নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

I am a former teacher, writer of poems and essays, idol talker on facebook and blogs. Sometimes I make websites and always listen to songs, songs mean only Rabindra Sangeet. My idea is that there is no need for sports in human life, because life itself is

আবদুল হক

https://www.facebook.com/HaqueIsOne

আবদুল হক › বিস্তারিত পোস্টঃ

আবদুল মান্নান সৈয়দের কবিতা : নিবিড় পাঠ

০৪ ঠা মার্চ, ২০১০ রাত ২:০৭

"অন্তিম জলের স্রোতে

নাভি অব্দি ডুবিয়ে রেখে দাঁড়িয়ে থাকবে তুমি---

চন্দ্র-সূর্য অস্ত যাবে তোমার যুগল স্তনে,

শ্রোণীতে পৃথিবী।"



(নারী: আবদুল মান্নান সৈয়দ)



১.

কতোকাল ধরে আবদুল মান্নান সৈয়দের কবিতা পড়ছি? সেই শৈশব থেকে, এক যুগ তো হবেই। তখনো সাহিত্যে প্রবেশ করি নি, মনে পড়ে, রাতভোর হারিকেন জ্বালিয়ে জীবনানন্দের ধূসর পাণ্ডুলিপি ও মান্নান সৈয়দের জন্মান্ধ কবিতাগুচ্ছের পাতার পর পাতা পড়ে যাচ্ছি বুঝে ফেলার কৈশোরক উদ্যম ও প্রতিজ্ঞায়। কিছু বুঝেছি ব'লে মনে হয় না, বদলে এতোই বিমূঢ় হয়ে পড়ি যে বাংলা সাহিত্যচর্চার সম্ভবপরতা বিষয়ে নিজের ভেতরে সংশয় দেখা দেয়। যে সময়ে এঁদের লেখা হাতে এসে পড়েছিল আমার, এবং যে ধরনের লেখা প্রায় প্রস্তুতিহীন অবস্থায় পড়া শুরু করেছিলাম তখন, তা আমার সেদিনের বুদ্ধিগত স্তর বা বয়সের বিবেচনায় অনুপযুক্তই ছিল। এর ফল হয়েছিল দুটো: একদিকে লেখালিখির ভবিষ্যত বাসনা প্রায় ত্যাগ করি, অন্যদিকে বাংলা সাহিত্যের বিকশিত উৎকর্ষ বিষয়ে নিঃসংশয় হই। আর, উত্তরকালে আবদুল মান্নান সৈয়দের "করতলে মহাদেশ" বইটি পড়ে সেই যে মোহগ্রস্ত হয়েছিলাম, সে মুগ্ধতার ঘোর কাটে নি এখনো।



কতো অসংখ্য লেখক/শিল্পী সম্পর্কে কতো অসংখ্য গদ্য, সমালোচনা, মন্তব্য, ভাষ্য, ভূমিকা ও ব্যাখ্যান তিনি লিখেছেন, তীক্ষ্ণ স্মৃতিশক্তির অধিকারী আবদুল মান্নান সৈয়দের নিজের কাছেও হয়ত তার সঠিক হিশেব নেই। সৈয়দের কবিতা বিষয়ে অবিধিবদ্ধভাবে দু'কলম লিখতে বসে মনে হচ্ছে, কবিতার বাইরে তাঁর যে বিপুল সমালোচনাকর্ম, তা আমার লেখার স্বাচ্ছন্দ্যে প্রত্যক্ষ না হলেও পরোক্ষ একটা বাধা। তাঁর গদ্য ও সমালোচনার এক-একটা বইকে মনে হচ্ছে যেন একেকটা প্রহরা--বারবার সতর্ক করছে যেন আন্দাজে কিছু না বলি, নির্দেশিত তথ্য যেন নির্ভুল হয়, বিশ্লেষণের পাশাপাশি যুক্তির পারম্পর্য যেন অশিথিল থাকে আগাগোড়া। এ সকল শর্ত শিরোধার্য ও আচরণীয় হলেও, আমার লক্ষ্য মোটেও তাঁর সমগ্র কবিতার আলোচনা নয়। আমি বরং তাঁর কাব্যের দু' একটা লক্ষণের ইঙ্গিত দিয়ে খানিকটা ভিন্নভাবে (এবং কখনো কখনো 'স্বেচ্ছায় ভুলভাবে', যার ওকালতি করেন হ্যারল্ড ব্লুম) তাঁর কিছু কিছু কবিতা পাঠ করে দেখতে চাই।



২.

'চল্লিশ-পঞ্চাশের কবিরা ছিলেন সত্যান্ধ, আর ষাটের কবিরা হলেন জন্মান্ধ' -- সৈয়দ আকরম হোসেনের এই স্মরণীয় উক্তি যে 'জন্মান্ধ কবিতাগুচ্ছ'কে মনে রেখেই, তা পরিষ্কার। আবদুল মান্নান সৈয়দ হয়তো কখনোই আর ওরকম কবিতা লিখবেন না (যেমন লিখবেন না 'উড়োনচন্ডী কবিনটেশ'-এর মতো প্রবন্ধ), কিন্তু 'জন্মান্ধ কবিতাগুচ্ছ' (১৯৬৭) এখনো আমার প্রিয় কাব্যগ্রন্থ। 'বাস্তব'/'পরাবাস্তবে'র লেবেল গৌণ আমার কাছে, এ গ্রন্থ হলো বিপুল কবিত্বশক্তি ও ক্ষমতাপ্রয়োগের মধ্য দিয়ে বাংলা বাক্যের গড়ন ও বাংলা ভাষার স্বভাব বদলানোর একটা সফল নিরীক্ষা। আমরা পড়ি:



"জ্যোৎস্না ভূতের মতো দাঁড়িয়ে আছে দরোজায়, সব দরোজায়, আমার চারদিকে যতোগুলি দরোজা আছে সময়ের নীলিমার পাতালের; জ্বলছে গাছসকল সবুজ মশাল; বাস একটি নক্ষত্র, পুলিশ একটি নক্ষত্র, দোকান একটি নক্ষত্র: আর সমস্তের উপর বরফ পড়ছে।"



'চিত্রকল্প' না বলে, পরবর্তী পঙক্তিতে, কবি একে বলছেন দৃশ্য, যে-দৃশ্যে আহত হয়ে তাঁর 'পাপের দু'চোখ চাঁদ ও সূর্যের মতো অন্ধ হয়ে গেছে'। আমাদের অবশ্য মনে হয় স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে এরকম একটি চিত্রকল্প রচনা করে কবি নিজেই বিস্মিত। আবদুল মান্নান সৈয়দ কখনো বরফ পড়া দেখেছেন কিনা জানি না, কিন্তু বলা-কওয়া ছাড়া রৌদ্রালোকিত বসন্তের কোনো উজ্জ্বল দিনে অকস্মাৎ নরম আলপিনের মতো বরফ পড়া শুরু হলে পর পুলিশের গাড়ি থেকে শুরু করে ব্লুমিংটনের সমস্ত বাড়িঘর দোকানপাট মল গ্যাসস্টেশন সুপারমার্কেট যখন ঠান্ডা কফিনের মতো অন্তহীনভাবে দীর্ঘ ও বিশাল এক চাদরের নিচে ধীরে ধীরে ডুবে যায়, তখন আমার স্মৃতি ও মস্তিষ্কে--কোনো ইংরেজি কবিতা নয়--কেবল অশোক-কাননের এ পঙক্তিগুলোই হানা দেয়।



আমরা জানি জন্মান্ধ কবিতাগুচ্ছ কবির প্রারম্ভিক যৌবনের রচনা; সৈয়দের বয়স তখন বিশ-বাইশের বেশি নয়। আমি মনে করি, ফরাশি সুররিয়ালিজম ও তার পড়শি পরাবাস্তব ধারাগুলোর কাব্যকৌশল রপ্ত করে, ভেবে-চিন্তে, তিনি এগুলো লিখেছেন এমন মনে করা সঙ্গত নয়। অশোক কানন, পাগল এই রাত্রিরা, গাধা এবং আমি, বেগানা সেরেনাদ--এ সবই মূলত কাব্যিক ঘোরে আক্রান্ত একজন খাঁটি আধুনিকের আত্ম-উন্মোচন। পরাবাস্তবিক অনুজ্ঞা কিংবা বিদেশি কাব্যের শিক্ষানবিশির সূত্রে নয়, জন্মান্ধ কবিতাগুচ্ছকে আজো যে আমরা কাব্য হিশেবে চিহ্নিত করতে পারি তার কারণ এগুলোর পরতে পরতে অন্তঃশীল সেই জিনিশ যাকে রবার্ট লাওয়েল দি ব্রুট ফ্লো অফ কম্পোজিশন বলেছেন। লাওয়েলের মতে কবিতার মানে কিছু আছে বটে (কবিতার ওভার-ইন্টারপ্রিটেশন নিয়ে তাঁর মনোজ্ঞ বিদ্রূপের কথা মনে পড়বে) যা সমালোচকেরা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে উদ্ধার করেন; কবি যদি আবার সমালোচক হন, তাহলে নিজের কোনো কোনো কবিতার অনেক অর্থ ও সংকেত তিনি খুলে দেখাতে পারেন। কিন্তু তাতে, লাওয়েলের ধারণায়, কবিতার একাংশ মাত্র আমাদের গোচরে আসে, সমগ্র কবিতাটির অন্তর্লীন শক্তি যে ব্রুট ফ্লো অফ কম্পোজিশনের ওপর দন্ডায়মান তার কিছুই অধিগম্য হয় না। জন্মান্ধ কবিতাগুচ্ছের পান্ডুলিপি আমরা দেখি নি, কিন্তু তাতে কাটাকুটির দাগ ছিল না এমন মনে করি না। কিন্তু শোধন আর সংস্কার রচনা-উত্তর ঘটনা; মূল কবিতাগুলো তো এক ক্ষিপ্র, বিদ্যুৎস্পৃষ্ট, নিহিত প্রবাহেরই শস্য। যে কোনো খাঁটি কবি এই অনিশ্চিত, সংগোপন, অপরিমিত, আকাঙ্ক্ষিত কিন্তু অজ্ঞাত, নিহিত প্রবাহের জন্যেই অপেক্ষা করেন দিনের পর দিন, কখনো মাসের পর মাস। আবদুল মান্নান সৈয়দের কবিতার পর কবিতায় এই নিহিত প্রবাহের জন্যে তাঁর আকুল ও একধরনের অপরাধমিশ্রিত প্রতীক্ষা লক্ষ করা যায়। প্রতীক্ষা তো সব কবিই করেন, কিন্তু কোনো অপরাধবোধ নিয়ে করেন কি?



আবদুল মান্নান সৈয়দ একজন চলিষ্ণু, সব্যসাচী, ও বহুপ্রজ লেখক। কবিতা, গল্প, উপন্যাস, কাব্যনাট্য---সৃষ্টিশীল সাহিত্যের সর্বক্ষেত্রে তিনি সমান স্বচ্ছন্দ। এর পাশাপাশি যদি তাঁর বিপুল সমালোচনাকর্মের কথা বিবেচনায় রাখি, তাহলে লেখক হিশেবে তাঁর প্রোফাইল সমগ্র বাংলাসাহিত্যের পরিপ্রেক্ষিতেই একটা অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য ঘটনা। সাহিত্যের সব এলাকায় সিদ্ধহস্ত হবার পরিণামে আবদুল মান্নান সৈয়দের কবিতায় তৈরি হয়েছে এক ডায়ালেকটিক, একটা বিরোধাভাস। এই বিরোধাভাস ও দ্বন্দ্ব শুধু প্রেরণা নয়, কখনো কখনো তাঁর কবিতার প্রতিপাদ্য হিশেবেও উপস্থিত। বহু দিক ও প্রান্ত থেকে সৈয়দের কবিতার বিশ্লেষণ সম্ভবপর হলেও, আমি কেবল এই জায়গাটায় সামান্য আলো ফেলতে চাই।



যেমন বলেছি, আবদুল মান্নান সৈয়দের কবিতার শরীরাত্মায় একটা অপরাধবোধ, যা খানিক পরিমাণে খ্রিস্টিয় পাপবোধের সঙ্গে তুলনীয়, বেশ অন্তরঙ্গভাবেই মিশে থাকে। সাহিত্যের সকল শাখায় বিচরণ এবং প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রায় সমতুল্য সাফল্যলাভের কারণে এই অপরাধবোধের জন্ম। তাঁর ভয়: রাশি রাশি গদ্য লেখার ফলে, তাঁর প্রিয় 'কবিতা' যদি ভুল বোঝে? যদি প্রতিশোধ নেয়? যদি 'ইস্পাতে বকুল' আর না ফোটে? 'ধ্যানের বিজন মসজিদে' গুন্ঠিত হীরা যদি আর মুকুটিত না হয়? কিংবা আনন্দ যদি আর 'অসীম নীলিমা হতে গাঢ় সবুজের দেশে বেগনি ফলশা হয়ে না ঝরে'? এই আশংকা থেকে তাঁর কবিতায় তৈরি হয় একটা অপরাধবোধ, যে অপরাধবোধ অধিকার করে নেয় তাঁকে ও তাঁর কবিতাকে--যেটা আবার যুগপৎ তাঁর কবিতা লেখার প্রেরণা ও প্রতিপাদ্য।



৩.

আবদুল মান্নান সৈয়দ 'তুমি' শিরোনামে অনেকগুলো কবিতা লিখেছেন। এ কবিতাগুলোর বিষয় কি 'প্রেম', না 'কবিতা'? ভালোবাসার নারী ও তাকে কেন্দ্র করে ব্যাকুল আকাঙ্ক্ষার উদ্গম ও-সবে নিঃসন্দেহে প্রবল। উৎকৃষ্ট প্রেমের কবিতা হিশেবেই ওগুলোকে আমরা চিনি জানি। কিন্তু চিত্তাকর্ষক প্রেমের কবিতা হিশেবে গ্রহণ করেও কবির দয়িতাকে অধিকাংশ সময় আমাদের নারী বলে মনে হয় না। কাব্যরস উপভোগের চেয়ে যৌনরসে যাঁদের বেশি উৎসাহ, তাঁরা অবশ্য কবিতাগুলোর বহিরঙ্গ সরল পাঠেই তৃপ্ত হবেন। যেহেতু কবিতা পড়তে গিয়ে বয়সভেদে কেবল অন্যকিছুই আমাদের পড়া হয়, তখন আবদুল মান্নান সৈয়দের বিপজ্জনক ও ভীষণভাবে লোভনীয় ইন্দ্রিয়ঘন কবিতাগুলোর শিল্পগত আবেদন গৌণ হয়ে পড়ার সম্ভাবনা বেশি। আমি বলতে চাই, বহিরঙ্গে নারী হলেও, এগুলোর অন্তস্থ প্রতিপাদ্য 'কবিতা'। একটা উদাহরণ:



"দারুণ খরায় আমি পেয়ে গেছি তরমুজ-খেত।

ফুটেছে শ্রীহর্ষ আজ অতলান্ত বেদনাসমেত।

প্রথম বর্ষণে কটি খুলেছে অঢেল গন্ধরাজ।

কৃষ্ণ চাঁদ ঝরে গিয়ে করতলে সূর্য জ্বলে আজ।

স্বচক্ষে দেখছি ঐ উড়ে চলে গন্ধময় সুর।

ছিঁড়েছি অনন্ত থেকে মুহূর্তের একটি আঙুর।"



(তুমি ৫, আ মা সৈ-এর শ্রেষ্ঠ কবিতা)



আবদুল মান্নান সৈয়দের লেখকজীবনে--চরম অসুস্থতার ভেতরেও---'দারুণ খরা' বলে যেহেতু কিছু নেই, সেজন্যে অনুমান করি প্রতিদিনের গদ্যকাজের অভ্যস্ত রুটিনে হঠাৎ কোনো রঙিন আমলকি বা 'জ্যোৎস্নারাত্রির আশরফি' আবির্ভূত হওয়ার কথাই তিনি বলছেন। এ কি নিহিত প্রবাহের সেই দুর্লভ মুহূর্ত যখন কলকাতার বিশ্রী গরম, ধূলো, ও দমবন্ধ আবহাওয়ার ভেতরেও চারপাশ তাজ্জব করে অঝোরে "বৃষ্টি" নেমে আসে? যদিও 'দয়িতা কবিতা' শিরোনামেই একটা কবিতা আছে তাঁর, সৈয়দের কবিতাভুবনের একটা বড় অংশে 'দয়িতা' হিশেবে 'কবিতা'র উপস্থিতি খেয়াল করলেই লক্ষ করা সম্ভব। দয়িতা কবিতার একজায়গায় আমরা পড়ি:



"খুব মধ্যরাতে

দুই মানবিক তারার মতো জল-ভরা চোখে

যাবতীয় গদ্যকাজের জন্যে

নিজের কাছে মাপ চাই আমি

দূরতম নক্ষত্র থেকে একটি তরল তীর ছুটে এসে

বিঁধে যায় আমার আত্মায়"



(দয়িতা কবিতা, শ্রেষ্ঠ কবিতা)



এর সঙ্গে দেখতে-এক্কেবারে-ভিন্নরকম 'তুমি ৬' শিরোনামের নিম্নোক্ত চরণগুলো মিলিয়ে পাঠ করা যেতে পারে:



"অমাবস্যা রাতে

হঠাৎ কালো ঢল-নামা নদীতে

কেবলি প্রতিরুদ্ধ নৌকোর

কেবলি কালো জোয়ারের জলের চড়-খাওয়া নৌকোর

ভিতর থেকে আকুল দেখা

দূরের স্থির গম্ভীর আলো-জ্বলা জাহাজ তুমি"



(তুমি ৬, শ্রেষ্ঠ কবিতা)



কিংবা 'কেন লিখি' কবিতার এ লাইনগুলো:



"আজো তাকে তৃপ্তিহীন করেছে কুরুনি;

স্মৃতি আজো চড় মারে নদীর ঢেউয়ের মতো তীরের মাটিকে।

--দিনভোর গদ্যের গ্লানি---মাঝরাতে পাড়ি দিই কবিত্বদ্বীপের দিকে

পশ্চাতে পড়ে থাকে জীবনের ক্লেদাক্ত ঘুরুনি।"



(কেন লিখি, শ্রেষ্ঠ কবিতা)



'চৈত্রের ডানাঅলা ঘোড়া'য় বিদ্যুৎ বিঁধে যায় বলেই কবিতা লেখেন আবদুল মান্নান সৈয়দ। তাঁর দয়িতা মানবী নয়, কবিতাই---আকর্ষণ ও আবেদনে যা জগতের সবচেয়ে সুন্দরী নারীকেও নিষ্প্রভ করে দেবার ক্ষমতা রাখে। সমাজ, রাষ্ট্র, বাস্তব ও বহির্জগত, মানবীয় সম্পর্ক কিংবা খ্যাতি সবই তুচ্ছ তাঁর কবিতার কাছে, দয়িতার কাছে: কেননা সেই কবে থেকেই তো তিনি খুঁজে চলেছেন 'ছেলেবেলার হারিয়ে ফেলা সবুজ প্রিজম'; সেই কবে থেকেই তো দীর্ঘ এক প্রতীক্ষায় তাঁর বসে থাকা কখন স্বপ্নের চৌবাচ্চা থেকে বেরিয়ে পড়বে লাল-নীল-সবুজ-সোনালি সবগুলি মাছ। যদি সেই অবাক মুহূর্ত শব্দবন্দী করা না যায় যখন হাঁটু ভেঙে ঝরে পড়ে স্বপ্নের রেলগাড়ি, যদি ক্ষুধিত বাস্তবের বিপরীতে ফলশার বেগনি-মাখা ছেলেবেলার পুনরাবির্ভাব না ঘটে, তাহলে সে ব্যর্থতা হবে এমন, সিদ্ধিদাতা গদ্যের গণেশও যার ক্ষতিপূরণে অক্ষম। শব্দে ও অক্ষরে যিনি আবাল্য সমর্পিত, কপালগুণে কদাচিৎ প্রাপ্ত সেই বিরল দুর্লভ প্রাণিত মথিত মুহূর্ত ছাড়া, সৈয়দের পক্ষেও, বহুকালধরে সহবাসী নিজের দয়িতা/কবিতার ওপর অধিকার প্রতিষ্ঠা যে অসম্ভব, বহু কবিতায় তার অকপট স্বীকারোক্তি পাই।



৪.

আবদুল মান্নান সৈয়দ প্রবলভাবে ইন্দ্রিয়ঘন, তীব্র, সংরক্ত, গোলাপে-ইস্পাতে গড়া জমাট বাঁধুনির চিত্রকল্পময় কবিতা লেখেন। বলেছি, সৈয়দের অনেক উল্লেখযোগ্য কবিতার প্রতিপাদ্য অবিরলভাবে কবিতা--অর্থাৎ কবিতা যেখানে একটা স্বতন্ত্র সত্তা ও ব্যক্তিত্ব নিয়ে নিজ অস্তিত্বের ঘোষণা দেয়; বলাবাহুল্য, এটা তাঁর কাব্যের একটা সম্ভবপর পঠন মাত্র, কোনো অর্থেই একমাত্র, অনিবার্য, কিংবা বাধ্যতামূলক পঠন নয়। যে বিশেষ পঠন প্রস্তাব করছি তা কিছুটা ভিন্ন, যাকে সদর্থে ভুলপাঠও বলা যেতে পারে। এই ভিন্ন বা ভুল পাঠ প্রস্তাবের উদ্দেশ্য অর্থ-তাৎপর্য-ব্যাখ্যানের দিক থেকে অভিন্ন ও অপরিবর্তিত কবিতা-নামক-টেক্স্টের আয়তন বাড়ানো যায় কি না তা যাচাই করে দেখা।



গদ্যের সঙ্গে একধরনের, প্রায় সাংসারিক, সংঘাতে সৈয়দের কবিতার জন্ম। এই সংঘাতে তাঁর বহু কবিতা জেগে উঠলেও বিষয়টিকে কেবল গদ্য আর কবিতার বিবাদ হিশেবে দেখলে ভুল হবে। গত শতাব্দীর বিশ্রুত আধুনিকেরা কবিতার জটিল বুদ্ধিভিত্তির জন্যে কবিতার পাশাপাশি অনেক মেনিফেস্টোও রচনা করেন; কিন্তু কে না আমরা জানি, কবিতার আবেদন যতোটা আমাদের আবেগ ও অনুভূতির কাছে, ততোটা বুদ্ধির কাছে নয়। সেজন্যে ভাষার আধারে একটা বিশেষার্থে প্রাণিত মুহূর্তের আলোড়নকে সম্ভবপর অবিকলতায় ধরা যে-কোনো সৎ কবির প্রধান ও একমাত্র চেষ্টা হয়ে দাঁড়ায়। মুশকিল হল, অনুভূতি (অভিজ্ঞতা) আর অভিব্যক্তির (প্রকাশ) বিরোধ মেটানো দার্শনিকের জন্যে যেমন, কবির পক্ষেও তেমনি অসম্ভব। এই অনতিক্রম্য বিরোধ বিষয়ে আগাগোড়া সচেতন থেকে একজন কবির প্রায় সমগ্র জীবনই মানবিক বিচিত্র-জটিল-সূক্ষ্ম অনুভূতি ও তার সমান্তরাল (কিংবা সম্ভবপররকম সমীপবর্তী) অভিব্যক্তির আতীব্র অনুসন্ধানে ব্যয়িত হয়। বিপরীতে, অনুভূতির বদলে দার্শনিকেরা জোর দেন সত্যের ওপর (যাকে বলতে পারি অভিজ্ঞতার সত্য, যেমন ফেনমেনলজিতে)। তবে যেহেতু এমন কোনো দর্শনের কথা আমরা জানি না যা ভাষাশ্রয়ী নয় (অর্থাৎ এমন কোনো দর্শন নেই, ভাষার ব্যবহার ছাড়াই যা দার্শনিকের নিজের কাছে বা দর্শনের পাঠকের কাছে বোধগম্য), অর্থাৎ ভাষার সাহায্য ব্যতিরেকেই ব্যক্ত, সেজন্যে কবি আর দার্শনিকের কেন্দ্রীয় সমস্যায় খুব তফাত নেই। শব্দের সঙ্গে জগতের (বাস্তবের বা প্রতিপাদ্য প্রপঞ্চের) সম্পর্ক কী, এ জিজ্ঞাসা পাশ্চাত্য দর্শনের একেবারে গোড়ার কথা। যে-কোনো প্রধান দার্শনিক প্রকল্প বৃহদর্থে শব্দ ও জগতের সম্পর্ক নিরূপণে নিয়োজিত; কারণ, এ সম্পর্ক-নিরূপণের সংকট এড়িয়ে সত্যের মীমাংসা হতে পারে না। কিন্তু দার্শনিকেরা যেহেতু এক ধরনের বৈজ্ঞানিক সংস্কারে আস্থাবান, তাই প্রধান ঘরানার ক্যাননিকাল দার্শনিকবৃন্দ ভাষাকে (যে-ভাষায় দর্শনের অন্বেষিত সত্য ব্যক্ত হচ্ছে) একটা উপায় কিংবা মাধ্যমের বেশি কিছু মনে করেন নি। তাঁদের ধারণা, ভাষা একটা ট্রান্সপারেন্ট, স্বচ্ছ, পরিষ্কার কাঁচ---যার যথোপযুক্ত ব্যবহারে সত্য উন্মোচিত হয়। হাইডেগার কিংবা উত্তরকালের দেরিদার মতো হাতে গোনা কয়েকজন দার্শনিকের কথা বাদ দিলে (মার্কিন দেশে ব্যাপক সমাদৃত হলেও--তা-ও আবার সাহিত্য ও হিঊম্যানিটিজের বিভাগগুলোতে--দেরিদা দার্শনিক না ছদ্মবেশি সাহিত্যিক সে বিতর্কের মীমাংসা আজো হয় নি), অন্য সব দার্শনিকই ভাষা জিনিশটাকে দরকারি টুল্সের অতিরিক্ত কিছু ভাবতে অনাগ্রহী। এ বিশ্বাসের মূলে একটা বৈজ্ঞানিক সংস্কার কার্যকর। দার্শনিকেরা মনে করেন, গণিতের ভাষা যদি বাহুল্যহীন হতে পারে, সঙ্গীতের স্বরলিপি বা নোটেশন যদি বিশ্বজনীন হতে পারে, তাহলে দর্শনের ভাষাকেও সকলপ্রকার অর্থের দিত্ব/বহুত্ব, কিংবা অলংকার, প্রতীক ও রূপক থেকে মুক্ত করে শুদ্ধ, স্বচ্ছ, একেবারে ট্রান্সপারেন্টরূপে ব্যবহার্য করে তোলা সম্ভব। মোট কথা, দার্শনিকদের দৃষ্টিতে ভাষা হল তাঁদের তত্ত্ব ও বিমূর্ত ভাব বা অর্থের একটা বাহক মাত্র (অনেকটা গাণিতিক চিহ্নসম্বলিত অভিন্নার্থ-নির্দেশক ফর্মূলা, থিয়োরিম, বা ইকোয়েশনের মতো), এবং তাঁরা মনে করেন, ভাষার নিজের বা ভাষায় অন্তরিত শব্দের এমন কোনো ক্ষমতা নেই যে তা দার্শনিক-উদ্দিষ্ট অর্থের পরিবর্তন, বদল, বা ব্যত্যয় ঘটাতে পারে। দর্শনের ভাষা সংক্রান্ত এই আলোকপর্বীয় বিশ্বাস অবশ্য গত শতাব্দীতে উত্তরাধুনিকদের হস্তক্ষেপ ও বেপরোয়া আক্রমণে বেশ টলে গেছে।



আবদুল মান্নান সৈয়দ কি দার্শনিকদের ভাষা-সংক্রান্ত এই মত মানবেন? শুধু তিনি কেন, জগতের কোনো কবিই ভাষার এই অধস্তন সত্তা স্বীকার করবেন না। ভাষা যদি অনুভূতি, বক্তব্য, বা অভিজ্ঞতার সেবাদাস হত, তাহলে কোনো একটা জিনিশকে অব্যর্থভাবে প্রকাশ করবার জন্যে যুগযুগান্তর ধরে কবিদের এতো রক্তপাতের দরকার কী? একটা কবিতা যেরকম চেয়েছিলেন ঠিক সেরকম লিখে ফেলার পরও বিভিন্ন স্তবক, পঙক্তি, বা কোনো কোনো শব্দের সংস্থান নিয়ে কবিদের মনে একটা উশখুশ থাকে। ভাষার শিক্ষক হওয়া সত্ত্বেও কবির এই দ্বিধা, সংশয় ও অতৃপ্তির কারণ কী? এটা কি এজন্যে নয় যে অনুভূতি ও অভিব্যক্তির মধ্যকার স্বাভাবিক ও অনিবার্য দূরত্ব কমিয়ে আনা সম্ভব হলেও একেবারে দূর করা অসাধ্য? অন্যভাবে বললে, যে-অনুভূতিকে কবি ব্যক্ত ও সঞ্চারিত করতে সচেষ্ট, তা ভাষার আনুকূল্য ছাড়া সম্ভব নয়; কিন্তু যেহেতু অনুভূতি ও ভাষা দুই ভিন্ন জিনিশ, এমনকি বিপরীত জিনিশ, সেজন্যে ভাষার ওপর অনুভূতির নিয়ন্ত্রণপ্রতিষ্ঠা বা কর্তৃত্বারোপ কবির জন্যে শেষপর্যন্ত এক অন্তহীন লড়াই। যে কবি যতো বেশি শক্তিশালী, তাঁর কবিতায় এ লড়াই ততো বেশি তীব্র, তীক্ষ্ণ, গভীর। আবদুল মান্নান সৈয়দ সেরকম একজন শক্তিশালী কবি যাঁর কবিতার স্বাচ্ছন্দ্য ও আলিশান বহিরবয়ব এ লড়াইয়ের সকল স্বাক্ষর নিশ্চিহ্ন করে ফেললেও নিজের অন্তর্গত কবিসত্তায় এ লড়াইয়ের সত্যতা তিনি স্বীকার করবেন। মনে কি পড়ে না তাঁর উচ্চারণ:



"আমাদের মনের ভিতরে

এক-ফোঁটা সমুদ্র

আমাদের এক-খন্ড স্বপ্নের ভিতরে

অগাধ সমুদ্র

ক্রমাগত সমুদ্রস্বপ্নে ডুবে থেকে

ঘুরে মরছি আমরা

কয়েকটি মাছ"।



(সমুদ্রপাশের এ্যাকুরিয়ামে কয়েকটি মাছ, শ্রেষ্ঠ কবিতা)



দার্শনিকেরা ভাষার এই ব্যবহারকে হয়ত অস্বচ্ছ ও দূষিত বলবেন ('অস্বচ্ছ' কেননা মাছ এখানে মাছ নয়, অন্যকিছুর প্রতীক; 'দূষিত' কেননা 'মনের ভিতরে এক-ফোঁটা সমুদ্র' কথাটির ব্যঞ্জিত অর্থ--যার অস্তিত্ব অবশ্য বৈজ্ঞানিক সংস্কারে আস্থাশীল দার্শনিকেরা স্বীকার করবেন না---পাঠ ও পাঠকভেদে ভিন্ন হওয়া যে স্বাভাবিক তা নয়, কবির উদ্দেশ্যেরও অন্তর্গত) যেমন বলেছেন জে এল অস্টিন এবং সমর্থন করেছেন তাঁর অনুগামী দার্শনিক জন সিরেল; কিন্তু এই অমোঘ, প্রতীকায়িত ও প্রতিমাময় উচ্চারণ যে অত্যন্ত বাস্তব হয়ে দেখা দেয় এবং আমাদের দ্রবীভূত করে ফেলে, এবং মুহূর্তেই যে একে কবিতা হিশেবে শনাক্ত করতে পারি, তার জন্যে শুধু কবিতা ও দর্শন, কিংবা কবি ও দার্শনিকের পার্থক্য নয়, ভাষা বিষয়ে তাদের মত ও বিশ্বাসের দুই মেরুবর্তী স্বাতন্ত্র্যও দায়ী। সেজন্যেই কি ঠিক পরের স্তবকে কবি বলছেন:



"ঘের-দেয়া আকাশের মধ্যে

কাঁচ-বসানো দেয়ালের মধ্যে

ক্রমাগত সমুদ্রের স্বপ্ন দেখতে দেখতে

ক্রমাগত বালি খুঁড়তে খুঁড়তে

আমরা কিছু মাছ

রূপান্তরিত হয়ে

হলাম নুড়িপাথর

কিছু মাছ

জলজ শৈবাল

আর আমি

এইসবের ভিতরে

নিজের অজ্ঞাতসারে

কখন হয়ে উঠলাম

একটি সোনার চাবি"।



কোন্ ঘের-দেয়া আকাশের কথা বলছেন তিনি? কোন্ আকাশ? কেনই বা কাঁচ-বসানো দেয়ালের উল্লেখ? আমার মতে আবদুল মান্নান সৈয়দের নয়, এ হলো ওই কবিতার-ই স্বগতভাষণ। নয় কি? ঘের-দেয়া আকাশ কিংবা কাঁচ-বসানো দেয়ালের মানে যদি হয় বাস্তব--সে যে অর্থেই বাস্তব হোক (অনুভূতির, কল্পনার, দিব্য আলোড়নের)--তাকে উন্মোচনের জন্যে কেবল কবিতার পক্ষেই তো হওয়া সম্ভব সোনার চাবি: ভাষার বশীকরণ মন্ত্রবলে যার প্রাপ্তির সংবাদ শেষতম চরণে ঘোষণা করেছেন ষাটের সর্বাধুনিক কবি আবদুল মান্নান সৈয়দ। তাহলে আসুন একবিংশ শতাব্দীতে আমরা আবার কবিতার জয়ধ্বনি করি, কেননা কবিতা বাস্তবের অধিক বাস্তব; কেননা কবিতা মানবভাষার শক্তি, ক্ষমতা ও উদ্ভাবনার শুদ্ধ অন্তসার; কেননা কবিতা বাস্তবের অনুগমন করতে করতে, তার নুড়িপাথরের শরীর ও জলজ শৈবালের আত্মা অধিকার করতে করতে, শেষ পর্যন্ত তার রূপান্তর ঘটায়: সমুদ্রপাশের এ্যাকুরিয়ামে কয়েকটি মাছ কবিতাটির মানে কি এই নয়?

মন্তব্য ৯ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (৯) মন্তব্য লিখুন

১| ০৪ ঠা মার্চ, ২০১০ রাত ২:১১

মিটুলঅনুসন্ধানি বলেছেন: ভালো লাগলো...

০৪ ঠা মার্চ, ২০১০ রাত ২:১৮

আবদুল হক বলেছেন: ধন্যবাদ!

২| ০৪ ঠা মার্চ, ২০১০ রাত ২:৩৭

তমিজ উদ্‌দীন লোদী বলেছেন: ভালো লাগলো।

০৪ ঠা মার্চ, ২০১০ সকাল ৮:৫৭

আবদুল হক বলেছেন: ভালো লাগলো।

৩| ০৪ ঠা মার্চ, ২০১০ রাত ৩:২৭

সাগর রহমান বলেছেন: চমৎকার।। + প্রিয়তে...

০৪ ঠা মার্চ, ২০১০ সকাল ৮:৫৯

আবদুল হক বলেছেন: ধন্যবাদ!

৪| ০৪ ঠা মার্চ, ২০১০ ভোর ৪:১৭

সৈয়দ মবনু বলেছেন: তোমার স্টাডিতে আরো বরকত হোক।
সুন্দর আলোচনার ধন্যবাদ।

০৪ ঠা মার্চ, ২০১০ সকাল ৯:০৩

আবদুল হক বলেছেন: বরকত? হোক।

৫| ২৩ শে এপ্রিল, ২০১৫ সন্ধ্যা ৬:১৩

জাহাঙ্গীর.আলম বলেছেন:
ভাল লাগলো ৷

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.