নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

নাদরীসের ব্লগ

শুধু তোমার জন্য প্রেমকে আমি পরিণত করেছি কবিতায়...!

নাদরীস

নেই তবু যা আছের মতো দেখায় আমরা তাকে আকাশ বলে ডাকি, সেই আকাশে যাহারা নাম লেখায় তাদের ভাগ্যে অনিবার্য ফাঁকি ! --নির্মলেন্দু গুণ

নাদরীস › বিস্তারিত পোস্টঃ

মেহরপুরের আমঝুপি নীলকুঠি

০৭ ই নভেম্বর, ২০১২ সন্ধ্যা ৬:৩২



চিত্র: মেহেরপুরের আমঝুপি নীলকুঠি



আয়তনের বিচারে বাংলাদেশের সবচেয়ে ছোট জেলা মেহেরপুর । সুদূর অতীতকাল থেকে এ অঞ্চল নানা ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী হয়ে আছে। বিভিন্ন ঘাত প্রতিঘাতের মধ্যদিয়ে এই অঞ্চলেই উদিত হয়েছে বাঙ্গালির স্বাধীনতার সূর্য। এ অঞ্চলের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে আছে নানা ঐতিহাসিক নিদর্শন, গড়ে উঠেছে অনেক ঐতিহাসিক স্থাপনা, এরকম একটি স্থাপনার নাম আমঝুপি নীলকুঠি।



অবস্থান:



আমঝুপি নীলকুঠিটি মেহেরপুর জেলা শহর থেকে প্রায় ছয় কিলোমিটার পূর্বদিকে অবস্থিত। আমঝুপি গ্রামের দক্ষিণপাড়ার কাজলা নদীর পাড়ে এক চিত্তাকার্ষক নৈসর্গিক পরিবেশে এ নীলকুঠির অবস্থান। নীল তৈরি করতে প্রয়োজন হতো পানির। সেজন্য বাংলাদেশের নীলকুঠিগুলো গড়ে উঠেছিল কোনো না কোনো নদীর ধারে। আমঝুপি নীলকুঠিটিও তাই তৈরি হয়েছিল কাজলা নদীর তীরে। অতীতে এটি নীলকুঠি হিসেবে নির্মিত হলেও পরে এটি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাচারি অফিস হিসেবে ব্যবহৃত হতো। ঢাকা মেহেরপুর হাইওয়ে থেকে বাম পাশেই নীলকুঠি। প্রায় সাত একর জায়গা জুড়ে নীলকুঠি কম্পাউন্ড। কুঠি হতে দক্ষিন দিকে পাকা শান বাধানো ঘাট সোজা চলে গেছে কাজলা নদীর মাঝে।



নামকরণ:



কুঠিবাড়ি ঢোকার প্রবেশ পথের দু পাশের রাস্তার বড় বড় আম গাছগুলো ঝড়ে ভেঙ্গে গেছে। তারপরও কুঠিবাড়ির চারদিকে আমগাছে পরিপূর্ণ। আমঝুপি গ্রামের নামকরণের সঠিক ইতিহাস জানা না গেলেও ধারণা করা হয় এ অঞ্চলে আমগাছের সমারোহ এবং ঝোপঝাড়ের আধিক্য থাকায় নাম হয়েছে আমঝুপি। ১৯৭২ সালে তাজ উদ্দিন এখানে আসেন এবং আমঝুপি নামের সার্থকতা রক্ষায় প্রচুর আম গাছ রোপন করেন। তিনি একে পর্যটন কেন্দ্র হিসাবে প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন। এ কুঠি স্মৃতি ধরে আছে ইংরেজ কুঠিয়াল কেনি, সিম্পসন, জেমস হীল, ফারগুন ক্রাফোর্ড, ওয়ার্টস, হেমিলটনের অত্যাচার, নির্যাতন আর শোষনের কাহিনীর।



পলাশীর ষড়যন্ত্রে আমঝুপি নীলকুঠি:



নবাব সিরাজ-উদ্দৌলার বিরুদ্ধে অনুষ্ঠিত অনেকগুলো ষড়যন্ত্রের একটি বা সর্বশেষটি মেহেরপুরের সন্নিকটে আমঝুপি কুঠিবাড়িতে অনুষ্ঠিত হয় বলে একটি অপপ্রচার সমপ্রতি প্রচলন করা হয়েছে। কিন্তু এই ধারণা ইতিহাস সমর্থিত নয়। সৈয়দ আমিনুল ইসলাম তার মেহেরপুরের ইতিহাস গ্রন্থে এ প্রসঙ্গে উলেখ করেছেনঃ আমঝুপি নীলকুঠিকে নিয়ে একটি বিকৃত ইতিহাসের অবতারণা করা হয়েছে যা সংশোধন হওয়া প্রয়োজন । আমঝুপি নীলকুঠি নীলকরদের শত অত্যাচারের একটি ঐতিহাসিক স্থান। একথা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখেনা, নীলকুঠিয়াল মিকেনী, সিম্পসন, ফার্গুসেন, জেমস হিল এদের আনন্দের হোলি আর কৃষকদের নির্যাতিত হওয়ার কাহিনী আমঝুপি নীলকুঠির আকাশে-বাতাসে এখনো জড়িয়ে আছে। এই ঐতিহাসিক স্থানের গুরুত্ব অপরিসীম। কিন্তু দুঃখের বিষয় আমঝুপি নীলকুঠির ইতিহাসকে বিকৃত করে তার ললাটে এক কলংকের ইতিহাস লেপন করে দেওয়া হয়েছে। আমঝুপি নীলকুঠির দেয়ালের গায়ে বিকৃত ইতিহাসের যে শিলালিপি প্রতিস্থাপিত হয়েছে তা হবহু তুলে ধরছি আলোচ্য বিষয়টি সহজতর করার জন্যঃ



“আমাদের ইতিহাসের সোনালী স্মৃতি” ইতিহাস একটি জাতির জীবনের ধারাবাহিক চলচ্চিত্র এবং এর সভ্যতার স্মারক। মৌন অতীতকে সে মানুষের কাছে বাগময় করে তোলে নির্মোহ নিরপেক্ষতায় । ইতিহাস তাই গৌরব গর্ব ও কলংকদায়ক একসুত্রে গেঁথে প্রকাশের দায়িত্ব গ্রহণ করে। এই ইতিহাসের সড়ক বেয়েই মানুষের চিরকালের যাওয়া-আসা, প্রবাহমান জীবন স্রোত এমনি করে বয়ে চলে কাল থেকে কালান্তরে। ইতিহাসের এমনি এক ধূসর পথে সীমান্ত শহর মেহেরপুরের কোল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে আমঝুপি। এই পথে একদিন মোগল সেনাপতি মানসিংহের বিজয় রথ ছুটেছে। এই পথে ভাস্কর পণ্ডিতের বর্গী দল ধূলি উড়িয়ে গেছে লুণ্ঠনের কালো হাত বাড়িয়ে। বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার অধিপতি নবাব আলীবর্দী খাঁর মৃগয়ার স্মৃতিও রয়েছে এই খানে।

পলাশীর পরাজয়ের নীলনক্সাও রচিত হয়েছিল এইখানে- এই আমঝুপিতে। জনশ্রুতি আছে যে, এইখানেই রবার্ট ক্লাইভের সঙ্গে মীরজাফর ও ষড়যন্ত্রকারীদের শেষ বৈঠক হয়েছিল এবং তার ফলে শুধু নবাব সিরাজউদ্দৌলারই ভাগ্য বিপর্যয় ঘটেনি, বাঙালী হারিয়েছিল তার স্বাধীনতা।

ইংরেজ আমলের সূচনাপর্বে বাংলার নির্যাতিত মানুষের নীল রং রক্তে গড়ে ওঠে আমঝুপি নীলকুঠি। খুব সম্ভবত ১৮০০-১৫ সালে এখানে নীলকুঠি স্থাপিত হয়। ইতিহাস ও বিল্ডিংয়ের নির্মাণ কৌশল দেখে প্রত্নতত্ত্ববিদগণও তাই বলেন। কুঠিয়াল কেনী সিম্পসন, ফার্গুসেন সতীর্থদের অত্যাচার নির্যাতন শোষণের স্মৃতি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে কুঠি-আমঝুপি। নির্যাতিত নীলচাষীর দুর্বার আন্দোলনের ফলশ্রুতিতে একদিন বাংলার বুক থেকে নিশ্চিহ্ন হলো নীলচাষ। হাত বদল হয়ে আমঝুপি নীলকুঠি মেদিনীপুর জমিদারী কোম্পানীর কাচারীতে পরিণত হলো। দেশভাগের পর জমিদারী উচ্ছেদের সঙ্গে সঙ্গে সে অধ্যায়েরও সমাপ্তি ঘটলো।

উলেখ্য, এই নীলকুঠিসহ বাংলার সকল নীলকুঠীর প্রতিষ্ঠা হয় পলাশীর যুদ্ধের অনেক পরে অন্ততঃ কুড়ি বছর পরে। আমিনুল ইসলামের মতে, লুই বর্মো নামের জনৈক ফরাসী নীলকুঠিয়াল ১৭৭৭ সালে বাংলাদেশে সর্বপ্রথম নীলকুঠী স্থাপন করে। আর ইংরেজদের মধ্যে ক্যারেল বুম নামক জনৈক ব্যক্তি ১৭৭৮ খৃষ্টাব্দে বাংলার নদীয়া জেলায় প্রথম নীলচাষের উদ্যোগ নেন এবং নীলকুঠি স্থাপন করেন। প্রকৃত পক্ষেই চন্দননগর নিবাসী ফরাসী ঔপনিবেশিক Louis Bonnaud ১৭৭৭ সালে এদেশে সর্বপ্রথম নীলচাষ ও নীলের ব্যবসায় শুরু করেন। ব্যবসা-বাণিজ্য কিংবা নীলগাছের চাষ ও নীল উৎপাদন ও বিপণন ব্যতীত অন্য কোন কারণে নীলচাষ প্রচলনের পূর্বকালে আমঝুপিতে কোন কুঠি স্থাপনের কোন ঐতিহাসিক প্রমাণ নেই। এমনকি কোন সম্ভাবনার অনুমানেরও ভিত্তি নেই। বস্তুতঃ সমগ্র মেহেরপুর জেলার কোথাও (এমন কি মেহেরপুর শহর বা বাগোয়ান পরগণার অন্য কোন স্থানে) নীল চাষ ও নীলের ব্যবসায় শুরু হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত কোন ইংরেজ কুঠি নির্মিত হয়নি। সমসাময়িক ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় ইংরেজদের কুঠি যাকে তারা গালভরা বুলিতে Fort বলতো সেগুলি ছিল প্রধানতঃ ঢাকা, কলকাতা, চন্দননগর, কাটোয়া, কাশিমবাজার প্রভৃতি বাণিজ্য কেন্দ্রগুলোতে। স্মরণ রাখা উচিৎ ইংরেজ বণিকদের রাজ্যাভিলাষ ছিলো না, নিরুপদ্রবে সর্বাধিক হারে লাভ প্রদানকারী বাণিজ্যের প্রতিই তাদের মূল দৃষ্টি নিবদ্ধ ছিল। তারা নিজস্ব সৈন্য বাহিনী গড়ে তুলেছিল নিরাপদ বাণিজ্য যাত্রা এবং ধনসম্পদ রক্ষার জন্য। প্রায় অপ্রত্যাশিতভাবেই রাজ্যলাভের সুযোগ তারা হাতে পেয়ে তার সর্বোত্তম সদ্ব্যাবহার করেছে মাত্র। এর প্রমাণ পাওয়া যাবে . House of Commons-এ রবার্ট ক্লাইভের ভাষণের নিম্নোদ্ধৃত অংশ থেকেঃ

Let the House figure to itself a country consisting of 15 millions of inhabitants, a revenue of four millions sterling, and a trade in proportion. By progressive steps the Company have become sovereigns of that empire. Can it be supposed that their servants will refrain from advantages so obviously resulting from their situation?

এখানে Situation বলতে রাজ্য জয়ের সহজ সুযোগের কথাই ক্লাইভ বলেছেন। সুতরাং সহজেই বোঝা যাচ্ছে প্রধান প্রধান বাণিজ্য কেন্দ্র ছাড়া অন্য কোথাও কুঠি স্থাপনের কোন সম্ভাবনাই ছিল না পলাশী যুদ্ধের পূর্ব পর্যন্ত। সুতরাং পলাশী যুদ্ধের পূর্বকালে আমঝুপিতে নীল কুঠি বা কোন প্রকারের ইংরেজ কুঠির অনুমান করা এবং সেই কুঠিতে ক্লাইভ-মীরজাফরের ষড়যন্ত্র কল্পনা করা নিতান্ত অবিমৃষ্যকারিতা।

আমঝুপি কুঠিবাড়িতে কোন ষড়যন্ত্র অনুষ্ঠিত হয়েছিল ইতিহাসে এর কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি এমনকি রবার্ট ক্লাইভও তার কোন রিপোর্ট, চিঠি বা ডাইরিতেও এ বিষয়ে কোন কিছু উলেখ করেন নি। তার বিভিন্ন সময়ের রিপোর্ট ও বৃটিশ সংসদে প্রদত্ত বক্তব্যাদিতেও আমঝুপি বা মেহেরপুর বা নদীয়ার কোন স্থানে কোন গোপন বৈঠক হয়েছিল এমন কোন তথ্য পাওয়া যায় নি।

পলাশীর যুদ্ধের পূর্বে মীর জাফর প্রমুখের সাথে রবার্ট ক্লাইভের ষড়যন্ত্রের বিষয়টি ক্লাইভ স্বীকার করেছেন তার এই রিপোর্টেঃ

About this time some of his principal officers made overtures to us for dethroning him. At the head of these was Meer Jaffier, then Bukhshee to the army, a man as generally esteemed, as the other was detested. As we had reason to believe this disaffectionate pretty general, we soon entered into engagements with Meer Jaffier to put the crown on his head. All necessary preparations being completed with the utmost secrecy, the army, consisting of about one thousand Europeans and two thousand sepoys, with eight pieces of cannon, marched from Chandernagore on the 13th and arrived on the 18th at Cutwa Fort. The 22nd, in the evening, we crossed the river, and landing on the island, marched straight for Plassey Grove, where we arrived by one in the morning. [Letter written on 26 July 1757 by Robert Clive to the East India Company on the Battle of Plassey.]

ক্লাইভের এই engagements with Meer Jaffier-with utmost secrecy কিভাবে অনুষ্ঠিত হয়েছিল তা কিন্তু ক্লাইভ উলেখ করেননি। তবে তার সাথে ক্লাইভের এ বিষয়ে কখনও কোনস্থানেই সরাসরি সাক্ষাৎ হয়নি । তাদের মধ্যে দুতিয়ালির কাজ করেছিলেন ওয়াটস, স্ক্র্যাফটন, রায় দুল্র্ভ, খোজা পেত্রস, জগৎশেঠ, রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের দেওয়ান কালী প্রসাদ প্রমুখ। কিন্তু তাদের এই দুতিয়ালি কোন ধারাবাহিক কার্যক্রম ছিলনা।

পলাশীর ষড়যন্ত্র কোন একটি বৈঠকের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না । এর কালিক, ভৌগলিক এবং স্বার্থগোষ্ঠীগত বিস্তৃতি ছিল বহুমাত্রিক। এর উৎস মুর্শিদাবাদের নবাব দরবার। এই দরবার সংশিষ্ট আমির-ওমরাহ, জমিদারবর্গ এবং নানাদেশীয় শেঠ-সওদাগর প্রভৃতি শ্রেণী সংশিষ্ট ছিল এই ষড়যন্ত্রে। এই ষড়যন্ত্র বিষয়ে বিস্তারিত বর্ণনা আছে রজতকান্ত রায়ের পলাশীর ষড়যন্ত্র ও সেকালের সমাজ গ্রন্থে।

আসলে এই আমঝুপির এই স্থানটির সে সময়কার অবস্থাটি তাহলে কি ছিল? এ ব্যাপারে সৈয়দ আমিনুল ইসলাম তার গ্রন্থে উলেখ করেছেন, কাজলা নদীর খরস্রোত-বিধৌত বাঘ-শুকর থাকার মতো বিশাল জঙ্গলে আবৃত ছিল বলে অত্র এলাকার প্রাচীন ব্যক্তিবর্গের কাছ থেকে জানা যায়। মেদিনীপুর জমিদারী কোম্পানীর অধীনে আমঝুপি নীলকুঠিতে ইংরেজ আমলের সর্বশেষ নায়েব ছিলেন মোঃ দবিরউদ্দিন। তিনি আমঝুপি নীল কুঠি সম্পর্কে অভিমত ব্যক্ত করেছেন যে, নীলকুঠিয়ালদের আমলে এখানে নীলকুঠি স্থাপিত হয়। তার পূর্বে এ অঞ্চলে তেমন কোন জনপদ ছিল না বললেই চলে। রবার্ট ক্লাইভ ও মীরজাফরের ষড়যন্ত্রের নীল নকশা প্রণয়ন সম্পর্কে তিনি বলেছেন, এটা অবাস্তব এবং অত্যন্ত দুঃখজনক কল্পকাহিনী।

পলাশীর ষড়যনেত্রর সাথে আমঝুপির নীলকুঠিকে সংশিষ্ট করে তৎকালীন সময়ের কতিপয় কর্তাভজা ইতিহাস রচনার নামে যে বালখিল্য প্রদর্শন করেছেন তা ক্ষমার অযোগ্য এক ইতিহাস বিকৃতি ও অত্যন্ত দুঃখজনক অপপ্রচার। এ বিষয়ে সকল বিভ্রান্তির অবসান হওয়া উচিত। এ ব্যাপারে দেশ বিদেশের প্রথিতযশা ইতিহাসবেত্তাদের আশু দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন।





কুঠিবাড়ির বর্ননা:



আমঝুপি নীলকুঠিতে দেশীয় স্থাপত্যের সাথে ইউরোপীয় স্থাপত্য বিশেষ করে ব্রিটিশ স্থাপত্যেরীতির সংমিশ্রণ ঘটেছে। মূল কুঠি ভবনের বহির্বিভাগ দেখে এর সামগ্রিক অবস্থা অনুধাবন সম্ভব নয়। ভবনটির বাইরে চাকচিক্য না থাকলেও বিবর্ণরুপ পরিগ্রহ করেনি। অভ্যন্তর ভাগের অবস্থা রহস্যাবৃত। ভবনটিতে প্রবেশের দুটি পথ আছে। মূল প্রবেশ পথ এবং ভবনের সম্মুখ ভাগ কাজলা নদীর দিকে। কারন তৎকালে নদী পথেই চলত সকল যোগাযোগ। তাছাড়া জানা যায় নীলকরদের নৌযান এসে এখানেই থামতো। ঢুকতো এ পথ দিয়েই। নদীর মাঝ থেকে একটি শান বাধানো সিড়ি উঠে এসেছে মূল ভবনের সম্মুখ ভাগের বাগানে। এটি তৎকালে কাঠ দ্বারা নির্মিত ছিল। এ বাগানের ভিতর দিয়ে ভবনটির বারান্দায় উঠতে হয়। এটিই ভবনটির প্রধান প্রবেশ পথ।





চিত্র: শান বাধানো ঘাট বা সিঁড়ি





চিত্র: বাগানের মধ্যে দিয়ে সিড়ি থেকে ভবনে আসার রাস্তা





চিত্র: ঐতিহাসিক নীলকুঠি ভবনের সম্মুখভাগ



কুঠিবাড়ির মূল ভবনটি সূদৃশ্য একতলা ভবন। এর অভ্যন্তরে রয়েছে মোট পনেরটি কক্ষ। স্তম্ভসারির ওপরে লাল টালির ছাদ-আচ্ছাদিত বারান্দা। তিনটি করে স্তম্ভ একত্রে স্থাপিত, যার ওপর সৃষ্ট ঢালু ছাদের বারান্দা আকর্ষণীয় রুপ লাভ করেছে। বারান্দা পার হয়ে প্রবেশ করতে হয় কুঠির অভ্যন্তরে।





চিত্র: একত্রে স্থাপিত তিনটি স্তম্ভ





চিত্র: স্তম্ভের সাহায্যে স্থাপিত বারান্দা



ভেতরে মস্ত বড় একটা হল ঘর। নীলকুঠির কক্ষগুলোর মধ্যে এটিই সর্ববৃহৎ। কাঠের মেঝে যুক্ত অর্ধগোলাকার এই কক্ষের এক কোনায় একটা ফায়ার প্লেস। কক্ষটির সামনের দেয়ালের উপরিভাগে টাঙানো বড় একটি মহিষের মাথা। এর দুপাশে আরো অনেকগুলো ঘর। এর কোনটিতে বসত নাচের আসর। কোনটায় ঝাড়বাতির আলোর নীচে লুন্ঠিত হত বাঙ্গালী নারীর সতীত্ব। কোনটাতে চলতো নীলচাষীদের উপর অমানুষিক নির্যাতন। জানা যায় এটি ছিল জলসা ঘর।





চিত্র: হল ঘরে স্থাপিত মহিষের মাথা





চিত্র: হল ঘরে স্থাপিত ফায়ার প্লেস



এই নীলকুঠিতে আছে আরো কয়েকটি ছোট-বড় কক্ষ। এসব কক্ষ ব্যবহৃত হতো বৈঠকখানা, সংগীত, নৃত্যগীত এবং আমোদ-প্রমোদ করার জন্য। এর সাথে রয়েছে চারটি সাজঘর ও পরিচারকদের কোয়ার্টার। পশ্চিম দিকে অবস্থিত পরিচারকদের ও সাহায্যকারীদের বসবাসের দালান যা বর্তমানে কুঠিবাড়ির নিরাপত্তাকর্মী ও তত্বাবধায়কের বাসভবন হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এ ভবনে ছয়টি কক্ষ বিশেষ অতিথিদের ব্যবহারের জন্য সংরক্ষিত আছে বটে, কিন্তু কক্ষগুলো সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে দুর্দশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। একটি কক্ষের ছাদ ধসে পড়ার উপক্রম হয়েছে।

ছোট-বড় কক্ষগুলির মধ্যে একটি কক্ষের মেঝে বিশেষ পদ্ধতিতে নির্মিত। আমঝুপি গ্রামে সাপের প্রাদুর্ভাব ছিল বলে জানা গেছে। কুঠিবাড়ি নির্মাণের সময় সাপ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য কক্ষটির মেঝে মার্বেল পাথর দিয়ে অত্যন্ত মসৃণ এবং ঢালু যুক্ত করে তৈরি করা হয়েছিল। এমন ঢালু মেঝে তৈরি করার নেপথ্যে যেন সাপ প্রবেশ করতে না পারে সে কথাটি মনে রাখা হয়েছিল। এ ভবনে রয়েছে তিনটি শয়ন কক্ষ। পেছন দিকে রয়েছে ভোজনকক্ষ। কক্ষগুলোর উপরিভাগে রয়েছে রঙিন কাচে আবৃত গোলাকার ক্ষুদ্র আলো প্রবেশের জানালা। জনশ্রুতি আছে, নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার বিরুদ্ধে পলাশী যুদ্ধের প্রথম বৈঠক এই গোপন কক্ষটিতেই অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এখানেই লর্ড ক্লাইভ, ঘসেটি বেগম, মীর জাফরসহ অন্য ষড়যন্ত্রকারীরা পলাশী যুদ্ধের নীল নকশা তৈরী করেছিল।







চিত্র: জনশ্রুতি মতে, পলাশীর ষড়যন্ত্র এই কক্ষটিতেই অনুষ্ঠিত হয়েছিল, এ কক্ষের মেঝে বিশেষভাবে নির্মিত





বাকি তিনটি কক্ষ তুলনামূলক ছোট আকারের। বাড়ির মোট রুমের সংখ্যা ১৫টি। এখন যেটা কুঠিবাড়ির পেছনের দিক, সেসময় সেটাই ছিল সামনের দিক। এই দিকেই কাজলা নদী।



কুঠিবাড়ির ভেতরে আজও রয়ে গেছে ইংরেজদের ব্যবহার করা চেয়ার, টেবিল, খাট, মহিষের শিং ইত্যাদি। ঘরগুলোর মেঝে অত্যন্ত মসৃন। কয়েক শতাব্দী আগের বানানো এ মেঝের মসৃণতা এ যুগেও বিস্ময়কর। কাজলা নদীর ওপর পর্যন্ত সম্প্রসারিত সেতু, শানবাধানো বসার আসনবেষ্টিত ঘাট নিঃসন্দেহে এই কুঠির সবচে চিত্তাকর্ষক ও ব্যাতিক্রমী বৈশিষ্ট্য। কুঠিভবনটির দৈর্ঘ ১৫ মিটার, প্রস্থ ১০ মিটার ও উচ্চতা প্রায় ৮ মিটার। এতে রয়েছে দুটি প্রবেশ পথ ও ১৮টি জানালা। আমঝুপি কুঠিবাড়ির পূর্বদিকে রয়েছে একটি মনোরম ফুলের বাগান। এছাড়া তহসিল অফিসের সামনে রয়েছে একটি পেয়ারা বাগান। কুঠিবাড়ির আম্রকাননের পাশাপাশি রয়েছে ইংরেজ আমলে লাগানো বেশ কিছু নাম না জানা বিশাল আকৃতির গাছ। দক্ষিণ দিকে কাজলা নদীর কোল ঘেঁষে সারিবদ্ধ দাঁড়িয়ে আছে নারিকেল গাছ। এসব গাছ ও বাগানের মনোরম নৈসর্গিক পরিবেশ কুঠিবাড়ির স্থাপত্যে যোগ করেছে ভিন্নমাত্রা, যা আমঝুপি নীলকুঠির নিথর পরিবেশকে করে তুলেছে প্রাণবন্ত।





চিত্র: ইংরেজদের ব্যবহৃত আসবাবপত্র



সাধারণ জনগণের ধারণা, এ ভবনটির ভেতরের তলায় রয়েছে আরো একটি ভূর্গভস্থ কক্ষ, যা গোপন অস্ত্রাগার হিসেবে ব্যবহৃত হতো। এ কক্ষটির মেঝেতে রয়েছে একটি কূপ, যার ব্যবহার রহস্যাবৃত। অনেকের মতে এটি ব্যবহৃত হত গোপন সুরঙ্গ হিসাবে, যার শেষ মাথা নদীতে গিয়ে মিশেছে। নীলকরদের অত্যাচারে নিহতদেরকেও এই সুরঙ্গ পথে নদীতে ভাসিয়ে দেয়া হত।





উত্তর-পূর্ব কোণে রয়েছে আস্তাবলের ধ্বংসাবশেষ। বর্তমানে এ ভবনের অংশবিশেষ ব্যবহার করা হচ্ছে ইউনিয়ন তহসিলের অফিসের কাজে। উত্তর-পশ্চিম কোণে অবস্থিত নিশ্চিহ্নপ্রায় ভবনটি গুদামঘর হিসেবে ব্যবহৃত হতো।

মূল ভবনের পাশেই রয়েছে পায়রার খোপ বা ঘর। জানা যায় এসব পায়রা ছিল প্রশিক্ষিত, যাদের দিয়ে চিঠি আদান-প্রদান করা হত।





চিত্র: কবুতরের ডাকঘর



মূল ভবনের উত্তর-পশ্চিমে ছিল নীল হাউজ। এখানে বড় বড় হাউজে নীল গাছের কান্ড পানিতে ভিজিয়ে রাখা হত। অতপর নীল গাছ পঁচা পানি শুকিয়ে নীল উৎপাদন করা হত। এখন শুধু নীল হাউজটির পশ্চিম পাশের দেয়ালের ভগ্নাংশ বাদে বাকিটা বিলীন হয়ে গেছে।





চিত্র: নীল হাউজের ভগ্নাবশেষ





চিত্র: এই ছিদ্র পথে পাইপের সাহায্যে হাউজে পানি সরবরাহ করা হত





নীল হাউজের উত্তরে ছিল টেনিস কোর্ট ও হাওয়া খানা। টেনিস কোর্টের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না আর হাওয়া খানার স্থলে পরবর্তিতে ছোট একটি স্থাপনা নির্মান করা হয়েছে। ক্ষুদ্রাকৃতির অপেক্ষাকৃত মজবুত ভবন টি, একসময় খেলার পর বিশ্রামাগার ও গোপন শলা-পরামর্শ করার বৈঠকখানা হিসেবে ভূমিকা রেখেছে।



এর উত্তরে আছে অফিসার্স মেস বা আমলা ঘর। এটি পূর্ব-পশ্চিমে লম্বা-লম্বি ও উভয় পাশে কক্ষ বিশিষ্ট একতলা ভবন। উভয় পাশের কক্ষগুলোর সামনে টানা বারান্দা আছে।







চিত্র: নীলকুঠির অফিসার্স মেস



এর উত্তরে পূর্বমূখী বিরাট একটি ভবন আছে। যা রেকর্ড অফিস বা তহসিল খানা নামে পরিচিত। এখানে ব্যবসায়িক কারবার চলত। পাশাপাশি ব্যবসায়িক হিসাব-নিকাশ, দলিল ও অন্যান্য দাপ্তরিক কাগজপত্র সংরক্ষিত থাকত।





চিত্র: নীলকুঠির তহসিল অফিস





আমঝুপি নীলকুঠির বর্তমান অবস্থা: ইংরেজ আমলের সূচনা পর্বে বাংলার মানুষের রক্তে গড়ে উঠে আমঝুপি নীলকুঠি, যার অধিকাংশ স্থাপনাই বর্তমানে ধ্বংসের পথে। বৃটিশ শাসনের পর এর দায়িত্ব বর্তে ছিল মেদিনীপুরের জমিদারের উপর। ১৭-১২-৫১ তে জমিদারী উচ্ছেদ হবার পর এর দায়িত্ব বর্তায় জেলা পরিষদের উপর। পরবর্তীতে ১৯৭৮ সালের ১৩ই মে, খুলনা বিভাগ উন্নয়ন বোর্ডের আমঝুপি অধিবেশনে আমঝুপি পর্যটন কেন্দ্ররূপে স্বীকৃতি পায়। ১৮০২০০০ (আঠার লাখ দুই হাজার ) টাকা ব্যয়ে আমঝুপি কুঠিবাড়ী সংলগ্ন এলাকায় আমঝুপি নামের বিলীয়মান স্মৃতিকে পুনর্জাগ্রত করার প্রয়াসে আম্রকানন স্মৃতিসহ একটি মনোরম পর্যটন কেন্দ্রে রূপান্তরের প্রকল্প গৃহীত হয়।বর্তমানে আমঝুপি নীলকুঠিটি পর্যটন কেন্দ্রের আওতায় একটি সরকারি রেস্ট হাউস হিসেবে নিবন্ধিকৃত। কুঠিবাড়িটি মেহেরপুর জেলা পরিষদের কর্তৃত্বাধীন। জেলা পরিষদ ও রাজস্ব বিভাগ উভয়ই এর ওপর কর্তৃত্ব দাবি করায় তাদের অর্ন্তদ্বন্দ্বর কারণে সংরক্ষণ ও উন্নয়ন বাধগ্রস্ত। এসব কারণে এখানে আগত ভ্রমণকারী ও পর্যটকদের পড়তে হয় বিব্রতকর অবস্থায়। কুঠিবাড়িটি নির্মাণের পর এ পর্যন্ত চারবার সংস্কারকাজ হয়েছে। কুঠিবাড়িটিতে ১৯৬২ সালে প্রথমবার, ১৯৭৮ সালে দ্বিতীয়বার, ১৯৯৬ সালে তৃতীয়বার ও ১৯৯৯ সালে চতুর্থবার সংস্কারকাজ হয়েছে। আমঝুপি নীলকুঠিটি সংস্কার করে পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তুললে সরকার এখান থেকে প্রতি বছর প্রচুর পরিমাণ রাজস্ব আয় করবে বলে মত প্রকাশ করেছেন এলাকাবাসী।

মন্তব্য ১ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (১) মন্তব্য লিখুন

১| ২৭ শে জানুয়ারি, ২০১৪ সকাল ১০:৪০

নীল বেদনা বলেছেন: বাহ্। আমি গিয়েছিলাম দেখতে। তবে সময়ের অভাবে খুব ভালো করে ঘুরে দেখতে পারি নি আর ভেতরেও ঢোকা হয়নি। আসলে ভেতরে যে ঢোকা যাবে সেটাই বুঝতে পারিনি।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.