নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আমাকে খুঁজে ফিরি

হুয়ায়ুন কবির

হুয়ায়ুন কবির › বিস্তারিত পোস্টঃ

দোটানা

২৩ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৭ বিকাল ৩:৪৪



আজ তিনদিন হলো আসাদ বাড়ি এসেছে। শুয়ে বসেই দিন কাটছে; ডাক্তারের পরামর্শ মোতাবেক Complete Bed Rest for seven days এর মতো। এটা অবশ্য আসাদের নিজের প্রেসক্রিপশন। আরও দশ পনেরো দিন থাকার ইচ্ছে। নিজের মনকে শান্ত রাখার জন্য গ্রামে আসা। অবশ্য এর মধ্যেই আসাদ এর পিতা মইনুদ্দিন সাহেব কিছু একটা টের পেয়েছেন। মইনুদ্দিন সাহেব ছয় বছর আগে সরকারী চাকুরি থেকে অবসর নিয়েছেন। অবসর নেবার পর সাধারণত মানুষেরা রগচটা হয়, কিন্তু মইনুদ্দিন সাহেবকে যেন আগের চেয়ে আরও প্রফুল্ল মনে হয়। খিটখিটে মেজাজের মানুষটির আকস্মিক এই বিপরীতমুখী বদলে যাওয়াতে বাড়ির পরিবেশটাই পুরো পাল্টে গেছে। সবসময়ই কেমন যেন উৎসব উৎসব ভাব।

মইনুদ্দিন সাহেব বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছেন। কেমন পরিচ্ছন্ন একটা ভাব। আসাদ বেরুতে গিয়ে মইনুদ্দিন সাহেবের মুখোমুখি হয়ে গেলো। আসাদ একটু বিচলিত বোধ করছে। কখন হাসিহাসি মুখে কোন বেকায়দা প্রশ্ন করে ফেলেন! চোরের মন পুলিশ পুলিশ টাইপের অনুভুতি হচ্ছে। আসাদকে অবাক করে দিয়ে মইনুদ্দিন বেশ অমায়িক কণ্ঠেই ছেলেকে ডাকলেন, কেমন আছিস বাবা। কোথাও যাচ্ছিস নাকি?

আসাদের সময়টা পনেরো বছরেরও বেশি আগে ফিরে গেলো। সেই মধুর ডাক; ভালবাসার মায়াবী অভিব্যক্তি।

মন খারাপ কেন? বাড়িতে আসার পর থেকেই দেখছি ঘর বন্ধ করে শুয়ে থাকিস। কোন সমস্যা?

না বাবা, কোন সমস্যা নেই।

সমস্যা না থাকলে এমন মনমরা হয়ে থাকিস কেন? আর সমস্যা থাকলে আমাকে বল। আপনজনের সাথে সমস্যা নিয়ে আলোচনা করবি নাতো বাজারের মুচির সাথে করবি? একটু বস, চা দিতে বলি। চা খেতে খেতে বাপ, ব্যাটা কথা বলি, নাকি?

না বাবা, তেমন কিছু হয়নি। রাতে তোমার সাথে কথা বলবো। এখন সাফিনকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাবো।

কোন ডাক্তারের কাছে যাবি? আমার বন্ধু শহীদ খানের কাছে যা। আমি মোবাইল করে দিচ্ছি। খুব ভালো ডাক্তার। হাতে যশ আছে। স্পেশাল কেয়ার নেবে। আসলে আপনজনের মধ্যে ডাক্তার, উকিল, পুলিশ এসব পেশার লোক থাকলে অনেক কাজে আসে। আমারতো মনে হয়, ওর কাছে গেলে কোন ফী নেবেনা, তারপরেও জোর করে হলেও ফী’টা ওকে দিবি। এটা ওর পেশা। পেশার সম্মান করতে হয়।

আসাদ প্রাণপণে হাসিটা চেপে রাখলো। মনে মনে বললো, বাবা, দুনিয়া বদলে গেছে, তুমি বদলালে না!

গত বছর আসাদকে সাত বছর বয়সী বড় ভাইয়ের ছেলে সাফিনকে নিয়ে বাবার স্কুল জীবনের বন্ধু ডাঃ শহীদ খানের কাছে যেতে হয়েছিলো। বাবা ফোন করেছিলেন যাতে তার নাতীকে একটু ভালোভাবে দেখে দেয়। ফোন করে বেশ উৎফুল্ল কণ্ঠে বলেছিলেন, আসাদ সিরিয়াল ধরতে হবে না। গিয়ে অ্যাসিস্ট্যান্ট এর কাছে শুধু আমার নাম বলবি। তুই যাবি এই কথাটা ডাক্তার তার অ্যাসিস্ট্যান্টকে বলে দিয়েছে। দেখেছিস, এটাই হলো বন্ধুত্ব, হা হা হা করে উচ্চকণ্ঠে তৃপ্তির হাসি হাসলেন।

আসাদ সাফিনকে নিয়ে ডাক্তার শহীদ খানের চেম্বারে গিয়ে অ্যাসিস্ট্যান্টের কাছে মইনুদ্দিন সাহেবের নাম বললেন। জবাবে অ্যাসিস্ট্যান্ট ছোকরাটা বললো, সিরিয়াল দিয়েছেন? সিরিয়াল ছাড়া ডাক্তার স্যারের কাছে যাওয়া যাবে না। আর আজ রোগীর চাপ বেশি। কাল সকালে ফোন করে সিরিয়াল দিয়ে তারপর আসবেন। ছোকরার কথায় না, ওর উগ্র আচরণে মেজাজটা চরম অবস্থায় পৌঁছালেও নিজেকে শান্ত রেখে আসাদ বললো, তুমি গিয়ে ডাক্তার সাহেবকে বলো মাইনুদ্দিন সাহেব আমাদের পাঠিয়েছেন। তুমি করে বলাতেই কিনা এক ছোকরা অ্যাসিস্ট্যান্ট মেজাজি ভঙ্গিতে আসাদের দিকে তাকিয়ে ডাক্তার সাহেবের রুমে ঢুঁকে। কিছুক্ষণ পর ফিরে এসে পুলিশ অফিসারের ভঙ্গিতে বললো, ডাক্তার স্যার আপনাদের বসতে বলেছেন। ছোকরার পাছায় কষে একটা লাথি দেবে কিনা ভাবতে ভাবতে ওয়েটিং রুমের চেয়ারে চাচা, ভাতিজা বসে গল্প শুরু করলো। সাফিনের সাথে বয়স্কদের মতো নানা বিষয় নিয়ে কথা বলতে লাগলো। ছেলেটা দেখতে শুকনা পাতলা হলে কি হবে, তর্কে কে.ডি. পাথকের ন্যায়। ওর সাথে কথা বলেও আরাম পাওয়া যায়। কোথা থেকে কি এনে তর্কের সাথে যুক্তি দিয়ে নিজের ধারনাটাকে প্রতিষ্ঠা করবেই করবে। মানে, সব কথার শেষ কথাটা হবে ওর এবং তা হবে অখণ্ডনীয় যুক্তি। মনে হয় দাদা ভাইয়ের চেয়ে ভাবীর কাছ থেকে পাওয়া ক্রোমোজোমের কার্যকারিতা ওর মধ্যে বেশি। বড় ভাবীও যুক্তিতর্কে বেশ পাকা।

ঘণ্টা দুয়েক পর ডাক্তার সাহেবের রুমে যাবার অনুমতি পাওয়া গেলো। ডাক্তার সাহেবের মুখটা বেশ কঠিন হয়ে আছে। কাঠিন্যটা মনে হয়না বহু রোগী দেখার কারনে। কারন সপ্তাহের ছয়দিনই তাকে রোগীর চাপ সহ্য করতে হয়। হঠাৎ করেই কারণটি আসাদের মনে ধরা পড়লো। ডাক্তার সাহেব অকারণেই বেশ উঁচু কণ্ঠে সাফিনকে চেয়ারে বসতে বললেন, আসাদকে রোগ সম্পর্কে কিছু জিজ্ঞেস করলেন না, সাত বছর বয়সী সাফিনকে বললো, তোমার কি হয়েছে, সমস্যাটা কি? সাফিন প্রথমে ভ্যাবাচ্যাকা খেলেও দ্রুত নিজেকে সামলে নিয়ে বললো, ঠাণ্ডা লেগেছে। মাথা ব্যাথা। ডাক্তার সাহেব বুকে স্টেথোস্কোপ লাগিয়ে চেক করলেন। আসাদের মনে হলো, একটু যেন জোরের সাথেই ওকে ঘুরিয়ে পিঠে স্টেথোস্কোপ লাগালেন। প্রেশকিপশন এর বইটি নিয়ে মিনিট পাঁচেক ধরে কি কি যেন লিখলেন। লেখা শেষ করে আসাদের দিকে বাড়িয়ে ধরে নির্দিষ্ট একটা ডায়াগনস্টিক সেন্টার এর নাম বলে মাথা ঝাঁকালেন। মানে নিষ্ক্রান্ত হও। আসাদ প্রেশকিপশনটা হাতে নিয়ে Advice গুলি দেখে হেসে ফেললো। ওখানে হাঁটুর এক্সরে সহ আট ধরনের টেস্ট Advice করা হয়েছে। মানিব্যাগ বের করে পাঁচশো টাকার দু’টা নোট বের করে সাফিনের হাতে দিয়ে ইশারা করতেই নোট দু’টি ডাক্তারের হাতে দিলো। ভিজিট সাতশো। বাকি তিনশো টাকা ফেরত দেবার সময় আসাদ ডাঃ শহীদ খানকে উদ্দেশ্য করে বললো, আপনি আমার বাবার বন্ধু। যদি তাঁর বন্ধু না হতেন, তবে ঠিক নাক বরাবর একটা ঘুষি খেতেন। তিনশো টাকা আপনার বকশিস। বয় বেয়ারাদের যেমন বকশিস দেওয়া হয় তেমন কিছু একটা ভেবে আনন্দচিত্তে গ্রহন করুন। আপনার আচরণ দ্বারা আপনি আমার বাবাকে অপমানিত করেছেন। বিনা ফী’তে আপনার কাছে চিকিৎসা নিতে আসিনি। ডাক্তার নামক কসাই না হয়ে যদি মানুষ হতে চান, তবে আপনাকে বন্ধুত্বের উচ্চ আসনে বসিয়ে রাখা মইনুদ্দিন সাহেবের সাথে কিছু সময় কাটিয়ে আসবেন। সাফিন ডাক্তারকে আড়াল করে হাত মুষ্ঠিবদ্ধ করে দেখালে চোখের ইশারায় আসাদ নিষেধ করলো।

আসাদ সাফিনকে বললো, চল ব্যাটা, চা খাবো।

চা না, কফি খাবো।

আরে ব্যাটা তুইতো বড় হয়ে গেছিস মনে হচ্ছে?

সাফিন দাঁত খিচিয়ে জবাব দিলো, এদিকে তাকাও, দেখো আমার কয়টা দাঁত পরেছে? চারটা। বড় হলেইতো দাঁত পরে। দেখোনা, দাদু’র দুইটা দাঁত পরে গেছে।

তর্ক করার মহাসুযোগ। কিন্তু মনটা সবমিলিয়ে এলোমেলো হয়ে আছে। চুপ করেই রইলো। সাফিনকে বললো, কাল তোকে নিয়ে সরকারী হাসপাতালে যাবো, যাবি?

কথাটা শুনেই সাফিনের চোখে মুখে আনন্দের ঢেউ খেলে গেলো। সেখানে চাচার সাথে গেলে মজার মজার ঘটনা ঘটে। সাফিনের খুব ভালো লাগে। ওদের উষধ খেলেও কেমন যেন তাড়াতাড়ি ভালো হয়ে যায়। শুধু আসাদ চাচা’ই ওকে সরকারী হাসপাতালে নিয়ে যায়। চাচা বাড়িতে আসলেই অসুস্থ হতে মন চায়।

রাতে খাবার পর মইনুদ্দিন সাহেবের সাথে আসাদের সামান্য কথাবার্তা হয়।
চাকরী নিয়ে তোর কোন সমস্যা হচ্ছে নাকি?

হুমম, একটু সমস্যা হয়েছে। কিন্তু সমস্যাটা মিটবে না। বাড়বেই এবং অতি তিক্ততার সাথে এর সমাপ্তি হবে। আসাদ চাকরী সংক্রান্ত আর কোন কথা বলতে চায় না বলেই হরবর করে একটানা বলে গেলো।

মইনুদ্দিন সাহেব অতি বুদ্ধিমান মনুষ্য শ্রেনীর মধ্যে না পরলেও ছেলে বিষয়টি এড়িয়ে যেতে চাচ্ছে তা বেশ ভালোভাবেই বুঝতে পারছেন। কথার ছন্দ হারিয়ে গেছে। আসাদকে ঘুমুতে যাবার কথা বলে নিজে ঘরে ঢুকলেন।
বেশ ভোরে আসাদের ঘুম ভাঙে। আশ্চর্য সুন্দর চারিদিক। যদিও ছোটবেলার পটে আঁকা চিত্রটি নেই, কেমন যেন শহুরে ভাব। মইনুদ্দিন সাহেবের প্রকৃতি প্রেমের কারনে আসাদদের বাড়িটায় কিছুটা হলেও গ্রাম্য ভাব রয়ে গেছে। মইনুদ্দিন ঘর থেকে কাউকে না জানিয়ে বের হয়ে আসলো। বাবার ঘর থেকে কুরআন তেলাওয়াতের সুমধুর আওয়াজ ভেসে আসছে।

দালান কোঠার সংকীর্ণ গলি পেরিয়ে বালু ভরাট করা একটা জায়গায় পৌঁছালো। তিন, চার, পাঁচ, সাত কাঠা হিসাবে ভাগ করা। দাবার ঘরের মতো মনে হচ্ছে। আসাদকে দেখে এই মুহূর্তে যে কেউ ভাববে, ও এখন ঘুমিয়ে আছে।

আট বা নয় বছর বয়সে আসাদ আর ওর বড় বোন সাবিনা খাতুন বর্ষাকালের কোন এক দুপুরের আগ মুহূর্তে শাপলা, শালুক তুলতে এখানে এসেছিলো। সাবিনা খাতুন ওর চেয়ে দু’বছরের বড়। নতুন সাঁতার শেখা আসাদ বোনের শাপলা, শালুক তোলার রোমাঞ্চকর গল্প শুনে সাথে যেতে চাইতেই সাবিনা খাতুনের কড়া ধমক- এতদূর সাঁতরে যেতে পারবিনা। আরও ভালোভাবে সাঁতার শিখে নে, তারপর যাওয়া যাবে। নাছোড়বান্দা আসাদকে ধমকে ঠেকাবে এমন সাধ্য কার! বোনের পিছু পিছু বাড়ির শুকনো জমিটা পার হয়েই দে পানিতে ঝাঁপ। চারিদিকে শুধুই পানি আর পানি। কচুরিপানার সাথে পাট ক্ষেতের নানা লতাপাতায় পরিপূর্ণ পানি, কেমন যেনো ঘোলাটে। সাঁতরাতে গিয়ে প্রায়ই বাধাগ্রস্থ হতে হচ্ছে। আনাড়ি সাতারু আসাদকে অনেক পেছনে ফেলে সাবিনা খাতুন উঁচু মতো একটা জায়গায় পৌঁছে ভাইয়ের দিকে ফিরে তাকায়। আসাদ এখনও অনেক পিছনে। ভাইয়ের জন্য অনেক দেরী হয়ে যাবে বলে মনে হচ্ছে।

ঢিবির উপর পৌঁছে বিশ্বখ্যাত মাইকেল ফেলপ্স এর হাসি আসাদের মুখে। সাবিনা খাতুন কি বলতে গিয়েও বললো না। ভাই, বোনের আগেই আরও গোটাকয়েক দুরন্ত বালক-বালিকা সেখানে পৌঁছে গেছে। আসাদ পৌঁছাতেই সবাই মিলে শাপলা, শালুক তোলার উৎসবে মেতে উঠলো।

ঘণ্টাখানেক উৎসব চলার পর বাড়ি ফেরার পালা। সাবিনা খাতুন আসাদকে সাঁতরে ফিরে যেতে পারবে কিনা জিজ্ঞেস করলো। মহাবীর আসাদ বেশ জোরে মাথা নেড়ে বোনকে নিশ্চিত করলো যে, সে পারবে। সাবিনা খাতুনের ইচ্ছে ছিলো আশেপাশের কোন একটা নৌকা ডেকে ভাইকে নিয়ে বাসায় ফিরবে। কিন্তু অতি আদরের ছোট ভাইয়ের জেদ মেশানো ঘাড় নাড়া দেখে সেটা আর করা হলোনা। ফিরতি পথে সাঁতরে যেতে মিনিট পনেরো সময় লাগবে। সাবিনা খাতুন ভাইকে নির্ভার করে শাপলা, শালুকের বোঝা নিজের কাঁধে নিয়ে সাঁতরে বাড়ির দিকে রওনা দিলো।

মাঝামাঝি দুরত্বে আসার পরই আসাদের ত্রাহি অবস্থা। কেমন যেনো দম বন্ধ হয়ে আসছে। সাবিনা বেগম পাশে পাশেই ধীর গতিতে সাঁতরে যাচ্ছে। ভাইয়ের অবস্থা দেখে আসাদকে বললো, তুই আমার হাত ধরে ধরে সাঁতার কাটতে থাক। কিছুক্ষণ পর সাবিনা খাতুন বুঝতে পারছেন, তার শক্তি আর সামর্থ্যের সবটুকুই নিঃশেষ হয়ে আসছে। শাপলা, শালুকের বোঝাটা পানিতে ফেলে দিলো। এদিকে আসাদের অবস্থা আরও খারাপ। বোনের হাতটা ছেড়ে দিয়ে তলিয়ে যাচ্ছে নাকি? সাবিনা খাতুন অজ্ঞানপ্রায় ভাইকে কাঁধে তুলে নিলো। ডাঙ্গা আজ এতো দূরে সরে গেলো কেনো? এদিকে আসাদ বোনের গলাটা শক্ত করে পেঁচিয়ে ধরে আছে। সাবিনা বেগমের দমবন্ধ হয়ে আসছে। চারিদিকে এতো অন্ধকার কেনো? সাবিনা খাতুন ভাইকে নিয়ে তলিয়ে যেতে যেতে সম্মিলিত উদ্ভিগ্ন কণ্ঠ শুনতে পেলো।

বাসায় ফিরতে ফিরতে সকাল নয়টার মতো হয়ে গেলো। সাফিনের মা নাস্তা দিতে দিতে জিজ্ঞেস করলেন, গতকাল নাকি ডাক্তার সাহেবের সাথে ঝামেলা করেছিস? বাচ্চা ছেলেপুলের মতো আচরণ করলে কি হয়! আজ সাফিনকে ভালো একজন ডাক্তারের কাছে নিয়ে যা। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, ছেলেটা দিন দিন শুকিয়ে কি অবস্থা হয়েছে। সারাক্ষণ বকবক করে করেই শরীরের শক্তি সব শেষ। পড়তে বসলেই নাকি ঘুম পায়। আসাদ শুধু সম্মতিসূচক মাথা ঝাঁকায়।

আসাদের প্রতি রাবেয়া বেগমের টানটা বড় বোনের মতোই। আসাদ পারতপক্ষে রাবেয়া বেগমের মুখোমুখি হয়না। ভাবীর মুখোমুখি হলেই বড় বোন সাবিনা খাতুনকে মনে পরে যায়।

রাবেয়া বেগম জিজ্ঞেস করলেন, কিরে আসাদ, তুই কাঁদছিস নাকি?

নাতো?

মাথা নীচু করে আছিস কেনো, মাথা তোল।

মাথা উঁচু করতেই রাবেয়া বেগম দেখলেন আসাদের চোখ ভরা জল; চোখ বেয়ে নেমে আসার আগেই অর্ধেক খাওয়া নাস্তা রেখে দ্রুত ভাবীর সামনে থেকে সরে গেলো।

ছেলেটা বড়বোনের খুব নেওটা ছিলো। রাবেয়া বেগমের প্রচণ্ড ইচ্ছে হচ্ছিলো আসাদকে সাবিনা খাতুনের মতো বুকে জড়িয়ে স্বান্তনা দিতে। কিন্তু সমাজ-সংসারের কিছু অলিখিত নিয়মের বেড়াজালে বন্দী মানুষের পক্ষে প্রচণ্ড ইচ্ছেটাও অনেক সময় পূরণ হয়না। সাবিনা খাতুন আর রাবেয়া বেগম খুব ঘনিষ্ঠ বান্ধবী ছিলেন। রাবেয়া বেগমের ‘ছেলে পুতুল’ আর সাবিনা খাতুনের ‘মেয়ে পুতুলের’ সাথে বিয়ে হয়েছিলো। তারপর থেকে দু’জন বান্ধবী থেকে বেয়াইন। আঁচলে মুখ গুঁজে রাবেয়া বেগম চিৎকার করে কেঁদে উঠার অদম্য ইচ্ছেটাকে চাপা দিতে প্রাণপণ চেষ্টা করছেন। বউচি, দাড়িয়াবান্ধা, কানামাছি খেলায় দুই বান্ধবী ছিলেন সমানে সমান।

সকাল দশটায় চাচা, ভাতিজা হাসপাতালের দিকে রওনা দিলো। সাফিন বকবক করেই যাচ্ছে- চাচ্চু আমরা বাসে যাবো, না রিক্সায়? বাসে গেলে ভালো লাগেনা, রিক্সায় গেলে অনেক মজা হয়। কতকিছু দেখা যায়।

আসাদ বললো, হেঁটে গেলে আরও বেশি দেখা যায়, মজা হয়। যাবি নাকি?

চাচ্চু, তুমি একটা পাগল। দেখনা আমার অসুখ। এতদূর হেঁটে যেতে পারবো, তুমিই বলো? অবশ্য তুমি যদি কোলে করে নিয়ে যাও তবে যাবো। কিন্তু তোমার কোলে উঠলে তুমি জোরে চেপে ধরো। ধরো তোমার কোলে চড়েই কষ্ট করে গেলাম। যেতে কতক্ষণ লাগবে জানো? ততক্ষণে হাসপাতালের ডাক্তাররা চলে যাবে।

অব্যর্থ যুক্তি।

আসাদ আবারো চুপ হয়ে গেলো। খালি রিক্সা দেখে হাসপাতালের নাম বলতেই রিকশাওয়ালা যেতে রাজী হয়। দরাদরি শেষে দু’জন উঠে পরলো।

আসাদ ভাবছে, আচ্ছা সাফিনকে কি এস.এস.সি. পরীক্ষার পর ঘটে যাওয়া ঘটনাটা বলা যায়? ছেলেটা ভয় বা কষ্ট পাবেনাতো?

সাফিন একটা গল্প শুনবি, ভয় পাবিনাতো?

সাফিন উত্তেজনায় নড়েচড়ে বসলো। যেভাবে তাকিয়ে আছে গল্প ওকে শুনাতেই হবে।

থাক বাবা, পরে আরেকদিন বলবো।

বাচ্চাদের দাবীগুলি অত্যন্ত দৃঢ় হয়। কিন্তু সাফিন মনে হয় অন্য একটু ভিন্ন ধাঁচের। কি মনে করে আর কিছু বললোনা। চুপচাপ রিক্সায় বসে আছে।

হাসপাতালের গেইটে নেমে ভাড়া পরিশোধ করতেই সাফিন চেচিয়ে বললো, চাচ্চু দেখো কতগুলি ব্যাগ পরে আছে। এগুলি কি বিক্রি হবে? আসাদ খেয়াল করে দেখলো সারি সারি বিশ/পঁচিশটি ব্যাগ। আশেপাশে দলবেঁধে কেতাদুরস্ত যুবক বয়সী বেশ কয়েকজন খোশগল্প করছে। চা, সিগারেটের দোকানগুলিও জমজমাট। বিভিন্ন ঔষধ কোম্পানির সেলস রিপ্রেজেনটেটিভ সাহেবরা গেইটের আশপাশ বেশ ব্যস্ত করে রেখেছেন।

টিকেট কাউণ্টারে বেশ ভিড়। বড়লোকেরা কি কৃপণ হয়ে গেলো! নাকি সরকারী হাসপাতালের মান হঠাৎ করেই উর্ধ্বমুখী হয়ে গেছে! অর্ধেকেরও বেশি লোকের বেশভূষা দেখে তাঁদেরকে স্বচ্ছল পরিবারের সদস্য বলেই মনে হলো। দেশের স্বাস্থ্য খাত তাহলে বেশ এগিয়েছে। শিশু ও মহিলাদের জন্য পূর্ব পাশে দুইজন আর পশ্চিম পাশে দুইজন করে চারজন টিকেট বিক্রি করছেন।

টিকেটের গায়ে গোল দাগ দেয়া লেখাটা ২২৩ নম্বর কক্ষ নির্দেশ করছে। আসাদ আর সাফিন দোতলায় উঠে ২২৩ নম্বর কক্ষ খুঁজে নিয়ে বারোজনের পেছনে দাঁড়ালো। ডাক্তার মনে হয় বেশ সময় নিয়েই রোগী দেখছেন। কচ্ছপ গতিতে ওরা এগুচ্ছে। সাফিনের মনে হয় দাঁড়িয়ে থাকতে একটু কষ্ট হচ্ছে। বামপাশের তিনটি চেয়ারের মধ্যে একটিতে সদ্য কৈশোরত্তীর্ণ ছেলেটি মোবাইলে কি কি সব করছে। হয়তো কোন ভার্চুয়াল বন্ধু বা বান্ধবীর সাথে চ্যাটিং করছে। বান্ধবীই হবে হয়তো, কেমন যেন লাজুক লাজুক হাসি! বাকি দুই চেয়ারে বয়স্ক দুইজন মহিলা।

কিছুক্ষণ পর কোথা থেকে নার্সের পোষাক পরা এক মহিলা দুইজন টিকেটধারী মহিলাকে নিয়ে অতি দ্রুততার সাথে ডাক্তারের রুমে প্রবেশ করলেন। লাইনে দাঁড়ানো সবার মধ্যেই বিরক্তিপূর্ণ মন্তব্য। বেশ সময় নিয়ে ওনারা বের হতেই লাইনে দাঁড়ানো একজন রুমে ঢুকতে গেলে তাকে সরিয়ে হাসপাতালের আরও একজন কর্মচারী অপর এক রোগীকে নিয়ে ডাক্তারের রুমে গেলো। লাইন থেকে গুঞ্জনটা আরেকটু জোরালো হলো। সাফিনের বিরক্তি আর দেখে কে। আসাদ কিছু একটা করার কথা ভাবছে। ডাক্তার সাহেবকে গিয়ে কিছু বলবে কিনা সিদ্ধান্ত নিতে পারছেনা। এমন সময় টিকেট কাউণ্টারের একজনের পিছু পিছু টিকেটধারী দুইজন মহিলাকে বেশ দ্রুত পা চালিয়ে আসতে দেখা গেলো। আচ্ছা, হাসপাতালের স্টাফরা কি দ্রুত কাজ সারা যায় টাইপের কোন পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছে, যাতে করে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা রোগীরা কোনকিছু বলার সুযোগ না পায়? প্রায় ছুটতে থাকা তিনজনের দলনেতা কাউণ্টারের টিকেট বিক্রেতা আসাদের কাছাকাছি আসতেই আসাদ ডান পা’টা একটু বাড়িয়ে দিলো। লোকটা প্রায় ঝড়ের গতিতে দরজায় হুমড়ি খেয়ে পরলো। দরজার হাতলের উপর কপাল ঠুকে রক্তারক্তি কাণ্ড। এমন মর্মান্তিক ঘটনা, কিন্তু আসাদের সামনে সাফিন আর পিছনে দাঁড়ানো ভদ্রমহিলা খিলখিল করে হেসে উঠলো। সংক্রামক ব্য্যধির ন্যায় অতি দ্রুত লাইনে দাঁড়ানো সবার মাঝে উল্লাসটা ছড়িয়ে পরলো। আশেপাশে থাকা হাসপাতালের কর্মচারীরা আহত লোকটাকে জরুরী বিভাগে নিয়ে যাবার জন্য ব্যস্ত হয়ে পরেছে। ওদের মধ্য থেকে হাসপাতালের বয়স্ক একজন কর্মচারী বলে উঠলেন, শালারা হাসপাতালে চাকরী করতে করতে দালালীও শুরু করে দিয়েছে, ছিঃ। আসাদ মনে মনে হাসপাতালের জরুরী বিভাগে কর্মরত ডাক্তারের উদ্দেশ্যে বললো, তোর কাজ বাড়িয়ে দিলাম বন্ধু।

আসাদের পা বাড়ানোর ব্যাপারটি হয়তো লাইনের সবার জানা হয়ে গেছে। ঘটনার পর পরিস্থিতি আসাদের কাছে বেশ অনুকূল বলেই মনে হচ্ছে।

আসাদ মোবাইলে ব্যস্ত থাকা ছেলেটাকে বললো- খোকা, ডাক্তার দেখাবে? উত্তরে ছেলেটি না সূচক মাথা নাড়লো। আসাদ বেশ খানিকটা গলা চড়িয়ে বললো- তুই যে, স্কুলের ক্লাস ফাঁকি দিয়ে এখানে বসে আছিস এটাকি তোর বাবা, মা জানে?

ছেলেটি একটু দ্বিধাগ্রস্ত স্বরে বললো, আমি স্কুলে পড়িনা, কলেজে ফার্স্ট ইয়ারে পড়ি।

তোর ক্লাস কি এখানে?

জ্বী না।

উঠ ব্যাটা, কলেজে গিয়ে ক্লাস কর। ব্যাটা ফাজিল, চড় মেড়ে তোর দাঁত ফেলে দেবো।

সাফিন বলে উঠলো, চাচ্চু, মোশারফ করিমের ভাষায় বলো, ফহিন্নির ......।

লাইনে দাঁড়ানো সবার মাঝে আবারও হাসি ছড়িয়ে পরলো। আরে, বোরকা পরা মহিলার কোলের দুই, আড়াই বছরের বাচ্চাটাও দেখি হাসছে!

ছেলেটি মনে হয় বেশ লজ্জা পেয়েছে। কুণ্ঠার সাথে উঠে গেলে সাফিন খালি দ্রুত খালি চেয়ারে নিজের দখলে নিয়ে নিলো। ঘণ্টাখানেক পর ডাক্তারের রুমে প্রবেশের সুযোগ মিললো।

অল্প বয়সী মহিলা ডাক্তার। গায়ের রংটা একটু চাপা। কিন্তু চোখে মুখে কি এক পবিত্রতার দ্যুতি। এতো রোগী দেখার পরও ক্লান্তির সামান্যতম প্রকাশ নেই। দারুনতো! ওনার একটা নাম দেয়া যাক, মমতাময়ী না মায়াবতী। কোন নামই পছন্দ হচ্ছেনা। আচ্ছা আপাতত শুধু ডাক্তারই থাক।

কোমল কণ্ঠে মহিলাটি সাফিনকে তাঁর পাশে রাখা চেয়ারে বসতে বললেন।

তোমার নাম কি?

আমি সাফিন।

খুব সুন্দর নাম, তা তোমার সমস্যাটা কি?

কিছুই না। মাঝে মাঝে জ্বর আসে। আচ্ছা, বাচ্চাদেরতো জ্বর আসবেই তাইনা? একটু জ্বর হলেই ডাক্তার শহীদ খান, অমুক, তুমুক প্রফেসর এর কাছে নিয়ে যায়। কত টাকা খরচ হয়! আর খেলনা কিনে দিতে বললেই বলে, খেলনা দিয়ে বাড়িঘর সব ভরে ফেলেছিস। আর কত খেলনা লাগবে?

ডাক্তার হেসে ফেললেন। অত্যন্ত দক্ষতা আর মমতার সাথে ওকে পরীক্ষা করতে লাগলেন, যেন মা তাঁর ছেলেকে আদর করছেন।

আসাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, তেমন কোন সমস্যা মনে হচ্ছে না। আর কিছু না বলে তিনি গোল দাগ দেওয়া ২২৩ নম্বর লেখা বহির্বিভাগীয় রোগীর টিকিটে কিছু লিখে আসাদের হাতে ধরাতে গেলে সাফিন টান দিয়ে ওটা নিজের দখলে নিয়ে নিলো। বোকা বোকা চোখে টিকিটের উপর লেখার দিকে তাকিয়ে বললো, পাঁচ টাকার টিকেটের জন্যই এতো কম ঔষধ!

ডাক্তার একটু অবাক হয়ে আসাদের দিকে তাকালেন। আসাদ বললো, আপনি প্রফেসর শহীদ খানকে চেনেন?

ডাক্তার উত্তর দিলেন, জ্বী, আমি যে মেডিকেল কলেজ থেকে পাস করেছি, উনি সেখানে আমাদের ক্লাশ নিতেন। উনি আমার স্যার ছিলেন।

আসাদ হেসে বললো, আপনি ছাত্রী হিসাবে মনে হয়না খুব ভালো ছিলেন। ছাত্রী হিসাবে ভালো ছিলেননা বলেই আপনার স্যারের কাছ থেকে পাওয়া শিক্ষা কর্মজীবনে কাজে লাগাতে পারছেন না। ডাক্তার বেশ হতভম্ব হয়ে গেলেন। আসাদ ইশারা দেওয়া মাত্র সাফিন ওর পকেট থেকে ডাঃ শহীদ খানের প্রেসক্রিপশনটা ডাক্তারের হাতে ধরিয়ে দিলো। ডাক্তার অবাক হয়ে কাগজটার দিকে তাকিয়ে রইলেন।

আপনার নামটা জানতে পারি।

অবশ্যই, আমি সালমা, ডাঃ সালমা।

ডাঃ সালমা আপা, আপনি ভালো ছাত্রী না হলেও অনেক ভালো একজন ডাক্তার, অসাধারন ভালো একজন মানুষ, মায়াবতী বা মহানুভব জাতীয় একজন। আপনার জীবন সুন্দর হোক।

আসাদ আর ডাক্তারকে অবাক করে দিয়ে সাফিন বললো, আন্টি, আপনার বিয়ে হয়েছে?

না, কেনো?

আসাদ সাফিনের হাত ধরে টেনে দ্রুত রুম থেকে বেরিয়ে এলো।

একটা থাপ্পড় দিবো ব্যাটা ফাজিল। ওনার বিয়ে হয়েছে কিনা জিজ্ঞেস করলি কেনো?

উত্তরে সাফিন ফোকলা দাঁতের রহস্যময় হাসিটা ওর চেহারায় ঝুলিয়ে রাখলো।

রিক্সায় বাড়ি ফেরার পথে আসাদের মনে হলো। কালকেই ঢাকা যেতে হবে। চাকরীটার একটা দফারফা করতে না পারলে মনটা শান্ত হবেনা। আর দু’একদিন গেলেই বাড়ির সবার মনের প্রশ্নগুলি উগরাতে শুরু করে দেবে। আসাদের পক্ষে ঐসব প্রশ্নগুলির উত্তর দেওয়া সম্ভব না।

সকাল দশটা। আসাদ অফিসে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছে। সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত, আজ অফিসে ওর শেষ দিন । আসাদ বেশভূষা নিয়ে মহা সমস্যায় আছে। ফিটফাট হয়ে যাবে, নাকি গতানুগতিক কিছু একটা পরবে। আজব সমস্যা। আজকের অফিসে যাওয়ার সাথে বেশভূষার কোন সম্পর্ক থাকার কথা না। অবশ্য নাগা সন্যাসীদের মতো জটা চুল ঝাঁকিয়ে উলঙ্গ হয়ে যাবারও কোন মানে নেই। রুমে কোন আয়না নেই। আয়নার দরকারও নেই। নিজেকে দেখার মধ্যে আনন্দ থাকলেও আসাদের কাছে বিষয়টি কেমন যেন গুরুত্বহীন মনে হয়।

মানুষ সম্ভবত নিজেকেই সবচে বেশি ভালবাসে। বিদঘুটে বয়স্ক মানুষ, যার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকতেও যে কারো অসহ্য মনে হবে, সেই লোককেই দীর্ঘক্ষণ আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল পরিপাটি করে আঁচড়ানো, গোঁফ ঠিকঠাক করতে দেখা যায়। আয়নায় প্রতিবিম্বটা নিজের বিকট চেহারা নয়, মনে হয় প্রেমিকার মুখের দিকে প্রচণ্ড ভালবাসা নিয়ে অবাক তাকিয়ে থাকা; শুধুই মুগ্ধতা আর রূপসুধা পান করা।

এসব উদ্ভট চিন্তা করতে করতে হাতের কাছে দোমড়ানো মোচড়ানো পাঞ্জাবিটা পড়েই আসাদ মতিঝিলের আকাশচুম্বী বিল্ডিংয়ের আট তলায় অফিসের দিকে রওনা দিল। পায়ে মলিন স্যান্ডেল।

অফিসের সদর দরজায় ঢুকতেই ইউনিফর্ম পড়া সিকিউরিটি গার্ডের বুটের আওয়াজ ‘ঠাশ’; অনেকটা ককটেল ফাটার মতো। ডানহাত কপালে। আসাদ হেসে ফেলল।

কেমন আছেন রহমত সাহেব?

জ্বী ভাল স্যার। আপনি কেমন আছেন? অনেকদিন পর অফিসে আসলেন। কোন অসুখ বিসুখ হয়নিতো?

অফিসের সবাই সিকিউরিটি গার্ডদের তুমি করে বলে। শুধু আসাদ স্যারই কি সুন্দর করে রহমত সাহেব বলেন। আপনি আপনি করেন। বড় ভাল লোক। চেহারা দেখলেই বুঝা যায় মানুষটা ভাল না মন্দ।

আসাদ বলল, আছি আর কি, চলছে গাড়ি যাত্রাবাড়ী টাইপ।

ভীষণ অবাক করা ব্যাপারটা আসাদের চোখ এড়িয়ে গেল। মনটা বিক্ষিপ্ত না থাকলে আসাদ দেখতে পেত, লম্বা, চওড়া শরীরের মানুষটির চোখের মমতা হঠাৎ করেই উধাও হয়ে গেছে। টকটকে লাল হয়ে আছে। লাল চোখের কোণে অশ্রু জমা হতে শুরু করে দিয়েছে।

ছিমছাম পরিপাটি, আলো ঝলমলে অফিস রুম। ফারুক গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ এর সর্বোচ্চ কর্তা ফারুক সাহেবের মুখোমুখি বসে আছে আসাদ। রুমটিতে ঢোকার পর থেকেই এক দৃষ্টিতে আসাদের দিকে তাকিয়ে আছেন তিনি। দৃষ্টিটা আসাদের কাছে ভাল ঠেকছে না। ঝড় তুফান শুরু হবার আগ মুহূর্তে যেমন হয় অনেকটা সেরকম; সবকিছু শান্ত, ভয়ংকর কিছু একটা ঘটে যাওয়ার অনাকাঙ্খিত প্রত্যাশা। অফিসের কোন কর্মকর্তা-কর্মচারীর সাথে ফারুক সাহেবের একান্ত সাক্ষাতের পর্বগুলি সাধারনত এভাবেই শুরু হয়।

ফারুক সাহেবের ভরাট কণ্ঠ গমগম করে উঠল-

তো আসাদ সাহেব কি সিদ্ধান্ত নিলেন, এখানে চাকুরী করবেন, না চলে যাবেন ?

এখানে আমার পক্ষে চাকুরী করা সম্ভব না।

ফারুক সাহেবের কণ্ঠটা আরেকটু চড়া হল-

এখানে চাকুরী করা সম্ভব না বলতে কি বুঝাচ্ছেন? অফিসটাকে আপনার কাছে কি গোয়াল ঘর মনে হয়; চারিদিকে গোবর আর চনার গন্ধ?

আমার কাছে অফিসটাকে গোয়ালঘরের চেয়েও জঘন্য লাগে।

যেমন?

আসাদ যা ভেবেছিল, ফারুক সাহেবের আঁতে ঘা লেগেছে। আসাদের নিজের ভিতর দীর্ঘদিন পুষে রাখা যন্ত্রণাটাও চেপে রাখতে কষ্ট হচ্ছে। মনে হয় আজ আর চেপে রাখা সম্ভব হবেনা।

আসাদ জবাবে বলল, ডাস্টবিনের মত লাগে। আর সেই ডাস্টবিনের ময়লা খাবার জন্য একটা মাত্র কুৎসিত কাক আছে, ওটা এই মুহূর্তে আমার সামনে বসা।

ইউ বাস্টার্ড, আই উইল কিল ইউ টাইপের কঠিন কিছু কথা শোনার জন্য আসাদ মনে মনে প্রস্তুত হয়ে আছে। কিন্তু আসাদকে হতভম্ব করে দিয়ে ফারুক সাহেব বেশ মোলায়েম স্বরে বললেন, চাকরী ছেড়ে কি করবেন?

আসাদ বলল, এখনও সিদ্ধান্ত নেইনি। কিছুদিন ঘুরে বেড়াব। তারপর কি করা যায় ভাবতে বসব। একটা চায়ের দোকান দেব বলে প্রাথমিকভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছি। দোকানটা একটু চালু জায়গায় দিলেই হবে। দৈনিক নিদেনপক্ষে শ পাঁচেক কাপ চা বিক্রি হবে, বেশিও হতে পারে। প্রতি কাপে দুই টাকা করে থাকলে নীট লাভ একহাজার টাকা। আইডিয়াটা কেমন স্যার?

ফারুক সাহেব মুচকি মুচকি হাসছেন। আলোচনাটা ওনার কাছে কেমন যেন খেলা খেলা মনে হচ্ছে। খেলতেও ভাল লাগছে। তিনি বললেন,

আমার কাছে আরেকটা ভাল আইডিয়া আছে। অবশ্য সেটা পূর্বনির্ধারিত না। আজকে আপনার কথাবার্তা আর পোশাক পরিচ্ছদ দেখেই আইডিয়াটা মনে এসেছে। আশা করি চায়ের দোকানের চেয়ে ইঁদুর, তেলেপোকা, ছারপোকা মারার ঔষধ বিক্রি করলে আরও ভাল করতে পারবেন। কাঁধে একটা ব্যাগ নিয়ে হাঁটবেন আর সুর করে করে বলবেন,

“ইঁদুর মারেন, তেলাপোকা মারেন, ছারপোকা মারেন। চোরার ঘরে চোরা , তেইল্যা চোরা, যায়গায় খায়, যায়গায় ব্রেক, কাইত হইয়া খায় চিত হইয়া মরে, লাফাইয়া খায় দাফাইয়া মরে। ইঁদুর-চিকার মারামারি নষ্ট করে বাসাবাড়ি, ঔষধ লাগান তাড়াতাড়ি। আশা করি ঘুরাঘুরি আর রুটি, রুজির ব্যবস্থা দুটোই করে ফেলতে পারবেন।”

আসাদ আহ্লাদি কণ্ঠে জবাব দিল, স্যার প্রফেশনালরা ছাড়া এত সুন্দর করে কেউ বলতে পারেনা। আপনি কি স্যার কখনও ...... ?

ফারুক সাহেব স্থির চোখে আসাদের দিকে তাকিয়ে আছেন। গালের বামপাশের থলথলে চর্বি তিরতির করে কাঁপছে। ডানহাত ড্রয়ারের দিকেই যাচ্ছে মনে হয়। রাগের চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে গেছেন প্রায়। আরেকটু রাগালে কেমন হয়?

স্যার, পরামর্শতো দিলেন। আপনার পরামর্শমত কাজ করে যাতে সফলকাম হতে পারি সেজন্য একটু কষ্ট করবেন, প্লীজ?

ফারুক সাহেব ডানহাতটি আবার টেবিলের উপর উঠিয়ে নিলেন। কি ধরনের কষ্ট করতে হবে?

আপনি সাহায্য করবেন প্রতিশ্রুতি দিলে বলব। শুধু শুধু আপনার মূল্যবান সময় নষ্ট করার কোন মানে নেই।

প্রতিশ্রুতি দিলাম।

আগামী আমাবস্যার রাতে কোন এক পচা ডোবায় সম্পূর্ণ উলঙ্গ হয়ে দুই পা চেঙ্গি মাইরা পানির নিচে অবস্থান নিবেন। তারপর এক ডুবে ‘চালতা গোটা পান’কে দুভাগ করবেন। ‘চালতা গোটা পান’ চিনেছেন তো স্যার? এটা বরিশাল অঞ্চলের বিখ্যাত পান। পান কিন্তু স্যার চালতা গোটাই হতে হবে। আর কাটবেন রোয়া কাঁচি দিয়ে। অর্ধেক পান পানিতে ফেলে দিয়ে বাকিটা নিয়ে ডাঙ্গায় উঠে কচ্ছপের খোলে ডোবার পানি নিবেন। পানিটুকু একদমে খাবেন এবং মনে মনে আমার সাফল্য কামনা করবেন। তারপর অর্ধেক পান চিবুতে চিবুতে ন্যাংটা অবস্থায় দুইশ কদম হেঁটে জামাকাপড় পড়বেন। খবরদার একটুও যাতে ব্যতিক্রম না হয়। তাহলে কিন্তু আমার সাফল্যতো আসবেইনা, আপনি পরবেন মহা গাড্ডায়।

আসাদকে আবারও আশ্চর্য করে দিয়ে ফারুক সাহেব শান্ত কণ্ঠে বললেন, আমি চেষ্টা করব। আর তুমি, আজ থেকে বাকি জীবন আমার কাছ থেকে নুন্যতম ছয়শ গজ দূরে থাকবে।

ছয়শ গজ কেন? পিস্তলের রেঞ্জ না আপনার দৃষ্টিসীমার কারনে ছয়শ গজ? আজ তাহলে যাই, From now on you are no longer my boss.

বেরুতে গিয়েও আসাদ পিছু ফিরল। একটা কথা, আপনি আপনার চাচাত ভাই বদিউল ইসলাম ওরফে বল্টুর মিথ্যা অভিযোগ শুনে যে ছালাম সাহেবকে ছাঁটাই করেছেন, তিনি গত পরশু রাত একটার দিকে ব্রেইন স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়েছেন। শরীরের বাম পাশটা অকেজো। দুই দুইটি বিয়ের উপযুক্ত মেয়ের বোঝা আর না খেয়ে থাকার কষ্টটা শেষ বয়সে বয়ে যেতে রাজী ছিলেন না। মরতে চেয়েছিলেন। তা না মরে ভদ্রলোক গোঁদের উপর বিষফোঁড়ার মত সংসারের বোঝাটা আরও বাড়িয়ে দিয়েছেন। আর একটা কথা, বল্টুর বউটি আসলেই দেখার মত সুন্দরী। দ্রুত বদল হওয়া রিসেপশনের অসহায় সুন্দরী মেয়েদের সাথে নিয়ে সাইট ঘুরতে গেলে প্রোটেকশন সাথে রাখবেন। ইদানিংকার অল্প বয়সী সুন্দরী মেয়েগুলি বেশি উর্বরা কিনা! আনারী আর কঠিন দুনিয়ার পিশাচগুলিকে চিনেনা বিধায় ওরা পার্সের ভিতর প্রোটেকশন সাথে নিয়ে ঘুরে না। কোন সময় কি ঘটে যায়। খোদা হাফেজ স্যার, আমার সাফল্যের জন্য দোয়া করার কথাটা মনে রাখবেন প্লীজ।

ফারুক সাহেবের হতকচিত চেহারা দেখার সময় নেই। দ্রুত সবকিছু পিছু ফেলে রাস্তায় নেমে হাঁফ ছাড়তে হবে।

মুষলধারে বৃষ্টির সাথে প্রচণ্ড গতির বাতাস। সুনসান রাস্তা। আশেপাশের ফুটপাথগুলিও খালি। ভালই লাগছে। সারা শরীর বৃষ্টির পানিতে ধুয়ে যাচ্ছে; নিজের শরীর মন থেকে সমস্ত কষ্ট, গ্লানি আর অন্ধকারকে ধুয়েমুছে নেয়া।

পা’টা এত ভারী মনে হচ্ছে কেন? হাঁটতে খুব কষ্ট হচ্ছে। প্রশান্তি আর ক্লান্তিগুলি একাকার হয়ে গেছে যেন। আসাদের প্রচণ্ড ঘুম পাচ্ছে। বৃষ্টির পানিতে তলিয়ে যাওয়া রাস্তার উপর শুয়ে পরলে কেমন হয়? পানির উপর ভেসে ভেসে অজানার পথে ছুটে চলা। আসাদ রাস্তার উপর শুয়ে পড়ে। আহ কি শান্তি। শান্তিতে চোখ বুঝে আসছে। কে যেন আসাদের পাশে বসে উপুর হয়ে ওর মুখের দিকে নিঃশব্দ, অপলক তাকিয়ে আছে।

আসাদের ঘুম ভেঙ্গে যায়। বাইরে প্রচণ্ড বৃষ্টি। আসাদ ভাবে এতক্ষণ তাহলে স্বপ্ন দেখছিলাম। চোখ খুলেই রহমত মিয়াকে দেখতে পেল। আসাদ একটু দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে ভাবছে, সকালে অফিসে না গিয়ে আমার এখানে কি করছে? ঘুমের ঘোরটা কাটতেই পুরো ব্যাপারটা ধরতে পারল। মুচকি হেসে জিজ্ঞেস করল,

কি রহমত সাহেব, সেই চকচকে ছুরিটা সাথে এনেছেন তো, যেটা দিয়ে শেষবারের মত দলের সর্দারের গলা কেটেছিলেন মানুষ হবার জন্য? ফিনকি দিয়ে গরম রক্ত আপনার শারা শরীরে ছিটকে ছিটকে পরছিল। গগনবিদারী চিৎকার বা গালিগালাজের আওয়াজের বদলে খোলা কণ্ঠনালী দিয়ে গরম বাতাস বের হচ্ছিল। চার হাত, পায়ের দাপাদাপিতে বিশাল বড় গর্তের মত হয়ে উঠেছিল মৃত্যুপথযাত্রীর দেহের চারিদিক। মানুষ মেরে সেদিনই প্রথম ভয় পেয়েছিলেন। গলা কাটবেন অসুবিধা নেই। তার আগে চা নাস্তা খেয়ে নেই। তারপর গল্পগুজব করে চিৎ হয়ে শুয়ে পরব। আপনি অতি আনন্দের সাথে আমার গলা কাটবেন। গলাকাটার আগ পর্যন্ত আপনি আমার মেহমান। মেহমানদারি কবুল করা ছাড়া আমার একটা পশমও কাটতে পারবেন না।

রহমত সাহেব স্থির চোখে আসাদের দিকে তাকিয়ে আছেন। চোখ দুটিতে অপার্থিব রহস্যরা খেলা করছে। চোখ দেখে দোটানা, সিদ্ধান্তহীনতা বা বিস্ময়ভাব কোনটাই বুঝার উপায় নেই।

আসাদ মনে মনে বলতে থাকে, রহমত সাহেব আপনি আমাকে খুন করতে পারবেন না। কোনভাবে, কোন কারনেই না। দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন মাথা নিয়ে বীভৎস মৃত্যু আমার জন্য নয়। আমার অনেক কাজ বাকি আছে, যে কাজে আপনি সহ আরও বেশকিছু মানুষের গল্পের শেষোদ্ধার হবে।

আসাদ মনে মনে বলেই যাচ্ছে- যেদিন আমার মৃত্যু হবে, সেদিন আমি লোকালয় থেকে অনেক অনেক দূরে কোথাও থাকব। স্বাভাবিক মৃত্যুর পর নীরব, নিথর প্রান্তরে পরে থাকবে আমার লাশ। সত্য মানুষেরা এসে আমার জানাজা, দাফন, কাফন করবে। দোয়া করবে আমার আত্মার শান্তির জন্য। হাস্যমুখ মৃতদেহটা দাফন করার পর আমার মুক্ত আত্মা মানে আসল আমি শুরু করব আমার আলোকিত যাত্রা; অন্তহীন, অবিরাম।

মন্তব্য ৪ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (৪) মন্তব্য লিখুন

১| ২৪ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৭ বিকাল ৫:৫২

হুয়ায়ুন কবির বলেছেন: দোটানা

২| ২৪ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৭ রাত ১১:০০

আলমগির কবির বলেছেন: ালো লাগলো

৩| ২৫ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৭ বিকাল ৫:৫৭

হুয়ায়ুন কবির বলেছেন: ধন্যবাদ আলমগির কবির।

৪| ১৯ শে অক্টোবর, ২০১৭ রাত ৯:৪০

আলমগির কবির বলেছেন: আপনাকেও ধন্যবাদ হুমায়ুন কবির

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.