![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
অনিক।
আসল নাম, আহমেদ অনিক। ক্লাস ফোরের ছাত্র।
ঋতুরানী শরৎকালের দুপুর। দুপুর একটায় স্কুল ছুটির পর বাবা, মা আর বড় বোনের সাথে ভাত খাওয়া শেষ করল। খাবার পর বিছানায় খানিকক্ষণ গড়াগড়ি করে বাবা দোকানে চলে গেলেন। যাবার আগে স্ত্রী রাবেয়া খাতুনকে অনিকের দোকানে যাওয়ার কথাটা আবারও স্মরণ করিয়ে দিলেন। দোকানের কর্মচারীটা পনের দিনের ছুটি নিয়ে গতকাল দেশের বাড়ি বরিশাল গেছে। এতবড় দোকান একা চালানোটা মুশকিল। অনিক থাকলে একটা ক্যাশ বাক্স অন্তত সামলাতে পারবে।
অনিক ছটফট করছে। গ্রামের সমবয়সী ও বড়রা প্রায় সবাই ঘুড়ি ওড়াতে খোলা ক্ষেতে জড়ো হয়েছে। মনটা পরে আছে ঘুড়ি ওড়ানোর সঙ্গীদের ওখানে। নীল আকাশে উড়ছে লাল, নীল, নানা রংয়ের ঘুড়ি। চারদিকে সবুজের মাঝে আকাশে যেন রংয়ের ছড়াছড়ি। এতক্ষণে ঘুড়ি ওড়ানো ও ঘুড়ি কাটাকাটিতে মেতে উঠেছে সবাই। সে নিজে অবশ্য ঘুড়ি ওড়ায় না। ওর লাটাই, ঘুড়ি কোনটাই নেই। বাবা’র কড়া নির্দেশ, ঘুড়ি ওড়ানোর বদভ্যাসটা একবার পেয়ে বসলে অনিকের লেখাপড়া শিকেয় উঠবে। দুষ্টু ছেলেরাই নাকি ঘুড়ি ওড়ায়। বাবা এমন কেন ! মুহিব ভাইয়া ঢাকার কত বড় একটা কোম্পানিতে চাকুরী করেন। তিনিওতো ছুটিতে বাড়ি আসলে সারাদিন লাটাই, ঘুড়ি নিয়ে পরে থাকেন। তিনি নাকি ছোটবেলা থেকেই ঘুড়ি ওড়ান এবং বেশ ভালই ওড়াতে পারেন। তারতো লেখাপড়া বা স্বভাবে খারাপ কিছু চোখে পরেনা। বাবা কি বোকা, না আমাকে দেখতে পারেনা?
শরৎকালের মিষ্টি রোদেলা দুপুরে মা, বড় জেঠি, মেঝো জেঠি, ছোট জেঠি সহ আশেপাশের মহিলারা অনিকদের উঠোনে শীতল পাটি বিছিয়ে চুল বাছা আর গল্পগুজবে মত্ত। বড় আপা ঘরের ভিতর একাকী শুয়ে আছে। তার নাকি মাথা ব্যাথা। বড় জেঠির কি এক কথায় সবাই কিশোরী মেয়েদের মত খিলখিল করে হেসে একজন আরেকজনের উপর গড়িয়ে পড়ছে। চারিদিকে কি অদ্ভুত আনন্দ। শুধু অনিকের মনটাই খারাপ।
অনিককে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে রাবেয়া খাতুন বললেন, এখনও দোকানে যাসনি? তোর বাবাতো রেগে যাবে। তাড়াতাড়ি দোকানে যা। বড় আপার বান্ধবী পাশের বাড়ির শম্পা আপা ফোঁড়ন কেটে বললেন, তাড়াতাড়ি যা, নইলে চাচাজান দোকানের ঝাঁপের লাঠি দিয়া মাথায় বাড়ি দিয়া ঘিলু বের করে দেবে। ঘিলু ছাড়া খালি মাথা নিয়া ঘুরবি ...... হি হি হি হি। অনিকের মা কপট রাগে বললেন, কি যে বলিস না শম্পা! মগজ ছাড়া মানুষ বাঁচে ... বলতে বলতে তিনিও হেসে ফেললেন। হাসি সংক্রামক; সকলেই আবারও হেসে প্রায় গড়াগড়ি খাওয়ার অবস্থা। অনিকের প্রচণ্ড রাগ হচ্ছে। মন চাচ্ছে শম্পা আপুর বড় বড় চুলগুলি ধরে হ্যাঁচকা টান মেরে মাটিতে ফেলে দেয়, ব্যাথায় যাতে বাবাগো, মাগো করতে থাকে। একদিন ঠিকই এমন করবে বলে সিদ্ধান্ত নেয় অনিক।
দৌড়ে দোকানের দিকে যাবার সময় অনিক ওর মায়ের হাসিমাখা কণ্ঠ শুনতে পেল, বাড়িতে ফেরার সময় তোর বাবার কাছ থেকে টাকা নিয়ে দুইটা আমড়া নিয়ে আসিস।
অনিকদের দোকানটি বেশ বড়। একদিকে মুদিমাল, আরেকদিকে ষ্টেশনারী ও পান সিগারেটের জন্য আলাদা করা হয়েছে। মুদিমাল, ষ্টেশনারী ও পান, সিগারেটের জন্য আলাদা ক্যাশ বাক্স। মুদিমালের ক্যাশ বাক্সের কাছে অনিককে বসতে বলে বাকি মাল নেওয়া লোকটির সাথে নতুন করে ঝগড়া শুরু করলেন। তুমুল ঝগড়া। মজা দেখার আশায় আশেপাশের লোকজন ভিড় করে আছে।
শালার পো আজ একবছর যাবৎ আমার পাওনা পাঁচ হাজার টাকা দেস না। পাইকাররা কি আমার হমন্দি লাগে? মাল কি মাগনা আনিরে হউরের পুত। আমার দোকানে বাকি ফালাইয়া অন্য দোকানতে নগদে মাল কিনস? আরও কিছু অশ্লীল বকাঝকা করে মনের ঝালটা মিটাতে চাইলেও ছেলের সামনে এসব বলা ঠিক হবেনা ভেবে রশিদ মিয়া চুপ করে গেলেন। সিদ্ধান্ত হল আগামী মাসের মধ্যে দেনাদার তার সমূদয় পাওনা শোধ করবে। রশিদ মিয়া এতকিছুর মধ্যেও ছেলের অবাক দৃষ্টিটা ঠিকই লক্ষ্য করলেন।
হঠাৎ করেই সবকিছু শান্ত হয়ে গেল। রশিদ মিয়া দোকানে উঠে বেচাকেনা শুরু করলেন। মুদিমালের অংশে তাকিয়ে লক্ষ্য দেখেন অনিক দুই সের চাল মাপতেই সবকিছু উল্টাপাল্টা করে দিচ্ছে। পোয়াখানেক চাল বস্তার নিচে পরে আছে। অনুমান করে কাগজের ঠোঙায় দুই সেরের বদলে তিন সের উঠিয়ে পাল্লায় দিয়েছে। কমাতে গিয়ে হয়ে গেছে দেড় কেজি। রশিদ মিয়া ওর অবস্থা দেখে হাসবেন না কাঁদবেন বুঝে উঠতে পারছেন না।
রশিদ মিয়া নিজেই উঠে গিয়ে চাল মেপে মুদিমালের ক্যাশ বাক্সে টাকা রাখতেই অনিকের মায়ের জন্য আমড়া কেনার টাকা চাওয়ার কথাটা মনে পড়ে যায়। কিন্তু কিছুক্ষণ আগের ঝগড়াঝাঁটি আর নিজের অপদার্থের মত কাজকারবারে বাবার কাছে আমড়া কেনার টাকা চাইতে সাহস পাচ্ছেনা।
সন্ধ্যার কিছু আগে রশিদ মিয়া অনিককে বললেন, তুই বাসায় চলে যা। আমি দোকান বন্ধ করে চলে আসব। কি আর করা তাড়াতাড়িই দোকান বন্ধ করতে হবে। এতকিছু একা সামলানো যায় না।
সন্ধ্যার পর রশিদ মিয়া অত্যন্ত গম্ভীর মুখে বাড়ি ফিরেই অনিককে পড়ার চেয়ার থেকে ঘাড় ধরে তুলে একনাগাড়ে চড় মারতে লাগলেন।চিৎকার করে বলতে লাগলেন, শূয়রের বাচ্চা, আজ তোকে মেরেই ফেলব। কোন চোর আমার ছেলে হতে পারেনা। তুই আমার ছেলেনা। তুই ক্যাশ বাক্স থেকে টাকা চুরি করেছিস। তুই অনিক না, তুই একটা চোর। ধাক্কা মেরে ওকে বাইরের উঠানে ফেলে দিলেন। বের করার সময় কাঠের দরজার সাথে ধাক্কা লেগে অনিকের ঠোঁট কেটে যায়। বেশ ভালই কেটেছে। অনিক রক্ত পড়ার ধারাটা টের পাচ্ছে। রক্তের ধারাগুলি চোখের পানির সাথে মিশে ফোটায় ফোটায় উঠানের উপর পরছে।
রাবেয়া খাতুন গোয়ালঘরে ধোঁয়া দেয়ায় ব্যস্ত থাকাতে মারপিটের ঘটনাটা টের পাননি। আফিয়ার মুখ থেকে সব শুনে ধোঁয়া দেয়া বন্ধ করে দৌড়ে উঠানে গিয়ে অনিককে মাথা নিচু করে বসে থাকতে দেখলেন। হারিকেনের আলোতে রক্ত, চোখের পানি আর ফোলা ঠোঁট দেখে মাথাটা কেমন যেন ঘুরে উঠল। ছেলের শুশ্রূষা শেষে স্বামীর মুখোমুখি হলেন।
অনিককে এভাবে মারলেন কেন?
ও ক্যাশ থেকে চুরি করেছে।
কত টাকা চুরি করেছ?
দুই টাকা।
দুই টাকায় কয়টা আমড়া পাওয়া যায়?
মনে হয় দুইটা, বেশি খেঁচাখেঁচি করলে তিনটাও কেনা যায়। এসব আজব প্রশ্ন করছ কেন?
আপনার কি মনে হয়, ওই টাকা দিয়ে অনিক কি করত?
ঘুড্ডি কিনে ওড়াত, আর কি করবে।
আপনি একটা, আপনি একটা ............ খারাপ কিছু বলতে গিয়েও রাবেয়া বেগম চুপ করে গেলেন। নিষ্প্রভ কণ্ঠে বললেন ওকে আপনার কাছ থেকে টাকা নিয়ে আমড়া আনতে বলেছিলাম। রশিদ মিয়ার কাছে পুরো বিষয়টিই পরিস্কার হয়ে গেল। ছেলেটা ভয়ে তার কাছ থেকে টাকা চায়নি।
অনিকের রক্ত বন্ধ হয়েছে। বাজারের ফার্মেসী থেকে ডাক্তার ডেকে এনে ব্যাথার ঔষধ দেয়া হয়েছে। কপাল ভাল ঠোঁটে কোন সেলাই করতে হয়নি। কাটা ঠোঁটের কারনে রাতে অনিক ভাত খেতে না পারায় ওকে শুধু দুধ খাওয়ানো হয়েছে। অনিক ওর মাকে জানিয়েছে যে, সে আজ বাবা-মা’র সাথে ঘুমাবে না। বড় বোন আফিয়ার সাথে ঘুমাবে।
রাত প্রায় বারটা বাজে। আফিয়া ভাইকে বুকে জড়িয়ে ঘুমিয়ে আছে। চুপিসারে রশিদ সাহেব ওদের ঘরে ঢুকলেন। বাবার পায়ের শব্দ পেয়ে আফিয়ার ঘুম ভেঙ্গে যায়। হারিকেনের স্বল্প আলোতে আফিয়া বাবার হাতে ধরা ঘুড়ি আর সুতাসহ লাটাই দেখতে পায়। আস্তে করে ভাইকে সামান্য সরিয়ে বাবার কাছে এল। রশিদ সাহেব তিনটা ঘুড়ি আর লাটাই আফিয়ার হাতে দিয়ে বললেন, সকালে এগুলি অনিকের হাতে দিবি। ঘুড্ডি ওড়ালে আমার কোন আপত্তি নেই, তবে নেশায় যাতে না পরে সেদিকটা তুই খেয়াল রাখবি।
আমার ভাই খারাপ হবেনা বাবা। অনিক আমার ভাই। রশিদ সাহেব চোখের পানি আড়াল করতেই কিনা কে জানে; দ্রুত ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন।
বাবা ঘর থেকে বের হতেই আফিয়া ছোট ভাইকে ডেকে তোলার সিদ্ধান্ত নিল। অস্ফুট আওয়াজের ডাক শুনেই অনিক এক লাফে শোয়া থেকে উঠে বসে। এই দেখ, বাবা তোর জন্য কি এনেছে বলেই ঘুড়ি আর সুতাসহ লাটাই বাড়িয়ে ধরে। উত্তেজিত কণ্ঠে অনিক বলে উঠে, আপা হারিকেনের আলোটা একটু বাড়াতো।
ও মা, কি সুন্দর ঘুড্ডি। দেখ আপা দেখ, সাদা ঘুড্ডির লেজটা কেমন সবুজ ! সবুজ আর লাল ঘুড্ডি দুইটাও অনেক সুন্দর। তবে এই সাদা ঘুড্ডিটাই সবচেয়ে সুন্দর। সবার চেয়ে আমার ঘুড্ডিগুলিই বেশি সুন্দর, তাইনারে আপা। আচ্ছা আপা, বাবা মাঞ্জা দেয়া সুতা কোথায় পেলরে?
কি জানি কোথায় পেয়েছে। এখন ঘুমা। আফিয়ার স্বরটা একটু রুক্ষ হলেও কেমন যেন ভেজা ভেজা। ভাইয়ের আনন্দটা সে নিজের মধ্যে খুব তীব্রভাবেই অনুভব করতে পারছে।
আপা, ওই আপা, ঘুড্ডিগুলি আর লাটাইটা বিছানায় রেখে ঘুমাই?
তোর যা মন চায় কর। আমাকে ঘুমাতে দে।
আফিয়া আধখোলা চোখে তার অতি আদরের ছোট ভাইটির দিকে তাকিয়ে আছে। অনিক মাঝে মাঝেই অস্ফুট কণ্ঠে বলে উঠছে, বাকাট্টা হুতা লোট। যেন অনিক সাহেব এই মাঝরাতে অন্যজনের ঘুড়ি কেটে নিজের বিজয়ী মনোভাব প্রকাশের জন্য মনের আনন্দে চিৎকার করে যাচ্ছেন।
ঘুড়ি ওড়ানোর আগে সবাই যেভাবে মাথায় ঘষে নিয়ে ঘুড়িটা একটু বাঁকা করে নেয়, অনিকও সেভাবে সবুজ লেজওয়ালা ঘুড়িটাকে মাথায় ঘষছে। উত্তেজনায় ঘুড়ির উপর চাপটা একটু বেশিই পরে গেছে মনে হয়। কট শব্দে মাঝের কঞ্চির কাঠামোটা ভেঙ্গে যায়।
আফিয়া ছোট ভাইয়ের অস্ফুট কান্নার শব্দটা শুনে যাচ্ছে। দীর্ঘক্ষণ পর আফিয়া শোয়া থেকে উঠে বসে ভাইকে বুকে জড়িয়ে ধরে। বুকের মাঝে মুখ লুকিয়ে অঝোর কান্নায় ছোট্ট শরীরটা কেঁপে কেঁপে উঠছে। আফিয়া বেশ জোর দিয়েই বলে, ওই পাগলা, কাঁদিস কেন, আমি আছিনা। তোর কয়টা ঘুড্ডি লাগবে?
অনিক মুখ উঠিয়ে বোনের চোখে চোখ রাখে। অনিক আপার চোখের দিকে তাকিয়ে পরম ভরসা আর আশ্রয় খোঁজে। আপার চোখে সে যা ভেবেছিল তারচেয়েও বড় আশ্রয় আর ভরসাটা টের পেল। রশিদ সাহেব আর রাবেয়া খাতুন দরজা ওপাশ থেকে একদৃষ্টিতে ভাই-বোনের দিকে তাকিয়ে আছেন। তাদের চোখেও শব্ধহীন কান্নার ঢল।
২| ২৪ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৭ রাত ১১:০৩
আলমগির কবির বলেছেন: দারুণ
৩| ২৫ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৭ বিকাল ৫:৫৭
হুয়ায়ুন কবির বলেছেন: ধন্যবাদ আলমগির কবির।
৪| ২৫ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৭ রাত ১০:০৫
ভ্রমরের ডানা বলেছেন:
ব্লগে স্বাগতম... আপনার আঘামী দিনগুলোর জন্য অশেষ শুভকামনা...
৫| ২৬ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৭ রাত ১২:০০
হুয়ায়ুন কবির বলেছেন: ভ্রমরের ডানা, আপনার শুভ কামনার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ। ভাল থাকবেন।
৬| ০৯ ই অক্টোবর, ২০১৭ সন্ধ্যা ৭:২৭
আলমগির কবির বলেছেন: আরও লেখা চাই।
©somewhere in net ltd.
১|
২৪ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৭ বিকাল ৫:৫১
হুয়ায়ুন কবির বলেছেন: ঘুড্ডি ............।।