নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

হান্নান কল্লোল

গল্পকার, কবি, অনুবাদক, প্রাবন্ধিক৷ দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী৷

হান্নান কল্লোল › বিস্তারিত পোস্টঃ

গতিধারা প্রকাশিত ‘এই সময়ের নির্বাচিত গল্প’-সংকলনে আমার গল্প ‘ঘূর্ণিপাক’। বন্ধুরা, মন্তব্য/সমালোচনা প্রত্যাশা করছি।

২২ শে জুলাই, ২০১৪ দুপুর ২:৩৩

ঘূর্ণিপাক// হান্নান কল্লোল



১. সকাল দুপুর পেরিয়ে বিকেল নেমেছে। এখনও শয্যাত্যাগ করেনি পার্থ। নিশ্বাসের শব্দ জানান দেয় যে জীবিত আছে সে। তবে জাগ্রত কি নিদ্রিত তা বোঝার কোনো জো নেই। চোখ বুজে নিথর হয়ে শুয়ে আছে সে।



কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে অদিতি পার্থর কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। তার বাঁ হাত মাথার নিচে, ডান হাত ল্যাপটপের ওপরে। ফেসবুক লগ ইন করা। তেরোটি ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট, সাতটি মেসেজ, ঊনপঞ্চাশটি নোটিফিকেশন।



পার্থর বিছানায় বসে নোটিফিকেশনে ক্লিক করে অদিতি। প্রথমেই লেখা― Elora Zahan, Lui Sen and 13 others commented on your status.



অদিতি মনে মনে বলে, দেখি তো কী লিখেছে পার্থ!



আমি চাই বা না চাই



যা নাই তাই বেশি পাই



শূন্যতার মতো ঈশ্বরের মতো



ধেৎ উপমায় বড্ড ভুল হয়ে গেল



ঈশ্বর ও শূন্যতা সমতুল্য নয় কখনও



ঈশ্বরের চে’ শূন্যতা অধিক অর্থ বহন করে



কেননা শূন্যতা সর্বকালীন ও সর্বত্র বিরাজমান



ঈশ্বর আছে কি নাই তা-ই তো অনেকের জানা নাই



কিংবা থাকা না থাকার মাঝামাঝি এক বায়বীয় সত্তা সে



দুত্তুরি ছাই কী বলতে গিয়ে মুখ ফসকে কী যে বলে ফেলি



চলুন সবাই মিলে ঈগল নিয়ে জানা অজানা আলোচনা চালাই



আপনাদের ঈশ্বরের দোহাই ঈগলের কথা আপাতত জিগায়েন না...



প্রলাপের মতো পার্থর ফালতু স্ট্যাটাসকে কেউ কেউ কবিতা মনে করেও প্রশংসসূচক কমেন্ট করেছে। হাসি পায় অদিতির। হাসি সামলে নিয়ে সে চোখ বুলায় ইলোরা জাহানের লেখায়:



প্রতিরাতে ঈগলবেশে ঈশ্বর নেমে আসে পার্থর পৃথিবীতে।



অসহ্য ঠেকে ইলোরার কমেন্ট। সে হুট করে ক্ষেপে যায় পার্থর ওপর। সজোরে ধাক্কা মেরে বলে, যাচ্ছি!



পার্থ চোখ বন্ধ রেখেই অদিতিকে বিছানায় টেনে নেয়।



বাহুবন্ধন থেকে নিজেকে মুক্ত করে অদিতি ছোটে বাথরুমে। তরল সাবানে ধুয়ে ফেলে সিগারেটের দুর্গন্ধময় মুখের লালা। পুরো শরীরটাই ঘিনঘিন করছে। একটা কাকস্নান সেরে নিলে স্বস্তি পাওয়া যেতো। সময় একদম কম। স্কুল থেকে ছেলেটাকে আনতে বেরুতে হচ্ছে এখনি।



অদিতিদের সন্তান পড়ে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে। পার্থ চেয়েছিল এলিল প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করুক রিন্টুর মতো। তা শুনে ভীষণ চটে গেল অদিতি। কফির পেয়ালা মেঝেতে ছুড়ে মেরে বলল, আমার সাথে আশ্রিতা রহিমার তুলনা?



শুকনা হাসি হেসে হাতজোড় করে পার্থ বলল, প্লিজ, অকৃতজ্ঞ হয়ো না; ওকে আমাদের পরম আপনজন ভাবতে চেষ্টা করো।



সরি, এমনটি আর কখনও হবে না, রহিমার ত্যাগের কথা স্মরণে এনে নিচু গলায় অদিতি জানাল।



অদিতি অবশ্য কথা রেখেছে। অবজ্ঞা বা অসম্মান করে রহিমার সঙ্গে কথা বলেনি আর কোনোদিন।



আজ বেরিয়ে যাবার সময় সে বলে, রহিমা বুবু, তোমার অসুবিধা না হলে গুরুজীর জন্য কি একটু পায়েস রেঁধে রাখবে?



রহিমা সম্মতিসূচক মাথা নাড়ে।



গাড়িতে চড়ে বসামাত্রই, কী আশ্চর্য, পার্থর স্ট্যাটাসের অসংলগ্ন কথাগুলো ঘুরেফিরে মনে পড়ছে অদিতির।



এ্যালিলকে পাশে বসিয়ে ফেরার পথে সুরে সুরে সে গেয়ে ওঠে― আমি চাই বা না চাই/ যা নাই তাই বেশি পাই/ জানি নাই, জানি নাই/ তুমি আছ কি নাই...।



মা’র সুরারোপিত কথাগুলো ষষ্ঠবর্ষী এলিলের কানে বেসুরো লাগে। সে প্রায় চিৎকার করে বলে, মম্! স্টপ ইয়োর নাই নাই।











অদিতি রবীন্দ্রসঙ্গীতের একজন নামকরা শিল্পী। রেডিও টেলিভিশনে নিয়মিত গায়। রবীন্দ্রজয়ন্তীসহ বিশেষ কোনো অনুষ্ঠানেও ডাক পড়ে তার। শিল্পীখ্যাতি যতই সে পাক না কেন রেওয়াজের সময় গুরুজীকে তার কাছে রাখা চাই। একদা গুরু-শিষ্যার মাখামাখি এতটাই গাঢ় ছিল যে পার্থর পিতৃত্বকে গোপনে ডিএনএ টেস্ট করাতে হয়েছিল। সেকথা থাক্।



অদিতি ঘড়িঘন্টা মিলিয়ে নিয়মমাফিক কণ্ঠশীলনে মত্ত থাকে। সে-সময় সে অবস্থান করে জাগতিকতার বাইরে। সন্তান-স্বামী-সংসারের কথা ভুলে যায় যেন।



এক বিকালে ব্যতিক্রম ঘটে। সঙ্গীতসাধনায় মনঃসংযোগ করতে পারছে না অদিতি। কারণটা গুরুজীর অনুপস্থিতি। শিষ্যার নিজহাতে তৈরি করা খাবার বেশি খেয়ে পেটখারাপ হয়েছে তাঁর।



গুরুজীর কথা ভাবতে ভাবতে হারমোনিয়াম নিয়ে অদিতি পার্থর ঘরে ঢোকে। দু-পা ভাঁজ করে বিছানায় বসে বলে, গান শুনবে?



ছায়াবন্ধু ইলোরা জাহানকে চ্যাটের জবাব লেখতে লেখতে পার্থ বলে, নিশ্চই।



অদিতি গেয়ে চলছে― মাঝে মাঝে তব দেখা পাই, চিরদিন কেন পাই না...।



পার্থ ফেসবুক থেকে চোখ সরিয়ে দু-চার বার তাকিয়েছে শিল্পীর দিকে।



মনোযোগের পরিমাপ করা সম্ভব হলে অদিতি বুঝতে পারত শ্রোতা হিসেবে সে পাশ নম্বর পাবার যোগ্য কি অযোগ্য।



গান শেষ করে অদিতি অনুযোগের স্বরে বলে, একসময় তুমি তো রবীন্দ্রসঙ্গীতের ভক্ত ছিলে।



আছি এখনও।



তবে বোঝা যায় না।



আসলে তাঁর ভাববাদী গানগুলি আমাকে আর টানে না।



থাক্, থাক্, যুক্তি দেখাতে হবে না। আমার গানও শুনতে হবে না। তুমি তোমার ফেসবুক বন্ধুদের নিয়েই মজে থাক।



অদিতির তরুণীসুলভ অভিমানোক্তি শুনে পার্থর হাসতে ইচ্ছে হয়। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে সে হাসি আটকাতে চায়। পারে না। দু-কদম এগিয়ে গিয়ে স্ত্রীর হাত ধরে হাসিমুখে বলে, রাগলে তোমাকে আরও সুন্দর লাগে।



অদিতির মুখেও চাপা হাসির আভাস মিলে। নরম চোখে তাকিয়ে আদুরে গলায় সে বলে, এসব কমন কথা তুমিও বলতে পারো বুঝি?



কেন নয়! সুন্দরকে তো সুন্দর বলতেই হয়, বলে পার্থ দরজা বন্ধ করে আসে। অবরুদ্ধ ঘরে আদরের আদানপ্রদান করতে চায়। একটু সরে দাঁড়িয়ে অদিতি বলে, আচ্ছা, তুমি কি শুধু আমার দৈহিক সৌন্দর্যকেই দেখতে পাও?



তোমার সৌন্দর্য তোমার দেহেই প্রকাশমান।



নারীর মধ্যে দেহ ছাড়া আর কিছু দেখো না?



বলো কী! পোশাক-প্রসাধন-মুখোশ সবই তো দেখি।



ইয়ার্কি হচ্ছে। বি সিরিয়াস, প্লিজ।



হলাম। কী করতে হবে আমাকে?



পার্থর দু-হাত আঁকড়ে ধরে আবেগকম্পিত কণ্ঠে অদিতি বলে, আমার সৌন্দর্য তোমার চোখে মেখে আত্মার ভেতর দৃষ্টি ফেলে দেখো!



আত্মা! ওটা তো বিমূর্ত এক ধারণামাত্র।



ওহ! এত দর্শন আওড়াচ্ছ কেন?



আচ্ছা, ঠিক আছে। তোমার আত্মায় কী দেখতে পাবো আমি?



জবাবে অদিতি কিছু বলার জন্য তৈরি হতেই দরজায় দুমদুম কিল পড়তে থাকে। এ্যালিলের কচিকণ্ঠ শোনা যায়।



পাপা, ওয়াই ইজ দ্য ডোর ক্লোউস্ড? মম্, ওউপান্ দ্য ডোর প্লিজ!







প্রাতঃনিদ্রা পার্থর ভীষণ প্রিয় একটা বিষয়। প্রভাতে শয্যাত্যাগের কথা কল্পনাও করতে পারে না সে।



ইলোরার ফোনে রাত ভোর হবার আগেই আজ তার ঘুম ভেঙে গেছে। সূর্যোদয় দেখার ইচ্ছেও হয়। উঠি উঠি করে বেলা বাড়ে।



রহিমা চা নিয়ে ঘরে ঢোকে। পার্থ ঘুমজড়ানো কণ্ঠে বলে, তুমি জান না, আমি বেড-টি’র আগে বেড-ব্রেকফাস্ট খাই?



নাশতা তৈরি শেষ হয় নাই, ভাইজান।



হাতের ইশারায় রহিমাকে চলে যেতে বলে আবার চোখ বন্ধ করে পার্থ। স্বপ্নের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। ঘুমই জোড়া লাগছে না, স্বপ্ন আসবে কোত্থেকে? জীবনটা স্বপ্ন হয়ে গেলে ভালো হতো, ভাবে সে। কেন ভালো হতো তা জানে না পার্থ।



সে জানবেই বা কী করে? ক’দিন ধরে, বলা যায়, অনিয়মই হচ্ছে তার। প্রয়োজন হলে সারা রাত জেগে থাকা, ইচ্ছে হলেই কল্পনার আকাশে ডানা মেলা কিংবা স্বপ্নের গহিনে হারিয়ে যাওয়া, কোনোটাই আগের মতো সফলভাবে হচ্ছে না তার।



চিকিৎসাবিজ্ঞানের ওপর ভীষণ ক্ষিপ্ত পার্থ। এ বিজ্ঞান আজও আবিষ্কার করতে পারেনি এমন একটি টনিক যা সেবন করলে স্বপ্ন দেখা যায় ইচ্ছেমতো, এমন কোনো ইনজেকশন যা নিলে চিলের মতো কল্পনার আকাশে ভাসতে পারা যায়, এমন কোনো বটিকা যা খেলে রাত জাগা যায় প্যাঁচার মতো।



ফেসবুকে মেতে ওঠার জন্য রাত জাগাটাই পার্থর জন্য অধিক জরুরি। ইদানিং মাঝরাত থেকেই নিদ্রাপরি এসে আছর করে তার চোখের পাতায়। বড়জোর রাতের শেষ প্রহরের সূচনা নাগাদ টিকতে পারে সে। এর পরের কত কিছু, বিশেষ করে ইলোরা জাহানের কবিতা মিস করতে হয় তাকে।



ড্রাগ লাইসেন্স থাকলে পার্থ একটা মেডিসিনের ফ্যাক্টরি গড়ে তুলত। তার প্রধান প্রোডাক্ট হতো এওয়েকিং পিল বা এন্টি-স্লিপিং পিল।



সাত-পাঁচ ভাবনায় নিমগ্ন থেকে সে টের পায়, এ্যালিল এসে কাছে বসেছে।



ল্যাপটপ অন করে পার্থর পিঠের ওপর রেখে সে গেইম স্টার্ট করে দেয়। পাশের ঘর থেকে ভেসে আসে রিন্টুর পড়ার আওয়াজ।



বৃষ তৃণ খায়। মৃগ কৃশ প্রাণি।



রহিমাকে ডেকে এনে পার্থ জিগ্যেস করে, তোমার ছেলে এসব কী পড়ছে?



ক্লাস ওয়ানের বাংলা বই পড়তাছে।



ও, আচ্ছা। যাও।



রহিমাকে বিদায় করে পার্থ ঢোকে বাথরুমে।



ফ্রেস হয়ে সে অদিতিকে বলে, সকাল সকাল যখন উঠেই পড়লাম, চলো সবাই একসাথে খাই।



ব্রেডে মাখন মাখাতে মাখাতে অদিতি বলে, আগের পারমানেন্ট বুয়া আর নেই। ছুটাবুয়া এসে ঘরদোর পরিষ্কার আর কাপড় ধোয়ার কাজ করে চলে যায়। রান্নাবান্নাসহ বাদবাকি কাজ রহিমাই সামলায়। সময় পেলে আমিও টুকিটাকি সাহায্য করি।



রহিমা কোনো কাজই আর করবে না। তুমিও মশগুল হয়ে থেকো সঙ্গীতসাধনায়। যে কয়জন বুয়া লাগে রেখে দাও। বুয়া পেতে দেরি হলে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দাও।



কী বলছ আবোলতাবোল!



তাহলে রহিমার কিডনিটা খুলে দাও, পার্থর গলায় আষাঢের মেঘ ডাকে।



ভাইজান যে কী কন! মাথায় কাপড় টেনে রহিমা বলে।











নাক ডাকার শব্দ আর শোনা যাচ্ছে না। রিন্টুর কাছ থেকে রহিমা ছুটে যায় পাশের ঘরে। চোখ না খুলেই পার্থ জিগ্যেস করে, ক’টা বাজে?



সাড়ে পাঁচটা।



সকাল না সন্ধ্যা?



সইন্ধ্যা।



একঘুমে সারাটা দিন কাবার করে দিলাম।



মাইঝখানে আর একটা রাইতও চইল্যা গেছে।



মানে?



আফ্নে কাইল সকালে ঘুমাইছিলেন। ভাইজান কি ঘুমের বড়ি খাইছিলেন?



হুঁ! ডাকোনি কেন?



আফায় বারণ কইরা গেছেন।



সে কোথায়?



কাজের মাইয়া আনতে গেরামের বাড়িত গেছেন। কিছু খাইয়া লইন ভাইজান।



পার্থর ঘুমের ঘোর পুরোপুরি কাটেনি। আড়মোড়া ভেঙে ওঠে সে। জানালার বাইরে তাকায়। কুয়াশাঢাকা স্ট্রিটলাইটের আলো ঝাপসা ঝাপসা।



ঝিমধরা মাথা কাজ করছে না। এ মুহূর্তে প্রথমে কী করণীয় বুঝতে না পেরে আঙুল মটকাচ্ছে পার্থ। কী ভেবে ফোন করে গুরুজীকে।



আধঘন্টার মধ্যে গুরুজী হাজির। ততক্ষণে ফ্রেস হয়ে নিয়েছে পার্থ।



গুরুজীকে নিয়ে পারিবারিক লাইব্রেরিতে মুখোমুখি বসে সে। টেবিলে মাথা রেখে সিরিয়াস টাইপের কিছু বলার জন্য মানসিকভাবে তৈরি হয়ে নিচ্ছে পার্থ। গুরুজী চোখ ঘুরিয়ে দেখতে থাকেন পার্থর দু-পাশের বুকসেল্ফগুলো। ডানপাশে বঙ্কিম-শরৎ-রবীন্দ্র-নজরুল আর বামপাশে র্মাক্স-এঙ্গেলস-লেলিন-স্তালিন রচনাবলী। গুরুজীর পেছনে আরও চারটি সেল্ফ। সেগুলোর প্রতি আগ্রহ হারান তিনি। ডাস ক্যাপিটাল বইটার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করেন, আপনি কি মার্ক্সবাদী?



আরে, বাদী বিবাদী কিছু না। একসময় পড়তাম, এই আর কি! টেবিল থেকে মাথা তুলে জবাব দেয় পার্থ।



মনে কিছু করবেন না, আপনি কি নাস্তিক?



চেষ্টা করছি আস্তিক হবার। পরকাল থাকলে ভালোই হতো। নরকে শাস্তি পেতে পেতে কিংবা স্বর্গে কামকেলিতে রত থেকে অস্তিত্বকে উপভোগ করা যেতো।



জবাব শুনে চুপসে যান গুরুজী। আলোচনার প্রসঙ্গ পাল্টান তিনি।



আমায় জরুরি তলবের কারণ জানতে পারি?



অস্থির হবেন না। একটু ধৈর্য ধরে বসুন। ওহ! আজ পর্যন্ত আপনার নামটাই তো জানা হলো না।



সেটা আমার দুর্ভাগ্যই বটে! লোকে আমাকে আজম হেনরি নামেই চিনে।



তা হেনরি সাহেব, বিয়ে-থা করেননি কেন?



আয়রোজগারেরই হিল্লেই হয়নি এতদিন। এখন তো বুড়োই হয়ে যাচ্ছি।



নারকেলপুলি নিয়ে লাইব্রেরিতে প্রবেশ করে রহিমা। তাকে বসার ইশারা করে হেনরির উদ্দেশ্যে পার্থ বলে, খেতে খেতে ওর জীবনইতিহাস শুনতে থাকুন; ভাতটাত খেয়ে আমি আসছি।



অসময়ে ভাত খাবেন?



খাবার আবার সময় অসময় কী?



পার্থ বের হতে না হতেই রহিমা শুরু করে তার জীবনকাহিনী। এবং তা চলতে থাকে ঘন্টাব্যাপী। দুঃখের কথা শুনতে শুনতে ক্লান্ত হয়ে পড়েন হেনরি সাহেব।



পার্থ ঢোকার পর রহিমা বের হয়ে যায়। কণ্ঠে বিরক্তি মিশিয়ে হেনরি বলেন, রহিমার লাইফ-হিস্ট্রি জেনে আমার কী লাভ?



সেটাই আসল রহস্য। আচ্ছা, সংক্ষেপে বলুন তো শুনি, কী কী জানলেন ওর জীবন সম্পর্কে?



জ্বী, বলছি, বলে হেনরিসাহেব থামেন এবং গলা খাঁকারি দিয়ে পুনরায় শুরু করেন।



জন্মের আগে বাবা ও জন্মকালে মা মারা যায় রহিমার। সে প্রতিপালিত হয় এতিমখানায়। তার বিয়ে হয় এক বেশ্যার দালালের সাথে। কিছুদিন পর সেই দালাল তাকেও প্ররোচিত করে দেহদানে। রাজি হতে পারেনি সে। তার ওপর শুরু হয় অমানবিক নির্যাতন। তাই সে পালিয়ে আসে প্রসবমাসে। আপনার গাড়ির সামনে লাফ দেয় আত্মহত্যার জন্য। গুরুতর আহত মেয়েটিকে আপনি নিয়ে যান ক্লিনিকে। উন্নত চিকিৎসাসেবায় সে সুস্থ হয়ে ওঠে অল্পদিনেই। এরপর আত্মহত্যা স্থগিত করে মা হবার স্বপ্নে বিভোর হয়। তার কোলজুড়ে আসে একটি ফুটফুটে শিশু। শিশুটিকে এতিমখানায় রেখে পালিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত নেয় সে। আপনার আন্তরিকতা ও মানবিকতা তাকে পলায়নপরতা থেকে নিবৃত্ত করে। সে আপনার পরিবারের একজন হয়ে থাকতে থাকে এখানে।



টেবিল চাপড়ে পার্থ বলে, ওয়েল ডান! এ প্লাস পেয়েছেন আপনি।



হেনরি টাক মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে কিছু একটা বলতে চেয়েও বলতে পারেননি।



পায়চারি করতে করতে পার্থ স্বগতোক্তির চাইতে একটু জোরে বলে, সে বড় একটি ব্যাপার গোপন করেছে।



কী?



অনুমান করুন তো সেটি কী হতে পারে?



কপাল কুঁচকে কিছুক্ষণ ভেবে হেনরি সভয়ে বলেন, আপনার সাথে তার দৈহিক সম্পর্ক নয় তো?



চমকে ওঠে পার্থ। রেগেও যায় কিছুটা। কণ্ঠে দৃঢ়তা এনে বলে, আমাকে এতটা স্বার্থপর ভাবতে পারলেন আপনি?



আমায় ক্ষমা করবেন।



ক্ষমা তো আপনাকে করেই রেখেছি মিস্টার হেনরি। তা না হলে আপনি বেঁচে আছেন কীভাবে?



জ্বী!



আপনাকে খুন করার পরিকল্পনা করেছিলাম। পরে তলিয়ে দেখলাম, মৃত্যুদণ্ড পাবার মতো অপরাধী আপনি ছিলেন না। একবার ভাবুন, হত্যাকাণ্ডটি যদি সংঘটিত করেই ফেলতাম, আর যাই হোক, আপনি তো জীবনটাকে ফিরে পেতেন না।



পার্থর কথা শুনে বেশ ভড়কে যান হেনরি। টেবিলে রাখা চায়ের পেয়ালা পিরিচ নাড়াচাড়া করে চেয়ারে নড়েচড়ে বসেন। গ¬াসের তলানিতে পড়ে থাকা জলটুকু গিলে গলায় স্বাভাবিকতা আনার চেষ্টা করে বলেন, আমাকে সন্দেহ করেন জানতে পারলে আপনার বাসায় গান শেখাতে আসতাম না। কাল থেকে আসছি না আমি।



বেঁচে থাকলে আসতে হবেই আপনাকে।



এর মানে কী?



আমি যা বলছি মন দিয়ে শুনুন। রহিমাকে বিয়ে করবেন আপনি।



এতটুকু শুনেই হেনরি লাফিয়ে ওঠেন। কিছু বলার জন্য উদ্যত হওয়ামাত্রই পার্থ তাঁর কপালে পিস্তল ঠেকায়। জলগম্ভীর স্বরে বলে, এক গুলিতে মাথার খুলিটা উড়িয়ে দেবো। বসুন চুপ করে।



ভীতু প্রকৃতির হেনরি বাধ্য বালকের মতো বসে পড়েন। কম্পিত কণ্ঠে বলেন, বলে যান শুনি।



রিন্টুকেও মানুষ করবেন পিতৃস্নেহে। বিনিময়ে আপনি পাবেন বিশাল এই বাড়ি আর এক কোটি টাকার চেক।



পার্থর কথা শেষ না হতেই দৌড়ে আসে রিন্টু। কাঁদো-কাঁদো হয়ে বলে, আমার পিস্তলটা পাই না।



আজম হেনরির দিকে আড়চোখে তাকিয়ে পার্থ অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে। হাসতে হাসতে পিস্তলটা রিন্টুর হাতে দিয়ে বলে, যাও, খেলো গিয়ে। যেতে চেয়েও ফিরে এসে ছেলেটি জানতে চায়, উনি কে?



তোমার বাবা, আবারও একচোট হেসে জবাব দেয় পার্থ। লজ্জা লজ্জা একটা ভাব নিয়ে মাকে ডাকতে ডাকতে রিন্টু বিদায় হয়। ইলোরার ফোন পেয়ে ছেলেটার পেছন পেছন দ্রুতপায়ে পার্থও বাইরে চলে যায়।



পার্থর আচরণে হেনরি হতবাক। তার মানসিক সুস্থতা সম্পর্কে তিনি সন্দিহান হয়ে পড়েন।



চলে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে তাঁর। না জানিয়ে চলে যাওয়াটা সৌজন্যবিরুদ্ধ। তাই ঠায় বসে আছেন তিনি।



ফোনালাপ শেষ করে আধঘন্টা পর ধীরপায়ে ফিরে আসে পার্থ। এবার তার ভিন্নরূপ। নিঃসম্বল মানুষের মতো অসহায়ভাবে হেনরির সামনে এসে দাঁড়ায় সে। চট করে হেনরির হাত ধরে বলে, অনেক দুর্ব্যবহার করে ফেলেছি আপনার সাথে।



আরে না! আপনার সবকিছু আমি ফান হিসেবেই নিয়েছি।



এভাবে বলবেন না প্লিজ! বিশ্বাস করুন, যা কিছু বলেছি, যেভাবেই বলি না কেন, সিরিয়াসলি বলেছি।



ঠিক আছে! আমাকে ভাববার ক’টা দিন সময় দিন।











অদিতির নামে একটা ফ্ল্যাট বুকিং দিয়ে বাসায় ফিরছে পার্থ। পথে ইলোরার সঙ্গে দেখা। পার্থ ও ইলোরা একে অন্যের অনেক কিছু যদিও জানে, এর আগে তারা সামনাসামনি হয়নি কখনও। প্রথম দেখাটাকে সেলিব্রেট করতে তারা ঢোকে চাইনিজ রেস্টুরেন্টে।



আলো-আঁধারিতে বসে চিংড়িসূপ্ খেতে খেতে ইলোরা বলে, হেনরিসাহেব কি তোমার প্রস্তাবে রাজি হয়েছেন?



সে রকম কিছু হলে তোমাকে জানাতাম অবশ্যই। তবে তিনি গতকালও এলেন অদিতির কাছে। যাবার সময় কোলে নিয়ে আদর করে রিন্টুকে ললিপপ দিলেন। রহিমাকেও দেখে গেলেন চোরাচোখে।



পজিটিভ সিম্পটম। আচ্ছা, তুমি তাঁকে এতকিছু অফার করতে গেলে কেন?



আমার সব সম্পদই অন্যদের দিয়ে দেবো।



পাগলের মতো কী বলছ, পার্থ?



কোনো সম্পদে আমার মালিকানা রাখতে চাই না। অতিরিক্ত সম্পদ আমাকে কর্মহীন করেছে। কর্মহীনতা আমার জ্ঞানকে করেছে পঙ্গু। কথাগুলো বলে পার্থ হাই তোলে। ইলোরার কোনো প্রতিক্রিয়া দেখতে না পেয়ে সে আবার কথা বলা শুরু করে।



ভাবছি, একটা অসহায় বিধবা আশ্রম স্থাপন করবো। সেটা পরিচালনার দায়িত্ব নেবে তুমি?



তা না হয় দেখা যাবে। অদিতির কথা কিছু বলছ না যে!



ফ্ল্যাটে উঠিয়ে ওকে মুক্ত করে দেবো।



তিনি কি মুক্তি চান?



মুখ ফুটে বলে না কিছুই। তবে সে―



বাদ দাও সেকথা। এ্যালিলের কী হবে?



অদিতির কাছেই থাকবে সে। তুমি কী বলো?



কোনো জবাব না দিয়ে ইলোরা তাকায় পার্থর লাল লাল চোখের দিকে। চোখের ভাষা একেবারেই দুর্বোধ্য ঠেকে। অজানা-অচেনা জগতের এক চিরনিঃসঙ্গ বাসিন্দা মনে হয় তাকে। অন্যমনস্কভাবে ইলোরা প্রশ্ন করে, কীসের অভাব তোমার?



জানি না। তবে মাঝেমধ্যে মনে হয়, সম্পদ-সুখ-ভোগবিলাসের বাইরেও অনেক কিছু পাওয়ার আছে।



কী পাওনি তুমি?



কিছু পেতে হলে চাইতে হয়। আমি তো নিজের জন্য কারো কাছে কোনো কিছু চাইতেই শিখিনি।



এখন থেকে পেতে ও নিতে শিখো।



পেতে হয় হাত পেতে, নিতে হয় নত থেকে।



প্লিজ পার্থ! হেঁয়ালি রাখো। কিছু চেয়ে দেখো জীবনের কাছে, মানুষের কাছে।



জীবনের কাছে চাইতে পারি পরিত্রাণ। মানুষের কাছ থেকে পাবো কি প্রণয়ত্রাণ?



নিজের প্রশ্নে নিজেই বিস্মিত পার্থ। ইলোরার কোনো জবাব প্রত্যাশা না করেই বিড়বিড় করে সে বলতে থাকে― কখনও ভাবি, জীবনবৃত্ত থেকে বিচ্ছিন হয়ে যাই; আমার একাকীত্ব বাড়ুক; আমি নিক্ষিপ্ত হই শূন্যতার অতল গহ্বরে; তারপর নিঃসীম নৈঃশব্দ্যে বসে শুধুই অন্তহীন অপেক্ষা।



কথাগুলো ফেসবুকে পোস্ট করা ইলোরা জাহানের একটি কবিতার শেষ স্তবক কাটছাঁট করে বলেছে পার্থ। ঠোঁটে মুগ্ধতার মৃদু হাসি ঝুলিয়ে ইলোরা জানতে চায়, অপেক্ষার অবসান চাও না তুমি?



চাই। দ্রুত অবসান চাই।



মুহূর্ত কয়েক চুপ থেকে ইলোরা বলে, বিষণœতায় ভুগতে ভুগতে তুমি বিষাদগ্রস্ত হয়ে পড়েছ যা মানুষকে আত্মহননের দিকে ঠেলে দিতে চায়।



সাইকিয়াট্রিস্টের মতো বেশ ভালোই বলেছ তুমি। আমি সূইসাইডাল পেশেন্ট নাকি?



যাক্, বাঁচা গেল! তুমি তাহলে আত্মহত্যা করছ না।



নিজের প্রাণসংহার করার মতো এতটা বোকা আমি নই। আমিও বেঁচে থাকতে চাই সারাটা জীবন।



অবশ্যই। শুধু প্রাণ নিয়ে নয়, জীবন নিয়েই বেঁচে থাকবে তুমি। বেঁচে থাকার অর্থও খুঁজবে।



বেঁচে থাকা কখনই অর্থহীন নয়। তা গুহাবাসেই হোক আর বনবাসেই হোক।



পার্থর সঙ্গে পারম্পর্যহীন আলাপচারিতায় ইলোরার মাথাব্যথা বেড়েছে। বাড়ছে জ্বরটাও। বমি বমি লাগছে। অস্থিরতায় উঠে দাঁড়িয়ে সে বলে, আমি এসেছিলাম ডাক্তারের কাছে, প্যাথলজিকেল রিপোর্ট নিতে।



চলো, আমিও যাই।



গাড়িতে বসে পার্থ গুনগুনিয়ে গাইতে থাকে, মাঝে মাঝে তব দেখা পাই, চিরদিন কেন পাই না...।



মুগ্ধ হয়ে গান শুনতে শুনতে ইলোরা ভাবে, এভাবে প্রিয়তম বন্ধুর পাশে যদি বসে থাকা যেতো অনন্তকাল! কিন্তু পার্থর গান শেষ হবার আগেই পথচলার সমাপ্তি ঘটে।



চেম্বারে ঢোকার পর ডাক্তার পার্থকে জিগ্যেস করেন, পেশেন্ট কী হয় আপনার?



ফ্রেন্ড।



পার্থর দিকে চোখ টিপে ডাক্তার চেম্বারের বাইরে গিয়ে দাঁড়ান। পার্থও তাঁর মুখামুখি হয়।



এনিথিং সিরিয়াস, ডক্টর?



সরি, সি হ্যাজ গট ব্রেইন ক্যান্সার। ডুন্ট ফীল নার্ভাস। ইট’স ইন প্রাইমারি স্ট্যাজ ইয়েট।











পার্থর গুরুগম্ভীর ভাব দেখে অদিতি গান থামায়। তবলা থেকে হাত সরান আজম হেনরি।



ইলোরার দুঃসংবাদটা শুনে পার্থর কাঁধ ছুঁয়ে ধরা গলায় হেনরি বলতে থাকেন, আপনার প্রস্তাব আমি মেনে নিয়েছি। তবে নিঃশর্তে। কোটিপতি হবার সখ আমার নেই। এই টাকায় মেয়েটির জীবন বাঁচান।



নির্বাক অদিতির দিকে একবার তাকিয়ে হেনরি সাহেব পার্থর উদ্দেশ্যে আবার বলেন, আরেকটি কথা, পারেন তো তিনতলা এই বাড়িটা কাজে লাগিয়ে একটা ক্যান্সার হসপিটাল গড়ে তুলুন।



পার্থ অবাক বিস্ময়ে সহায়সম্পদহীন আজম হেনরিকে দেখে নিয়ে দৃষ্টি ফেরায় অদিতির প্রতি।



অদিতি বুঝতে পারছে না কী বলবে, কী করবে। ফ্যাল ফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে পার্থর ছলছল চোখের দিকে।



আচমকা উঠে দাঁড়ায় অদিতি। পার্থর হাত চেপে ধরে বলে, চলো, ইলোরার কাছে যাই।



কথাটা পার্থর কানে দৈববাণীর মতো বেজে চলছে৷ তার পৃথিবীতে ঘূর্ণিহাওয়া বইছে প্রবলবেগে।

মন্তব্য ২ টি রেটিং +২/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ২২ শে জুলাই, ২০১৪ বিকাল ৩:৫৫

অর্ণি আনজুম বলেছেন: সমাজতান্ত্রিক গল্প।

২| ২২ শে জুলাই, ২০১৪ রাত ৮:২৪

সকাল রয় বলেছেন:

আলোচনা যদি করি তাহলে বলতে হয়- গল্প ভালো হইছে।

আর যদি সমালোচনা করি তাহলে কোন একদিন সেটা আপনার খারাপ লাগবো। তাই করলাম না।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.