![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
মাওলানা আব্দুল গফুর, ইমনের শিক্ষক। বয়স প্রায় পঞ্চাশের কাছাকাছি। সফেদ দাঁড়ি আর চেহারার উজ্জ্বলতা তাঁর শ্যামলা রংয়ের দীর্ঘ দেহটায় অন্যধরনের এক দ্যুতি ছড়িয়ে রাখে সারাক্ষণ। তিনি অত্র এলাকার মসজিদের ইমাম এবং একই সাথে ইমনদের বাড়িতে লজিং মাষ্টার হিসাবে ওকে দুইবেলা করে পড়ান। বিনিময়ে তিনবেলা খাবার আর ঈদের সময় নতুন পাঞ্জাবী আর লুঙ্গি। এলাকাটি গ্রাম হলেও কেমন যেন মফস্বলী ভাব আছে। লোকজন কৃষি কাজও করে, আবার বিজলী বাতির আলোতে রাতের খাবারও খেতে পারে।
আজ চার বছর হল তিনি ইমনকে পড়াচ্ছেন। ইমনের বয়স যখন সাড়ে তিন বছর তখন থেকেই ওকে পড়াচ্ছেন। ছেলেটা একদিন অনেক বড় হবে।
ইমন এখন ক্লাস ফোরের ছাত্র। ছাত্র হিসাবে বেশ মেধাবী আর চটপটে। বাংলা, অংক, ইংরেজী অক্ষর আর সংখ্যাগুলি চেনার পরপরই ওকে English to Bangla Dictionary কিনে দিয়েছেন। মাওলানা আব্দুল গফুর সাহেবকে অবাক করে দিয়ে পনের দিনের মধ্যেই পুরো বইটি মুখস্ত করে ফেলে। প্রায় দুইশ Word এর বইটি মুখস্ত করার পর মাওলানা আব্দুল গফুর তাঁর ছাত্রের পরীক্ষা নিলেন। ছেলেটি বাংলা-ইংরেজী বানান সহ সবগুলির অর্থ নিখুঁতভাবে বলে গেল। মাওলানা আব্দুল গফুর সাহেব বললেন, মাশাআল্লাহ্।
অথচ এই ছেলেই কিনা ক্লাশ ওয়ান এর প্রথম সাময়িক পরীক্ষার দুইটাতেই ডাবল জিরো পেয়েছিল! প্রাইমারি স্কুলের যে মাষ্টার খাতা দেখেছেন তিনি মনে হয় একটু রসিক প্রকৃতির। দুইটা শূন্যই আকারে বেশ বড়। মনে হয় পাশাপাশি দুইটা হাঁসের ডিম।
আজ দশ বছর তিনি দেশের বাড়ি ময়মনসিংহে যান না। বউ, বাচ্চা বা অতি কাছের বলতে কেউ নেই। বিয়ের তিন বছরের মাথায় বউটি হঠাৎ করেই মারা যায়। সম্পত্তি বলতেও বাপের ভিটেটুকু। কে না কে ওখানে দখল নিয়ে বসে আছে। ওসবের দিকে এখন আর মন টানে না। মসজিদ লাগোয়া বেড়ার ঘরেই থাকেন তিনি। খাবারের চিন্তাও করতে হয় না। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়িয়ে বিভিন্ন বই পুস্তক পড়েন। সবই যে ধর্মীয় বই তা না। মসজিদের বেতন বাবদ যা পান, তা দিয়েই বিভিন্ন ধরনের বই পুস্তক কিনে পড়েন। বিজ্ঞান, ধর্ম, কবিতা, গল্প, উপন্যাস তা যে লেখকেরই হোকনা কেন তিনি পড়েন এবং বেশ মনোযোগ দিয়েই পড়েন।
সপ্তাহখানেক আগে এলাকার বেশ প্রভাবশালী মাদবর, ইমন এর দুঃসম্পর্কের দাদা, ইসহাক মিয়ার সাথে তাঁর মনকষাকষির মত একটা ঘটনা ঘটে। পীর সাহেব আগামী পরশু দিন প্রথমবারের মত স্বশরীরে মাদবর সাহেবের বাড়িতে আসছেন। বিশাল আয়োজন। পাঁচ পাঁচটি ডেকচিতে বিরিয়ানি রান্না হবে যাতে গ্রামের সবাই খেতে পারে। কুদ্দুস বয়াতি আর হনুফা বয়াতিকে খবর দেয়া হয়েছে। ওরা স্বামী-স্ত্রীর পালা গান করবে। হুজুরের জন্য বেশ কয়েকবছর আগে থেকেই হুজুরখানা নাম দিয়ে পাকা ঘর বানানো হয়েছে। বিশাল পালংকের উপর হুজুরের শোবার বালিশ, দুইটা প্রমাণ সাইজের কোলবালিশ। হুজুরের সাদা রং খুব পছন্দ। নিজ বাড়ি সহ লাগোয়া হুজুরখানার ভিতর-বাহির, চাদর, বালিশ সবকিছুই সাদা। এলাকায় আরও দু’টি পাকা বাড়ি আছে, তার মধ্যে তাদের বংশের একজনের একটি দো’তলা, আরেকটি অন্য বংশের একজনের একতলা দালান; তাঁদের প্রতিদ্বন্ধী বংশের। মাদবরের দাওয়াত তিনি বিনীতভাবে প্রত্যাখ্যান করেন। প্রত্যাখ্যানের বিনীত ভাবটুকু মাদবর সাহেবের চোখে পরেনি। তিনি শুধু প্রত্যাখ্যানের তীব্র জ্বালাটাই অনুভব করলেন। মনে মনে নিজেকে ধৈর্য্য ধরার তাগাদা দিলেন। সময় সুযোগ মত টাইট দিলেই হবে, কঠিন টাইট।
মাগরিব নামাজের পর আজ একটু দেরী করেই মাওলানা আব্দুল গফুর ইমনকে পড়াতে আসলেন। বাড়ির লাগোয়া বাড়িতে গতকাল মাঝরাতে হুজুর কেবলা ইসহাক মিয়ার বাড়িতে তশরিফ এনেছেন। চারিদিকে যেন ঈদ উৎসব। হুজুর কেবলাকে নাম ধরে ডাকা যাবেনা। শুধু ‘বাবা’ বলতে হবে। বাবারও ‘বাবা’ ছেলেরও ‘বাবা’। একদিকে এলাকার লোকজনের জন্য ‘বাবা’ ডাকটা ভালই হয়েছে। কারন, আড়াই লাইনের নাম নেয়া এত সহজ না!
স্থির, মনোযোগী ইমনকে আজ একটু বেখেয়ালী মনে হচ্ছে। ছোট একটা ছড়া পড়তেই এক ঘণ্টার উপর চলে গেছে। পড়া দেবার নাম নেই। অথচ এমন একটা ছোট ছড়া শেষ করতে ওর মাত্র পনের থেকে বিশ মিনিট সময় লাগার কথা।
হঠাৎ দমকা হাওয়ার সাথে ডেকচি থেকে আসা বিরিয়ানির মুখরোচক ঘ্রাণ নাকে এসে ধাক্কা দিল। মাওলানা আব্দুল গফুর এর কাছে ইমনের আজকের অস্থিরতার কারনটা পরিস্কার ধরা পরল। তিনি মনে মনে এসব অনাচার থেকে নিজকে এবং ইমন নামের অসাধারন ছেলেটিকে রক্ষার জন্য সৃষ্টিকর্তার কাছে সাহায্য চাইলেন।
সময় বাড়ার পাশাপাশি ইমনের অস্থিরতাও সমানতালে বাড়ছে। মাওলানা আব্দুল গফুর এর মনে ছেলেটির জন্য খুব কষ্ট হচ্ছে; আহারে বাচ্চা ছেলেটা বিরিয়ানি খাওয়ার জন্য কিরকম ছটফট করছে! যদি সম্ভব হত তাহলে আজই নিজের হাতে রান্না করে ছেলেটাকে বিরিয়ানি খাওয়াতেন। তিনি প্রতিজ্ঞা করলেন, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ইমনকে একদিন নিজের টাকা দিয়ে ভরপেট বিরিয়ানি খাওয়াবেন।
বাড়ির কাজের মেয়েটি রাতের ভাত দেবে কিনা জিজ্ঞেস করতেই মাওলানা আব্দুল গফুর বললেন, আজ আমি আর ইমন একসাথে খাব। দু’জনের জন্য খাবার আন। ইমনের মা দরজার ওপাশ থেকে বললেন, হুজুর, আজ ইমন ওর দাদা বাড়িতে উরসের বিরিয়ানি খাবে। ওর দাদা খুব করে বলে দিয়েছেন যাতে অবশ্যই ইমন ‘বাবা’র সাথে দেখা করে খেয়ে আসে।
মাওলানা আব্দুল গফুর সাহেব স্বভাববিরুদ্ধ দৃঢ় কণ্ঠে বললেন, ইমন আজ আমার সাথেই খাবে আর আজকে ও উরসের কোন খাবারও খাবেনা। পীরের কাছেতো অবশ্যই যাবেনা। পীরকে সিজদা দেবার জন্য আল্লাহ্ আমাদের সৃষ্টি করেননি। মহান আল্লাহ্, আমাদের সৃষ্টিকর্তা আপনি, আমি, ইমন সহ কাউকেই কোন মানুষের সেজদা না করার জন্য কঠোর নির্দেশ দিয়েছেন। পারলে আপনারাও কথাটা মনে রাখার চেষ্টা করবেন।
উচ্চারণে কি এক অমোঘ নির্দেশনা আছে। ইমনের মা ছালেহা বেগম চুপ করে গেলেন। তিনি ভিতর থেকে দু’জনের খাবার পাঠালেন।
ইমনের চোখ দু’টি ছলছল করছে। ওর কাছে ভাতকে মনে হচ্ছে পাথরের টুকরা। চিবুতে গেলেই দাঁতে ব্যাথা ব্যাথা লাগছে। মন চাইছে হুজুরকে ধাক্কা মেরে চেয়ার থেকে ফেলে দিয়ে এক দৌড়ে উরস উপলক্ষে যেখানে গান হচ্ছে সেখানে ছুটে যায়। হুজুর তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে আছেন। হুজুরের চোখ আজ এত লাল দেখাচ্ছে কেন? ইমন কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না। হুজুরের লাল চোখ আর পাথর খাওয়াটা অত্যন্ত যন্ত্রণাদায়ক।
মাওলানা আব্দুল গফুর এর ভিতরটা কাঁদলেও চোখের আগুনটাকে মোটেই নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করছেন না। সত্য পথে চালাতে গেলে মাঝে মাঝে প্রচণ্ড আঘাত করতে হয়। মাওলানা আব্দুল গফুর নিশ্চিতরূপে জেনেছেন, এই পীর নামক লোকটি মানুষের কাছ থেকে সেজদা নেন। কোন ওয়াক্ত না মেনেই নামাজ পড়েন। কি আশ্চর্য, দুনিয়ার লোকগুলি এত বেকুব হয়ে যাচ্ছে কেন? মুসলমান হয়ে মূর্তি পূজারীদের মত মানুষ পূজা করে যাচ্ছে! “লা হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ"।
বাইরে প্রচণ্ড বৃষ্টি, সঙ্গে তুমুল বাতাস। এমন ঝড় বৃষ্টির মাঝে আজ ইমনকে আজ পড়াতে যাওয়া সম্ভব হবে না। মাগরিব এবং এশা ওয়াক্তের নামাজের সময় মুসল্লী পেয়েছেন মাত্র একজন, যিনি আজান দেন- মুয়াজ্জিন। এই মসজিদে বাঁধা কোন মুয়াজ্জিন নেই। মসজিদে যিনি একটু আগে আসেন, তিনিই আজান দেন। এশার নামাজের পর মুয়াজ্জিন সাহেব ছাতা নিয়ে বাড়ির দিকে রওনা দিলেন।
নামাজের পর টিনের ডিব্বায় থাকা মুড়ি খেয়ে নফল নামাজের সিদ্ধান্ত নিলেন। একাকীত্ব- এ সময়টা প্রচণ্ড ভাল লাগে। কেমন যেন অদৃশ্য এক সুতোয় সৃষ্টিকর্তা আর সৃষ্ট জীবের মাঝে বন্ধন তৈরি হয়। পরম ভালবাসায় সৃষ্টিকর্তাকে অনুভব করা যায়। ভালবাসার আবেগে কখন যে চোখ দিয়ে পানি বেরিয়ে আসে বুঝতে পারা যায়না। ভালবাসা কি এমনই হয়! সৃষ্টিকর্তাকে ভয় না, শুধুই ভালবাসতে ইচ্ছে করে। এই যে, বাইরে প্রচণ্ড বৃষ্টি আর বাতাস। কি সুন্দর মায়াবী পরিবেশ, এটাতো আল্লাহ্ তায়ালা’র করুণারই নিদর্শন।
হালকা ধাক্কায় দরজা খুলে যায়। ইসহাক মিয়া তার সঙ্গীকে নিয়ে মাওলানা আব্দুল গফুর এর ঘরে প্রবেশ করলেন। মাওলানা আব্দুল গফুর সেজদায় পরে আছেন। কোন কিছুই টের পাচ্ছেন না। ঘরের ভিতর দশাসই দুই দুইজন মানুষ প্রবেশ করেছে, তা তার চেতনার কোন অংশকেই স্পর্শ করেনি। অপার্থিব এক মোহমায়ায় আচ্ছন্ন হয়ে সেজদায় উপুড় হয়ে পরে আছেন।
ইসহাক মিয়ার কেমন যেন ভয় ভয় লাগছে। সত্যিকারের পুরুষ মানুষকে কোনকিছুতেই ভয় পেতে নেই। ইসহাক মিয়া হাঁক ছাড়লেন-
পুইন্না।
জ্বী মাদবর সাব।
সেজদা থ্যাইক্কা উঠতেই রশিটা দিয়া ঐ কাঠমোল্লার গলায় ফাঁস দিবি। দুই মিনিটের বেশি সময় নিতে পারবিনা।
লাঠি হাতে প্রায় ছয় ফুটের কাছাকাছি লম্বা ঘোর কালো পাহাড়ের মত লোকটা মনে হয় একটু ইতস্তত করছে।
ইসহাক মিয়া আবারও গর্জে উঠলেন, ঐ মা ......’র পুত। খাম্বার মত খাড়াইয়া রইছস ক্যান। রশি ল।
লালচোখ আর ঠাটা পরার মত কঠিন ধমক খেয়ে পুইন্না কোমরে প্যাঁচানো দেড় হাত লম্বা রশিটা বের করল।
ইসহাক মিয়া মন্তব্যের স্বরে বলল, কাঠমোল্লা সেজদায় এতক্ষণ লাগাইয়া কি করতাছে?
বেশ লম্বা সময় পর মাওলানা আব্দুল গফুর সেজদা থেকে উঠে বসলেন। দ্বিতীয় সেজদার মাঝখানে বসে ‘আল্লাহুম্মাগফিরলি, ওয়ারহামনি, ওয়াহদিনি, ওয়া আফিনি, ওয়ারযুকনি’ পড়ছেন। এইসময় পুইন্না তার হাতে থাকা দড়ি দিয়ে গলাটা পেঁচিয়ে দুইদিক থেকে হ্যাঁচকা টান দেয়। মুহূর্তেই ঘাড়ের হাড় ভেঙ্গে মাওলানা আব্দুল গফুরের মৃত্যু নিশ্চিত হলে ইসহাক মিয়া বলেন, ইট ভর্তি বস্তাটায় মোল্লার লাশটারে ভইরা গাঙ্গে ফালাইয়া দে।
এক সপ্তাহ হয়ে গেল। হুজুর আসছেনা। ইমন মনে মনে বলে, হুজুর, আমি আর কখনও ঐসব বিরিয়ানি খাবনা। কোনদিনই আর বিরিয়ানি খাবনা। আমাকে মাফ করে দেন হুজুর। আমি কখনও মানুষকে সেজদা করব না। আপনি দয়া করে আমাকে পড়াতে আসেন। আমার অনেক পড়া বাকি আছে।
২| ২৪ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৭ রাত ১০:৫৯
আলমগির কবির বলেছেন: অনেক সুন্দর
৩| ২৫ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৭ বিকাল ৫:৫৮
হুয়ায়ুন কবির বলেছেন: ধন্যবাদ আলমগির কবির।
৪| ০৯ ই অক্টোবর, ২০১৭ সন্ধ্যা ৭:২৭
আলমগির কবির বলেছেন: আরও লেখা চাই।
©somewhere in net ltd.
১|
২৪ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৭ বিকাল ৫:৫২
হুয়ায়ুন কবির বলেছেন: মাওলানা আব্দুল গফুর