![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আমার জীবনটা নিতান্তই নিরশ এবং একঘেয়ে। কোথাও থেকে শুরু হয়ে চলছে একই সুর -তাল -ছন্দে ; ফলে সে সুর আর ভাল লাগে না, তাল আর দোলায় না, ছন্দ আর নাচায় না। তারপরও সে সুর -তাল -ছন্দ মাঝে মাঝে চরমে পৌঁছায়।
বাড়ি যাচ্ছি। দেশের পরিস্থিতি সুবিধার না। হরতাল আর অবরোধের নাগপাশে আবদ্ধ সবাই ; ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায়। পেট্রোল বোমায় অহরহ মানুষ মরছে। সন্ধ্যা হলে বোমার ভয়টা বেড়ে যায় তাই ইচ্ছা ছিল সকাল সকাল বের হব। যখন রওয়ানা হলাম তখন মধ্যাহ্ণ।
আজিমপুর গোরস্থানের সামনে দিয়ে যাচ্ছি। হঠৎ একটা পাগলমত ভিক্ষুক গায়ে ময়লার আস্তর নিয়ে সামনে এসে পথ রোধ করে দাড়াল। কখন আবার জড়িয়ে ধরে এই ভয়ে পকেট থেকে ৫টাকা বের করে দিয়ে দ্রুত হাটা দিলাম। ঐ দিন মিলন ভাই বলছিল "shock & horror technique"।
ভাবলাম ক্যাম্পাস হয়ে যাব। চার -পাঁচ দিনের জন্য বাড়ি যাচ্ছি। বন্ধুদের সাথে দেখা করে যাই। ক্যাম্পাসে অনেক্ষণ আড্ডা মেরে প্রায় সন্ধ্যা। এমনই হয়। বন্ধুদের সাথে আড্ডায় বসলে আর সময় জ্ঞন থাকে না।
বাসটা প্রায় ফাকা। বোমার ভয়ে মানুষজন কম। দেখে-চিনতে ভাল একটা সিটে বসলাম। কিছুক্ষণের মধ্যে গাড়িটা কানায় কানায় ভর্তি। বুঝলাম দীর্ঘদিন মানুষের বন্দীদশা সয় না। আমার পাশে যে ছেলেটা বসেছে তার চুলের স্টাইল বিদঘুটে। হাতে জোড়া চারেক চুড়ি, গলায় চেইন বোধ হয় সোনার। আশ্চর্য! আমি ছেলেটাকে খুব আগ্রহ নিয়ে দেখছি। লাল পেন্ট, কমলা রংয়ের শার্ট আর হলুদ জুতায় পিকুলিয়ার দেখাচ্ছে। হাতে একটা iphone! আমি নিজের অজান্তে ছেলেটাকে হিংসা করতে শুরু করেছি। নিজের অজান্তেই আমার হাতটা পকেটে চলে গেল। আমার পকেটে একটা কম দামি ফোন। ছেলেটাকে হিংসা করা আমার উচিৎ হচ্ছে না। আমি ছেলেটাকে ভালবাসতে চেষ্টা করছি কিন্তু পারছি না। কি করা যায়! ছেলেটার সাথে কথা বলা যায়। মনেমনে সিদ্ধান্ত নিলাম ছেলেটার সাথে কথা বলব তখনই ছেলেটা নেমে গেল। এখন ছেলেটার ব্যাপারে আগ্রহ বোধ করছি। জানালায় মাথা গলিয়ে দেখলাম ছেলেটা ভীড়ের মধ্যে মিশেগেছে। অনুভব করলাম হিংসাটা ভালবাসায় পরিবর্তন হয়েগেছে।
ছেলেটা নেমে যেতেই খালি সিটটাতে বসার জন্য একরকম লড়াই শুরু হয়ে গেল। একটা লোক প্রায় ঝাপিয়ে পড়ল। জানালা থেকে মুখ ফিড়িয়ে তাকালাম। লোকটা 'স্যরি' বলে নড়ে বসল। গাড়ির যাত্রিদের দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিলাম। কোন বৃদ্ধ বা মহিলা থাকলে সিট ছেড়ে দেব। না কোন বৃদ্ধ নেই, মরনের ভয়টা তাদেরই বেশি যদিও মৃত্যু তাদেরই বেশি নিকটবর্তী। একটা মেয়ে দাড়িৃয়ে আছে। সিট ছেড়ে দিলে আশেপাশের লোকগুলো হয়তো অন্য কিছু ভাববে। আবার জানালা দিয়ে বাইরে তাকালাম। রাতের ঢাকা আসলেই সুন্দর। কথাটা ঠিক হচ্ছে না, রাতের দৃশ্য সর্বত্রই সুন্দর।
এবার কুমিল্লা গামী কোন বাসে উঠতে হবে। দেশের সবাই অনিশ্চয়তার মধ্যে দিন কাটাচ্ছে, গাড়ি অনেক কম। অনেক্ষণ অপেক্ষার পর একটা বাস পেলাম, ভাড়া দ্বিগুণ।
গলায় একটু পানি ঢেলে নিলাম। চা হলে ভাল হত। চা -র কথা মনে হতেই কাফির কথা মনে হল।
একলা চলার একটা আনন্দ আছে যদিও কিছু ঝামেলাও এড়াতে পারা যায় না। আমার পাশের সিটে একটা মহিলা বসেছে। পান চিবাচ্ছে। আমার মাও পান খায় তবুও এ মহিলার পান খাওয়া আমার কাছে ভাল লাগছে না।
গাড়িটা চলতে শুরু করেছে। আমি জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রাত দেখছি, ঠিক রাতও দেখছি না। মহিলা আমাকে ডাক দিল, কই যাচ্ছ গো?
আমি, কুমিল্লায়। একটু থেমে ভদ্রতার খাতিরে জিঙ্গেস করলাম, আপনি?
মহিলা, আমিও, ছেলের বাসায় আইছিলাম। কই থাইক্ক্যা আইছ গো?
আমি,এইতো ঢাকা থেকে। কাটছাট জবাব দিলাম যেন আর কোন কথা না বলে। কিন্তু এরপর থেকেই মহিলার কথা শুরু হল। আমি মহিলার কথা যদিও শুনছি না বা মহিলার দিকে তাকাচ্ছিও না তবুও সে নিজে নিজে বকবক করেই যাচ্ছে। 'একটাই ছেলে। ঢাকায় চাকরি করে। মায়ের ন্যাওটা। স্ত্রীকে দেশেই রাখতে চেয়েছিল মার সেবা করার জন্য। নিজেই ছেলের বউকে ঢাকায় পাঠিয়েছে জোর করে, ছেলের খাওয়া দাওয়ায় সমস্যা।......................বকে জাচ্ছে অনর্গল ; ছেলের বউটাও ভালই........তবে..পরের মেয়েতো। এমনিতে আমার সাথে খারাপ করেনি কখনো, মিথ্যা বলব কেন (মনে হয় কেও মিথ্যা বলার জন্য অনুরোধ করেছে তাকে)। মহিলাটা অকৃতজ্ঞ নয়।
ওপাশের সিটে একটা যোয়ান মহিলা দুটা বাচ্চা নিয়ে গাড়িতে উঠেছে। দুইটা বাচ্চাকে সামলাতে হিমসিম খাচ্ছে মহিলাটা। আমার পাশে বসা মহিলাটা একটা বাচ্চাকে কোলে নিল। আমার কাছে এখন মহিলাটাকে ভাল লাগছে। মহিলাটার মাঝে একটা সহজাত মাতৃত্ববোধ আছে। আমি এখন মহিলাটাকে আর উপেক্ষা করতে পারছি না। মহিলাটা আমার উপর একটা প্রভাব ফেলতে সক্ষম হয়েছে।
কুমিল্লা পৌঁছাতে আরো আধ ঘন্টার মতো লাগবে। একটু ঝিমুনি আসছিল কিছুক্ষণের জন্য। পাশের মহিলার ডাকে চোখ খুলে দেখি গাড়ি থেমে আছে। মহিলা বলল, 'নামবা না গো কুমিল্লা আইয়্যা পড়ছে।' মহিলাটা কথার শেষে 'গো ' বলে, প্রথম বিরক্ত লাগলেও এখন ভালই লাগছে। মহিলার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাড়ির দিকে পা বাড়ালাম। এখন মহিলাটাকে মিস করতে শুরু করেছি। একটু হেটে এসে একটা বটগাছের নিচে দাড়ালাম। হঠাৎ মনে পড়ল ছোটবেলায় এ বটগাছটাকে কিযে ভয় পেতাম! দিনের বেলায়ও এর নিচে দিয়ে একলা যেতাম না। দু -একজন থালেও দৌড়ে পার হতাম। এক সময় এখানে দাড়িয়ে থেকে ভূতের মত আমাদের ভয় দেখিয়েছে নিত্য। আর আজ একটুও ভয় পেলাম না। মনে হল বটগাছটা যেন বলছে,'এতদিন কোথায় ছিলে বন্ধু! এখন আর আমাকে ভয় পাও নাতো?' আগ্রহ নিয়ে গাছটাকে ছুঁয়ে দেখলাম। । এখান থেকে বাড়ি দেখা যায়। তবে এখন দেখা যাচ্ছে না ; রাতের অন্ধকার। দুপুর বেলা সূর্যের আলোয় চালের টিন চিকচিক করে। একটু দাড়িয়ে বুক ভরে নিশ্বাস নিলাম। আনন্দে বুকটা ভরে উঠল। এই বটগাছ, কাঁচা রাস্তা, দুপাশের ধানক্ষেত, রাতের আধাঁর, ঝিঁঝিঁপোকার ডাক কত চেনা! কত আপন! এতগুলো আপনজনকে একসাথে আবিষ্কার করার পর আমি নিজেকেই যেন হারিয় ফেলেছি। একটা স্বর্গীয় অনুভূতি হচ্ছে। অতল -অসীমে হারিয়ে ফেলছি নিজেকে। চলার গতিটা স্বাভাবিক ভাবেই মন্থর হয়ে এল।
বাড়ির প্রবেশ পথে এসে দাড়ালাম। প্রতিবার, যখনই বাড়ি আসি এখানে এসে দাড়ানোর অনুভূতিটা অন্য রকম। নিজের ওজনটা যেন কমে যায়। বুকটা আবেগে ভারি হয়ে আসে আর লাজুক একটা ভাব - যেন নতুন বউ ; ভাষায় প্রকাশ অযোগ্য একটা অনভূতি।
'ঠুক.... ঠুক....... ঠুক..........।'
-'কে? '
-'আস্সালামু আলাইকুম।'
-'ওয়ালাইকুম আস্সালাম।' দরজা খুলে হাসি মুখে দাড়িয়ে মা। এইতো আমি চাই। তোর এ হাসির জন্যইতো এতদূর ছুটে আসি। এই মুহূর্তে আমিই পৃথিবীর সবচেয়ে সুখি মানুষ..........সম্ভবত তুইও, তাইনা মা!?
০৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৫
©somewhere in net ltd.