নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আমার এই পথ চাওয়াতেই আনন্দ

ফাহমিদা বারী

আমার ব্লগ মানে গল্প। গল্প পড়ার আমন্ত্রণ জানাই :)

ফাহমিদা বারী › বিস্তারিত পোস্টঃ

গল্প- বানরের থাবা (মূল গল্প- দ্য মাংকিজ প)

০৪ ঠা অক্টোবর, ২০২৫ দুপুর ১২:৩৯



(আমার অনুবাদ গল্পগ্রন্থটি থেকে একটি গল্প সামুর পাঠকদের উদ্দেশ্যে পোষ্ট করছি। গল্পটি বেশ বড়, তাই পর্বে পর্বে পোস্ট করছি।)


এক

এক শীতের রাতে গল্পটা শুরু হয়েছিল।

খুব শীত পড়েছে সেদিন। বাইরে শুরু হয়েছে প্রচণ্ড ঝোড়ো বাতাস। শোঁ শোঁ শব্দে কানে তালা লেগে যাওয়ার জোগাড়।
জানালার পর্দাগুলোকে ভালোভাবে টেনে দিয়ে ফায়ারপ্লেসের আগুনটাকে উসকে দেওয়া হয়েছে। সেই আরামদায়ক উষ্ণতায় ফায়ারপ্লেসের পাশের রকিং চেয়ারটাতে বসে উলকাঁটা বুনছিলেন বৃদ্ধা মিসেস হোয়াইট। মাঝে মাঝে চোখ পড়ে যাচ্ছিল স্বামী আর ছেলের দিকে। দুজনে তখন জমিয়ে দাবা খেলছে। তার স্বামী মিস্টার হোয়াইট ছেলের সাথে দাবা খেলাতে বিশেষ সুবিধা করতে পারেন না কখনোই। এমন এমন উদ্ভট চাল চেলে বসেন যে, তার বেচারা ‘রাজা’ খুবই বিপজ্জনক অবস্থাতে পড়ে যায়। সেদিকে তাকিয়ে তার পেরেশান অবস্থা দেখে বৃদ্ধা দুই একটা রসালো মন্তব্য করতে ছাড়েন না। স্বামীর নাকানিচুবানি দেখে মনে মনে খুবই মজা পান তিনি।


‘বাতাসের আওয়াজ শুনতে পাচ্ছ? কী ভীষণ জোরে ঝড় শুরু হলো আজকে!’ মিস্টার হোয়াইট আচমকাই অপ্রাসঙ্গিক ভাবে কথাটা বলে বসলেন। এই কথা অন্যদিকে ঘোরানোর পেছনে একটা ছোট্ট কারণ আছে। এইমাত্র তিনি দেখতে পেয়েছেন যে, একটা ভীষণরকম ভুল চাল দিয়ে ফেলেছেন। খেলা আর দুই সেকেন্ডেই শেষ হয়ে যেতে পারে। ঠেকানোর একমাত্র উপায় হচ্ছে, ছেলের নজরকে দাবার চাল থেকে অন্যদিকে সরিয়ে রাখা।

কিন্তু তাতেও শেষরক্ষা হলো বলে মনে হচ্ছে না। ছেলে তার যথেষ্ট বুদ্ধিমান। খুব মন দিয়ে দাবার বোর্ডের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বলল, ‘হুম আমি শুনতে পাচ্ছি বাবা। বাতাসের এই জোর দাপটেও তো বেঁচে যাব, কিন্তু তোমার রাজাকে তো আর বাঁচানো গেল না বলে মনে হচ্ছে! এই...নাও চেক!’
মিস্টার হোয়াইটের কানে কথাটা গেল বলে মনে হলো না। তিনি বলে চললেন, ‘উঁহু! এত ঝড় ঝঞ্ঝার মধ্যে আজ আর ও আসতে পারবে বলে মনে হচ্ছে না!’
‘এই...মেট!’ ছেলের মন তখনো খেলাতেই। বাবার কথাতে তাকে তেমন একটা মনোযোগ দিতে দেখা গেল না।

এবারে গলার স্বরটা একটু চড়িয়েই মিস্টার হোয়াইট বললেন, ‘এই হচ্ছে মুশকিল বুঝেছ? এত দূরে কান্ট্রিসাইডে এসে বসত গাড়ার এই হচ্ছে মুশকিল! একটু বৃষ্টি হলো তো রাস্তা দিয়ে নৌকা ভাসানো যাবে! কাদায় মাখামাখি ফুটপাথ দিয়ে হাঁটা যাবে না। মানুষজনের কোনো মাথাব্যথাও নেই তাতে। অবশ্য কীভাবেই বা থাকবে? রাস্তার ওপরে বাড়িই আছে গোটা দুয়েক... যেখানে মানুষজন বাস করে!’

‘আহা দুঃখ করো না ডিয়ার! তুমি ঠিক এর পরেরবার জিততে পারবে।’ একটু দূরে বসে একটা মৃদু কটাক্ষ হানলেন মিসেস হোয়াইট। মা ছেলের মধ্যে এই সুযোগে একটা চোরা হাসিও বিনিময় হয়ে গেল। হারতে বসলেই কথাবার্তাকে অন্যদিকে ঘোরানোর এই ট্রিক মিস্টার হোয়াইটের জন্য নতুন কিছু নয়।

ধরা পড়ে গিয়ে একটু লাজুক দোষী হাসি দিলেন মিস্টার হোয়াইট। কিছু একটা বলতে যাবেন, ঠিক এমন সময়েই বেশ জোরে বাইরের গেট খোলার শব্দ শোনা গেল। সেই সঙ্গে ভারী বুটের আওয়াজ।

‘ঐ যে এসে গেছে!’ এবারে ছেলে হারবার্ট হোয়াইট বলে উঠল।

এত ঝড় ঝঞ্ঝার মাঝেও বন্ধু আসতে পেরেছে দেখে মিস্টার হোয়াইট খুশিতে লাফিয়ে উঠলেন। দ্রুত ঘরের দরজা খুলে বন্ধুকে সাদর সম্ভাষণ জানালেন তিনি। তারপর তাকে ভেতরে নিয়ে আসতে আসতে স্ত্রী পুত্রকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘এই হচ্ছে আমার বন্ধু সার্জেন্ট মেজর মরিস।’

মা আর ছেলে আগন্তককে সাদর আমন্ত্রণ জানালো। তারা একটু অবাক চোখে আগন্তুককে দেখছে। ভদ্রলোকের বাদামি পুড়ে চাওয়া চামড়া তার কষ্টকর বাইরের কাজ সম্পর্কে ভালোই ধারণা দিচ্ছে। শক্তপোক্ত দীর্ঘদেহী আর তীক্ষ্ণ চোখের মানুষটাকে দেখে কেমন একটু যেন অন্যরকম অনুভূতি জাগে। চোখের দিকে তাকালে মনে হয়, তিনি কেবল বন্ধু নন... অনায়াসে একজন বিপজ্জনক শত্রুও হতে পারবেন।

করমর্দন শেষে মিস্টার মরিস ফায়ারপ্লেসের পাশে একটি সোফায় বসলেন। মিস্টার হোয়াইট আগে থেকেই বন্ধুর জন্য হুইস্কি গ্লাস আর বরফ সাজিয়ে রেখেছেন দেখে মনে মনে খুব খুশি হয়ে উঠলেন তিনি। পর পর তিন গ্লাস হুইস্কি পেটে ঢোকার পরে তার চোখের উজ্জ্বলতা ফিরে এলো। নিজের দুর্গম এলাকায় যুদ্ধরত জীবন, সাহসী কাজকর্ম আর বিচিত্র সব মানুষের সাথে সাক্ষাত... এসব নিয়ে অল্পসময়েই তিনি গল্পে মেতে উঠলেন। হোয়াইট পরিবার গোল সার্কেল হয়ে তাদের অতিথির চারপাশে বসে পড়ল। প্রত্যেকের চোখেমুখে অসীম আগ্রহ। তিন জন দারুণ মনোযোগী শ্রোতা পেয়ে বক্তার মুখেও খই ফুটতে শুরু করেছে তখন।


গল্পের এক পর্যায়ে মিস্টার হোয়াইট স্ত্রী পুত্রকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘একুশ বছর চলে গেছে! যখন ও বাইরে গিয়েছিল তখন ছিল হাল্কা পাতলা হিলহিলে গড়নের এক পরিণত যুবক। আর আজকে দেখো কেমন গাট্টাগোট্টা দেখতে হয়েছে!’
‘উনি বেশ ভালোই ছিলেন ওখানে। দেখে তো এমনটাই মনে হচ্ছে!’ মিসেস হোয়াইট মৃদু সুরে বললেন।

‘বুঝলে মরিস, আমি নিজে একবার ইণ্ডিয়াতে যেতে চাই। দুনিয়াটা একটু ঘুরে ফিরে দেখা দরকার। এক জায়গাতেই দিনের পরে দিন পড়ে থাকার কোনো মানে হয় বলো?’ মিস্টার হোয়াইট বললেন।
‘যেখানে আছ সেখানেই বেশ আছো! সুখে থাকতে ভূতে কিলোচ্ছে বুঝি?’ মরিস সাহেব বন্ধুর সাথে মজা করলেন।
‘পুরনো সব মন্দির, ফকির ওঝা, রাস্তায় দাঁড়ানো রঙ বাজিকর... এদেরকে চাক্ষুষ দেখতে খুব ইচ্ছে করে।’

‘হ্যাঁ, সাপ ব্যাঙ কালাজাদু তন্ত্রমন্ত্র মশা ম্যালেরিয়া ... এসবও সেই সঙ্গে গিয়ে দেখে এসো!’

বন্ধুর টিটকারিতে মিস্টার হোয়াইট না দমেই বললেন, ‘আচ্ছা ভালো কথা! তুমি সেদিন কী একটা বানরের থাবা না কী নিয়ে যেন কথা বলতে শুরু করেছিলে! ব্যস্ততায় সেদিন শোনা হয়নি। কী বলতে চেয়েছিলে বলো তো?’
‘না কিছু না! শোনার মতো কিছুই না!’ একটু যেন তাড়াতাড়িই বলে উঠলেন মিস্টার মরিস।
‘বানরের থাবা! সেটা আবার কী?’ মিসেস হোয়াইটও বেশ কৌতূহলী হয়ে উঠলেন কথাটা শুনে।
‘মানে... যেটাকে কালাজাদু বলে এরকম ব্যাপার আর কী!’

মিস্টার মরিসের দিকে তিনজন শ্রোতাই এবারে ঝুঁকে এলো। তাদের চোখমুখে আগ্রহ যেন ফুটে বেরুচ্ছে। গল্পটা তো দারুণ ইন্টারেস্টিং মনে হচ্ছে!
কিন্তু আগ্রহ জাগিয়ে দিয়ে মিস্টার মরিস যেন অকস্মাৎ অন্য দুনিয়ায় চলে গেছেন! কী জানি গভীর এক ভাবনায় ডুবে গেছেন তিনি তখন। হুইস্কির খালি গ্লাসটা ঠোঁটের কাছে ছুঁইয়ে আবার অপ্রস্তুতভাবে রেখে দিলেন। মিস্টার হোয়াইট সেটাকে আবার ভরিয়ে দিতে দিতে বললেন, ‘ঘটনাটা নিজের মধ্যে না রেখে খুলেই বলো না বন্ধু!’


মিস্টার মরিস নিজের পকেটে হাত দিয়ে একটা শুকনো মামি হয়ে যাওয়া বানরের থাবা বের করে আনলেন। বিস্ময় আর কিছুটা ঘৃণা নিয়ে তাকিয়ে থাকা শ্রোতা তিনজনকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘এই যে এটার কথাই বলছিলাম দেখো! একটা সাধারণ শুকনো ছোট্ট বানরের থাবা।’

মিসেস হোয়াইট জিনিসটা দেখামাত্রই ঘৃণায় নাকমুখ কুঁচকে ফেলেছেন। কিন্তু হারবার্ট সেটাকে হাতে নিয়ে খুবই কৌতুহলের সাথে নেড়েচেড়ে দেখতে লাগল। তার কাছ থেকে নিয়ে মিস্টার হোয়াইটও দেখলেন কিছুক্ষণ। তারপর টেবিলের ওপরে রাখতে রাখতে বললেন, ‘এটার বিশেষত্ব কী?’

‘একজন বৃদ্ধ ফকির মন্ত্র পড়ে এটাতে ভরে দিয়েছে। সে ছিল একজন তন্ত্রমন্ত্র জানা এলেমদার ফকির। তার উদ্দেশ্য খারাপ ছিল না। মানুষের জীবন যে তার ভাগ্য দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত হয়, এটা প্রমাণ করাই তার উদ্দেশ্য ছিল। আর যে ব্যক্তি নিজের ভাগ্যকে পরিবর্তন করতে চাইবে তাকে খুব খারাপ ভাবে পস্তাতে হবে। ফকির যে মন্ত্র এটাতে ভরে দিয়েছে তার গুণে অথবা দোষে তিনজন আলাদা আলাদা মানুষ তাদের তিনটি ইচ্ছা পূরণ করে নিতে পারবে। তিনজনের তিনটি ইচ্ছা পূরণ হয়ে গেলেই এটি তার সমস্ত শক্তি হারিয়ে ফেলবে। চতুর্থজনের এটা আর কোনো কাজেই আসবে না। কিন্তু প্রতিটা ইচ্ছা পূরণের জন্য তিনজন ব্যক্তিকে একটা কড়া মূল্য চুকাতে হবে। একসময় মনে হবে, হয়ত ইচ্ছাটা পূরণ না হলেই ভালো হতো!’


মিস্টার মরিসের কথা বলার ভঙ্গিমা দেখে সবার মুখেই একটা মৃদু হাসির ঝিলিক খেলে গেল। সেই হাসিতে যে ঈষৎ ব্যঙ্গ মিশে আছে, ব্যাপারটা বুঝতে তার অসুবিধা হলো না। আর এটা বুঝতে পেরে মনে মনে একটু ব্যথিত হয়ে উঠলেন তিনি।

হারবার্ট একটু চালাকির সাথে প্রশ্ন করল, ‘আঙ্কেল আপনি কেন তাহলে এটার সাহায্যে নিজের তিনটি ইচ্ছে পূরণ করে নিচ্ছেন না?’
মধ্যবয়সের অভিজ্ঞতার ভারে স্তিমিত চোখজোড়া দিয়ে অবুঝ অপরিণামদর্শী তারুণ্যের দিকে তাকিয়ে মিস্টার মরিস বললেন, ‘আমি আমার তিনটি ইচ্ছেই পূরণ করে নিয়েছি।’

এবারে মিসেস হোয়াইট জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আর কেউ কি তার ইচ্ছে পূরণ করেছে?’

‘প্রথম ব্যক্তি, যার কাছে এটি ছিল সেও তার তিনটি ইচ্ছে পূরণ করেছে। তার প্রথম দুটি ইচ্ছে কী ছিল, আমি জানি না। কিন্তু তৃতীয় ইচ্ছেটি ছিল মৃত্যু। আর সেই ইচ্ছে তার পূর্ণ হয়েছে। ওটা পূরণ হওয়ার পরেই এই বানরের থাবা আমার হাতে এসে পৌঁছেছে।’ মিস্টার মরিসের কণ্ঠস্বরে এমন একটা গাম্ভীর্য ছিল যে ঘরের মধ্যে আশ্চর্য এক নীরবতা নেমে এলো।

শেষমেষ মিস্টার হোয়াইটই নীরবতা ভঙ্গ করলেন এক সময়। বললেন, ‘আচ্ছা বেশ। তোমার যদি তিনটি ইচ্ছেই পূরণ হয়ে গিয়ে থাকে, তাহলে এটাকে আর রেখে দিয়েছ কী করতে?’

‘শখেই বলতে পারো! প্রথমে চিন্তা করেছিলাম এটাকে বিক্রি করব। কিন্তু পরে মনে হলো, বিক্রি করতে পারব না। এটা ইতিমধ্যেই আমাকে প্রচুর বিপদে ফেলেছে। আমার হয়ত অন্য কাউকে বিপদে ফেলা উচিতও হবে না। তাছাড়া... বেশিরভাগ মানুষ বিশ্বাসই করবে না এটার ওপরে। আর যদিবা কেউ করেও থাকে, প্রথমেই তারা আমাকে এর দাম দিবে না। এটাতে সত্যিই কাজ হয় কী না তা যাচাই করে নেওয়ার চেষ্টা করবে। তারপর দাম দিলে দিতেও পারে।’

‘যদি তোমার আরও তিনটা ইচ্ছা এটি পূরণ করতে পারত, তাহলে কি তুমি এটাকে রেখে দিতে?’ মিস্টার হোয়াইট জিজ্ঞেস করলেন।
‘আমি জানি না! আমি সত্যিই জানি না!’ কথাগুলো বলতে বলতে মিস্টার মরিস জিনিসটাকে ফায়ারপ্লেসের আগুনের মধ্যে ফেলে দিলেন। সেটা দেখামাত্রই মিস্টার হোয়াইট মৃদু আর্তনাদ করে সেটাকে দ্রুত সেখান থেকে বের করে আনলেন।

‘ওটা পুড়ে গেলেই ভালো হতো!’ দুঃখিত গলাতে মিস্টার মরিস কথাটা বললেন। তার বন্ধু আর পরিবার এই গল্পটাকে হয়ত বিশ্বাস করতে পারছে না, এটা ভেবে তিনি মনে মনে কষ্ট পাচ্ছিলেন।

‘বেশ তো মরিস তুমি যদি এটাকে না রাখতে চাও, তাহলে আমাকে দিয়ে দাও না কেন! আমি রেখে দিই ওটাকে!’ মিস্টার হোয়াইটের কণ্ঠে স্বচ্ছ আবেদন।

‘না আমি ওটা কিছুতেই তোমাকে দিতে চাই না। তুমি আমার বন্ধু মানুষ। তোমার কোনো ক্ষতি হোক আমি তা চাই না!’ গলার সুরে বেশ কঠোর মনোভাব প্রকাশ পেল মিস্টার মরিসের। ‘আর তাছাড়া আমি ওটাকে আগুনে ছুঁড়ে দিয়েছিলাম। তুমি উঠিয়ে নিয়েছ। কাজেই এরপর কিছু হলে আমি এর দায়িত্ব নিতে পারব না। যদি একজন দায়িত্বশীল মানুষ হও তাহলে ওটাকে আগুনেই ছুঁড়ে ফেলে দাও!’


মিস্টার হোয়াইট সেটা শুনেছেন বলে মনে হলো না। জিনিসটাকে হাতে নিয়ে নাড়তে নাড়তে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘এটা কীভাবে কাজ করে মরিস?’

একবার ভ্রু কুঁচকে বন্ধুর দিকে তাকিয়ে সার্জেন্ট-মেজর মরিস হতাশ গলায় বললেন, ‘এটাকে ডান হাতে শক্ত করে ধরে তোমার ইচ্ছের কথা জোরে করে বলবে। এমনভাবে বলবে যেন নিজে ঠিকমত শুনতে পারো। কিন্তু আমি আবারও বলে দিচ্ছি তোমাকে, এর পরিণতি কিন্তু ভালো কিছু হয় না!’

‘শুনে তো আরব্য রজনীর গল্প বলে মনে হচ্ছে! আচ্ছা তুমি আমার জন্য চারজোড়া হাত এনে দিতে পারো না?’ ঠাট্টাচ্ছলে কথাগুলো বলেই মিসেস হোয়াইট টেবিলে ডিনার লাগানোর জন্য উঠলেন।

স্ত্রীর কথা শুনেই মিস্টার হোয়াইট পকেটে হাত দিয়ে জিনিসটাকে বের করে আনতে গেলেন। বন্ধু মরিস তার কাঁধ চেপে ধরে অনুনয়ের সুরে বললেন, ‘তুমি যদি একান্তই কিছু চাও এটার কাছে, তাহলে দয়া করে যৌক্তিক কিছু চাও!’
কথাটা শুনেই তিনি আবার সেটাকে পকেটে পুরে ফেললেন।


খাবার টেবিলে বসে বানরের থাবার প্রসঙ্গটা একরকম ধামাচাপাই পড়ে গেল। তারা তিনজনে মিলে মিস্টার মরিসের কাছে থেকে ইণ্ডিয়ার আরও কিছু এ্যাডভেঞ্চারের গল্প শুনলেন।
ট্রেন ধরার ব্যস্ততায় মিস্টার মরিসকে একটু তাড়াহুড়া করেই উঠতে হলো। তিনি চলে যাওয়া মাত্র হারবার্ট তার বাবাকে বলল, ‘তুমি কি এটার জন্য উনাকে কিছু দিয়েছ নাকি বাবা? উনার অন্য গল্পগুলোর মতো যদি এটা তেমন বিশ্বাসযোগ্য কিছু না হয়, তাহলে তো তুমি নির্ঘাত ঠকে গিয়েছ। আমরা এটা থেকে কিছুই আদায় করতে পারব না। একেবারেই গাঁজাখুরি গল্প সব!’

‘দিয়েছি সামান্য কিছু টাকা। ও অবশ্য নিতে চায়নি। আমিই জোর করে দিয়ে দিয়েছি। কিন্তু যাওয়ার আগেও সে বারবার করে আমাকে নিষেধ করছিল। বুঝলাম না! এত মিনতি করে কেন বলছে!’ মিস্টার হোয়াইটের গলায় একটু বিস্ময়। বন্ধুকে তিনি চিনতেন। তার এতটা সাবধান করে যাওয়ার অর্থ বের করতে পারছেন না তিনি। সে তো এতটা কুসংস্কারে বিশ্বাসী মানুষ ছিল না কোনোকালেই!

‘তাহলে আর কী বাবা! চিন্তা করো না! আমরা খুব শিগগিরই ব্যাপক ধনী বিখ্যাত আর সুখি মানুষ হয়ে যাব। এক কাজ করো না বাবা! রাজা হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করো। মা তাহলে দিনরাত আর এত অভিযোগ করবে না!’ হাসতে হাসতে বলল হারবার্ট। ডাইনিং টেবিল গোছাতে গোছাতে মিসেস হোয়াইটও সেই হাসিতে যোগ দিলেন।

পকেট থেকে বানরের থাবাটাকে বের করে মিস্টার হোয়াইট অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে রইলেন। বিড়বিড় করে বললেন, ‘বুঝতে পারছি না এটার কাছে কী চাওয়া যায়! আমার কাছে তো সবকিছুই আছে!’

‘আপাতত তুমি যদি এই বাড়ির দুইশ পাউণ্ডের ঋণটা পরিশোধ করতে পারো, সেটাই যথেষ্ট হবে বাবা! দুইশ পাউন্ড চাও এটার কাছে, দেখি ইনি কী করেন!’ হারবার্ট হাসিমুখে বাবার কাঁধে হাত রেখে বলল।

প্রত্যুত্তরে মিস্টার হোয়াইট একটু অপ্রস্তুত চোখে স্ত্রীর দিকে তাকালেন। বন্ধুর গাঁজাখুরি গল্প বিশ্বাস করে ফেলেছেন, এটা নিয়ে তিনি মনে মনে একটু লজ্জিত। লাজুক হাসি দিয়ে কুণ্ঠিত হাতে তিনি বানরের থাবাটাকে ডান হাতে উঁচু করে ধরলেন তারপর একটু সিরিয়াস ভঙ্গিতে বললেন, ‘আমি দুইশ পাউন্ড চাই!’

কথাটা বলেই হঠাৎ কেমন যেন চমকে তিনি কয়েক পা পিছিয়ে গেলেন। হাত থেকে বানরের থাবাটা ছিটকে পড়ে গেল নিচে। স্ত্রী পুত্র ছুটে এলো তার কাছে। মিসেস হোয়াইট উদ্বিগ্ন গলায় জানতে চাইলেন, ‘কী হয়েছে? অমন করলে কেন?’

আচমকা কী একটা হওয়াতে মিস্টার হোয়াইটের মুখ মুহূর্তেই কেমন যেন ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। বোকা বোকা মুখে তিনি বললেন, ‘এটা কেমন যেন সাপের মতো কিলবিল করে উঠল।’

‘সাপের মতো কিলবিল? উফ! মাথাটা গ্যাছে তোমার! বন্ধুর ওসব গালগপ্পো ভালমতোই বিশ্বাস করেছ বুঝতে পারছি।’ মিসেস হোয়াইটের গলায় একটু বুঝি তিরস্কারের সুর। কিন্তু সেই তিরস্কারে মিস্টার হোয়াইট বিচলিত হলেন না। তিনি তখন অবিশ্বাস নিয়ে তাকিয়ে আছেন ঐ অদ্ভুত জিনিসটার দিকে।

এবারে ছেলে হারবার্ট সেটাকে হাতে তুলে নিয়ে মজা করে বলল, ‘কিন্তু আশেপাশে তো কোনও টাকাপয়সা দেখতে পাচ্ছি না বাবা! আমি নিশ্চিত কিচ্ছুটি দিতে পারবে না এই ব্যাটা! খামাখা পণ্ডশ্রম!’

‘কী হলো তোমার? এমন মনমরা হয়ে পড়লে কেন?’ এবারে মিসেস হোয়াইট একটু নমনীয় হলেন। স্বামীর মুখচোখ দেখে ভালো ঠেকছে না তার কাছে। এত বিমর্ষ হয়ে পড়ার কী আছে কে জানে! স্ত্রীর কথাতে শুধু ছোট করে উত্তর দিলেন, ‘হয়ত কিছুই না! কিন্তু এটা এমন শক দিলো কেন বুঝতে পারছি না!’


ছোট্ট পরিবারটি ফায়ারপ্লেসের চারপাশে গোল হয়ে বসলো আবার। এবারে কিন্তু আগের সেই উচ্ছ্বাস আর ফুরফুরে ভাবটা নেই। সবাই কেমন একটু চুপচাপ বসে আছে। বিশেষ করে মিস্টার হোয়াইটের মুখের ভাব অতিরিক্ত গম্ভীর। প্রচণ্ড ঝড়ো বাতাসে ওপরতলার একটা দরজায় জোরে পাল্লা খোলা আর বন্ধ হওয়ার শব্দ হলো। মিস্টার হোয়াইট একেবারে লাফিয়ে উঠলেন শব্দটা শুনে। এত ভয় কেন পেলেন, সেটা তিনি নিজেও বুঝতে পারলেন না!
একসময় ঘুমের সময় হলো। স্বামী স্ত্রী উঠে গেলেন ঘুমানোর জন্য।

হারবার্ট হাসিমুখে মা-বাবাকে শুভরাত্রি জানিয়ে বলল, ‘দেখো তোমাদের বিছানার মাঝখানে আজ নিশ্চয়ই একটা টাকাভর্তি ব্যাগ অপেক্ষা করে বসে আছে। আমার তো মনে হচ্ছে আজকেই টাকাটা পেয়ে যাবে। চিয়ার আপ!’

হারবার্টের স্বভাবের মধ্যেই সবসময় একটা চটুল বিনোদন আর প্রাঞ্জল ঠাট্টা করার মেজাজ লুকিয়ে আছে। কিন্তু আজকে সেও একটু বিরসমুখে একা একা অন্ধকারে সেই নিভে আসা ফায়ারপ্লেসের আগুনের সামনে বসে রইল।
সেই অদ্ভুত অন্ধকারের মধ্যে সে ফায়ারপ্লেসের নিভন্ত আগুনের মাঝে নানারকম ছায়া আর মুখ দেখতে পেল। কিছু কিছু মুখের আকৃতি এতটাই ভয়ংকর মনে হলো যে হারবার্ট টেবিলের ওপরে হাতড়ে একটা গ্লাস খুঁজতে গেল। তার ইচ্ছে হচ্ছিল সেই গ্লাসে রাখা পানিটুকু ঐ আগুনের মধ্যে ঢেলে দেয়। হাতে গ্লাস ঠেকল না। সেই বানরের পা টাকেই সেখানে খুঁজে পেল। মনের মধ্যে কেমন একটু করে উঠল যেন। তাড়াতাড়ি হাতটাকে নিজের কোটের গায়ে মুছে হারবার্ট সেখান থেকে উঠে পড়ল।
(ক্রমশ)

মন্তব্য ১৬ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (১৬) মন্তব্য লিখুন

১| ০৪ ঠা অক্টোবর, ২০২৫ দুপুর ১:২৯

মাহমুদুর রহমান সুজন বলেছেন: গল্পটি পড়তে ভালো লাগল। আপনাকে ধন্যবাদ এমন একটি গল্প পড়ার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য্।

০৪ ঠা অক্টোবর, ২০২৫ দুপুর ১:৪৭

ফাহমিদা বারী বলেছেন: ধন্যবাদ। কিন্তু গল্প এখনো চলমান।

২| ০৪ ঠা অক্টোবর, ২০২৫ দুপুর ১:৫৪

মাহমুদুর রহমান সুজন বলেছেন: সাথে আছি পরের পার্ট নিশ্বচ সহসায় পাবো।

৩| ০৪ ঠা অক্টোবর, ২০২৫ দুপুর ২:০৭

মোঃ খালিদ সাইফুল্লাহ্‌ বলেছেন: ইন্টারেস্টিং!

০৪ ঠা অক্টোবর, ২০২৫ দুপুর ২:২৬

ফাহমিদা বারী বলেছেন: ধন্যবাদ, সাথে থাকুন।

৪| ০৪ ঠা অক্টোবর, ২০২৫ বিকাল ৩:১০

জেনারেশন একাত্তর বলেছেন:




আপনাদের সময়ে HSC'র সিলেবাস অন্তর্ভুক্ত ছিলো?

০৪ ঠা অক্টোবর, ২০২৫ রাত ৯:০২

ফাহমিদা বারী বলেছেন: এই গল্প? নাহ!

৫| ০৪ ঠা অক্টোবর, ২০২৫ বিকাল ৪:৩৩

সুম১৪৩২ বলেছেন: অনুবাদ ভালো হয়েছে আপু , আপনাকে বিশেষ ভাবে ধন্যবাদ এই কারণ আপনি কপি পেস্ট মার্কা অনুবাদক না। পাঠক দের পড়ার মতো অনুবাদ হয়েছে। ভালো থাকবেন।

০৪ ঠা অক্টোবর, ২০২৫ রাত ৯:০৩

ফাহমিদা বারী বলেছেন: চেষ্টা করেছি ভাবানুবাদ করার। গল্পে কিছুটা পরিমার্জন এবং পরিবর্ধনের প্রয়োজন হলে সেটাও করেছি। তবে গল্পের মৌলিকত্ব যাতে ক্ষুণ্ণ না হয় সেদিকে দৃষ্টি রেখেছি।

৬| ০৪ ঠা অক্টোবর, ২০২৫ সন্ধ্যা ৬:১২

দি এমপেরর বলেছেন: ভালো অনুবাদ। পড়তে গিয়ে হোঁচট খেতে হয়নি। আপনার বইয়ের সাফল্য কামনা করি।

০৪ ঠা অক্টোবর, ২০২৫ রাত ৯:০৪

ফাহমিদা বারী বলেছেন: বইটা মোটামুটি সফল হয়েছে বলা চলে। আমি নতুন অনুবাদক। দেশে নতুন পাগলই ভাত পাচ্ছে না, আমি আবার নতুন পাগল যুক্ত হলাম!

৭| ০৪ ঠা অক্টোবর, ২০২৫ রাত ৮:৫৫

কলাবাগান১ বলেছেন: আমি মনে হয় ৭-৮ বছর আগে কাচা হাতে এটার অনুবাদ করে সামুতে পোস্ট করেছিলাম..।

০৪ ঠা অক্টোবর, ২০২৫ রাত ৯:০৪

ফাহমিদা বারী বলেছেন: সেটা তো নিঃসন্দেহে বিশাল ব্যাপার! ৭/৮ বছর বয়সে আমার এসব চিন্তাভাবনাই মাথায় আসেনি!

৮| ০৪ ঠা অক্টোবর, ২০২৫ রাত ৯:০৮

জনারণ্যে একজন বলেছেন: কৈশোরে এই গল্পটার অনুবাদ পড়া হয়েছিল। বিস্মৃতপ্রায় স্মৃতি - খুব সম্ভবত: এরকম কয়েকটা ছোটগল্প নিয়ে সেবা প্রকাশনীর একটা বই ছিল। ঠিক নিশ্চিত ও নোই - কারণ বিশ্ব-সাহিত্য কেন্দ্রের সুবাদেও প্রচুর বই পড়া হতো।

যাই হোক, এরপর আবার আপনার অনুবাদ পড়লাম। প্রথমবার সেই শৈশবে/কৈশোরে এই গল্পটা পড়ার পর যে অনুভূতি ছিল, দেখলাম হারিয়ে গেছে। এখন জাস্ট পড়ে গেছি।

অনুবাদ-বইগুলি একটু প্রাণহীন হয়; যেমন হয় সাধারণত এআই দিয়ে লিখলে। কোথাও যেন একটা ঘাটতি থাকে। শুনলে আপনার একটু মন খারাপ হলেও হতে পারে, আপনার এই গল্পটা কিন্তু পুরোপুরি সেই প্রাণহীনতা থেকে মুক্ত নয়।

ভালো থাকবেন।

০৪ ঠা অক্টোবর, ২০২৫ রাত ৯:৫৬

ফাহমিদা বারী বলেছেন: নাহ দুঃখ পাইনি। পুরো গল্পটা দিই, দেখুন বাকিটুকু কেমন লাগে। এটি আমার প্রথম অনুবাদ। চেষ্টা থাকবে ইনশাআল্লাহ ভবিষ্যতে অনুবাদ নিয়ে কাজ করলে বেটার কিছু করার। আপনাকে ধন্যবাদ।

৯| ০৪ ঠা অক্টোবর, ২০২৫ রাত ১১:১৭

কলাবাগান১ বলেছেন: ৭/৮ বছর বয়সে কে অনুবাদ করল?

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.