নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

হান্‌নান

হান্‌নান › বিস্তারিত পোস্টঃ

সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতা : হান্নান কল্লোল

২৯ শে জুন, ২০১৩ সকাল ৮:২৭

সংবাদপত্র হলো আদি ও শক্তিশালী এক গণমাধ্যম। জনগণকে প্রভাবিত করার সবচাইতে কার্যকরী মাধ্যমের নামও সংবাদপত্র। পাঠকের আস্থায় বলীয়ান হয়ে ইদানিং সংবাদপত্র একটি প্রভাবশালী প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। জনমানসে সামাজিক-মানবিক মূল্যবোধ, নৈতিক-আদর্শিক চেতনা প্রভৃতির প্রতিফলন ঘটাতে চেষ্টমান থাকবে সংবাদপত্র নামক প্রতিষ্ঠান- এমন প্রত্যাশা একুশ শতকের সমাজসচেতন সকল মানুষের। সংবাদপত্র জনস্বার্থের ধারক ও বাহক হয়ে জনকল্যাণে নিয়োজিত থাকবে এটাই চাহিতব্য। বিশেষ কোনো শ্রেণি বা মহলের স্বার্থসিদ্ধির সেবাদাসে পরিণত হলে একটি সংবাদপত্র সমাজে প্রতিক্রিয়াশীলতা ছড়ানো ছাড়া ইতিবাচক কোনো ভূমিকা রাখতে পারে না।



সংবাদপত্রে ঘটনার বিবরণে অবশ্যই থাকা উচিত বস্তুনিষ্ঠতা তথা সত্যনিষ্ঠতা। কেননা বিশ্বায়িত তথ্যপ্রযুক্তির এই শতকে তথ্যবিভ্রাট ঘটিয়ে পার পাওয়া দায়। সংঘটিত কোনো ঘটনার নিরপেক্ষ বর্ণনার সাথে অনুসন্ধিৎসু হয়ে তুলে আনা দরকার ঘটনার নেপথ্যে লুক্কায়িত বিষয়বস্তুকে। অতঃপর সেই সংবাদ পাঠক সমীপে পরিবেশন করতে হবে সুশ্রাব্য ভাষায় ও হৃদয়গ্রাহী উপস্থাপনায়।



সংবাদবিলাসী মানুষ ঘন্টায় ঘন্টায় রেডিও-টিভির সংবাদ শোনার পরেও অনেকেই সংবাদপত্রে মুদ্রিত সংবাদের প্রাধান্য দিয়ে থাকে। স্যাটেলাইট চ্যানেল ও ইন্টারনেট বিনোদনের ক্ষেত্রে অব্যাহত দাপট বিস্তার করলেও সংবাদপত্র এখনো এর আকর্ষণ হারায়নি।



সংবাদপত্রে নানামাত্রিক বর্ণময়তা নানাজনকে আকর্ষণ করে নানাভাবে। সংবাদ পরিবেশনার দায় নিয়ে সংবাদপত্রের আত্মপ্রকাশ ঘটলেও জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে তাতে সংযোজিত হতে থাকে অনেক বাড়তি আয়োজন। শিক্ষা, রাজনীতি, অর্থনীতি, বিজ্ঞান, খেলাধুলা, বিনোদন, সাহিত্য প্রভৃতির ক্রমাগত সন্নিবেশ তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ। এই প্রক্রিয়া চলমান থাকাটাই স্বাভাবিক।



অ-সুখের কথা, সংবাদপত্রে বিনোদনের পাতার তুলনায় সাহিত্যের পাতা বরাবরই থাকে অবহেলিত। ছোট বা বড় পর্দার গড়পরতা যে কোনো শিল্পী সংবাদপত্রে যতো গুরুত্ব পান, নন্দিত লেখক ততোটা পান না। সাহিত্য পাতায় শুধু লেখকদের লেখা প্রকাশ করা নয়, ছবিসহ তাঁদের জীবনী, সাক্ষাৎকারও ছাপানো উচিত। কারণ তাঁরাই তো সমাজ বিনির্মাণের নীরব কারিগর। তাঁদের প্রকাশিত বইয়ের পরিচিতি-পর্যালোচনা পাঠকদের সামনে নিয়মিত তুলে ধরা প্রয়োজন। তাতে বাড়তি একটা প্রাপ্তির সম্ভাবনা থাকে বইবিমুখ তরুণ প্রজন্ম ক্রমে বইমনস্ক হয়ে উঠতে পারে।



সংবাদপত্রের কাছে পাঠকের প্রত্যাশা দিন দিন বেড়েই চলছে। অধিকাংশ প্রত্যাশাই পূরণ করা সম্ভব নয়। কারণ সংবাদপত্র দুঃসাহসিকতা নিয়ে জনপ্রত্যাশার পক্ষে সবকিছু প্রকাশ করতে গেলে প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হয়। কিন্তু গণসাধারণ চায়, তাদের ভোগান্তি-লাঞ্ছনা-বঞ্চনার কথা লেখা হোক সংবাদপত্রের পাতায়। তাদের বিশ্বাস, সংবাদপত্র তাদের প্রাত্যহিক জীবনের হালচাল তুলে ধরবে সহমর্মিতা নিয়ে।



এ প্রসঙ্গে কিছু প্রশ্ন এসেই যায়! অর্ধনগ্ন বিদেশি তারকাতন্বীর ছবি সংবাদপত্রের পাতায় হররোজ শোভা পায়, জীবনসংগ্রামী ছিন্নবসনা দেশি নারীর ছবি থাকে না কেন? ধর্ষণের সংবাদ সবিস্তারে ছাপা হয় অহরহ অথচ যে মা কোলে হাড়জিরজিরে সন্তান নিয়ে নিত্যদিন ভিক্ষের দ্বারা মাতৃদায়িত্ব পালন করে তার ছবি ছাপা হয় না কেন? মাদকসহ কেউ ধৃত হলে তাকে নিয়ে সংবাদ শিরোনাম হয়, মাদকবিরোধী আন্দোলনে যে তরুণ অনুক্ষণ নিরত থাকে তাকে নিয়ে শিরোনাম হয় না কেন? অসৎ মানুষের সংবাদ বেশি বেশি ছাপা হলে সৎ মানুষের গুরুত্ব কমে যায় না কি? এমন আরো প্রশ্ন থেকেই যায় সংবাদপত্রের কাছে। এসব প্রশ্ন কেন আসে? আসে এজন্য, সংবাদপত্রের স্বাধীনতার বিপ্রতীবে দায়বদ্ধতা, দায়িত্বশীলতাও যে উপেক্ষণীয় বিষয় নয়।



সংবাদপত্রে নিষেধাজ্ঞা আরোপ, সাংবাদিক নির্যাতন, সাংবাদিক হত্যা ইত্যাকার ঘটনা প্রমাণ করে সংবাদপত্রের স্বাধীনতাবিষয়ক প্রচারণা বাত কা বাত ঘটনা বৈ আর কিছু নয়। যখন যে সরকার ক্ষমতায় থাকে তারা চায় সংবাদপত্র তাদের ইতিবাচক দিকগুলোই তুলে ধরুক; নেতিবাচকগুলো চেপে যাক। যে যাই বলুক, অবারিত তথ্যপ্রবাহের যুগে সংবাদপত্র ভোগ করছে নিয়ন্ত্রিত স্বাধীনতা। বাস্তবত সংবাদপত্রের স্বাধীনতার যথার্থ সংজ্ঞা প্রদান ও সীমা নির্ধারণ করা উচিত যাতে সংবাদপত্রে দায়বদ্ধতা ও দায়িত্বশীলতার প্রতিশ্রতি অব্যাহত থাকে এবং সংবাদপত্রকে যেন বিশেষ মহলের চাপে নিরপেক্ষতা হারাতে না হয়।



নিরপেক্ষতা না থাকলে ধনতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় সংবাদপত্র কখনো সেবাভিত্তিক হতে পারে না, শুধুই মুনাফাভিত্তিক হয়ে ওঠে। বাংলাদেশে ক্রমবর্ধমান সংবাদপত্রের সংখ্যার সাথে তাল মিলিয়ে সংবাদপত্রের মান, উৎকর্ষ, দায়বদ্ধতা আদৌও বাড়ছে কিনা তা খতিয়ে দেখা দরকার। পরিতাপের বিষয়, নির্ভরযোগ্য সূত্রবিহীন আজগুবি সংবাদে ভরপুর ‘হলুদ সাংবাদিকতা’ অভিধাটি নিবেদিতপ্রাণ সাংবাদিকদের মর্মাহত করে, তাঁদের নিবেদিতপ্রাণতায় কলঙ্কের কালিমা ছড়ায়।



সংবাদপত্রের মানোন্নয়ন ও উৎকর্ষ সাধনের জন্য প্রতিটি সংবাদপত্রেরই সম্পাদনায় একটি সুনির্দিষ্ট নীতিমালা থাকা বাঞ্ছনীয় যা সংশ্লিষ্টগণ কর্তৃক সর্বদা অনুসরণনযোগ্য। মতামত প্রকাশের ক্ষেত্রে কলামিস্ট স্বাধীন হলেও ভুল তথ্য, অচল বানান, যথেচ্ছা বাক্যগঠন, অশোভন মন্তব্য ইত্যাদির ওপর অবশ্যই সম্পাদকের নজরদারি থাকা জরুরি। চটুল কিংবা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত কলাম বর্জনপূর্বক চিন্তা উদ্রেককারী কলাম পাঠকের সামনে তুলে ধরা অপরিহার্য। এজন্য সম্পাদককে হতে হবে নিরপেক্ষ ও নির্মোহ দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী।



সংবাদপত্রের স্বাধীনতার সঙ্গে সাংবাদিকতার স্বাধীনতাও সম্পৃক্ত। কথিত মুক্তঅর্থনীতির নাগপাশে আবদ্ধ, বাণিজ্যিকি সংবাদপত্রজগতে সম্পূর্ণ স্বাধীন সাংবাদিকতা কতটুকু সম্ভব হতে পারে সেটাও বিবেচ্য বিষয়। পুঁজিবাদী-ভোগবাদী সমাজে সাংবাদিকতা নেশা থেকে পেশায়, পেশা থেকে ব্যবসায় রূপান্তরিত হলে নিরপেক্ষতায় ও দায়বদ্ধতায় সীমাবদ্ধতা চলে আসতেই পারে। সাংবাদিকগণ ব্যবসায়িক মনোভাব পোষণ না করে যে কোনো রকমের লোভ থেকে নিরন্তর নিবৃত্ত থাকবেন মানুষ সেটাই প্রত্যাশা করে। তাঁরা যেন কখনোই বিস্মৃত না হন, ঝুঁকিপূর্ণ সাংবাদিকতা পেশায় যারা নিয়োজিত ও নিবেদিত তাঁরা সম্মানির চাইতে অধিক সম্মান পেয়ে থাকেন সমাজের কাছ থেকে। বিশেষ শ্রেণি বা ব্যক্তির স্বার্থ ও মান বজায় রাখতে গিয়ে সাময়িক সুবিধা ভোগ করে তাঁরা যেন পরিণামে অসম্মানিত না হন এটাই সাংবাদিকগণের কাছে কাঙ্খিত।



সাংবাদিকতা বিষয়ে আরো দু’একটি কথা না বললেই নয়। ‘নবসাংবাদিকতা’ সাম্প্রতিক কালে ‘সৃজনশীল সাংবাদিকতা’, ‘সাহিত্যিক সাংবাদিকতা’ ইত্যাদি অভিধায় অভিহিত হয়ে থাকে। সৃজনশীল সাংবাদিকতায় সংবাদপত্রের নৈর্ব্যক্তিকতা হ্রাস পায় বিধায় তা বর্জনীয়; সাহিত্যিক সাংবাদিকতায় সংবাদপত্রের ঋদ্ধি ঘটে বলে তা গ্রহণীয়। সচেতন পাঠকমহলের কাছে ফিচার বা প্রতিবেদনে সাহিত্যিক সাংবাদিকতাই অধিক আদৃত।



‘history in hurry’ বা ‘তাৎক্ষণিক ইতিহাস’এর অভিধা পেরিয়ে সাম্প্রতিককালে সাংবাদিকতা ‘literature in hurry’ তথা ‘তাৎক্ষণিক সাহিত্য’এ এর অভিধা গ্রহণ করেছে। ‘literature in hurry’ এর মানে দাঁড়ায় সাংবাদিক যে ঘটনাগুলোকে প্রত্যক্ষে রেকর্ড করেন সেগুলো পরোক্ষে জগজ্জীবনের গল্পই বলে।

একজন সাহিত্যিক-সাংবাদিক কাল্পনিক ঘটনার লেখক না হয়ে বাস্তবিক ঘটনার লেখক হন। তিনি ঘটনা, বিষয় এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যকার সমুদয় জটিলতা খতিয়ে দেখেন। আবেগের অতল গহনে অবতরণ করে সর্বান্তকরণে জড়িয়ে পড়ার কারনেই পাঠকের সঙ্গে গভীরতম সম্পর্ক স্থাপনে সক্ষম হয়ে ওঠেন। তাই তিনি পাঠকদের মনে দীর্ঘস্থায়ী চাপ রাখতে পারেন।



সাংবাদিকতা শুধু তথ্য উপস্থাপন নয়, তথ্যগুলোর অন্তর্নিহিত কাহিনীটি পাঠকের মর্মঙ্গম করানোও। আর এক্ষেত্রে সাহিত্যিক-সাংবাদিকতাই পারে কার্যকর ভূমিকা রাখতে। সংবাদে পাঠককে আকৃষ্ট করে আকর্ষণটুকুও ধরে রাখা দরকার। আকর্ষণ করার কাজটা তথ্যকাহিনী করতে পারে কিন্তু আকর্ষণকে ধরে রাখতে হলে সহায়তা লাগবে সাহিত্যের। সাহিত্যিক-সাংবাদিকতায় সাহিত্যে সম্যক অবহিতি থাকা চাই। কেননা তাকে তাৎক্ষণিক সাহিত্য রচনা করতে হয়। উদ্ভূত যে কোনো পরিস্থিতিতে যে কোনো বিষয়ের ওপর তাৎক্ষণিক রচনাকার হিসেবে তাঁর পর্যাপ্ত ভাষাজ্ঞান থাকা জরুরি।



কে, কী, কখন, কোথায়, কেন, কীভাবে ইত্যাদির বর্ণনার বাহন হলো ভাষা। সাহিত্যিকের ভাষা তুলনামূলকভাবে নির্ভূল বলে সংবাদ পরিবেশনায় সেটি কাঙ্খিত। সংবাদের মাধ্যমে পাঠককে আলোড়িত ও আলোকিত করতে হলে সাহিত্যিক-সাংবাদিকতার বিকল্প নেই। ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত কার্যকারণ ও আবেগকে তুলে এনে ভাষার আলঙ্কারিক ব্যবহারের মাধ্যমে সংঘটিত কোনো বিষয়ের অধিক প্রভাব সৃষ্টিকারী, গভীরতর তাৎপর্য তুলে ধরে পাঠকপ্রবরের ভাবাকুল সাড়া পেতে সাহিত্যিক-সাংবাদিকতা অপরিহার্য।



সাহিত্যিক-সাংবাদিকতার কাজ হলো ঘটনার মূল্যসংযোজিত বর্ণনা। সাংবাদিকতার ভেতরে সন্নিবেশিত সাহিত্যই মূল্যটুকু সংযোজন করে। তাই সাংবাদিকতাকে সাহিত্যিক সংরূপে প্রতিষ্ঠিত করা দরকার। এজন্য অনুশীলন ও পরিশীলন করতে হবে সাহিত্যিক-সাংবাদিকতার। আর এভাবেই সাহিত্যিকতা ও সাংবাদিকতার মধ্যবর্তী বিভেদ রেখাটির ক্রমমোচন হতে পারে।



প্রাসঙ্গিক বিবেচনায় বিশেষ ক’জন সাহিত্য-ব্যক্তিত্বের নামোল্লেখ করা হলো। তাঁরা সাংবাদিক কিংবা সম্পাদক হিসেবে স্বনামখ্যাত। প্রবন্ধকার সজনীকান্ত দাস, প্রবন্ধকার সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, নাট্যকার রাজকৃষ্ণ রায়, কথা সাহিত্যিক সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, গবেষক সৈয়দ আবুল মকসুদ, ঔপন্যাসিক অদ্বৈত মল্লবর্মণ, ঔপন্যাসিক সন্তোষকুমার ঘোষ, ঔপন্যাসিক আনিসুল হক, কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত, কবি কাজী নজরুল ইসলাম, কবি জয় গোস্বামী, কবি আবু হাসান শাহরিয়ার, কবি সাজ্জাদ শরীফ, কবি কায়সুল হক, কবি শামসুর রাহমান, কবি রফিক আজাদ প্রমুখ সবিশেষ উলে-খযোগ্য।



পরিশেষে অপরিহার্যতায় উল্লেখ্য, মহাসমারোহে নতুন কোনো সংবাদপত্রের আবির্ভাব ঘটা অনেকটাই সহজ কিন্তু জনসাধারণের কাছে গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করা বেশ কঠিন। প্রতিযোগিতায় এগিয়ে যাবার জন্য নতুন সংবাদপত্রে থাকতে হবে আঙ্গিকে অভিনবতা, বৈষয়িক বিচিত্রতা, নৈর্ব্যক্তিক স্পষ্টতা ও নান্দনিক বহুমাত্রিকতা।



লেখক: গল্পকার ও কবি।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.