![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
গ্রীষ্মের ভর দুপুরে বস্তির ছোট একটা ঘরে খাদিজা বেগম একা বসে আছেন। দুপুর পার হয়ে যাচ্ছে। বড় মেয়ে সালমা আর ছোট ছেলে সালাম। ওরা এখনও স্কুল থেকে ফেরেনি। ফিরতে ফিরতে বিকেল হয়ে যাবে। আজ ঘরে চুলা জ্বলেনি, কোন কিছু থাকলেতো চুলা ধরানো হবে? দিনভর স্কুলে কাটিয়ে বাচ্চা দু’টি এসে কি খাবে এই চিন্তায় অস্থির খাদিজা বেগম। সকালে আগের রাতের রয়ে যাওয়া ভাত পানিতে ভিজিয়ে রেখেছিলেন বলে ওরা কিছু একটা মুখে দিয়ে সকালে স্কুলে গেছে। সারাদিনে ওদের আর কিছু খাওয়া হবে না। নিজের অজান্তেই চোখ থেকে কয়েক ফোটা পানি গড়িয়ে পরলো।
স্বামী জামাল মিয়া রিক্সা চালায়। রোজগারপাতি কম হবার কথা নয়। দু’ঘর পরের কিসমত মিয়াতো একই কাজ করে। ওদের সংসারেতো এত অভাব অনটন নেই! লোকটা ইদানীং টাকা দিয়ে করেটা কি? খাদিজা বেগম আজ রাতে বিষয়টা নিয়ে স্বামীর সাথে কথা বলবেন বলে সিদ্ধান্ত নিলেন।
বাইরে সালাম আর সালমার কথাবার্তা শুনা যাচ্ছে। আওয়াজটা বেশ চড়া আর উত্তেজনাপূর্ণ। আজ মনে হয় ওরা একটু আগেভাগেই এসে পরেছে! কারণটা কি? ওরা ঘরে ঢুকতেই খাদিজা বেগম জিজ্ঞেস করলেন, কিরে স্কুল থেকে আজ তাড়াতাড়ি ফিরলি যে।
সালমা উত্তর দিল, আজ আমাদের স্কুলের কমিটির মেম্বরের বাবা মারা গেছেন। স্কুল তাড়াতাড়ি ছুটি দিয়ে স্যারেরা সবাই লাশ দেখতে গেছেন।
ছেলে সালাম বলল, মা খেতে দাও। খাদিজা বেগম কি বলবেন ভেবে পাচ্ছেন না। অস্ফুট কণ্ঠে বললেন, আজ রান্না হয়নি। ভাত দিতে পারবনা। টিনের ডিব্বায় কয়টা মুড়ি আছে। মন চাইলে খেয়ে নে।
আশ্চর্য্য তো ভাই-বোনের মধ্যে কোন বিকার নেই দেখছি! ঘরে খাবার নেই তারপরেও এত আনন্দ কিসের! ওরা কি বাইরে থেকে কিছু খেয়ে এসেছে? মুখ দেখেতো মনে হচ্ছে না। মুখগুলি শুকিয়ে আছে, কিন্তু চোখগুলি কিসের প্রত্যাশায় যেন জ্বলজ্বল করছে। কিছু জিজ্ঞেস করতে গিয়েও চুপ করে গেলেন। কি এক আনন্দে দু’জনেই বিভোর। যাকগে, ছোট বাচ্চাদের আনন্দের জন্য কতকিছুইতো থাকে। দুনিয়ার বেশিরভাগ ঘটনা থেকেই ওরা আনন্দ খুঁজে নেয়। হোক তা সুখের কোন ঘটনা বা দুঃখের।
রাত নয়টার সময় এক কেজি চাল, আড়াইশো গ্রাম মসুরির ডাল, দুইটা ডিম আর এক কেজি আলু নিয়ে জামাল মিয়া ঘরে ফিরলে খাদিজা বেগম যতদ্রুত সম্ভব রান্না করতে লেগে পরলেন। ছেলে-মেয়ে দু’টি এখনও কিছু খায়নি। রান্নার মাঝেই স্বামীর দিকে তাকালেন, চোখগুলি কেমন যেন লাল মনে হচ্ছে। আরে আজ বেশ কয়েকদিন ধরেইতো জামাল মিয়া এমন চোখ লাল করে বাসায় ফিরে আসছেন! আশ্চর্য্যতো, এতো বেখেয়াল ছিলাম আমি। খাদিজা বেগম নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করছেন। শারীরিক ব্যাপারগুলিও ইদানীং কেমন যেন ম্যাটম্যাটে হয়ে গেছে। কোন সমস্যা হয়নিতো! ওপাশের ঘরের জমিলার স্বামীর মতো লোকটা নেশাপানি আর মেয়েমানুষের পাল্লায় পরেনিতো? আল্লাহ্ তুমি রহম করো, এমন যেন না হয়।
খাওয়া দাওয়ার পর খাদিজা বেগম জামাল মিয়াকে একটু ঝাঁঝালো কণ্ঠেই জিজ্ঞেস করলেন, আপনার কি হয়েছে, মানুষ কি আপনার রিক্সায় উঠে টাকা দেয় না? কয়েকমাস ধরেই ঘরে ঠিকমতো খাবার দাবার দেন না। এমন খোঁচা মারা কোথায় জামাল মিয়া বেশ উত্তেজিত হয়ে পরে। মনের অজান্তেই খাদিজা বেগমকে চড় মেরে বসেন। খাদিজা বেগমের উপর সেদিন থেকে শুরু হয় শারীরিক নির্যাতন। দিন দিন বাড়তেই থাকে।
খাদিজা বেগম মুখ বুঝে সয়ে যাচ্ছেন। সংসারটা যাতে আগের মতো সুখের হয়ে যায়, আল্লাহ’র কাছে দিনরাত এই প্রার্থনা করতে থাকেন।
ছেলে, মেয়ে দু’টি কয়েকদিন যাবৎ ‘বিরিয়ানি খাব’ বলে বলে কান ঝালাপালা করে দিচ্ছে। মাসকয়েক আগে কোন এক মৃত ব্যক্তির চারদিনের কুলখানির বিরিয়ানি খেয়ে মায়ের জন্যেও পলিথিনে করে এনে দিয়েছিলো। খাদিজা বেগম খবর পেয়েছেন, আশেপাশের কোথাও কুলখানির আয়োজন হলে ওরা স্কুল ফাঁকি দিয়ে সেখানে হাজির হয়। নিজে খাওয়াতে পারেন না বলে হীনমন্যতা থেকেই ব্যাপারটা মেনে নিয়েছেন খাদিজা বেগম। ইদানীং মানুষ কম মরছে মনে হয়। নাহলে হঠাৎ করে মায়ের কাছে বিরিয়ানি খাবার জন্য এতো ঘ্যানঘ্যান করছে কেন ওরা?
জামাল মিয়ার ভাবগতির আরও অবনতি হয়েছে। ইদানীং রাতেও বাড়িতে ফেরা কমিয়ে দিয়েছে। সংসার নামক একটা বন্ধন যে আছে সেটা যেন সে ভুলেই গেছে লোকটা। স্ত্রী, সন্তানদের খাবারটুকু সরবরাহেও তার কৃপণতা চরমে পৌঁছেছে। খাদিজা বেগম আর কতদিন এর ওর কাছে হাত পেতে সংসার চালাবেন! মাঝে মাঝে জামাল মিয়া যেসব মেয়েমানুষের কাছে যায়, ওদের মতো হয়ে যেতে মন চায় খাদিজা বেগমের। বাস্তবতার সব রূপ দেখেও খাদিজার ভিতরের মনুষ্যত্ব এখনও মরে যায়নি। তাই হয়তো অমন মেয়েমানুষ হয়ে উঠতে পারছেন না। কতদিন পারবেন আল্লাহ্ ই জানেন।
এক সপ্তাহ পর আজ জামাল মিয়া ঘরে ফিরেছে। রক্তরাঙ্গা চোখ। খাদিজা বেগম কিছুই বললেন না। না কোন অভিযোগ, না ভালবাসার আবেগ, না গত তিনদিন ধরে সন্তানদের নিয়ে না খেয়ে থাকার অনুযোগ। ছেলে-মেয়ে ঘুমালে খাদিজা বেগম টের পেলেন তার স্বামীর ঘরে ফেরার উদ্দেশ্য। মেয়ে মানুষ না পেয়ে খাদিজার কাছে আসা। চরম বিরক্তি আর ঘৃণায় জামাল মিয়াকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলেন। জামাল মিয়া এখন আর মানুষের মধ্যে নেই। ক্ষুধার্ত হিংস্র জানোয়ার একটা। ঘরের কোণের চ্যালা কাঠ দিয়ে খাদিজাকে পেটাতে লাগলেন। খাদিজা বেগম এতো মার খাওয়ার পরও সামান্য শব্ধও করলেন না। ছেলে-মেয়ের কাছে কিভাবে মুখ দেখাবেন- এই লজ্জা থেকেই হয়তো নিশ্চুপ থেকে মার খেয়ে যাওয়া। কিন্তু শেষ রক্ষা আর হলোনা। সালমা আর সালাম জেগে উঠলো। অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখছে তাদের মাকে কিভাবে পেটানো হচ্ছে। খাদিজা বুঝতে পারছেন, যে লজ্জা তিনি আড়াল করতে চেয়েছেন সেটা আর পারলেন না। একসময় ক্লান্ত হয়ে অশ্লীল গালিগালাজ করতে করতে জামাল মিয়া ঘর থেকে বের হলো।
খুব ভোরে ভাই-বোনের ঘুম ভাঙে। দেখতে পায় মা ঝুলে আছেন। শরীরটা বেড়ার ফাঁক দিয়ে আসা বাতাসে অল্প অল্প দুলছে।
দুপুরে জামাল মিয়া কোথা থেকে এসে লাশ দাফনের আয়োজনে লেগে গেলো। ভাবলেশহীন চেহারা। মনে মনে সে কি ভাবছে একমাত্র অন্তর্যামীই ভাল জানেন।
লাশ দাফনের পর সন্ধ্যায় জামাল মিয়া ঘরে ফিরে আসে। এসেই সালমা আর সালামকে বুকে জড়িয়ে ঢুকরে কেঁদে উঠে। কিছুক্ষণ পর জিজ্ঞেস করে, তোরা কিছু খেয়েছিস? ওরা নাসূচক মাথা নেড়ে জানালো আজ চারদিন যাবৎ ওরা কিছু খায় নি। কিছুক্ষণ পর সাত বছর বয়সী সালাম বাবাকে জিজ্ঞেস করে, বাবা, মায়ের চারদিনের খরচের সময় সবাইকে বিরিয়ানি খাওয়াবে? কতদিন বিরিয়ানি খাইনা!
জামাল মিয়া স্তব্ধ, হতবাক হয়ে ছেলের দিকে তাকিয়ে রইলেন। ছেলে-মেয়ে দু’জনের চোখে, মুখে কোন শোক নেই, ওখানে শুধুই ক্ষুধা, প্রচণ্ড ক্ষুধা। ওদের ক্ষুধার অভিব্যক্তিটাই শুধু টের পাচ্ছে জামাল মিয়া নামের মানুষটি। মানুষ, না অমানুষ !!!
২| ২৫ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৭ সকাল ১০:৩৮
হুয়ায়ুন কবির বলেছেন: অর্থহীন জীবন (রিয়াজ) ভাই, আপনার সাথে সহমত করছি। আপনার মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।
৩| ২৫ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৭ দুপুর ১২:৪২
হুয়ায়ুন কবির বলেছেন: ক্ষুধা ...............।।
৪| ০৯ ই অক্টোবর, ২০১৭ সন্ধ্যা ৭:২৬
আলমগির কবির বলেছেন: আরও লেখা চাই।
©somewhere in net ltd.
১|
২৫ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৭ সকাল ১০:২১
অর্থহীন জীবন (রিয়াজ) বলেছেন: পেটে যদি ক্ষুধা থাকে তাহলে কিছুই আর ভাল লাগে না সে আপনই হোক আর পরই হোক।