নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

কদম ফুল

এস্ এম্ হাসান

আমি প্রচুর হাসতে পারি; বোকার মত!

এস্ এম্ হাসান › বিস্তারিত পোস্টঃ

ডালি

২৯ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৬ বিকাল ৩:২৩

ডালি ঘুমিয়ে আছে। ঘুমন্ত ডালিকে একদম বাচ্চার মত মনে হচ্ছে। কপালে হাত দিয়ে শরীরের তাপ দেখলাম। না, জ্বর নেই। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে আছে। ঠোট দুটো ইষৎ ফাক। রেশমের মতো মসৃণ কালো চুলগুলো বালিশের উপর ছড়িয়ে আছে, কয়েকটা চুল ডালির গাল বেয়ে দু’ ঠোটের ফাক গলে মুখে ঢুকে পড়েছে। অবাধ্য চুলগুলো আলতো হাতে সড়িয়ে দিই।

গতকয়দিনের জ্বরের তাড়নায় ডালি প্রলাপ বকছিল। অজ্ঞান হয়ে পড়ছিল বার বার, আর জ্ঞান ফিরতে শরীর প্রচন্ড কাঁপছিল, জড়ানো ক্ষীণ গলায় বকে যাচ্ছিল অনর্গল, যেটুকু বুঝা যাচ্ছিল তাতে উগ্র ভালবাসার প্রকাশ আর বেশির ভাগই দুর্বোধ্য। বকতে বকতে কন্ঠ ক্ষীন হয়ে আসছিল এবং আবার আমার বুকের উপরেই অজ্ঞান হয়ে পড়ছিল।

এ কয় দিনে একটা কঠিন পরীক্ষাই দিতে হয়েছে। সংসার আর বাচ্চা সামলাতে একেবারে গলদঘর্ম, পদে পদে বিপাকে পড়তে হয়েছে। হাবিবা নিজের মেয়ে হলেও গালটিপে আদর আর চুমু খেয়ে স্নেহ প্রকাশ ছাড়া অন্যকিছু কখনো করতেই হয়নি আমাকে। তাই হঠাৎ ডালি এমন অসুস্থ হয়ে পড়ায় বেশ মুসকিলেই পড়তে হয়েছে। গত চারদিনে অবশ্য ঘরকন্নার একটা ট্রেনিং হয়ে গিয়েছে। চাল ফুটিয়ে ভাত রান্না আর ডিম ভাজিটা অবশ্য আগেই জানতাম- এ চারদিনে আরো কিছু রান্না কাজ চালিয়ে নেওয়ার মত করে শিখা হয়েছে।

গত তিনদিন বাসা ছেড়ে কোথাও যাইনি, যেতে পারিনি। মদের গ্লাস ঠোট সাপর্শ করেনি, লিলির সাথেও দেখা হয়নি, ফোনেও কথা হয়নি। লিলি বার বার কল দিলেও রিসিভ করিনি। ডালির জ্বরের সময় বার বার আল্লার নামে শপথ করছিলাম আর মদ ছোঁব না, লিলির মুখ দেখার ইচ্ছাও করব না; শুধু ডালিকে সুস্থ করে দাও। গতরাত থেকে ডালির আর জ্বর আসেনি; এরই মধ্যে মদের জন্য মাতাল হয়ে উঠেছি মনে মনে। লিলির ফোনের জন্য অধীর হয়ে উঠছি। আমিই ফোন দিতে পারি তবু শপথ করেছি বলে কিছুতেই ফোন দিতে মন সরছিল না।
ডালির রোগ ক্লিষ্ট মুখের দিকে তাকিয়ে বার বার মনে হচ্ছিল, "না তারেক, ডালিকে আমি সুখী করতে পারিনি!" আসলে চেষ্টাওতো করিনি! আমার নিজের অপরাধইতো ডালিকে সবচেয়ে বেশি কষ্ট দিচ্ছে।
যদি তারেক জানতে পারে, তার কলজের টুকরা ছোটবোনটিকে আমি যে নরক যন্ত্রনা দিচ্ছি তবে কী করবে? আমাকে খুন করবে? করতেও পারে। ডালির জন্য তারেক সব করতে পারে।
আমি আবার ডালির মুখের দিকে আগ্রহ নিয়ে তাকাই। ডালি ঘুমিয়ে আছে নিরাবেগ- কোন রাগ বা অভিযোগ নেই। আমি প্রতিদিন মাতাল হয়ে যখন ঘরে ফিরতাম দরজায় টোকা দেয়ার সাথে সাথে খুলে যেত। বুঝতাম ডালি এ টোকার জন্যই অপেক্ষা করছে। দরজা খুলে ঠিক এমনি নিরাবেগ নিষ্পলক তাকিয় থাকে। আমি লজ্জায় ভেতরে ভেতরে কুকড়ে যেতে থাকি, মদ পানের জন্য অনুশোচনা নিজেকে পুড়তে থাকে। অন্তরের অনুশোচনা বা লজ্জা যেন বাইরে প্রকাশ না পায় তাই আমি সিনা টানটান করে দাড়ানোর ব্যর্থ চেষ্টা করে দুলতে থাকি। তারপর ধীরে ধীরে দরজার একপাশে সড়ে দাড়ায় ডালি। আমি টলতে টলতে সসংকোচে নিজের ঘরে প্রবেশ করি।
এটা এখন প্রতিদিনের রুটিনে দাড়িয়েছে। তারপর গত চারদিন ডালির জ্বর এসে রুটিনে ব্যতিক্রম করে দিয়েছে। আমিও মনে মনে এমনটাই চাচ্ছিলাম- এমন একটা কিছু ঘটুক যাতে এটা পরিবর্তন হয়। আমি প্রতিদিন সকালে মনে মনে শপথ করি আর না। আজ কিছুতেই মদ পান করব না, লিলির দিকে ফিরেও দেখব না। কিন্তু বেলা বাড়ার সাথে সাথে সূর্যের তাপে শিশির কনার মত আমার শপথও বাষ্প হয়ে উড়ে যায়। এদের আমি ছাড়তে চাই কিন্তু এরা আমায় চোরাবালির মত নিচের দিকে টানতে থাকে। পতঙ্গ জানে না যে আগুনে ঝাপ দিলে তাকে পুড়ে মরতে হবে, তাকে হয়তো দোষ দেওয়া যায় না। কিন্তু যদি কেও জেনে পরে আগুনে ঝাপ দেয়!

ডালির ভাবলেশহীন ঘুমন্ত মুখটার দিকে আবার তাকাই, রোগক্লিষ্ট ও ক্লান্ত দেখাচ্ছে। বাঁ হাতের আঙ্গুলগুলোকে চিরুনির মত করে ডালির চুলগুলোতে আলতো করে বিলি কাটতে শুরু করেছি। একটু ভালবাসা প্রকাশ করতে ইচ্ছা হচ্ছে। ডালির শুকনো ঠোটদুটো স্পর্শ করতে আমার ঠোটদুটো ধীরে ধীরে নিচে নামছিল, ডালি দীর্ঘস্বাস ফেলে ঘুমের মধ্যেই পাশ ফিরল। আমি অপ্রয়োজনেই লজ্জাবোধ করলাম। আমার হাতটা ডালির মাথায় কখন থেমে গিয়েছে লক্ষ করিনি; আবার আলতো করে বিলি কাটতে শুরু করলাম।
ডালি আমার দিকে পেছন ফিরে শুয়ে আছে, তবু আমি বুঝতে পারলাম তার ঘুম ভেঙেছে। আমি আলতো করে চুলে বিলি কাটতে থাকলাম। ডালি আমার হাতটা তার মুঠার মধ্যে নিয়ে গালের সাথে চেপে ধরে আছে- বেশ শক্তভাবে। একটু পর পাশ ফিরে আমার দিকে একটুক্ষণ তাকিয়ে থেকে চোখ বন্ধ করল, হাতের মুঠোয় এখনো আমার হাতটা ধরা- ছাড়ল না বা মুঠো সিথিলও হল না। একটু পর যেন হঠাৎ মনে পড়েছে এমনি স্বরে বলল, আজ অফিস নেই?
আমি অন্যহাতটা ডালির কপালে রেখে বললাম, আজ যাব না।
আমার হাতটা মুঠা থেকে ছেড়ে দিয়ে তাড়া দিয়ে বলল, কেন! না, যাও।
-তোমার শরীর ভাল নেই।
ডালি আমার দিকে তাকিয়ে একটু হাসল কিন্তু অফিস যাওয়ার জন্য বারবার পিড়াপিড়ি করতে শুরু করল। মনে হচ্ছিল যেন আমি অফিসে গেলেই সে বেশি খুশি হবে কিন্তু আমার ইচ্ছা করছিল ডালির পাশটাতে বসে আজকের দিনটা কাটিয়ে দেই। তারপরও ডালির পিড়াপিড়িতে শেষ পর্যন্ত অফিসের উদ্দেশ্যে বের হলাম। ডালির কপালে হাত রেখে বললাম, আমি তারাতারি চলে আসব।

ভয় ছিল বস্ অফিস কামাইয়ের জন্য বকাবকি করেন কীনা! না, এ নিয়ে তিনি কিছুই বললেন না, ঘটনাটা খুবই ব্যতিক্রম। অফিসে সবাই আমার দিকে কেমন সহমর্মিতার নজরে তাকাচ্ছিল। একজনতো আগবাড়িয়ে এসে বলল, যায়েদ সাহেব, হতাশ হবেন না; ধৈর্য ধরুন, সব ঠিক হয়ে যাবে।
আমি অবাক হচ্ছিলাম সবাই কেমন করে জেনে গেছে যে, আমার স্ত্রী অসুস্থ- সবাই সহমর্মিতা প্রকাশ করছে, ভাল লাগল। সেদিন কে যেন বলছিল, এই অফিসের সবাই আমরা একটা ফ্যামিলি, ঠিকই বলেছিল।
কয়েকদিনের অসুপস্থিতিতে অনেক কাজ জমে ছিল। তাছাড়া চারদিন পর অফিসে এসে আবার ছুটি চাওয়া ভাল দেখায় না- অন্যের অধীনে চাকরিতো!
অফিস করতে করতে মনে মনে ভয় মিশ্রিত আশা ছিল এখনই লিলির সাথে দেখা হবে। শেষ পর্যন্ত লিলির সাথে আর দেখা হল না, মনে হচ্ছিল বেঁচে গেছি, লিলির সাথে দেখা হলে তাকে এড়িয়ে যাওয়া আমার জন্য সহজ হতো না।

নুরু আর আমি একসাথে অফিস হতে বের হলাম যখন তখন সন্ধ্যা হতে আর বেশি বাকি নেই। হাটতে হাটতে জিজ্ঞেস করলাম, আজ লিলি আসেনি?
নুরু অবাক হয়ে আমার দিকে তাকায়। আমার চেহারা পড়ার চেষ্টা করে। তারপর বলে, আপনি যানেন না?
আমি কিছু না বলে তাকিয়ে থাকি যার অর্থ 'না' ধরে নিয়ে নুরু বলে, তাহলে গত তিন দিন অফিসে আসেননি কেন?
স্ত্রী অসুস্থ ছিল বলার পর নুরু বলে, অ্, আমরাতো ভেবে ছিলাম......! তারপর একটু চুপ থেকে বলে, লিলিতো গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলে পড়েছে।
আমি অবাক হয়ে বলি, সেকি!
নুরু বলে, আমরাও কম অবাক হইনি।
আমি বলি, কিন্তু কেন আত্মহত্যা করল?
নুরু এবার হাসতে হাসতে বলে, আত্মহত্যা, হ্যা আত্মহত্যা- তবে বিয়েটা ছেলেদের জন্য যতটা আত্মহত্যা মেয়েদের জন্য ততটা নয়।
আত্মহত্যার মধ্যে আবার বিয়ে এল কেত্থেকে বুঝতে না পেরে অনেকটা নিজে নিজেই বলি, বিয়ে!
নুরু বলে, হ্যা, একেবারে এরেন্জন্ড ম্যারেজ।
তারপর নুরু ঘটনাটা বিস্তারে বলল। লিলি বিয়ে করেছে। চাকরি ছেড়ে দিয়ে বরের সাথে দেশ ছাড়ছে। নুরু ভেবেছিল খবর শুনে আমি একেবারে ভেঙে পড়ব, হয়তো কেঁদেও ফেলতে পারি। কিন্তু আমার হাসি মুখ দেখে সে অবাক হল, বোধ হয় একটু হতাশও হল- অন্যের দুখে একটু সান্ত্বনা দেওয়ারও একটা আনন্দ আছে যা থেকে নুরু বঞ্চিত হল।

নুরু থেকে বিদায় নিয়ে ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। মনে মনে বেশ কুন্ঠিত হয়ে বাসার সামনে এসে দাড়ালাম। কলিংবেলটা অনেকদিন হল নষ্ট হয়ে আছে, দরজায় টোকা দিলাম। টোকা দেওয়ার সাথে সাথেই দরজা খুলে গেল, বুঝলাম এ টোকার জন্যই ডালি অপেক্ষা করছিল।
আমার ফিরতে দেরি দেখে ডালি বোধ হয় ভেবেছিল রোজকার মত আমি মাতাল হয়েই ফিরব। কিন্তু যখন নিশ্চিত হল তেমন কিছু হয়নি তদুপরি আমি দেরি হবার জন্য কৈফিয়তের সুরে বললাম, কয়েকদিনে অনেক কাজ জমে গিয়েছিল যে শেষ করতে করতে দেরি হয়ে গেল, তখন ডালি নারী সুলভ একটু হাসল; এমন হাসি যার ঠিক নির্দিষ্ট কোন অর্থ হয় না। কোন মাতৃস্থানীয়া হাসলে যার অর্থ হতে পারে একটু প্রশ্রয় বা তিরস্কার, প্রেমিকা হাসলে প্রেম বা বন্ধু হাসলে নিছক আনন্দ আর দেয়ালাও হতে পারে। আমি তখনো দরজায় দাড়িয়ে। ডালি হাসতে হাসতেই বলল, "কী! 'আসুন মহারাজ' না বলা অবধি কি ওখানেই দাড়িয়ে থাকবে নাকি?"

ডালির এ হাসি মুখ অনেক দিন দেখিনি। ডালি এমন করে হাসেনি কিংবা আমি চেয়ে দেখিনি। আজ এ হাসি দেখে ভেতরে ভেতরে জমতে থাকা মেঘটা একটু হালকা হয়ে এল। ডালি যখন হাসে খুব বাচ্চা বাচ্চা দেখায়। অনেকদিন বাদে ডালির হাসি মুখ দেখে আরো বহুদিন পূর্বের একটা বাচ্চা বাচ্চা হাসি মুখ মনে পড়ল। আজকের এ ডালি আর সেদিনের সে ডালির মাঝে সত্যিই কোন পার্থক্য আমি করতে পারি না।

বৃহস্পতিবার। হাফ স্কুল ছিল। ছুটির পর পরিচ্ছন্ন হয়ে স্কুলের হস্টেলে আমার রোমের ফ্লোরে বসে খাবার আয়োজন করছি। আমরা যার যার রোমের ফ্লোরে বসেই খেতাম। ডাইনিং ঘরটা নোংরা হয়েই পরে থাকে বলে তেমন কেউ সেখানে খায় না।
তারেক ছুটে এসে বসল পাশের চৌকিটিতে। বলল, তারাতারি খাওয়া শেষ কর, আমার সাথে যেতে হবে।
আমি হস্টেল জীবনের জাতীয় খাবার আলু-মাছের ঝোল পাতে ঢালতে ঢালতে বললাম কোথায়?
তারেক- আমাদের বাড়ি।
তারেকের সাথে আমার বন্ধুত্বটা বেশ বাড়াবাড়ি রকমের হলেও কখনো তাদের বাড়ি যেতে বলেনি। তারেকের বাড়ি বেশি দূরে নয়- হেটেই যাওয়া যায় বলে সে প্রায়ই বাড়ি যায়। এমন করে হঠাৎ তারেকের বাড়ি যাবার প্রস্তাবে আমি মুখ তুলে তাকাই। তারেক বুঝতে পেরে বলল, আমাদের পাড়ার মসজিদে আজ মাহফিল হবে, অনেক বড় মাহফিল।
আমি মাথা নিচু করে খাচ্ছি আর তারেক বর্ননা দিচ্ছে কোন কোন বিখ্যাত হুজুর সেখানে ওয়াজ করতে আসবেন, কে কেমন ওয়াজ করেন, আমি তাদের ওয়াজ শুনে কেমন চমকে যেতে পারি সেসব। সবশেষে বলল, মা তোকে নিয়ে যেতে বলেছে।
তারেকের পরিবারের কাওকে না দেখলেও তাদের সবাইকে আমি বেশ চিনি। বিশেষ করে তারেকের মাকে। তারেকের মায়ের কথা বললেই আমার কল্পনায় ভেসে উঠত একটা মধ্য বয়সী মাতৃত্বপূর্ণ মুখ- যেটা আমি কল্পনায় একে নিয়েছিলাম।
তারপর তারেকদের বাড়ি গেলাম। যদিও উপলক্ষটা মাহফিল তবু আমার কাছে তারেকের পরিবারের সবাইকে দেখার ইচ্ছাটাই মুখ্য ছিল, বিশেষ করে তারেকের মাকে। কল্পনার তারেকের মা আর বাস্তবের তারেকের মা এক নয়, সম্পূর্ণ আলাদা। হাত-মুখ কোন একটা রোগে সাদা হয়ে গিয়েছে, হঠাৎ দেখলে চমকে যেতে হয়- আমিও চমকে গেলাম।
তারেকের বড়বোন, হাসিনা একটা বাচ্চা কোলে নিয়ে বসে ছিলেন। আমাকে কাছে টেনে নিয়ে চিবুক স্পর্শ করে অবাক হবার ভান করে বলেন, ওমা, একদম তারেকের মত দেখতে! তারেকের মায়ের দিকে তাকিয়ে বলেন, আম্মু, এদেরতো একেবারে জমজ ভাই বলে চালিয়ে দেয়া যাবে।
তারেকের সাথে আমার চেহারায় কিছুটা মিল আছে সেটা আমি জানি, স্কুলের অনেকেই বলে।

আর কেউ ঘরে নেই। তাদের সাথে হালকা কথাবার্তা সেরে আমরা মাহফিলের উদ্দেশ্যে বের হই। তারেকের একটা ছোট বোন আছে জানি। জিজ্ঞেস করায় বলল, মনে হয় ভাইয়ার সাথে মাহফিলে গেছে।
নিজের ছোট ভাই-বোন না থাকায় অন্যের ছোট ভাই-বোন আছে শুনলেই আগ্রহ হয়। তাছাড়া তারেক সারাক্ষণই পাঁচ মুখে ছোটবোনের কথা বলতে থাকে। ফলে আমারও আগ্রহটা একটু বেশি ছিল।

মাঠের এক পাশে উচু করে স্টেজ করা হয়েছে যারা ওয়াজ করবেন তাদের বসার জন্য। মাঠ জুড়ে সামিয়ানার নিচে পাটের চট বিছানো শ্রোতাদের বসার জন্য। মাঠের একেবারে শেষ প্রান্তে চটের অভাবে খড় বিছানো। স্টেজের একেবারে সামনে কয়েকজন মাত্র শ্রোতা বসে আছে। একজন হুজুর তারস্বরে চিৎকার করে ওয়াজ করে যাচ্ছেন, যদিও এলাকার মানুষ তেমন গুরুত্বই দিচ্ছে না। আসলে তিনি এলাকারই কোন এক মসজিদের ইমাম। উঠানের পাশে জন্মানো সবজিটির মত যা হাত বাড়ালেই পাওয়া যায়, রোজ খেতে খেতে যাতে বিরক্তি এসে গেছে, তেমনি এই হুজুরের ওয়াজও মানুষের মধ্যে কোন আগ্রহই সৃষ্টি করতে পারেনি। বড় বড় দাওয়াতি হুজুরেরা মাগরিবের পর হতে গভীর রাত অবধি সুর করে ওয়াজ করবেন। লোকজন গাছাড়া ভাবে এখানে সেখানে গল্প করছে আর ওযাজ শুনার আগ্রহটা রাতের জন্য তুলে রাখছে।

মাহফিল উপলক্ষে এলাকার ছেলেরা নানান জিনিসের দোকান বসায়- খাবারের, খেলনার, মেয়েদের কমদামি গয়নার- নানান জিনিসের। আমাদের ওই বয়েসে মাহফিলের প্যান্ডেলের চেয়ে দোকানগুলোর প্রতিই ঝোঁক ছিল বেশি। মাহফিল থেকে একটু দূরে একটা খালি জমিতে দোকানগুলো বসেছে। এদিকটা একটু ঘুরে দোকানগুলোর ওদিকটায় গিয়ে হাজির হলাম। সেখানেই তারেকের ছোট বোন ডালিকে পাওয়া গেল। এটা-সেটা কিনে দিয়ে ডালির সাথে বেশ ভাব হল। অনেক্ষণ ঘুরাঘুরি করে বাসায় আসলাম রাতের খাবার খেতে। খাবার খেয়ে আবার যাব মাহফিলে ওয়াজ শুনতে। চারপাশে বেশ করে মাইক লাগানো আছে বলে ঘর থেকেই সব শুনতে পাওয়া যায়। মাইকে ঘোষনা হল প্রধান বক্তা এসে পৌঁছেছেন। আমরা একটু দ্রুত খাবার খাই কেননা আমরা খাওয়ায় থাকতে থাকতেই যদি বড় হুজুর ওয়াজ শুরু করো দেয়। আমরা চাচ্ছিলাম যেন তার স্টেজে ওঠাটাও মিস না করি। কিন্তু খাবার শেষ করেও আমাদের তারেকের আব্বু ও ভাইয়ার জন্য অপেক্ষা করতে হয়- তারা আমাদের সাথে নিয়ে যাবেন বলে আমাদের বসতে বলেছেন।
ডালিও আবার মাহফিলে যাবে বলে অনেক্ষন নাচানাচি করে কখন ঘুমিয়ে পড়েছে। পরিবারের ছোট বলেই বেশ আদুরে। আমার সাথে বেশ ভাব হয়েছে ডালির। আসলে আমি বুঝতে পারছিলাম তারেকের পরিবারের সবাই আমাকে বেশ পছন্দ করেছে। তারেকের বড়বোনতো বারবার বলছিলই, কি মিষ্টি চেহারা, কেমন মায়ামায়া চাহনি। তারেকের বাবা আর ভাইয়ের ব্যাবহারে বেশ বুঝা গেল তারাও আমাকে আপন করে নিয়েছে প্রথম দিনেই।
*****
ধীরে ধীরে আমি তারেকদের পরিবারের একজন মেম্বার হয়ে গেলাম। যেকোন সামান্য উপলক্ষ্যেও আমার ডাক পড়তই। আর আমার উপস্থিতিতে ডালির ছোট ছোট ইদুরে চোখ দুটো আনন্দে নেচে উঠত। ঘরোয়া মিলাদ থেকে শুরু করে বিয়েসাদী পর্যন্ত সকল তাইতেই আমি উপস্থিত থাকতাম। বিশেষ কিছু রান্না হয়েছে তো আমি দাওয়াত পেতাম, অন্তত একটা ভাগ আমার থাকতই। তাছাড়া আমার প্রতি ডালির একটা বিশেষ পক্ষপাত ছিলই। ফলে ডালিও এটা সেটা আমার জন্য জমিয়ে রাখত, সেখান হতেও মাঝে মাঝে কিছু ভাগ পেতাম।
ডালির নাম ছিল ডালিম। তারেকের বাবা একটু টেনে ডাকত, 'ডালি--ম' এবং শেষের ম টা এমন আস্তে উচ্চারন করত যে শুনাই যেত না। ফলে ডালিম ধীরে ধীরে সবার মুখেই ডালি হয়ে ওঠে। কখনো কোন আত্মীয়-স্বজন আসলেই যখন ডালিম নামে কেউ ডাকে তখন সবার মনে পড়ে, হ্যা ডালির নামতো আসলে ডালিম। ডাকনাম ছাড়াও একটা ভাল নামও অবশ্য আছে, যেটা দরিদ্র পরিবারের তোলা কাপড়ের মত তোলাই থাকে। শুধু স্কুলের পরীক্ষার খাতার ব্যাবহারেই সে নামটা সীমাবদ্ধ থেকেছে। সে নামটা আমি জেনছিলাম অনেক পরে। জানার পর হতে আমি ডালিকে সে নামেই ডাকি। ডালি বলে, পৃথিবীতে এ নামে আমাকে শুধু তুমিই ডাক। পৃথিবী শব্দটা বেশ জোর দিয়ে উচ্চারন করে যেন আবদার করছে যেন আমি এনামেই সবসময় ডাকি।

তারেকের পরিবারের সবাই আমাকে খুবই আদর করত। আর ডালির সাথে ছিল 'খামচাখামচি' র সম্পর্ক। যতক্ষণ থাকতাম প্রতিযোগিতা চলত কে কাকে বুদ্ধিতে হারিয়ে দিতে পারে। চিমটির বদলে খামচিটা কার পাওনা। সামান্য কারনে বিশাল সাইজের কিল পড়ত পিঠে। সারাক্ষণ টম-জেরির মত লেগেই থাকতাম। তারেকের পরিবারের সবাই সেটা বেশ উপভোগ করত। ফলে তারেকদের বাড়িতে আমার যাতায়াত ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছিল। তখনই কেউ কথাটা রটিয়ে দেয়।
আমি আর তারেক তখন স্কুলের উচু ক্লাসে পড়ি। পাঁচ কান ঘুরে যখন আমার কানে কথাটা আসল আমি একেবারে হতবুদ্ধি হয়ে যাই। তারেকের একটা ছোট বোন আছে। আমার আর তার মাঝে একটা প্রেম প্রেম সম্পর্ক আছে, তাই আমি এমন ঘন ঘন তারেকদের বাড়ি যাতায়াত করি- এমন খবর স্কুলের প্রায় সকলের মাঝে প্রচার হতে সময় লাগে না।
তখন স্কুলের টিনেজারদের মধ্যে একটা অকথিত প্রতিযোগিতা চলত, কে প্রেম করে, কে করে না বা কে কয়টা প্রেম করে! যারা প্রেম করত তারা নিজেদের একটু উন্নত দরের বিবেচনা করত। তাদের আচরনে সিনেমাটিক হিরো হিরো ভাবটা প্রকট ভাবে প্রকাশ পেত যা কখনো কখনো হাস্যকর পর্যায়ে গিয়ে পৌছত। যারা প্রেম করত না তারাও একটা নিরব হাহুতাশ চাপা দিতে গিয়ে যারা প্রেম করে তাদের নিজেদের অজান্তেই হিংসা করত এবং প্রেমটাকে চারিত্রিক অধপতন হিসেবে প্রচার করে নিজেরা আত্মতৃপ্তির ঢেকুর তুলত।

আমি তারেকদের বাড়ি যখন থেকে যাতায়াত করি তখন ডালি নেহায়েত একটা বাচ্চা। তারপর ডালি কখন গায়ে গতরে বেড়ে উঠেছে, কুঁড়ি এসেছে, ফুল ফুটি ফুটি করছে- আমি খেয়ালই করিনি। এখন এই ভেবে আমার অবাকই লাগছে যে ডালি প্রেম করার উপযুক্ত হয়ে গিয়েছে।
আমি বা তারেকের সাথে কয়েকবারই আমাদের বন্ধুদের কয়জন তারেকদের বাড়ি গিয়েছিল। এমনিতে আমি গেলে নখেদাতে ঝগড়াটা বাদিয়ে দিতে তীর-ধনুক নিয়ে ঝাপিয়ে পড়লেও যখন অন্যকোন বন্ধুকে সাথে নিয়ে গিয়েছি তখন ডালি গর্তের ইদুরের মত কোথায় আড়াল হয়ে থাকত। গর্তের ইদুর যেমন গৃহস্থকে তার অস্তিত্ব জানতে দিতে চায় না তেমনি ডালিও যেন নিজের অস্তিত্বকে বাতাসের সাথে এমন মিশিয়ে দিত যে আমিও অবাক হয়ে যেতাম। বন্ধুদের মধ্যে কেও কেও যে ডালির ব্যাপারে বেশ আগ্রহ বোধ করত তা যতই চাপা থাকুক না কেন একটু আধটু প্রকাশ হয়ে পড়ত তাদের অজান্তেই। আমার সাথে ডালির এমন সহজ সম্পর্কটাও তাদের কাছে অসহ্য মনে হত। এরা জেনে গিয়েছিল যে ডালির সাথে আমার সম্পর্কটা বেশ গভীর কেননা তারেক অনেকবার তাদের সামনেই বলেছে, "তোকে ডালি যেতে বলেছে।" তারেক জানত আমি ডালিকে প্রচন্ড স্নেহ করি। যারা ডালির সাথে কোন রকমে একট সম্পর্ক গড়তে আগ্রহী ছিল তাদের কেউই হয়তো ডালির সাথে আমার প্রেমের সম্পর্কের এমন অমূলক কথাটি রটিয়েছে। কেন কি? কোন লোভনীয় বস্তু নিজের সাধ্যের বাইরে এবং অন্যের হাতের মুঠোয় দেখা এবং সহ্য করা বড় কষ্টের।

স্কুলে এমন রটনার পর তারেকদের বাড়ি যাতায়াত কমিয়ে দিয়েছি, আসলে এরপর আর তাদের বাড়িই যাইনি। এ রটনাটা সম্ভবত তারেকের কানেও গিয়েছে। নতুবা অন্যসময় কিছুদিন না গেলেই বেশ স্বাভাবিক ভাবেই বলত 'তোকে ডালি যেতে বলেছে'। এবার অনেকদিন না গেলেও তারেক এমন করে বলেনি। তারেক তাদের বাড়ি যেতে বললে আমিও নানা অজুহাতে এড়িয়ে যেতাম। স্কুলের লাস্ট ক্লাসে পড়ি বলে সেন্ট্রাল এক্সাম একটা অন্যতম অজুহাত ছিল। তারপর একদিন তারেক 'আম্মু যেতে বলেছে' বলে আমাকে তাদের বাড়ি নিয়ে গেল। অনেকদিন পর গেলাম। ডালিকে দেখে মনে হল হঠাৎই যেন সে অনেক বেড়ে উঠেছে, ফ্রক পড়া ছেড়ে দিয়েছে। কথা বলে বুঝলাম দেহের সাথে সাথে বুদ্ধিতেও বেড়েছে। আকস্মিক একটা হতাশা আমার মনকে ভারি করে দেয়। মনে হচ্ছিল সেই পুতুলের মত মেয়েটা কখন ধীরে ধীরে বড় হয়ে আমার মুঠি ফসকে বেরিয়ে গিয়েছে যার উপর আমার পূর্ণ নিয়ন্ত্রন ছিল। এমন অনুভূতিকেই কি প্রেম বলে?
কিন্তু কিছু সময় যেতেই বুঝতে পারলাম, না কিছুই বদলায়নি। একটু বাদেই নখেদাতে হামলে পড়লেও আমি যেন সহজ হতে পারছিলাম না। হাসতে হাসতে গায়ের উপর ঢলে পড়া কিংবা কোন অন্যায় আবদার যেটা পূর্বে খুবই স্বাভাবিক লাগত সেটাই খুব কটু লাগছিল। তারপর বারদুয়েক তাদের বাড়ি গিয়েছিলাম। কলেজ পড়ছিলাম যখন তখনই হঠাৎ তারেকের মা মারা যায় এবং কিছু মাসের ব্যবধানে বাবা বিদায় নেয়। তাদের বিদায় দেয়া ও দোয়া-মিলাদ উপলক্ষে স্বাভাবিকভাবেই আমি উপস্থিত ছিলাম। এরপর আর যাওয়া হয়নি অনেক দিন। কলেজ শেষ করে ভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছি। আমি আর তারেক, দুজন বরফ বেধে শক্ত বন্ধুত্বের বন্ধনে যে সুদৃঢ় ভাবে আটকে গিয়েছিলাম তা ততদিনে গলে গিয়ে পানিটুকু অবশিষ্ট আছে। একদিন তারেকের সাথে হঠাৎই দেখা। অনেকদিন বাদে সাক্ষাৎ; নানা কথার পর তাদের পরিবারের যে চিত্র আঁকল আমি অতীতের সাথে কিছুতেই মিলাতে পারছিলাম না। তারেকের বড় ভাই বিয়ে করে শহরে বাস করছে এবং তাদের সাথে তেমন যোগাযোগ নাই। ডালি বড়বোনের বাসায় আছে। বড়বোনের দেবর তাকে বিয়ে করতে উঠে পড়ে লেগেছে। ভগ্নিপতিরও তাই ইচ্ছে। কিন্তু ডালির সেই ছেলেকে একেবারই পছন্দ নয়। তবে কিনা ওদের ঘাড়ে বসে থেকে এ কথাটা স্পষ্ট করে বলে দেয়া যায় না। তাহলে হয়তো আর ওখানে তাকে থাকতে দেবে না। নানা বাহানায় এখনো অবধি বিয়েটা আটকে রাখলেও আর বুঝি সম্ভব নয়। এটুক বলে একটু চুপ করে থেকে শব্দ করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বলল, 'ডালি তোকে একবার যেতে বলেছে'। আমি চকিতে তারেকের দিকে তাকাই। তারেক অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে রেখেছে। আমি উদাসভাবে বলি, দেখি কখনো সময় হলে।
তারেক এবার আমার চোখের দিকে সোজাসুজি তাকিয়ে বলে, জানিসতো ডালি তোকে কত ভালবাসে।
আমি এতদিন পর একথা শুনে বেশ খানিকটা চমকে উঠি। স্কুলে যখন পড়তাম তখন একথা শুনে এমনি একটু চমকে গিয়েছিলাম। আমিও এখন বুঝতে পারি ডালি তখন সত্যিই আমায় ভালবাসত। তারপর কলেজে যখন পড়ি তখনতো ডালি নিজেই সে ভালবাসা স্পষ্ট করে প্রকাশ করেছিল। এরপর তারেকের বাবা-মার দাফন-কাফন উপলক্ষে কয়েকবার গেলেও তেমন করে ডালির সাথে আলাপ হয়নি। তারপর দীর্ঘ ক’বছরতো আর ডালির সাথে দেখাই নাই। আমি ভেবেছিলাম কিশোর বয়েসের একটু ভাল লাগা নিশ্চয়ই এতদিনে চাপা পড়ে গিয়েছে; অন্তত আমার থেকে কোন সাড়া যেহেতু পায়নি।

তারপর সেদিনের মত তারেক বিদায় নিয়েছিল। মাস চারেক পর তারেক আবার আমার ঠিকানায় এসে হাজির। আমি অবাক হলাম না, সেদিন আমার ঠিকানা নিয়ে গিয়েছিল। তখন আমি মেসে থাকি আর ভবিষ্যতের ডগোমগো রঙিন স্বপ্নে তখন অন্যকিছু ভাববার মত সময় নেই। তারেক এসে হাত চেপে ধরে বলে, যায়েদ, ডালিকে তুই বাঁচা।
বাংলা সিনেমা দেখা অনেক আগেই ছেড়ে দিয়েছি; হিন্দী আর ইংলিশ সিনেমা না দেখলে আধুনিক হওয়া যায় না- আধুনিকতার যে প্রচন্ড জোয়ার তাতে আমিও ভাসতে শুরু করেছি। তবু তারেকের বলার ভঙ্গিতে বাংলা সিনেমার কথা মনে হল। আমার হাসি পেয়ে যাচ্ছিল তবু তারেকের মুখের দিকে তাকিয়ে হাসতে পারলাম না। জিজ্ঞেস করলাম, কী ব্যাপার?
তারেক যা বলল তা এরকমঃ ডালিকে জোর করেই সেই ছেলে বিয়ে করতে চাচ্ছে। ডালি বলে দিয়েছে যদি সে ছেলের সাথে তার বিয়ে হয় তবে মরা ছাড়া তার কোন উপায় নেই। এমন বিপদে একমাত্র আমিই ভরসা হতে পারি, একটু আশ্রয় দিতে পারি।
আমি মনে মনে বিরক্ত হলেও চেপে গিয়ে বলি, আমাকে কি করতে বলিস?
তারেক আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলে, ডালিকে কিছু দিনের জন্য অন্তত যেন আমাদের বাড়িতে আশ্রয় দেই। তারেক চাকরির চেষ্টা করছে। চাকরিটা হয়ে গেলেই ডালির বিয়ের একটা না একটা ব্যবস্থা সে করে ফেলবেই। সে সময়টার পূর্ব পর্যন্ত অন্তত যেন আমাদের বাড়িতে একটু থাকবার ব্যবস্থা করি।
তারেকের সাথে তার বোনের বাড়ি যাই। ডালিকে ডেকে সরাসরি জিজ্ঞেস করি আমার সাথে যাবে কিনা। ডালি সেই ছোট্টবেলাটির মতই উপরে-নিচে মাথা নেড়ে জানায় যাবে। আমি ডালিকে নিয়ে বাড়ি আসি এবং বাবাকে বলি যে ডালি আমাদের বাসায় কিছু দিন থাকবে। বাবা তারেককে চিনতেন। কিছু বললেন না। পরে আমাকে একান্তে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি এই মেয়ে কে বিয়ে করেছ?
আমি বললাম, না।
পরে বললেন, বিয়ে করবে?
আমি তাতেও না বললাম। বাবা বেশ অবাক হয়ে বললেন, তবে! এ মেয়েকে তুমি নিয়ে এসেছ এবং এ মেয়েইবা তোমার সাথে আসল কেন?
পরে বাবাকে পুরো পরিস্থিতি বিতাং করে বললাম এবং এও বললাম যে সম্ভবত মেয়েটা আমাকে ভালবাসে। শুনে বাবা কিছুই বললেন না তবে ডালির আমাদের বাড়িতে থাকা নিয়ে কোন বাঁধ সাধলেন না।

ডালিকে বাড়িতে রেখে আমি আবার ঢাকায় এসে ভবিষ্যত স্বপ্নে বিভোর হই। সেদিকে ডালি আস্তে আস্তে বাবা-মাকে জয় করে নেয়। এর প্রায় বছর দেড়েক পরে তারেক আসে, এর মধ্যে সে আর খবরও নেয়নি। তারেক এসে বলে সে বোনের বিয়ের জন্য পাত্র জোগাড় করে এসেছে, পাত্র বেশ সুপাত্র। কিন্তু তাকে দেখে কিছুতেই মনে হয়নি যে, সে এমন কোন ভাল পাত্রের জোগাড় করতে পারবে। কেননা তার চেহারা ও পোষাক-আসাকেই বুঝা যাচ্ছিল সে নিজেই তেমন ভাল নেই।
বাবা তাকে বলে দিলেন, দেখ বাবা, আমাদের মেয়ের বিয়ে নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না। সময় মত আমরাই সেটার জোগাড়-যন্ত্র করব, ভাল ভাবেই। তুমি তোমার বোনকে নিয়ে দুশ্চিন্তা করতে হবে না।
বাবার কথা শুনে তারেক আর কিছুই বলেনি। ভাব দেখে মনে হচ্ছিল যেন বিরাট একটা দায় থেকে মুক্তি পেয়েছে।
আমিই ডালিকে বিয়ে করছি ভেবে বিদায় বেলায় আমার হাত চেপে ধরে বলেছিল, যায়েদ, ডালিকে কখনো কষ্ট দিস না।
উত্তরে আমি বোকার মত হাসি। কেননা তখনো আমি ডালিকে বিয়ে না করার সিদ্ধান্তেই ছিলাম।

এর বছর তিনেক পরে বাবা-মা যখন আমার বিয়ের আয়োজন করতে লাগলেন তখন পাত্রী হিসেবে ডালিকেই নির্বাচন করলেন। আমিও ভেবে দেখলাম, ডালি কোন দিক দিয়েই আমার অযোগ্য নয়। দেখতে-শুনতে ভাল, স্বভাব-চরিত্র ভাল, শিক্ষিতা। আমাকেও যখন প্রচন্ড ভালবাসে তখন আর অমত করার কোন কারনই থাকতে পারে না।
*****
ঘরটা এমন করে সাজানো যে প্রবেশ করেই মনে হল বাসর ঘর। একটু খেয়াল করে বুঝতে পারলাম, হ্যা বাসর ঘরই- এবং আমিই বর। ফুলেল বিছানায় লম্বা ঘোমটা টেনে একটা মেয়ে বসে আছে। ঘোমটাটা সড়াতে যখন হাত দুটো বাড়াতে গেলাম তখনই মেয়েটি খিলখিল করে হেসে উঠল। হাসির ধমকে আস্তে আস্তে ঘোমটাটা সড়ে যেতে দেখলাম মেয়েটি আমার ডালি। দেখে আমি চমকে উঠি যেমনি চমকে উঠে ছিলাম তারেকের মুখ থেকে শুনে "জানিসতো ডালি তোকে কত ভালবাসে"। আমার বিস্ময় লাগে এবং বিস্ময়ের ঘোর কাটার পূর্বেই ঘুম ভেঙে যায়। ডালি বিছানায় নেই। দেড় বছরের মেয়েটা; ডালি অবশ্য দেড় বছর বলে না, আঠারো মাস বলে; উপুর হয়ে ঘুমুচ্ছে। লালা ঝরে বালিশটা ভিজছে, আস্তে করে সোজা করে দিলাম।
বিছানা ছেড়ে উঠলাম। ডালি বারান্দায় বসে আছে নয়তো পায়চারি করছে। মনে মনে বিরক্ত হলাম, অসুস্থ শরীর নিয়ে রাত জাগা কেন! বারান্দার গ্রিলগুলো ধরে বাইরের দিকে একেবারে উদাস নজরে তাকিয়ে আছে। তাকিয়ে আছে কিন্তু কিছুই দেখছে বলে মনে হল না। একেবারে পাশ ঘেষে দাড়ালাম। তাতেও ডালি আমার উপস্থিতি টেরই পেল না। আস্তে করে ডাকলাম; সেই নামটা ধরে ডাকলাম যে নামে পৃথিবীতে একমাত্র আমিই ডালিকে ডাকি। ভেবে ছিলাম চমকে উঠবে। কিন্তু না শুধু ঘাড় বেকিয়ে তাকিয়ে আস্তে করে ডালির মাথাটা আমার কাঁধে রাখল। আমি ডালির মাথায় চুলের উপরেই চুমু খেলাম। একটু পরেই ডালির শরীর কেঁপে কেঁপে উঠতে থাকল। ডালি কাঁদছে দেখে আমি সান্ত্বনা দেয়ার ভঙ্গিতে মাথায় হাত বুলাতেই আমার বুকে মাথা রেখে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। তার চোখের পানিতে আমার বুকের পশমগুলো ভিজে উঠেছে আর আমি বারান্দার গ্রিলের ফাক দিয়ে বাইরের জোছনার দিকে তাকিয়ে আছি। কাঁদুক! মাঝে কিছুদিনের জন্য লিলি এসে আমাদের দুজনের মধ্যে যে দূরত্ব তৈরি করে দিয়েছে ডালির চোখের জলে সেটা দূর হোক, মুছে যাক এ কালো চিহ্ন।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.