ভিস’ ক্যাডারটিতে সেই আহলাদের ব্যাপারটা কাজ করে। এই ক্যাডারে মেয়েরা কীভাবে চাকরি চালিয়ে যেতে পারে তা আমার কাছে একটা বিশেষ বিস্ময়ের কারণ। এদের পোস্টিং এর কোনো দেশ-বিদেশ নেই। যেকোনো দেশে তাদের যখন তখন পোস্টিং হতে পারে। ঘর সংসার সামলিয়ে, স্বামীকে ম্যানেজ করে মেয়েদের পক্ষে এই চাকরি করা সম্ভব হয় কীভাবে কে জানে! দেশের বাইরে পোস্টিং হলে এদের বেতনও সেই দেশের মুদ্রার সম-অনুপাতে পরিবর্তিত হয়ে যায়। কাজেই অর্থকষ্টে পড়ার প্রশ্নই আসে না। আজ নিউইয়র্ক, কাল লণ্ডন...একেবারে ভিন্ন লেভেলের চাকরি!

আমি ওদের জিজ্ঞেস করলাম, ‘তোমাদের সমস্যা হয় না? সংসার করে কীভাবে চাকরি করো? মানে হাজবেণ্ড আর তোমার কি একই দেশে থাকার সুযোগ থাকে?’
তারা আগ্রহ নিয়েই আমার সব কৌতুহল মেটালো। বললো, ‘সমস্যা তো কিছু হয়ই! তবে ম্যানেজও তো হয়েই যাচ্ছে!’
ওদের চাকরির ধরণ নিয়ে আরো অনেক গল্প হলো। ম্যানেজ তো হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু সেই ম্যানেজ করতে গিয়ে কতরকম ত্যাগও যে একইসাথে স্বীকার করতে হচ্ছে... সেই গল্পও তারা বেশ মজা করে শোনালো। ওদের গল্প শুনতে শুনতে ধুকপুকুনির সময়টা বেশ ফুরফুরিয়েই কেটে গেল। দেখতে দেখতে একসময় আমার ভাইভার সিরিয়ালও চলে এলো।
আমি ওদের সাথে গল্পে এতটাই মগ্ন হয়ে ছিলাম যে, ভাইভার কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। কুতুব হাসিমুখে বললো, ‘অল দ্য বেস্ট স্যার!’ (ক্রমশঃ)

মন্তব্য ৬ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (৬) মন্তব্য লিখুন

১| ১৫ ই সেপ্টেম্বর, ২০২১ রাত ১২:৫০

সূর্যপাজী বলেছেন: আগে জানতাম অভাগা ক্যাডার হল শিক্ষা আর স্বাস্থ্য। ইঞ্জিনিয়ারদের অবস্থাও এত খারাপ! জানতাম না।
এইজন্য তো কেউ নিজ ক্যাডারে থাকতে চায়না। অন্য সাবজেক্ট এর পোলাপাইন এর রাস্তা পরিস্কার রাখার জন্য সাবেক এক সচিব কে পত্রিকায় হাহাকার করে কলাম লিখতে দেখেছিলাম। আহারে ক্যাডার সার্ভিস! সোনার হরিণ!

লেখা ভাল হয়েছে। শুভেচ্ছা আপনাকে।

১৫ ই সেপ্টেম্বর, ২০২১ সকাল ৮:১৪

ফাহমিদা বারী বলেছেন: ধন্যবাদ জানবেন।
আসলে কবি তো বলেই গেছেন, 'নদীর এপার কহে ছাড়িয়া নিঃশ্বাস'। আমাদের এমনিতে অবস্থা খারাপ ছিল না, কিন্তু যখনই নিজেদের জায়গা থেকে সরে এসে কিছু কাজ করার প্রয়োজন হয়, তখনই আসল দুরবস্থাটা টের পাই। ক্যাডার সার্ভিস আসলেই সোনার হরিণ।

২| ১৫ ই সেপ্টেম্বর, ২০২১ সকাল ৯:৫১

চাঁদগাজী বলেছেন:



এই কাহিনীর কি শেষ আছে?

১৫ ই সেপ্টেম্বর, ২০২১ সকাল ১১:১৯

ফাহমিদা বারী বলেছেন: :) সবকিছুরই শেষ আছে। আর এটা তো দুই বছরের কিছু অভিজ্ঞতা মাত্র।

তবে আমি লেখাটা শেষ করতে পারিনি এখনো। যতটুকু লিখেছি দিয়ে যাচ্ছি।

৩| ১৫ ই সেপ্টেম্বর, ২০২১ সকাল ১০:৪৪

কালো যাদুকর বলেছেন: ফরেন সার্রভিসে যারা কাজ করেন, তারা নঃমস্ব। কিভাবে পারেন এত ভাল রেজাল্ট করতে বি সি এষ এ?

ভাইভাতে গেলে আমার সব সময়ই টাল গোল পাকিয়ে যায়। ভাইভার প্রশ্ন গুলো এখানে বলে দিয়েন।
এই ফুল গুলোর নাম কি?

১৫ ই সেপ্টেম্বর, ২০২১ সকাল ১১:২৩

ফাহমিদা বারী বলেছেন: জি ফরেন সার্ভিসের জবটাকে আসলেই আমিও ভিন্নচোখে দেখি।
ভাইভার প্রশ্নগুলো সব ভালোভাবে মনে নেই। তবে ইঞ্জিনিয়ারিং বা প্রজেক্ট ম্যানেজমেন্ট রিলেটেড কিছু জিজ্ঞেস করেনি। আমার এপ্রোচ আর ইচ্ছাটাকেই বুঝতে চেষ্টা করেছিলেন। হাজবেণ্ড ওখানে আছে এটা জানতে পেরে তারাও আশ্বস্ত হয়েছিলেন হয়ত।

বিসিএসের ভাইভাতে কিছু ইঞ্জিনিয়ারিং প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছিলাম। সিমেন্ট বালুর রেশিও আর সেটাকে পেঁচীয়ে কী কী যেন সব জিজ্ঞেস করেছিল। এখন সত্যিই আর বিস্তারিত মনে নেই। মনের পর্দায় চর জমেছে।

এই ফুলগুলোই হচ্ছে ল্যাভেণ্ডার। আমার ইউকে ভ্রমণটাকে এর সুবাসের সাথে তুলনা করেছি।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.