![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
(গত বছরের বইমেলাতে জাগৃতি প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয়েছিল আমার অতিপ্রাকৃত গল্পগ্রন্থ 'প্রকৃত নয়, অতিপ্রাকৃত'। সেই বইয়ের একটি গল্প সামুর পাঠকদের জন্য শেয়ার করছি। গল্প বেশ বড়। তবু তিন পর্বে দিচ্ছি না। দুই পর্বে দিব। কেউ ধীরে ধীরে পড়তে চাইলে আরাম করে পড়ুন। তবু পড়ুন। গল্পটা আশাকরি অন্যরকম লাগবে )
লোকটা একটা বেশ বড়সড় পাথরকে একবার হাত দিয়ে ওপরে ছুঁড়ে মারছে, পরক্ষণেই সেটাকে খপ করে ধরে ফেলছে। আবার সেটাকে এদিক সেদিকে ছুঁড়ছে। আর প্রতিবারই দারুণ দক্ষতায় সেটাকে এমনভাবে ধরে ফেলছে যে, মনে হচ্ছে যেন পাথর নয়, লোকটা কোনো পিংপং বল নিয়ে খেলা দেখাচ্ছে!
আর পাথরটাও এমনভাবে তার দিকেই ছুটে আসছে যেন সে শত্রুকে আহত করে আবার নিক্ষেপকারীর হাতে ফিরে আসছে। ঠিক যেন একটা বুমেরাং!
পাথরটা যে এতটা বড় আর ভারি তা লোকটার হাতের ওঠানামায় বোঝার কোনও উপায় নাই। সে অনায়াস ভঙ্গিতে সেটা নিয়ে খেলছে। আমি মুগ্ধ চোখে লোকটার হাতের নৈপুণ্য দেখছি। সেই সঙ্গে দেখছি পাথরটাকে। এক মুহূর্তের জন্যও চোখটাকে সরাতে পারছি না। পাথরটা যেন আমাকে টানছে। মনে মনেই বললাম, ‘কী অদ্ভুত! কী অদ্ভুত!’
বসে আছি ট্রেনের কম্পার্টমেন্টে। সেকেন্ড ক্লাস কর্ম্পার্টমেন্ট। নাটোর থেকে ফিরছি। আমার পৈতৃক বাড়ি নাটোর। মা-বাবা গত হওয়ার পর থেকে বছরে একবার দুবার গিয়ে বর্গা দেওয়া জমিজমা থেকে ফসলাদি নিয়ে আসি। পৈতৃক ভিটার সাথে এটুকুই এখন সম্পর্ক আমার।
আজ ট্রেনে তেমন যাত্রী নেই। ফাঁকা ফাঁকা পরিবেশ। বেশ দূরে দূরে একজন দুজন যাত্রী একটা দুটো সিট দখল করে রাজার হালে বসে আছে।
আমি আর এই লোক মুখোমুখি দুটো সিটে বসেছি। আমাদের থেকে বেশ অনেকটা দূরে আরেকজন বসেছে। সে মগ্ন হয়ে ফোনে কথা বলছে। সম্ভবত প্রেমালাপ চলছে। আশেপাশের কোনও কিছুতেই তার মনোযোগ নেই।
আমার সামনে বসা লোকটার দিকে না চাইলেও আপনা থেকেই চোখ চলে যাচ্ছে। একটু চুপচাপ গোছের মানুষ। কথাবার্তা খুব একটা বলে টলে না সম্ভবত। সেও কেমন জানি নিজের জগতেই মশগুল। এই প্রচণ্ড গরমেও লোকটা একটা মাফলার গলায় দিয়ে বসে আছে। গায়ে ফুলহাতা জামা, পায়ে জুতা মোজা। ধারণা করলাম ঠাণ্ডা লেগেছে। লোকটার চাহনিতে একটা কেমন জানি অস্বাভাবিকতা আছে। সেটা কী ধরণের, তা ঠিক ধরতে পারলাম না। চোখের দৃষ্টি ধূসর। যখন কোনোদিকে তাকাচ্ছে, তখন যেন ঠিক সেই জিনিসটাকে নয়... সেটাকে ছাপিয়েও দূরের অন্য কিছু দেখছে।
প্রথমে কিছুক্ষণ তাকে বই পড়তে দেখলাম। তবে সেটা খুব অল্প সময়ের জন্য। বইয়ের পাতায় সে যেন তার চোখদুটোকে স্থিরই রাখতে পারছিল না। আমি তার চোখের মণির অস্থিরতাটুকুও ধরতে পারছিলাম। কীসের যেন একটা চাঞ্চল্য তাকে স্থির হয়ে বসতে দিচ্ছে না। এক হাতে বইটা নিয়ে আরেক হাতে নিজের কাপড়ের থলিটা ধরে বসে ছিল। সেখানে রাখা কিছু একটাতে হাত বুলাচ্ছিল। যেন ভেতরে একটা বিড়াল বাচ্চা বসে আছে। লোকটা পরম মমতায় হাত বুলিয়ে সেটাকে আদর করছে।
একসময় বইটাকে সরিয়ে রেখে দিয়ে সে থলিটা খুলে পাথরটা বের করে আনল। তারপর থেকেই এই সার্কাস চলছে। সামনে একজন দর্শককে বসিয়ে রেখে নিমগ্ন মৌনতায় লোকটা পাথর নিয়ে খেলছে।
আমি আর থাকতে না পেরে বলেই ফেললাম, ‘জনাব কি কোনও দলের সঙ্গে আছেন?’
চোখটাকে পাথরেই আটকে রেখে লোকটা জবাব দিল, ‘দলের সঙ্গে মানে?’
আমি একটু ইতঃস্তত করে বললাম, ‘এই মানে... যারা খেলাটেলা দেখায় আর কী! সার্কাস দল অথবা ঐ জাতীয় কিছু।’
লোকটা এবারে পাথরটা নামিয়ে এনে সোজাসুজি আমার দিকে তাকাল। এই এতক্ষণের মধ্যে এবারেই প্রথম তার মুখে একটু হাসি দেখলাম। স্মিত মুখে বলল, ‘আমাকে দেখে কি সার্কাসের সঙ মনে হচ্ছে?’
আমি লজ্জিত হলাম। তাড়াতাড়ি বলে উঠলাম, ‘আরে না না! আমি তা বলিনি ভাই। প্লিজ আমার কথায় কিছু মনে করবেন না। এত চমৎকার ভাবে পাথরটা নিয়ে নাড়াচ্ছেন যে...’
‘পাথরটা পছন্দ হয়েছে আপনার? নিবেন?’ কথাটা বলেই লোকটা এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল আমার দিকে। আমি একটা অস্বস্তি বোধ করতে শুরু করলাম। এমন অদ্ভুত প্রশ্ন কেউ করে? লোকটা সত্যিই খুব অদ্ভুত! এটা যেন কোনও বাচ্চাকে জিজ্ঞেস করা, ‘খেলনাটা পছন্দ হয়েছে তোমার? নিবে?’
আমি চুড়ান্ত লজ্জা নিয়ে বললাম, ‘আরে না না... আমি কেন নিব?’
কথাটা শুনেই লোকটার মুখে একটু যেন ছায়া ঘনাল। আমি অবাক হয়ে সেটা লক্ষ করলাম। লোকটার পরনের বেশভূষা একটু মলিনই বটে। চেহারাও যথেষ্ট উসকোখুসকো। যদিও বেশভূষা দেখে একজন মানুষকে বিচার করার কোনও মানে নেই, কিন্তু ধারণা করলাম লোকটা হয়ত অভাবী। এভাবে ট্রেনে উঠে খেলা দেখিয়ে অপরপাশের মানুষকে আকৃষ্ট করে পাথর বিক্রি করে বেড়ায়। সুদৃশ্য পাথর। হয়ত লোকটার ঐ থলিতে এমন আরও অনেক পাথর আছে।
হাত দুটো জড়ো করে লোকটা পাথরটা ধরে বসে আছে। আমি এতক্ষণ পরে খেয়াল করলাম, লোকটার হাতে শ্বেতীর দাগ। কিছু জায়গায় দাগটা বেশ গভীর। পাথরটা ধরে রাখা অবস্থাতে হাতদুটো অল্প অল্প কাঁপছে। হঠাৎ মনে হলো, লোকটার সম্ভবত কুষ্ঠ রোগ আছে। হ্যাঁ কুষ্ঠই হবে। জামার আস্তিন একটু সরে যেতেই দেখলাম, হাতের ত্বকে কেমন একটা ক্ষত তৈরি হয়েছে। আমি সেদিকে তাকিয়ে আছি বুঝতে পেরেই সঙ্গে সঙ্গে আস্তিনটা টেনে নামিয়ে দিলো। আমিও অন্যদিকে মুখ ফেরালাম। কাউকে আঘাত দেওয়ার মতো হীনমন্যতা আমার নেই। হয়ত সে নিজের অসুখটার জন্য মনে মনে কুণ্ঠিত। কারো কাছে সেটাকে প্রকাশ করতে চায় না।
কী বলা উচিত বুঝতে না পেরে বললাম, ‘তবে আপনার পাথরটা কিন্তু সত্যিই খুব সুন্দর। কোথায় পেয়েছেন এমন ধবধবে সাদা পাথর?এত বড়!’
আমার কথা শুনে লোকটা আবার উৎসাহিত হয়ে উঠল। তার ধূসর চোখে একটা চকচকে খুশির ছায়া ফুটে উঠল। তারপর সে আমাকে দীর্ঘ একটা গল্প শোনাল। সেই গল্পের ইতিবৃত্তান্ত শুনে বুঝলাম পাথরের এই গল্পটাতে সত্য মিথ্যার একটা ভেজাল আছে। তবু গল্পটা শুনে আকৃষ্ট না হয়ে পারা যায় না। লোকটার জবানিতেই গল্পটা আপনাদের শোনাই,
‘আমি পাথরের ব্যবসা করি। মার্বেল পাথর, সিরামিক পাথর... যেসব পাথর দিয়ে শৌখিন লোকজন বাসাবাড়ি বানায় আর কী! ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাছে এসব পাথর সাপ্লাই করে থাকি। যেখানে যার কাছ থেকেই ভালো পাথরের সন্ধান পাই, চলে যাই। বেশ কয়েকবার আমাকে ভালো পাথরের খোঁজ করতে নেপালে যেতে হয়েছিল। কাজ চালানোর মতো নেপালি ভাষাও আমার আয়ত্তে ছিল। পড়তেও পারতাম।
একবার একটা অর্ডার পেলাম এক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে। গুলশানের এক বিশাল কোটিপতি নিজের বাসার মেঝেতে এমন দামি পাথর বসাতে চাইছে যা দিয়ে গয়না বানালেও লোকে দাম দিয়ে কিনবে। আমি শুনে অবাক হলাম না। মানুষের আজকাল টাকা পয়সার অভাব নেই। আর টাকা থাকলে কত কিছুই তো করতে খায়েশ জাগে!
খবর পেলাম সেই পাথর পাওয়া যাবে নেপালে। যে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কাজটা করছে তারাই প্লেনভাড়া দিয়ে আমাকে নেপালে পাঠাল। কারণ তারা জানত, আমি দায়িত্ব নিলে তা করেই ছাড়ি। খুঁজেপেতে এমন পাথর নিয়ে আসব যা দেখে সবার চোখ কপালে উঠে যাবে। সেই পাথর খুঁজতে আমাকে পাতালে ঢুকতে হলে সেখানেও ঢুকব!
নেপাল গিয়ে খোঁজখবর করে জানতে পারলাম, পাথরের মান আসলেই ভালো। তবে দাম একটু চড়া। আমি অনেক কষ্টে দরদাম করে কিছুটা সহনশীল মাত্রায় নিয়ে এলাম।
সবকিছু ঠিকঠাক হয়ে যাওয়ার পরে যেদিন দেশে ফিরব তার দুই তিন দিন আগে ভাবলাম, এসেছি যখন তখন এই সুন্দর দেশটা একটু ঘুরে দেখি। কত কিছুই তো আছে দেখার মতো! একটা ট্রাভেল গ্রুপের সঙ্গে দিনের চুক্তি হিসেবে যুক্ত হলাম। অর্থাৎ যেদিন তাদের সঙ্গে ঘুরব, সেই দিনের টাকা মিটিয়ে দিব। গ্রুপে একজন ভালো গাইড থাকবে, সেইজন্যই এই ব্যবস্থা করলাম। তাছাড়া নিজে তো নেপালের সব জায়গা চিনিও না!
গ্রুপটার সঙ্গে ঘুরতে ঘুরতে অনেক জায়গা দেখলাম। পোখারা নামের একটা জায়গাতেও গেলাম। সেখানেও কিন্তু একটা তাজমহল আছে! সেই তাজমহলটিও স্ত্রীর প্রতি স্বামীর ভালোবাসার নিদর্শন হিসেবে তৈরি করা হয়েছিল।
আঠার দশকের শেষে রাজা শমশের জং বাহাদুর রানা এটি তৈরি করে। এই বাহাদুর রানা কিন্তু খুব একটা ভালোমানুষ ছিল না। নেপাল সেনাবাহিনীর জেনারেল হওয়া সত্ত্বেও এই লোক নিজের আপন চাচাকে ভাইয়ের মাধ্যমে খুন করে। কিন্তু এতকিছু করেও শেষরক্ষা হয়নি। বাহাদুর রানার ভাই বীর শেষমেশ নিজের ভাইকে নেপালের এক প্রত্যন্ত এলাকাতে নির্বাসনে পাঠিয়ে দিয়ে নিজেই সিংহাসনে বসে পড়ে। সেনাবাহিনী থেকেও তাকে অপমানিত করে তাড়িয়ে দেওয়া হয়। নির্বাসিত জীবনে নিজের স্ত্রীই ছিল তার একমাত্র সহচর। এই স্ত্রীর প্রতি নিজের ভালোবাসার প্রকাশ দেখাতেই বাহাদুর রানা তাজমহলটি তৈরি করে। স্ত্রীর সমাধির পাদদেশে তৈরি করা হয় পোখারার এই তাজমহল।
গাইডের মুখ থেকে তাজমহল তৈরির এই ইতিহাস শুনে খুব ব্যথা পেলাম। বসে বসে মন খারাপ করে ভাবতে লাগলাম, মানুষের মনের নোংরা প্রতিহিংসা, ক্ষমতার লোভ আবার সেই একই মনেই ভালোবাসার বসতির কথা। কী বিচিত্র মানুষের মন! এক মনেই কত জনের বাস! সেই গানটার কথা মনে পড়ে গেল,
‘’ এক জনায় ছবি আঁকে এক মনে,
ও রে মন!
আরেকজনায় বসে বসে রঙ মাখে
ও আবার সেই ছবিখান নষ্ট করে
কোন জনা, কোন জনা
তোমার ঘরে বসত করে কয় জনা
মন জানো না!’
মনে যখন এমন ভাবের লেনদেন চলছে, তখন একটু দূরেই দেখতে পেলাম এক লোক একটা পাথর নিয়ে খেলা দেখাচ্ছে। ঠিক যেরকম খেলা আমি একটু আগেই বসে বসে খেলছিলাম, সেরকমই বলতে পারেন। আমি দূর থেকে সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কেমন জানি মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে গেলাম। পাথরটার অদ্ভুত সৌন্দর্য আমাকে তীব্রভাবে আকর্ষণ করল। এত ধবধবে সাদা পাথরও হয়? তাও আবার এত বড় সাইজের! কীসের একটা টান আমাকে সেই লোকটার কাছে নিয়ে গেল। যেন পাথরটা একটা চুম্বক, আর আমি লোহা।
লোকটা আমাকে দেখল কিন্তু কিছু বলল না। নিজের মনেই খেলা দেখিয়ে যেতে লাগল। না থাকতে পেরে একসময় আমিই নিজে থেকে বললাম, ‘এটা কীসের পাথর? এত বড় পাথর ওপরে ওঠাচ্ছেন কেমন করে?’
এবারে লোকটা আমার দিকে তাকাল। একই প্রশ্ন করল যেটা আজকে আমি আপনাকে একটু আগেই করলাম, ‘পাথরটা আপনি নিবেন?’
আমিও খুব অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আমাকে দিয়ে দিবেন? কেন? এটা তো আপনার পাথর! আপনি এটা দিয়ে খেলা দেখান! আমাকে এমনি একটু দেখতে দিলেই খুশি হব। আমার হাতে একটু দিবেন? এত ভারি একটা পাথর আপনি এত সহজে নাড়াচাড়া করছেন কীভাবে, সেটাই দেখতে চাই।’
‘এটা হাতে নিয়ে দেখার অনুমতি নেই বাবু। আপনি তখনই এটা নিতে পারবেন যখন আপনি এটার মালিক হবেন।’
আমি এমন আজব কথা জীবনে কোনোদিন শুনিনি। পাথর হাতে নিয়ে দেখতে হলে সেটার মালিক হতে হবে কেন? ধারণা করলাম, হয়ত লোকটা বিক্রি করার ধান্দাতে এটা বলছে।
আমিও তাই সোজাসাপ্টাই জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনার পাথরের দাম কত?’
লোকটা একটু হেসে বলল, ‘আপনার ভালো লাগলে এমনিই নিয়ে নিতে পারেন বাবু! রুপিয়া দিতে হবে না!’
আমি ভাবলাম, সহজসরল গরীব মানুষ হয়ত সঙ্কোচে মুখ ফুটে কিছু বলতে পারছে না। তাই আমি কিছু টাকা বের করে দিতে গেলাম। লোকটা কিন্তু সেটা কিছুতেই নিলো না। সে আমাকে এমনিই পাথরটা দিয়ে দিতে চায়। আমিও আর অযথা কথা না বাড়িয়ে নিয়ে নিলাম। হয়ত না নিলে তার ভালোবাসার অপমান করা হবে। তাছাড়া পাথরটা আমার খুব পছন্দও হয়েছিল।
লোকটা এবার বলল, ‘এটা কিন্তু যেনতেন পাথর নয় বাবু! এটা আপনার ভাগ্য ফিরিয়ে দিতে পারবে!’
আমি মনে মনে হাসলাম। ঐ সেই একই বুজরুকি। পাথরের নানারকম গুণের কথা বলে মানুষকে মিথ্যে ধোঁকা দেওয়া। পাথর আবার ভাগ্য ফেরায় কীভাবে? ভাগ্য তো ফেরে আল্লাহপাকের ইচ্ছায় আর মানুষের পরিশ্রমে। পরিশ্রমী মানুষ আমি, এসব বুজরুকিতে আমি সহজে পটি না। তবু মজা করার জন্যই মনের ভাব চেপে রেখে বললাম, ‘আচ্ছা! তাহলে এত ভালো পাথরটা আপনি আমাকে দিয়ে দিতে চাচ্ছেন কেন? নিজের কাছে কেন রাখতে চাইছেন না?’
লোকটা এবারে আরও অদ্ভুত একটা কথা বলল। ‘এই পাথর কাজেকর্মে সৌভাগ্য আনে ঠিকই, তবে বেশিদিন একে নিজের কাছে রাখা যায় না। তাহলে সৌভাগ্য দুর্ভাগ্যে রূপ নিতে সময় নেয় না!’
আমি লোকটার কথা বিন্দুমাত্র বিশ্বাস করলাম না। কিন্তু পাথরটাকেও নিতে ভুললাম না। ওটা তখন আমাকে টানছিল। আর তাছাড়া ভেবে দেখলাম, আমার তো হারানোর কিছু নাই। পয়সা তো আর দিতে হচ্ছে না!
পাথরটা নিয়ে দেশে আসার পর থেকেই আমার ব্যবসা তরতর করে বেড়ে চলেছিল। আমি নিয়মিত বড় বড় সাপ্লাইয়ের অর্ডার পেতে লাগলাম। অবাক হয়ে ভাবতাম, লোকটা তাহলে তো ভুল কিছু বলেনি! পাথরটা তো সত্যিই আমার সৌভাগ্য ফিরিয়ে নিয়ে এলো! আমি আস্তিক মানুষ। তাই অবশ্যই বিশ্বাস করি আল্লাহ্র ইশারা ছাড়া কিছুই হয় না। হয়ত পাথরটা একটা দাওয়াই, একটা উছিলা মাত্র!
তবে লোকটার শেষের কথাগুলোও আমি ভুলিনি। এই পাথর সৌভাগ্য আনে ঠিকই, কিন্তু একে বেশিদিন নিজের কাছে রেখে দিলে সৌভাগ্যের পরিবর্তে দুর্ভাগ্য এসে জড়ো হয়।
আজ প্রায় পাঁচ পাঁচটি বছর ধরে আমি এই পাথরটাকে আগলে নিয়ে বসে আছি। এর মোহে প্রায় অন্ধ হয়ে গেছি। কিছুতেই একে কাছছাড়া করতে পারি না। কিন্তু প্রতি মুহূর্তেই ভয় হয়, এই বুঝি দুর্ভাগ্য এসে সবকিছু কেড়ে নিয়ে যায়! তাই আমি এখন এমন একজনকে খুঁজছি যে এটার উত্তরাধিকার বহন করবে, এটাকে ভালবেসে গ্রহণ করবে।’
এই বলে লোকটা তার কথা শেষ করল। আমি তাজ্জব হয়ে লোকটার গল্প শুনছিলাম।
উত্তরাধিকার! এক খণ্ড পাথরের উত্তরাধিকার! পাথর খন্ডটি কি সত্যিই এত মূল্যবান? লোকটি গভীর আগ্রহে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘বিশ্বাস করবেন না হয়ত, আপনার চোখে আমি পাথরটার প্রতি সেই ভালোবাসা দেখতে পেয়েছি যেটার সন্ধান আমি করছি। মনে হচ্ছে এতদিনে বুঝি পাথরটাকে আমার হাতছাড়া করার সময় এসেছে!’
আমি কিছুক্ষণ বেকুবের মতো বসে রইলাম। লোকটার কণ্ঠের বিষণ্ণতাকে ছাপিয়ে এক অন্যরকম আকুতি আমাকে স্পর্শ করল। বললাম,‘কিন্তু আপনি তো যে কাউকেই এই পাথরটা দিয়ে দিতে পারেন! আমাকেই কেন দিতে চাইছেন?’
‘কারণ আপনি পাথরটার ব্যাপারে আগ্রহ দেখিয়েছেন। যারা এর প্রতি আগ্রহ দেখায় না, তাদেরকে এটা দিলে আমি দায়মুক্ত হতে পারব না!’
‘দায়? কীসের দায়?’
‘এই যে এতদিন ধরে পাথরটার কাছ থেকে সৌভাগ্য ভোগ করেছি সেটার দায়!’
‘দূর যতসব কুসংস্কার! পাথর সৌভাগ্য দেওয়ার কে?’
‘পাথর কিছু না... সবই আল্লাহপাকের ইচ্ছা। তবু চাইলে নিতে পারেন। হয়ত আপনার কাজে আসবে! আর সময় হলে আপনিও অন্য আরেকজনকে এটা দিয়ে দিবেন।’
আমি দ্বিধাজড়ানো গলায় বললাম, ‘কিন্তু আমি কীভাবে বুঝব যে এটা এখন অন্য কাউকে দিয়ে দেওয়ার সময় এসেছে?’
লোকটা রহস্যমাখা হাসি হেসে বলল, ‘এটা আপনি ঠিক বুঝে যাবেন! কাউকে কিছু বলে দিতে হবে না!’
‘আপনি বুঝেননি সময়মত?’
‘বুঝেছিলাম তো! কিন্তু ঐ যে... মায়া…অদ্ভুত এক মায়ার কারণে কীভাবে জানি দেরি হয়ে গেল!’
আমি কিছুটা সময় চিন্তা করে বললাম, ‘বেশ দিয়েন আমাকে পাথরটা। নিব আমি।’
কথাটা শুনেই লোকটার মুখচোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। সে পাথরটা ওপরে তুলে গভীর এক দৃষ্টি মেলে সেটার দিকে তাকাল, যেন পুরনো কোনও বন্ধুর সঙ্গে শেষ আলাপনটা সেরে নিচ্ছে। আমি অবাক চোখে তার কাণ্ডকারখানা দেখছি। তবে পাথরটার মধ্যে সত্যিই যেন কী একটা আছে। আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো সেটার সৌন্দর্য দেখছি। সাদা পাথর তো কম দেখিনি জীবনে। কিন্তু এই সাদার মধ্যে কেমন যেন অন্যরকম একটা আভিজাত্য আছে।
লোকটা পাথরটা আমাকে দিতে গিয়েও কী মনে করে বলল, ‘আমি আর কিছুক্ষণ এটাকে সাথে রাখি?’
বললাম, ‘বেশ তো রাখুন না! আমার স্টেশন আসতে এখনো অনেক দেরি আছে। আপনি যদি বেশি তাড়াতাড়ি না নেমে পড়েন তাহলে আরও অনেকক্ষণ সময় পাচ্ছেন এটাকে ধরে রাখার।
‘আমি পরের ষ্টেশনেই নেমে যাব!’ লোকটা থমথমে মুখে বলল।
এরপর বেশ কিছুটা সময় লোকটা পাথরটাকে কোলের ওপরে বসিয়ে ডায়েরি খুলে কী যেন লিখতে লাগল। আমার উপস্থিতি যেন সে বেমালুম ভুলেই গেছে! আমিও তাকে বিরক্ত না করে জানালার বাইরে চোখ দিলাম। ট্রেনের গতি একটু যেন মন্থর। স্টেশন কি চলে এলো?নাকি অন্য কারণে ধীরে চলছে?
আমি ট্রেনে ওঠার পর থেকেই আমার সামনে বসা এই ভদ্রলোক আর তার পাথর নিয়ে এত বেশি মশগুল হয়ে পড়েছিলাম যে, নৈসর্গের শোভা আমার চিন্তা থেকে দুরই হয়ে গিয়েছিল!
সব ভাবনা ভুলে আমি এখন সেই নৈসর্গিক শোভা দেখায় মনোযোগী হলাম। কিন্তু অল্প কিছু সময় পরেই বুঝতে পারলাম, পাথরটার কথা ভুলতে পারছি না। আমার চিন্তায় এলোমেলোভাবে সেই পাথরের কথাই ঘুরেফিরে আসছে। একটা পাথর কীভাবে ভাগ্য ফেরায়? লোকে হাতে যে পাথরের আংটি পরে এও কি সেরকম কিছু? কিন্তু আমি জীবনে কোনও দিন এসব বুজরুকিতে বিশ্বাস করিনি। লোকটার অনুরোধ আর পাথরটার সৌন্দর্য আমাকে যেন কেমন হতবিহ্বল করে ফেলেছে!
কিন্তু ভাগ্য পরিবর্তনের কথাটাকেও একেবারে ফিরিয়ে দিতে পারছি না। সত্যিই যদি এমন কিছু হয়? বলা তো যায় না! লোভের খুব সূক্ষ্ণ একটা চোরা কাঁটা আমার ভেতরটাকে চুপিসারে একটা খোঁচা মেরে গেল।
আবার সামনে চোখ ফেরালাম এবং একটা ধাক্কা খেলাম। লোকটা নেই! তার সেই থলেটাও নেই। আরে! কী আশ্চর্য! চলন্ত ট্রেনে কোথায় গেল লোকটা? নাকি দিতে চেয়েও মন ঘুরিয়ে ফেলেছে? হয়ত ক্ষণিকের ভুলে দিতে চেয়েছিল। এখন আবার দিবে না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। হুম... তাই হবে! মনের অজান্তেই একটু মন খারাপ হলো। ইস! এটুকু সময়েই পাথরটার প্রতি কেমন একটা মায়া জন্মে গেছিল!
লোকটা কিন্তু অল্পসময়ের মধ্যেই আবার ফিরে এলো। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘আরে! কোথায় গিয়েছিলেন?’
লোকটা নাকমুখ কুঁচকে উত্তর দিলো, ‘টয়লেটে গিয়েছিলাম। ট্রেনের টয়লেটের কথা আর কী বলব ভাই... যাকগে!’
আমি চোখের কোনা দিয়ে লোকটার দিকে তাকালাম। তার কাঁধে থলে। কী আজব! সে থলে নিয়েই টয়লেটে গিয়েছিল। চলন্ত ট্রেনের টয়লেট থেকে থলিটা অনায়াসেই পড়ে যেতে পারত। আর তাছাড়া এখানে রেখে গেলে কী হতো? আমাকে বিশ্বাস করতে পারছে না?পাথর তো সে আমাকে দিয়েই দিয়েছে! এখন আর লুকিয়ে রেখে কী হবে? হয়ত থলির মধ্যে আরও কোনও মূল্যবান জিনিস আছে, মনে মনে ভাবলাম।
অবশেষে লোকটা তার পাথরটা বের করে আমার হাতে ধরিয়ে দিলো। আর কোনও মায়া মহব্বত না দেখিয়ে বলল, ‘পাথরটার প্রতি কীসের যেন একটা মায়া জন্মে গেছে ভাই। এখন থেকে এটা আপনার।’
বলেই সে আর দাঁড়াল না। আমি খেয়াল করলাম, ট্রেন থেমে গেছে। লোকটার স্টেশন এসে গেছে। সে আমার দিকে একটা বিদায়ী দৃষ্টিপাত করে ট্রেন থেকে নেমে পড়ল। আমি জানালার কাছে সরে এসে লোকটাকে দেখতে চেষ্টা করলাম। বেশিক্ষণ দেখতে পেলাম না। সে খুব দ্রুত ভিড়ের মধ্যে মিশে গেল।
এবারে আমি তাকালাম পাথরটার দিকে। আগেই বলেছি শ্বেতশুভ্র তার গড়ন। চেহারাতে রাজকীয় আভিজাত্য। দেখে চোখ সরতে চায় না। হাতে নিতেই সে যেন আশ্লেষে আমার দুই হাতের তালুর মধ্যে নিজের পুরো শরীরটাকে এলিয়ে দিলো। আমি পাথরটা হাতে নিয়ে ওপরে ছুঁড়ে মারলাম। কী আশ্চর্য! পাথরটা দিব্যি ওপরে উঠে আবার নিখুঁত লক্ষ্যভেদে আমার হাতে ফিরে এলো। অথচ আমি জীবনে কোনোদিন এরকম কোনও কারিকুরি দেখাইনি। আজ যেন এটাকে হাতে নিতেই আমি দারুণ এক খেলোয়াড় হয়ে উঠলাম।
মনের মধ্যে অজানা এক শক্তি টের পেলাম। সারা শরীরে যেন টগবগে তাজা রক্তের ছোটাছুটি শুরু হয়ে গেল। এই শক্তির উৎস আমার জানা নেই। লোকটার কথাগুলো মনে হচ্ছে ভুল না। জীবনের সুদিন বুঝি খুব দূরে নয়!
পেশায় আমি একজন ছাপোষা কেরানি। দিন আনি দিন খাই দশা না হলেও আহামরি কিছু নয় মোটেও। মাসের আয় মাস শেষে আর হাতে থাকে না। গিন্নির দুটো শখ আবদার মেটাতে পারি না। বহুদিন চাকরি ছেড়ে ব্যবসা করার কথা চিন্তা করেছি। কিন্তু ব্যবসা করতে শুধু যে মূলধনই লাগে তা নয়, হিম্মতও থাকা চাই।
আজ জানি না কেন, পাথরটা হাতে নিতেই একটা অন্যরকম সাহসও পেলাম মনে। মনে হলো, ব্যাংকে সামান্য যেটুকু টাকা আছে, আর বিয়ের সময় শশুরবাড়ি থেকে পাওয়া বউয়ের কিছু গয়না… সব জড়ো করলে বেশ কিছু টাকারই তো জোগাড় হয়। অনলাইনে আজকাল অনেকেই নানা কিছু করছে। হাউজহোল্ড আইটেম, মেয়েদের রেডিমেড ড্রেস অনেক কিছুরই ব্যবসা করা যেতে পারে। আমি জিনিসপাতি কিনে আনব, বউ সেগুলো অনলাইনে লাইভ করে মানুষকে দেখাবে। আমার বউয়ের মতো এত রসিয়ে কসিয়ে কজন কথা বলতে পারে?শুধু একটাই সমস্যা। গহনাটা তার কাছ থেকেই আদায় করতে হবে। বউয়ের কাছে গয়না চাইলে তো আর এমনি এমনি দিবে না! বলতে হবে, তাকে ব্যবসার ফিফটি ফিফটি পার্টনার বানিয়ে নিব। এটা বললে হয়ত আপত্তি করবে না।
ভাবতে ভাবতেই অজানা আগ্রহ আর উত্তেজনায় একেবারে চনমনে হয়ে উঠলাম। আমার গন্তব্যে যখন নামলাম, তখন নিজেই যেন নিজেকে চিনতে পারছিলাম না!
বাসায় গিয়ে আমার বউ সুমনার কাছেও একই কমপ্লিমেন্ট পেলাম।
‘কী গো, দেশের বাড়িতে গিয়ে তো দেখি একদিনেই ভোল পাল্টে গেছে তোমার! এত ফুরফুরে দেখাচ্ছে! এতক্ষণ ট্রেনে বসে ছিলে, ক্লান্ত লাগছে না?’
উত্তরে আমি শুধু হাসলাম। পাথরের কথাটা বলতে গিয়েও শেষ মুহূর্তে চেপে গেলাম। আগে দেখি কী হয়। এখনই অত বেশি পাঁচ কান করার দরকার কী! সত্যি সত্যিই যদি সৌভাগ্যের দেখা পাই, তাহলে হাতবদলের সময় আসার অনেক আগেই পাথরটা অন্য কেউ বগলদাবা করে নিয়ে যাবে। মেয়েমানুষের পেটে তো কথা থাকে না। দেখা যাবে, কালকের মধ্যেই আশেপাশের পাড়া প্রতিবেশী সবাই পাথরের কথা জেনে বসে আছে!
আমি বাসায় ফিরে খুব সাবধানে আমার জামাকাপড়ের ড্রয়ারের মধ্যে কাপড়ের ভাঁজের আড়ালে পাথরটাকে লুকিয়ে রাখলাম। আমার জীবনে আয় উন্নতি বাড়লেই হলো। সবার সামনে পাথরটাকে নিয়ে আসার তো কোনও দরকার নাই। আর যখন অন্য কাউকে দেওয়ার সময় হবে, সেই সময় কী করা যায় ভেবে দেখব। এত জলদি ভাবার কোনও দরকার নাই।
পরেরদিন সারাবেলা অফিসে কাজ করলেও মনের মধ্যে পাথরটা চেপে বসে থাকল। হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখার জন্য মন আনচান করতে লাগল। বাসায় ফিরেই আর দেরি করলাম না। বউয়ের চোখকে ফাঁকি দিয়ে সোজা চলে এলাম আমার ঘরে। ড্রয়ারের কাপড়চোপড়গুলো সরিয়ে বের করে আনলাম পাথরটাকে। কিছুটা সময় নেড়েচেড়ে দেখে এত যে সুখ পেলাম! মনে হলো, অদ্ভুত একটা শান্তি আমার মনের ভেতরটাকে যেন শীতল করে দিচ্ছে।
সুমনাকে পটিয়ে পাটিয়ে গয়নাগুলো নিতে পেরেছি। শুনে প্রথমে একটু আপত্তি যে করেনি তা নয়। কিন্তু আমিও নিখুঁত বক্তার মতো আমার বাকপ্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছি। ইনিয়ে বিনিয়ে বুঝিয়েছি ব্যবসাটা দাঁড় করাতে পারলে আমাদের কত ভালো হবে! এই কেরানিগিরি করে কতদিন আর চলবে? সুমনা শুধু আশঙ্কা দেখিয়ে বলেছে, ‘কিন্তু ব্যবসায় যদি লস হয়? এতগুলো টাকা... আমার গয়না... সব তো পানিতে যাবে! আমরা তো একেবারে রাস্তায় নেমে যাব!’
আমিও সাহস দিয়ে বলেছি, ‘এভাবে চিন্তা করলে তো জীবনেও কিছু করতে পারব না। নো রিস্ক নো গেইন!’
‘কিন্তু কীসের ব্যবসা করবে? বললেই কি ব্যবসা করা যায়? বুদ্ধি লাগে না?’
‘আরে কীসের বুদ্ধি! তুমি গুছিয়ে কথা বলতে পারবে না? আমি মেয়েদের ড্রেস কিনে আনব পাইকারি রেটে। আমার বন্ধু রাজীব তো কাপড়ের ব্যবসাই করে। ওর কাছ থেকে বুদ্ধি নিব দরকার হলে। অনলাইনে ব্যবসা করব। শুরুতে অল্প করেই করব। পরে অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা!’
সুমনা আর কথা বাড়ায়নি বটে, কিন্তু মুখটা সারাদিন হাঁড়ির মতোই করে রেখেছে।
আমার তখন অন্যরকম গিয়ার! শুরু করব বলে আর এক মুহূর্তও দেরি করতে ইচ্ছে করছে না। পরদিনই গিয়ে রাজীবের সঙ্গে শলাপরামর্শ করলাম। শুরুতে তেমন একটা গুরুত্ব না দিলেও পরে সে ঠিক বুঝতে পারল, আমি ব্যবসার ব্যাপারে সিরিয়াস। রাজীব কিছু ভালো পরামর্শ দিলো। বলল, প্রথমে ওর সঙ্গে গিয়ে পাইকারি বাজারগুলো একটু চিনে নিতে। তারপর রুচি অনুযায়ী লেডিজ ড্রেস পছন্দ করে এনে বিসমিল্লাহ বলে কাজে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে।
এরপরের ছয়টা মাস আমার জীবনের ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ একটা সময়। কোথা দিয়ে যে কী হয়ে গেল, আমি ভেবেও কোনও কুলকিনারা পেলাম না। শুধু একসময় বুঝতে পারলাম, যে টাকা আয় করতে এতদিন রক্ত পানি করে পরিশ্রম করেছি, সেই টাকা কত অনায়াসেই আমার হাতের মুঠোয় এসে ডিগবাজী খাচ্ছে।
সুমনার অবস্থা হলো দেখার মতো। সে এত টাকা জীবনে দেখেনি। অবশ্য আমিই কি দেখেছি? প্রতিদিন প্রায় শ’খানেক ড্রেস সেল হতে লাগল। নিয়মিত লাইভে আসতে আসতে সুমনা ক্লান্ত হয়ে পড়তে লাগল। তবু টাকার আমদানি দেখে কোনও কিছু ছাড়তেও পারে না। ওর বেহাল দশা দেখে আমিই ভালো বেতন দিয়ে দুজন লেডি এসিস্ট্যান্টের ব্যবস্থা করে দিলাম। প্রতিদিন শুধু অর্ডার নিয়ে আর হিসাব কষেই বেচারিরা হাঁপিয়ে ওঠে।
হু হু করে আয় উন্নতি বাড়তে লাগল। একসময় আমার চাকরি করার প্রয়োজনও ফুরিয়ে এলো। অনেক মানুষের প্রশ্নবোধক দৃষ্টিকে উপেক্ষা করে আমার এতদিনের চাকরিটা থেকে ইস্তফা নিয়ে নিলাম।
দিন শেষে আমি আর সুমনা বসে বসে টাকার হিসাব করতাম। ভুল হয়ে যেত বারবার। হাসতে হাসতে আবার সেই ভুল শুধরিয়ে নিয়ে নতুন করে হিসাব করতে বসতাম। দুজনে হতবিহবল হয়ে টাকার মাঝখানে বসে বসে ভাবতাম, স্বপ্ন দেখছি না তো!
জীবনের কত কত না পাওয়া সাধ আর স্বপ্ন ছিল, ভাবিনি যেসব কোনওদিন পূরণ করতে পারব। একটা বাড়ি করার স্বপ্ন দেখতাম। দামি একটা গাড়ি, বিদেশে ঘুরতে যাওয়া...কত কত না পাওয়া সাধ এতদিন সাধ্যের অভাবে ধুঁকে ধুঁকে মরত। এতদিনে সময় এলো সেই স্বপ্নগুলোকে সত্যে পরিণত করার।
প্রথমেই একটি বাড়ি কিনব বলে ঠিক করলাম। ঢাকা শহরে নিজের একটা বাড়ি হবে, এই দুরাশাও করিনি কখনও। দুই বছর আগেও মনে করেছিলাম, যেন তেন জায়গায় মাথা গোঁজার কিছু একটার মালিক হতে পারলেই জীবন ধন্য হয়ে যাবে। এখন কিন্তু সেটি আর ভাবতে পারলাম না।
সুমনার তেমন উচ্চাশা ছিল না। সে একটা বাড়ি পেলেই খুশি। কিন্তু আমি ঠিক করলাম বাড়ি করতে হলে গুলশান বনানী অথবা বারিধারার বাইরে করব না। টাকা যখন আসছেই, ইচ্ছেগুলোর কেন হাত পা বেঁধে রাখব?
এদিকে টাকার আমদানি কিন্তু এখনো আগের মতোই সচল। অনলাইনের পাশাপাশি এখন এলিফ্যান্ট রোডেও একটা অফিস ভাড়া নিয়েছি। তাই বলে অনলাইনের ব্যবসাতে গুরুত্ব কম দিচ্ছি না। দুইজন মেয়ে এসিস্টেন্টের সাথে আরও একজনকে কাজে নিয়োগ দিয়েছি। অনলাইনের বেচাকেনা থেকে শুরু করে লাইভ করার ব্যাপারটাও এখন ওরাই দেখে। সুমনা মাঝে মাঝে শুধু এটা সেটা নির্দেশ দেয়।
এলিফ্যান্ট রোডের অফিসে কয়েকজন পুরুষ সেলসম্যান রেখেছি। মার্কেটিং এর দিকটা আমি দেখাশোনা করি। তবে সেলসের ব্যাপারটা সেলসম্যানরাই সামলায়। ওখানে আমি হাত ঢোকাই না।
এর মধ্যে একবার রাজীব এসেছিল আমার সঙ্গে দেখা করতে। ওকে এলিফ্যান্ট রোডের দোকানের এড্রেসটা দিয়েছিলাম। রাজীব সব দেখেশুনে হাঁ হয়ে বলল, ‘এসব কী এলাহি কারবার করে ফেলেছিস রে! মাত্র এই দু’বছরে এসব তো রীতিমত অসম্ভব ব্যাপার! ঠিক করে বল তো আলাদীনের চেরাগের সন্ধান পাসনি তো?’
রাজীবের চোখে আমি কীসের যেন একটা ছায়াকে নেচে বেড়াতে দেখলাম। ছোটবেলার বন্ধুর জন্য সেই চোখে যতটা না ভালোবাসা ছিল,সূক্ষ্ণ এক ঈর্ষার দাপাদাপি ছিল অনেক বেশি।
খারাপ লাগতে গিয়েও লাগল না। উল্টো এক অন্যরকম আত্মতৃপ্তিতে বুক ফুলে উঠল। আজ রাজীবও আমাকে ঈর্ষা করতে বাধ্য হচ্ছে! অথচ এমন একটা সময় ছিল যখন আমার বাসায় পা দেওয়ার মতো সময়ও রাজীবের হতো না। কখনও দেখা করতে চাইলে ওর বাসায় কিংবা দোকানে দেখা করতে বলত। নিজে কখনও আমার বাসায় আসত না। এটা সেটা কথার ফাঁকে হাতে জোর করে টাকা গুঁজে দিত। সেই দান গ্রহীতার কাজে লাগত ঠিকই, কিন্তু দাতার উচ্চ অবস্থানের অহংকারটাও একেবারে অদেখা থাকত না। আজ এতদিনে তাহলে উল্টো সুর বাজছে আমাদের জীবনে!
(পরের পর্বে সমাপ্ত। পরের পর্ব আসবে ইনশাআল্লাহ আগামিকাল)
#ফাহ্মিদা_বারী
২| ১৬ ই অক্টোবর, ২০২৫ রাত ১১:৩৫
জেনারেশন একাত্তর বলেছেন:
“The Monkey’s Paw”এর অনুকরণে।
মন্তব্য মুছে লাভ নেই, রিজিকে যা আছে তা হবে।
১৭ ই অক্টোবর, ২০২৫ রাত ১২:০৯
ফাহমিদা বারী বলেছেন: কুত্তার ঘেউ ঘেউ শুনতে ইচ্ছা করে না বদমাশ! বুঝিস না? যা ভাগ! ছেই ছেই!
৩| ১৬ ই অক্টোবর, ২০২৫ রাত ১১:৫৯
মোঃ খালিদ সাইফুল্লাহ্ বলেছেন: পরের পর্বের অপেক্ষায়। খুব সুন্দর লিখেছেন।
১৭ ই অক্টোবর, ২০২৫ রাত ১২:১১
ফাহমিদা বারী বলেছেন: ধন্যবাদ। আগামীকাল ইনশাআল্লাহ।
৪| ১৭ ই অক্টোবর, ২০২৫ রাত ১২:০৩
মোঃ খালিদ সাইফুল্লাহ্ বলেছেন: জেনারেশন, পাবনা!!! পাবনা ভর্তি হলে মাথার গোলমাল কমবে। সবার পোস্টে লেদিয়ে লাভ হবে না।
১৭ ই অক্টোবর, ২০২৫ রাত ১২:১১
ফাহমিদা বারী বলেছেন: ব্লক করার সিস্টেম আছে ভাই? থাকলে জানায়েন। লোকটাকে আপনে বলে সম্বোধন করতেও আজকে আর ইচ্ছা করল না। এখন হয়ত আমার বংশের পরিচয় নিয়ে কথা বলতে আসলে। সে যে সারমেয় শ্রেণীর অন্তর্ভূক্ত, এটা তারে কে বোঝায় বলেন দেখি? আল্লাহপাকের রহমত আছে বলেই আমি মানুষ, সে ব্যাটা বেজন্মা সারমেয়। বোঝে না!
৫| ১৭ ই অক্টোবর, ২০২৫ রাত ১২:১৬
অপু তানভীর বলেছেন: আপনি নেড়ি কুকুরটাকে এখনও ব্লক করেন নাই? এর ঘেউ ঘেউ তো থামবে না। চলতেই থাকবে।
এই পোস্টে গেলে বুঝতে পারবেন কিভাব ব্লক করতে হয়।
১৭ ই অক্টোবর, ২০২৫ রাত ১২:১৮
ফাহমিদা বারী বলেছেন: অনেক কৃতজ্ঞ হলাম অপু ভাই। এখুনি যাচ্ছি।
১৭ ই অক্টোবর, ২০২৫ রাত ১২:২৮
ফাহমিদা বারী বলেছেন: সমস্যা হচ্ছে। 'অনুগ্রহ করে আবার চেষ্টা করুন' এটা দেখাচ্ছে। নেড়ি কিছু করে রেখেছে কী না কে জানে!
৬| ১৭ ই অক্টোবর, ২০২৫ রাত ১২:২৯
অপু তানভীর বলেছেন: নিক আইডি ঠিক মত কপি করে নিষিদ্ধ তালিকাতে যোগ করুন। তাহলেই হবে।
১৭ ই অক্টোবর, ২০২৫ রাত ১২:৩০
ফাহমিদা বারী বলেছেন: নিক আইডি মানে তো তার প্রোফাইলের লিংক তাই না?
৭| ১৭ ই অক্টোবর, ২০২৫ রাত ১২:৩২
অপু তানভীর বলেছেন: না না লিংক না।.......blog.net/blog/FahmidaBari
আপনার নিক FahmidaBari । ঠিক তেমন ভাবে তার নিকটা কপি করে তালিকাতে যোগ করুন। পুরো লিংক না। শুধু এই নিক টুকু।
১৭ ই অক্টোবর, ২০২৫ রাত ১২:৩৮
ফাহমিদা বারী বলেছেন: আলহামদুলিল্লাহ পারছি ভাই! ইয়াহু!!
৮| ১৭ ই অক্টোবর, ২০২৫ রাত ১২:৪৩
অপু তানভীর বলেছেন: এই যে নিজের ব্লগ বাড়ি থেকে পাথি মেরে দুর করলেন এবার দেখবেন আপনি যে যে পোস্টে মন্তব্য করবেন সেই সেই পোস্টে আপনার মন্তব্যের নিচে গিয়ে ঘেউ ঘেউ করবে। তারপর নিজের পোস্টে আপনার নাম নিয়ে ঘেউ ঘেউ করবে।
এটাই হচ্ছে স্বভাব। একেবারে পিউর দেশি নেড়ির যেমন স্বভাব, সব এটার ভেতরে আছে।
১৭ ই অক্টোবর, ২০২৫ রাত ১:৩৪
ফাহমিদা বারী বলেছেন: এটা যে সে করবে আমি খুব জানি। তবু ভালো। অন্তত কিছু একটা পোস্ট দিয়ে তো শান্তিতে থাকতে পারব!
৯| ১৭ ই অক্টোবর, ২০২৫ রাত ১২:৪৪
মোঃ খালিদ সাইফুল্লাহ্ বলেছেন: লেখক বলেছেন: যা ভাগ! ছেই ছেই!
১৭ ই অক্টোবর, ২০২৫ রাত ১:৩৫
ফাহমিদা বারী বলেছেন: হাহাহা..
এটা আমার দাদি বলতেন। দাদি গ্রামের মানুষ ছিলেন। কুকুরকে ছেই কুত্তা ছেই ছেই বলে তাড়াতেন
১০| ১৭ ই অক্টোবর, ২০২৫ রাত ১২:৫২
মোঃ খালিদ সাইফুল্লাহ্ বলেছেন: লেখক বলেছেন: লোকটাকে আপনে বলে সম্বোধন করতেও আজকে আর ইচ্ছা করল না।
আমি যে মন্তব্য করেছি সেখানে ঠিক আপনার এই অনুভূতিই আমার মাঝেও কাজ করেছে। ভর্তি হোন এই আপনি সম্বোধন করতেও ইচ্ছে হয় নি!! তাই প্যাসিভে মন্তব্য লিখেছি! ৪ নং মন্তব্য দ্রশটব্য!
১৭ ই অক্টোবর, ২০২৫ রাত ১:৩৫
ফাহমিদা বারী বলেছেন: তবু আপনি ধৈর্য রাখতে পেরেছেন। আমি আজকে আর পারলাম ই না! মাঝখান থেকে আমার গল্পের দফা রফা। কেউ আর এখানে গল্প পড়তে আসবে না। গ্যাণজাম দেখতে আসবে।
©somewhere in net ltd.
১|
১৬ ই অক্টোবর, ২০২৫ রাত ১১:০৮
সৈয়দ কুতুব বলেছেন: পড়ার পর্ব পড়ার অপেক্ষায় থাকলাম।