![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
পাখিদের লজ্জা দিয়ে মাঝরাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে গেল। এই মাঘ মাসের শীতেও সারা শরীর ঘামে ভেজা। আমি কি কোন দুঃস্বপ্ন দেখছিলাম? সাদেক, বারো বছরের একটি ছেলে আমার ডানদিকে দাঁড়িয়ে গ্লাস ভর্তি পানি নিয়ে অপলক তাকিয়ে আছে। সেকি ভয় পেয়েছে? মনে হয় না। ও ভয় পাওয়ার মত ছেলে না। সাদেক জিজ্ঞেস করল, লালী, কালী কে? বড় ছুরি কিসের জন্য? আর এতো জোরে জোরে আপনার মা’কে ডাকছিলেন কেন?
অসময়ে ঘুম ভাঙ্গার কারনটা এখন বুঝতে পারছি। নিশ্চিত ভয় বা দুঃখ পাওয়ার মত কোন স্বপ্ন দেখছিলাম। মা, ছুরি, লালী, কালী- হ্যাঁ, আমার শৈশবের সবচেয়ে কষ্টের ঘটনাগুলির একটা আজ স্বপ্নে দেখেছি। ত্রিশ বছরের এই আমি হঠাৎ করে কেন ছয়/সাত বছর বয়সে ঘটে যাওয়া ঘটনা স্বপ্নে দেখে এমন উত্তেজিত হবো! অদ্ভুত, মানব জীবনের সবকিছুই অদ্ভুত।
আমি সাদেকের হাত থেকে পানি নিয়ে এক চুমুকেই সবটুকু শেষ করলাম। ওর প্রশ্নের জবাব দেবার প্রয়োজন দেখছিনা। কিছুদিনের মধ্যেই কোন এক ভালোলাগার মুহূর্তে ও ঠিকই আমার মা, ছুরি, লালী, কালী বিষয়ক কথাগুলি পেট থেকে বের করে নেবে।
আরে, কথা কি মানুষের পেটে থাকে! আশ্চর্য তো! আমি হাসতে লাগলাম- পেটের মধ্যে কথার স্টক!
আমার হাসি দেখে সাদেক কেমন যেন একটু নিশ্চিত হল। আমি ওকে বললাম, তোকে আর কষ্ট করতে হবেনা, তুই ঘুমা। সাদেক বলল, এখন ঘুমালে আর ফজর নামাজ পড়া হবে না। এখন একটু লেখাপড়া করে নেই। তারপর ফজরের নামাজ পড়ে ঘুমাবো। আমি বললাম, যা তুই পড়তে বস। আমার মনে হয় ঘুম আসবেনারে সাদেক। বাইরে একটু হাঁটাহাঁটি করি।
নামাজের ব্যাপারে ইদানীং ওর আগ্রহটা বেশ লক্ষণীয়। মাসখানেক আগে মহল্লায় তরুন, যুবকদের উদ্যোগে এক বিরাট ওয়াজ ও দোয়ার মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়েছে। সেখানে কামেল ওয়ায়েজীর নসীহতের ফল বুঝা যাচ্ছে সাদেকের আগ্রহে। কিশোর বয়সে আশেপাশের এলাকায় যেখানেই ওয়াজ ও দোয়ার মাহফিল হতো সেখানেই আমার সরব উপস্থিতি ছিল। যতবড় মাওলানা, তত বড় নাম। পুরো নাম বলতে নূন্যতম নয়টি শব্দ বলতে হবে। ও হ্যাঁ, ওয়াজে না যাবার কারণটা বলি। ওয়ায়েজী মহোদয় ওয়াজ শুরু করার কিছু সময় পরই কথার ফাঁকে বিশাল এক ধমক দেবেন। যেমন, ওই মিয়ারা জোরে বলেন ‘সুবহানআল্লাহ’। উপস্থিত দর্শক, শ্রোতারা একটু জোরে বলে উঠেন ‘সুবহানআল্লাহ’। এরপর আরও জোরে ধমক দিয়ে বলেন, ওই মিয়ারা বউ কি খাওয়ায় নাই, এত আস্তে বলেন কেন? অবিবাহিতরা মুচকি হাসে, আর বিবাহিতরা লজ্জায় মুখ লুকানোর জায়গা খোঁজেন।
ওয়াজের ব্যাপারে আমার আরেকটি অপ্রিয় বিষয় আছে। ওয়াজ মাহফিলগুলোয় আল্লাহ্ তায়ালাকে চরম ভয়ঙ্কর রূপে উপস্থাপন করা হয়। আল্লাহ্ তায়ালা’র সৃষ্ট জাহান্নাম, জাহান্নামের ভয়াবহতা। আমার মনে হয় আল্লাহ্ তায়ালা’র প্রতি ভয় না, তাঁর নিয়ামতসমুহ এবং মহান দয়ালু বিশেষণের চিত্রটা এঁকে সৃষ্টিকর্তার প্রতি ভালবাসার আবেশ সৃষ্টি করা উচিৎ। মানব চরিত্রের স্বাভাবিক প্রক্রিয়া হচ্ছে, যার বিরুদ্ধে লড়াই করার শক্তি, সামর্থ্য নেই এবং তাঁর প্রতি যদি মনে প্রচণ্ড ভয় থাকে, তবে অবশ্যই ওনাকে এড়িয়ে চলবে সে। আর ভালবাসার কারো প্রতি আকর্ষণটা এত ইস্পাত কঠিন যে, আমাবস্যার ঘনঘোর অন্ধকার রাতেও গভীর জঙ্গল পাড়ি দিয়ে তাঁর সান্নিধ্য লাভের তীব্র ইচ্ছা তৈরি হবে। আরও আছে, ওয়াজ ও দোয়া মাহফিলের শেষের দিকে জান্নাতের বাগানের টুকরা অনুষ্ঠান থেকে উপস্থিত দর্শক, শ্রোতারা হতাশ হয়ে ফিরে আসেন। কারন সে সময় ওয়ায়েজী মহোদয় বলেন, ‘নামাজ, রোজা, আমল যাই করেন আলাহ পাক ইচ্ছা না করলে বেহেস্তে যেতে পারবেন না মিয়ারা’।
যে মাহফিল থেকে সাদেক নসীহত নিয়েছে, সেই ওয়াজের ওয়ায়েজী হয়তো ব্যতিক্রম ছিলেন। তিনি নিশ্চয়ই ভয়ের বদলে আল্লাহ্ তায়ালা’র প্রতি ভালবাসা সৃষ্টি হওয়ার মত সুন্দর সুন্দর কথা বলেছেন। নইলে সাদেকের মতো বান্দার এমন পরিবর্তন আশ্চর্য্য হবার মত ঘটনা কেন ঘটবে! এসব জটিল ভাবনার মধ্যেই ফজরের আজান। সাদেক জামাতে নামাজ পড়ার জন্য মসজিদে রওনা হলো। অদ্ভুত সুন্দর একটা দৃশ্য। ভাবছি, ঘরে বসেই ফজরের নামাজটা পড়ে নেই। কতদিন আল্লাহ্ তায়ালা’র কাছে নিজেকে পরিপূর্ণভাবে সমর্পিত করা হয়না!
সাদেকের সাথে আমার পরিচয় যখন ও ক্লাস ফোর এ পড়ে। তখন আমি মফস্বলে নিজ বাড়িতে থাকি। আমার এক ধুরন্ধর বন্ধু ভিডিও ক্যাসেটের ভাড়া ব্যবসা। সে সময় ভিসিডি আর ক্যাসেট ভাড়ার ব্যবসা বেশ জমজমাট। সন্ধ্যায় ব্যবসায়ী বন্ধুর দোকানে বসে আছি। দোকানের পিচ্চিটার অভাব দু’জনেই বেশ টের পাচ্ছি। নিকোটিনের অভাবটা বেশ জ্বালা দিচ্ছে দু’জনকেই। কাকে দিয়ে সিগারেট আনাই? সিগারেট এর দোকানগুলি বেশ একটু দূরে। এসময় হাতে চাঁদ পাওয়ার মতো সাত বছর বয়সী এক ছেলেকে হেঁটে যেতে দেখে বন্ধুজন ওকে দোকানের ভিতর ডেকে আনলো। ছেলেটিকে আন্তরিকভাবে জিজ্ঞেস করল, তোমার নাম কি বাবা; কাজ আদায় করে নেবার অব্যর্থ অস্ত্র।
আমার নাম সাদেকুল ইসলাম।
তোমার বাবার নামটা কি যেনো?
মরহুম আয়নাল হক।
ও তোমার বাবা নেই!
তুমি পড়ালেখা কর?
জ্বী, আমি ক্লাস ফোর এ পড়ি, রোল নম্বর- ২।
বন্ধুজন বেশ অমায়িক কণ্ঠে বললেন, বাহ বেশ ভাল। লেখাপড়া করে অনেক বড় হও বাবা। একটা কাজ করে দেবে বাবা?
কি কাজ?
তিনটা সিগারেট এনে দেবে?
উত্তরে সাদেক বলল, লেখাপড়া করতাছি কি আপনাগো সিগারেট আইন্না দেওনের লাইগ্যা? আমি সিগারেট আনতে পারুম না। এ কথা বলেই সাদেক ছুটে দোকান থেকে বের হয়ে গেল। দুই বন্ধু অবাক হয়ে ওর চলে যাওয়া দেখতে লাগলাম।
আজ একমাস হয়ে গেল, চাকুরীটা হারানোর পর থেকে পার্কের বেঞ্চে সকাল থেকে সন্ধ্যা অব্দি বসে বসে সময় কাটানো। সময়গুলি খারাপ যায়না। কতকিছু ঘটে এই পার্কে। আধুনিক যুগের অত্যাধুনিক মানুষগুলির মাঝে সবই আছে, শুধু মানুষকে মানুষ বলার মত বিশেষ কয়েকটি মৌলিক বৈশিষ্ট্যগুলো যেন হারিয়ে ফেলেছে এরা। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে বিবেক। বারো রকমের মানুষের মেলা এই পার্কে।
জমানো কিছু টাকা ছিল। ঐ টাকা দিয়েই চালিয়ে যাচ্ছি। কতদিন চলতে হবে তাও জানিনা। যেদিন সাদেক চাকুরী হারানোর কথাটা জানবে সেদিন আরেক সমস্যা তৈরি হবে, যেটা সামলানো বেশ মুশকিল হয়ে পরবে। ওর ধারনা মতে আমি হচ্ছি যোগ্যতম ও সৎ একজন ব্যক্তি, যে অফিসের সব কাজই জানে। আমার অফিসটি ওর চেনা। জানার পর অফিসে গিয়ে আবোলতাবোল কি জানি কি করে বসে! ভালোলাগার মানুষগুলি সম্পর্কে উচ্চ ধারনা পোষণ করা মানব চরিত্রের একটা অলঙ্ঘনীয় দিক। সাদেককে দেখলে, আমার সম্পর্কে ওর কথা শুনে যে কেউ এই বিশ্বাস নিয়েই ফিরবে।
চিন্তা করছি ছোটখাটো একটা ব্যবসা শুরু করবো। ঢাকা শহরে কত রকমের যে ব্যবসা! আচ্ছা, একটা ব্যবসা খুললে কেমন হয়। ফলের দোকান। মতিঝিলের কোন এক কোণায় বসে বিক্রি। এ ব্যবসা যারা করছে তাদের ভাবসাব দেখেতো মনে হয় লাভের অঙ্কটা মন্দ না। ব্যবসার পলিসিটা একটু অন্য রকম হবে। গুলিস্থানের ফুটপাথের চৌকিতে শার্ট বিক্রির মতো সুর দিয়ে বলবো, যেইটা নেন একশ টাকা। নাহ এভাবে হবেনা। সাদেকের সাথে কোন একদিন সুযোগ বুঝে পরামর্শ করতে হবে।
সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। আমি পার্কেই আছি। এখন পার্কে শুরু হবে আরেক মেলা। যেমন খুশি তেমন সাজ এর মত, যা মন চায় তাই কর জাতীয় কিছু। আমাদের মানে সাদেক আর আমার এক রুমের টিনশেড ঘরে ফিরতে হবে। আগামীকাল মনির সাহেবের বাড়ি যাবো। ওনার জীবন কাহিনী শুনতে হবে। লোকটি খুব ভাল একজন মানুষ। ওনার বিপদের সময় একদিনের জন্য ভদ্রলোকের পাশে ছিলাম। অবদান বলতে এতটুকুই। বিনিময়ে আমার জন্য সবকিছু বিলিয়ে দিতে প্রস্তুত। বড়ই আজব!
সাদেকের সাথে দু’বছর আগে আমার দ্বিতীয়বার এই পার্কেই দেখা হয় কোন এক শুক্রবার বিকেলে। পার্কে বসে আমার মনে হলো কে যেন আমাকে লক্ষ্য করছে। ভাবভঙ্গি দেখে মনে হয় না খারাপ কোন উদ্দেশ্য আছে। কাছে ডাকতেই কেমন যেন সঙ্কুচিত হয়ে আমার কাছে আসলো। দেখেই মনে পড়ল “লেখাপড়া করতাছি কি আপনাগো সিগারেট আইন্না দেওনের লাইগ্যা? আমি সিগারেট আনতে পারুম না।” কথাটা মনে পড়তেই হাসতে লাগলাম। আমার হাসিতে ওর ভয়টাও মনে হয় উবে গেল। চেহারায় অভাবের ছাপটা অত্যন্ত প্রকট। আমি জিজ্ঞাস করলাম, কি সাদেক আলী সাহেব, কেমন আছেন? ঢাকা শহরে, কবে থেকে, কেমনে কি?
সাদেক উত্তরে 'ভাল আছি' এ জাতীয় কিছু একটা বলল বেশ অনুচ্চ কণ্ঠে।
চা খাবি?
হুমম, খাবো।
আমি এক ফেরিওয়ালাকে ডেকে ওর জন্য বিস্কুট, কলা আর চা আর আমার জন্য স্রেফ চা দিতে বললাম । দেখলাম সাদেক বেশ গোগ্রাসে খাচ্ছে। বুঝতে পারছি লম্বা সময়ের ক্ষুধার্ত এক কিশোর। আরো কলা, বিস্কুট আর চায়ের অর্ডার করলাম ওর জন্য।
সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, কিরে কোথায় থাকিস। ও বলল এই পার্কেই আছি গত ষোলদিন যাবত। পাক্কা ষোল দিন? উত্তরে সাদেক বলল হুম, ষোল দিন।
তা তুই এখানে আসলি কিভাবে? তোর মা কোথায়?
মা একমাস আগে মারা গেছে। হঠাৎ অজ্ঞান হইয়া পইরা গেলো। আর উঠে নাই। ওখানে মা ছাড়া আর কেউ আছিলোনা। তাই ঢাকা শহরে আইসা পরছি। বাড়িওয়ালা ঘরের সবকিছু রাইখ্যা আমারে খেদাইয়া দিছে। তিনদিন না খাইয়া ট্রেনে উঠলাম। তারপর এই জায়গায়।
আমি ব্যাচেলার মানুষ। ওকে আমার সাথে যাবে কিনা জিজ্ঞেস করতেই রাজি হয়ে গেলো। বন্ধনহীন দুইজন মানুষ সেই থেকে অদৃশ্য এক মায়ার জালে জড়িয়ে গেলাম। তখন থেকে, নাকি ওর মায়ের সাথে দেখা হবার পর থেকেই এর শুরু!
এভাবেই আরও দু’টি বছর কেটে গেল। হঠাৎ একদিন দুপুর বেলা হাসপাতাল থেকে ফোন পেলাম। হাসপাতাল থেকে জিজ্ঞাসা করলো সাদেক নামের কাউকে চিনি কিনা। আমি ফোনে ঠিকানা ও আনুষঙ্গিক সবকিছু জেনে অফিসের কাউকে কিছু না বলেই হাসপাতালে চলে গেলাম। সাদা চাদরে মোড়ানো ছোট্ট বিছানায় শুয়ে আছে সাদেক নামের কিশোর ছেলেটি। পুরো মাথা ব্যান্ডেজে মোড়ানো। বেডের স্ট্যান্ডে ঝুলছে স্যালাইন। নার্সকে জিজ্ঞেস করতেই বললেন, ছেলেটির অবস্থা বেশি ভাল না। মাথায় প্রচণ্ড আঘাত পেয়েছে। কতক্ষণে জ্ঞান ফেরে বা আদৌ জ্ঞান ফিরবে কিনা ডাক্তার নিশ্চিত নন।
আমি ঘোর লাগা চোখে তাকিয়ে আছি সাদেকের দিকে। মনে মনে ওর সাথে গল্প করছি, জানিস তুই যেদিন সিগারেট আনার কথা বলায় আমাদেরকে অপমানজনকভাবে প্রত্যাখ্যান করেছিলি আমার বন্ধু অনেক ক্ষেপে গিয়েছিল। আমি কিন্তু অনেক মজা পেয়েছিলামরে সাদেক। অনেক খুঁজে তোর মা’কে পেয়েছিলাম। ওনার সাথে কথাও হয়েছিল। একটা সত্য কথা বলি। তুই কিন্তু কিছু মনে নিবিনা। তুই রহিমা বেগমের পেটের সন্তান না। যে পার্কে তোর সাথে আমার দেখা হয়েছিল ঐ পার্কে একদিন মধ্যরাতে তোর মা একটা পলিথিনে মোড়ানো ব্যাগে কয়েকঘণ্টা বয়সী তোকে পেয়েছিলরে সাদেক। হয়তো কোন নষ্ট জুটির অস্থির আবেগের পাপের মধ্য দিয়ে তোর জন্ম। আমার কথা শুনে কি রাগ করছিস? মধ্যরাতে ঐ পার্কে তোর মা রহিমা বেগম কি করছিল সেটা কিন্তু জিজ্ঞেস করিস না আবার। আমি বলতে পারবোনা। বড় হলে তুইও বুঝতে পারবি মধ্য রাতে রহিমা বেগমেরা ওখানে কি করে। তোকে পেয়ে পোড় খাওয়া কঠিন হৃদয়ের রহিমা বেগমের মাতৃত্ব উথলে উঠে। বস্তি আর নোংরা পেশা ছেড়ে তোকে নিয়ে অনেক দূর, আমাদের এলাকায় আসে। মানুষের বাড়িতে কাজ করে তোকে নিজের পরিচয়ে বড় করতে থাকে। তোর বাবার নামটা ছিল বানানো।
ভাইয়া, বিড়বিড় করে কি বলছ? আমি অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছি। কি স্বাভাবিকভাবেই না কথা বলছে! নার্স কি আমার সাথে মিথ্যে বলেছেন? ও কি আমার কথাগুলি শুনে ফেলেছে? মনে হয়না। আমিতো মনে মনে ওর সাথে কথা বলেছি। মনের কথা শুনার ক্ষমতা হয়নি ওর।
সাদেকের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, এখন কেমন লাগছেরে পাগলা? সাদেক উত্তর দিল, কিছু বুঝতে পারছিনা ভাইয়া। ভাইয়া, তোমাকে একটা কথা বলব, খুব গোপন কথা। আমি যদি আরও বড় হই তবে আবার তোমাদের এলাকায় যাব। বাড়িওয়ালাকে খুন করবো। আমি তোমাকে আমার মায়ের মৃত্যুর ঘটনাটাটা বানিয়ে বলেছি। ঐ বাড়িওয়ালা আমার মা’কে গলা টিপে খুন করেছিল। হ্যাঁ ভাইয়া, আমি সব দেখেছি ... বলতে বলতে আবারও সাদেক গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পরল। কিছুক্ষণ পর ডাক্তার এসে পালস, চোখ পরীক্ষা করে নার্সকে বললেন, ছেলেটার মুখটা ঢেকে দিন।
আমি মনে মনে সাদেককে বললাম, সাদেক তোকে যে আমার স্বপ্নে দেখা মা, ছুরি, লালী, কালী’র কাহিনী বলা বাকি আছে। মনির সাহেবের জীবনের গল্পটাও যে তোর শুনা হলোনা। আর, আমি যে প্রতিজ্ঞা করেছি দুই ভাই মিলে বাড়িওয়ালাকে খুন করবো- এর কি হবে? তোর আসল মা-বাবাকে খুঁজে দু’ভাই মিলে শায়েস্তা করবো। আমাকে একা করে চলে গেলি। আমি যে অনেক একারে পাগলা, একেবারেই একা। তোকে বলার জন্য কত গল্প যে বাকি আছে ..................... কাকে শুনাবোরে পাগলা।।
ঘুম থেকে জেগেই দেখি ফিটফাট এক ভদ্রলোক আমার ঘরে বসে আছেন। বসার ভঙ্গিতেও স্মার্টনেস। দারুনতো! আচ্ছা স্মার্টনেস এর কি কোন দ্যুতি থাকে! সাদেকের মৃত্যুর পর আজ পনের দিন হয়ে গেছে। এর মধ্যে খুব একটা বাইরে যাওয়া হয়নি। আজ ইচ্ছে ছিল মনির সাহেবের সাথে দেখা করার। এই স্মার্ট ব্যাটা আবার কোন কাজে আমার কাছে আসবে? আমার মতো সাধারন মানুষের সাথে তার মতো স্মার্ট লোকের কোন কাজ থাকতে পারেনা।
আমি কি এই অল্প কয়েকদিনের মধ্যে সন্দেহবাতিক হয়ে পরেছি? মানুষের পরিবর্তনটা কি খুব দ্রুত হয়? আমি আমার মধ্যে বড় একটা পরিবর্তন টের পাচ্ছি। বুঝতে পারছি, কোন এক ঘোরটোপের মধ্যে বন্দী হয়ে পরেছি। মানুষ গিরগিটির মতো দ্রুত রং বদলাতে পারেনা। কিন্তু কি এক অবিশ্বাস্য কারনে আমার আচরণে বিশাল পরিবর্তন এসে গেছে। সাদা থেকে কালো বা কালো থেকে সাদা বা নীল এমন কিছু একটা। কারন বসে থাকা অত্যন্ত স্মার্ট লোকটিকে দেখে আমার হতকচিত হওয়া উচিৎ। কিন্তু আমার মধ্যে কোন ভাবান্তরই টের পাচ্ছি না। আমি লক্ষ্য করলাম, তিনি বেশ তাচ্ছিল্যের সাথে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। এমন স্যুটেড, ব্যুটেড লোক আমাকে, আমার শোবার ঘরকে তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতেই দেখবে, এর মধ্যে কোন অস্বাভাবিকতা নেই। তার যাতায়াত হবে বড় বড় জায়গায়, কোন কর্পোরেট অফিস বা এমন বিশাল কিছু একটায়।
ভদ্রলোক নিজের পরিচয় দিতে লাগলেন, আমি নাঈম; মনির স্যারের পার্সোনাল সেক্রেটারি। উনি আপনাকে তাঁর বাসায় ডেকে পাঠিয়েছেন। সাথে গাড়ি আছে।
আমি টয়লেটে যাব। বাথরুমে যাবার আগে একটা সিগারেট খাওয়া অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে। ঘুম থেকে উঠে একগ্লাস পানি, তারপর একটা সিগারেট। ব্যাস, কোষ্ঠকাঠিন্যে আক্রান্ত রোগীর মতো ঘণ্টার পর ঘণ্টা টয়লেটে বসে থাকবার দরকার নেই।
আমি নাঈম সাহেবের দিকে নিশ্চুপ তাকিয়ে আছি। কারন, তার কথার মধ্যে কোন প্রশ্ন খুঁজে পাচ্ছিনা। তিনি তার পরিচয় দিচ্ছেন, দিতে থাকুন। এসব কথার পিঠে অবশ্য বলা যায়, আপনি কোন ক্লাস পর্যন্ত পড়েছেন বা প্রেম করছেন না বিয়েসাদি হয়ে গেছে? আজ কিছুই বলতে ইচ্ছে করছে না।
চৌকি থেকে নেমে এক গ্লাস পানি খেয়ে সিগারেট ধরালাম। জোরে জোরে টান দিচ্ছি, যাতে ধোঁয়ায় ঘর ভরে যায়। সামনে বসা নাঈম সাহেব মনে হয় সিগারেটের ধোঁয়া সহ্য করতে পারছেন না। তিনি কাশতে লাগলেন। কাশতে কাশতে চোখ দিয়ে পানি বের হবার অবস্থা।
নাঈম সাহেবকে হতভম্ব অবস্থায় রেখেই টয়লেটের দিকে রওনা দিলাম। পত্রিকা থাকলে ভাল হতো। পত্রিকা পড়ার উছিলায় ঘণ্টা খানেক বসে থাকা যেত। নাঈম সাহেবকে আরেকটু হতভম্ব করা যেত, মহা হতভম্ব। নাহ, মহা হতভম্ব শব্ধটা যুতসই হচ্ছেনা।
বাথরুম থেকে বেরিয়ে নাঈম সাহেবের মহা হতভম্ব মুখ দেখব বলে আশা করেছিলাম। কিন্তু লোকটা এরই মধ্যে হতভম্ব ভাবটা কাটিয়ে উঠেছেন। চেহারায় বেশ কাঠিন্য ভাব এসে গেছে। নাঈম সাহেব বললেন, স্যার কিন্তু সকাল থেকে আপনার জন্য বসে আছেন। একটু তাড়াতাড়ি করেন। আপনার ঠিকানা খুঁজে আপনার ঘরে ঢুকতেই সাড়ে দশটা বেজে গেছে। আপনার এখানে দুই ঘণ্টা ধরে বসে আছি। এবারও তার কথায় কোন প্রশ্ন নেই। জবাবেরও দরকার নেই। আমি শুধু দৃঢ় কণ্ঠে ঘোষণার সুরে বললাম, আজ আমার রমনা পার্কে চাওয়ালার সাথে মিটিং আছে। আপনার মনির স্যারকে গিয়ে বলবেন পরে কোন একসময় তার সাথে দেখা করবো। নাঈম সাহেব চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে আমার চেয়েও কঠিন কণ্ঠে বললেন, আগে বললেই পারতেন। শুধু শুধু আমাকে দুই ঘণ্টা বসিয়ে রাখলেন। প্যারেড লিডারের মতো গর্জে উঠলাম, চুপ ব্যাটা মিথ্যুক। তুই বেটা আমার এখানে এসেছিস এক ঘণ্টা, তেতাল্লিশ মিনিট আগে। সতের মিনিট শর্ট করে দিয়েছিস। যা বের হ হারামজাদা, মিথ্যাবাদী। কোন মিথ্যাবাদীর সাথে আমি কোথাও যাবনা।
নাঈম সাহেব ভেঙ্গে পরেছেন মনে হয়। কঠিনের সাথে কঠিনের লড়াই; তলোয়ার যুদ্ধ। দু’টার মধ্যে একটাতো ভাঙবেই। নাঈম সাহেব মোলায়েম স্বরে কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে গেলেন। আমি লাল চোখ নিয়ে নাঈম সাহেবের দিকে তাকিয়ে আছি। আমি আমার তর্জনী উঁচিয়ে আধ খোলা দরজা দেখিয়ে দিলাম। নাঈম সাহেব মাথা নীচু করে চলে যাচ্ছেন। আরে তর্জনীর ঈশারার এতো ক্ষমতা! একটু চিন্তিত মনে হচ্ছে নাঈম সাহেবকে। মনে হয় আমাকে সাথে না নিতে পারায় তার চাকরী নিয়ে টানাটানি পরে যাবে। পৃথিবীর কত মানুষেরইতো চাকরী চলে যায়। নাঈম সাহেবের মাধ্যমে সংখ্যার আধিক্যতে একটি ১ যোগ হবে মাত্র। তাতে দুনিয়ার কিছু আসবে যাবে বলে মনে হয় না। আবার বিশাল বড় কিছুও হতে পারে। চাকরী গেলে নাঈম সাহেব হয়তো তার প্রেমিকাকে হারাবেন। তাদের ভালবাসার ফসল হয়ে ফুটফুটে একটা শিশু জন্ম নিতো, যে দেখতে সাদেকের মতোই হবে হয়তো। দরজার পাশে টানানো লাইফ সাইজের ছবির দিকে তাকিয়ে বললাম, সাদেক; পাগলা ভাই আমার, তুই কেমন আছিসরে?
ছবি কখনও কথা বলেনা। অবশ্য ছবির কাছ থেকে আমিও উত্তর আশা করছিনা।
আজ অনেকদিন পর ঘর থেকে বাইরে বের হলাম। মজিদ মিয়ার হোটেলে নাশতা খাবো। মাঝে মাঝে খিদে জাগে, চরম খিদে।
মজিদ মিয়ার হোটেলের দুইটি দরজা। একটা সদর দরজা, আরেকটা স্টাফদের আসা-যাওয়ার জন্য। এটা মজিদ মিয়ার ইচ্ছায় হয়েছে না দোকান ভাড়া প্রদানকারীর ইচ্ছায় একদিন জিজ্ঞেস করতে হবে। মজিদ মিয়া পান চিবুচ্ছেন। পানের রসে তার সফেদ দাঁড়ির একাংশ রঙিন হয়ে গেছে। তার সাথে আমার ছোটখাটো একটা সমস্যা ছিল। শফিকের কারনে এখন স্বাভাবিক।
আমার দেখা সব হোটেল মালিকই বসেন কাস্টমারের দিকে মুখ করে। মজিদ মিয়া বসেন কাস্টমারদের দিকে পিছন ফিরে। মজিদ মিয়ার পেছেনের দিকটা বেশ নাদুস নুদুস, থলথলে। কি বিশ্রী একটা দৃশ্য! ব্যাপারটা আগে কখনও খেয়াল করিনি। আমার বন্ধু শফিককে নিয়ে ঢাকা শহরের জঘন্যতম চা খেতে মজিদ মিয়ার হোটেলে ঢুকলাম। এই হোটেলের সবকিছুই সুস্বাদ, কিন্তু চা’ টাই শুধু জঘন্য। আমার মনে হয় ‘চা’ খেতে খেতে কাস্টমার যাতে সময় নষ্ট না করতে পারে সেজন্য এই ব্যবস্থা। চালু দোকান, ‘চা’ খেতে খেতে চেয়ার দখল করে রাখলে ব্যবসার মুনাফা কমবে বলেই মজিদ মিয়ার ‘চা’ ঢাকার সবচেয়ে জঘন্য চা। মজিদ মিয়ার এই কৌশলটাও বেশ ফলপ্রসু বলেই আমার ধারনা।
শফিক একটু পাগলাটে ধরনের। ইদানীং ব্যবসাপাতিতে অকল্পনীয় উন্নতির পাশাপাশি পাগলামিটাও বেড়েছে। ঐদিন ওর পাগলামির উর্ধ্ব মাত্রাটা দেখার জন্যই ওর প্রস্তাবিত দামি রেস্তোরায় খেতে না গিয়ে মজিদ ‘মিয়ার নিউ মদিনা হোটেল’ এ আসলাম। ভাগ্য সুপ্রসন্ন; শফিক এমন এক চেয়ার পেলো যেখান থেকে মজিদ মিয়ার নাদুস নুদুস, থলথলে পশ্চাৎদেশ পুরোটাই দেখা যাচ্ছে। শফিক চেয়ারে বসতে গিয়েও উঠে দাঁড়ালো। আমি বুঝতে পারছি আমার আশা পূর্ণ হতে চলছে। মজিদ মিয়ার কাছে গিয়ে কোন কিছু না বলে মজিদ মিয়ার বিশাল দেহ সহ তার চেয়ারটিকে ৯০ ডিগ্রী এঙ্গেলে ঘুরিয়ে দিলো। ব্যাটার শক্তি কি আগের চেয়েও বেড়েছে নাকি! চেয়ারের একটি পায়া কটকট করে উঠলো। আচানক এমন ঘটনায় মজিদ মিয়া হতভম্ব। অনেক কষ্টে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। দ্রুত নিজেকে সামলে মারমুখী ভঙ্গিতে অবতীর্ণ হলেন। সংঘর্ষ অনিবার্য মনে হচ্ছে। মজিদ মিয়া কিছু বলার আগেই মোশারফ করিমের ভাষায় শফিক গর্জে উঠলো, হালা ফহিন্নির ঘরের ফহিন্নি, তোর এইহানে মাইনষে কি মাগনা খায়? তুই জানস, তোর পশ্চাৎদেশ হচ্ছে দুনিয়ার সবচেয়ে কুৎসিত একটা জিনিস। হালার পো হালা, একটা চোপার দিয়া ৩২ খান দাত হালাইয়া দিমু, নাহে কানে কিছু দেকপি না। মোশারফ করিম থেকে সৈয়দ হাসান ইমাম, আবার মোশারফ করিম। কথাবার্তার ধরনের এমন দ্রুত পরিবর্তন ও শফিকের ভাবভঙ্গিতে জোঁকের মুখে নুন পরলো। মজিদ মিয়া কাস্টমারদের সামনে এমন বেইজ্জতিতে প্রচণ্ড লজ্জা পাচ্ছেন বলে মনে হচ্ছে। তার চোখ ছলছল করছে। শফিক আমাকে টেনে হিঁচড়ে দোকান থেকে বের করে নিয়ে এলো। এরপর থেকে মজিদ মিয়া কাস্টমারদের মুখোমুখি বসেন এবং আমার সাথেও তার আচরণটা বেশ অমায়িক।
অসাধারন পরাটা, ভাজি আর অতি জঘন্য চা খেয়ে সিগারেট জ্বালাতে জ্বালাতে পার্কের দিকে হাঁটা শুরু করলাম। রাস্তায় লোকজন আজ একটু কম বলেই মনে হচ্ছে। কোথাও কোন সমস্যা নাকি! এই শহরে কখন, কোথায় কোন কারনে কি যে ঘটে! গাড়ি রিক্সা ধাক্কা দিলো। সাথে সাথেই সব রিক্সাওয়ালা একজোট হয়ে গাড়ির ড্রাইভারের সাথে ঝামেলা বাঁধিয়ে দেবে। মুখে যেসব কথা বলবে, এগুলির বাস্তবায়ন হলে মা, বোন সবাই ফরজ গোসল করতে বাধ্য হবেন বা হাসপাতালের গাইনী বিভাগের ডাক্তারদের কাছ থেকে চিকিৎসা নেবেন। আর যদি প্রাইভেট কার হয় এবং গাড়ির মালিক গাড়িতে থাকেন তবে ঘটনা আরও প্যাঁচ খাবে। এক পর্যায়ে কোটিপতি গাড়ির মালিকও চরমভাবে অপদস্ত হবেন।
এমনি এক ঘটনার প্রেক্ষিতে মনির সাহেবের সাথে পরিচয়। ইত্তেফাক মোড়ে দামী এক জীপ সামনের রিক্সাকে ধাক্কা দেয়। আমার বিচারে রিক্সাওয়ালার দোষটাই বেশি। ব্যাটা ফাঁকা রাস্তার মাঝখান দিয়ে গুনগুন করতে করতে বেশ ফুর্তি নিয়ে খালি রিক্সা চালাচ্ছে। পিছনের জীপ থেকে বেশ কয়েকবার হর্ন দেয়া স্বত্তেও রিক্সাওয়ালা সাহেবের কোন বিকার নেই। জীপ গাড়িকে সাইড নেবার সুযোগও দিচ্ছেনা। আশ্চর্য্য তো, শালার ব্যাটা গাঁজা টাজা খেয়ে রাজা-বাদশার মন নিয়ে ঘোড়া হাঁটাচ্ছে নাকি? হঠাৎ করেই রিক্সাওয়ালা ব্রেক কষে রিক্সা থামিয়ে দেয়। রিক্সার পেছনে জীপ গাড়ির হালকা ধাক্কা। আর যায় কোথায়? কাকের মতো দল বেঁধে আশেপাশের দশ-বারো জন রিক্সাওয়ালার সাথে ধান্ধাবাজ টাইপের কয়েকজন জীপ গাড়িটি ঘিরে ধরলো। কোন প্রশ্ন নেই। সোজা ড্রাইভারের কলার ধরে নামিয়ে এলোপাথাড়ি মার। এমন অবস্থায় জীপের পেছনে বসা সাদা পাঞ্জাবী পরা অত্যন্ত সুদর্শন এক ভদ্রলোক বেরিয়ে এসে ব্যাপারটি সামলাতে চাইলেন। জঙ্গি টাইপ আন্দোলন, কে শুনে কার কথা। ‘ধনীরা গরীবের রক্ত চুষে খাচ্ছে। ধনীদের হাতে গরীবরা মরছে’ জাতীয় বিপ্লবী একটা কথা কে যেন দলের লোকদের মধ্যে ছড়িয়ে দিলো। আর যায় কোথায়, ড্রাইভারের সাথে সাথে ভদ্রলোকের উপরও হামলে পড়লো বেশ কয়েকজন। দূর থেকে কে যেন আধলা ইট দিয়ে ভদ্রলোকের মাথায় সজোরে ঢিল ছুড়লো। এই ফাঁকে একজন ভদ্রলোকের পাজামা, পাঞ্জাবী ঘেঁটে মোবাইল, মানিব্যাগ যা পেলো তাই নিয়ে দে ছুট। জীপের ভিতর ঢুঁকে কে একজন কি কি সব বের করে দে ছুট। দে ছুট করতে করতে যে যা পারে তাই নিয়ে ভাগছে। টোকাই টাইপের দশ-এগারো বছর বয়সী একটা ছেলেকে দেখলাম অত্যন্ত দক্ষতার সাথে সামনের লুকিং গ্লাস খুলে ছুটে কোথায় যেন পালিয়ে গেলো। দশ-পনেরো মিনিটের মধ্যে সব শান্ত। রাস্তা ফাঁকা। বিপ্লবী আন্দোলন শেষ। All Quiet on the Western Front.
রক্তাক্ত দু’টি মানুষ অজ্ঞান হয়ে পরে আছে। কারো কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। আমি অনেকক্ষণ চেষ্টার পর প্রায় জোর করে একটা সিএনজি থামালাম। গন্তব্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। সিএনজি তে উঠার পর ভদ্রলোক শুধু একবার আমার দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকালেন। আবার নিথর হয়ে পরে রইলেন।
আহত দু’জনের আত্মীয়, পরিজন কারো সাথেই যোগাযোগের সুযোগ নেই। ভদ্রলোকের প্রচুর রক্তপাত হওয়ায় জরুরী ভিত্তিতে রক্ত দেওয়ার প্রয়োজন। রক্তের গ্রুপ মিলে যাওয়ায় এবং অন্যকোন উপায় না দেখে নিজের শরীর থেকেই রক্ত দিলাম।
সন্ধ্যায় হাসপাতালে আসার পর প্রায় চার ঘণ্টা পার হয়ে গেলো। তারপরই শুরু হলো মহা হুলস্থূল কাণ্ড। একের পর এক গাড়ি আসতে থাকলো। দামি গাড়িগুলি থেকে আভিজাত্যের প্রকাশ ঘটিয়ে বড় মাপের মানুষেরা (!) নেমে আমাদের বেডের দিকেই আসতে লাগলো। আরে বাপ, এর মধ্যে একজন মহিলাকে দেখে মনে হলো যেন বিয়ে বাড়িতে এসেছেন। বেশ সময় লাগিয়ে সাজগোজ করেছেন মনে হয়। গয়নার ভারটাও কম মনে হচ্ছেনা। আরে, এদের সাথে একজন পুলিশ অফিসারও তার দলবল নিয়ে এসেছেন দেখছি! হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকেও বেশ তটস্থ মনে হলো। নিশ্চয়ই আহত গাড়ি মালিক কেউকেটা একজন।
দীর্ঘক্ষণ অভুক্ত অবস্থা, রক্ত দেওয়া আর ছুটোছুটির কারনে শরীর বেশ ক্লান্ত আর অবসন্ন। পুলিশ অফিসার এসে অহেতুক নানা ধরনের প্রশ্ন শুরু করে দিলো। আমি প্রাণপণে স্থির থাকতে চেষ্টা করছি। কতক্ষণ পারবো বুঝতে পারছিনা। পুলিশ অফিসারের ইন্টারোগেশনে মনে হচ্ছে আমিই দু’জনকে পিটিয়ে, ইট দিয়ে মাথা ছেঁচে হাসপাতালে নিয়ে এসেছি। যতোসব ‘কানার হাটবাজার’। আরে কানার হাটবাজারইতো মনে হচ্ছে। সাবাশ- ফকির লালন শাহ।
রাত তিনটায় পুলিশের কাছে নাম, ধাম দিয়ে ফিরে আসার সময় পুলিশ অফিসার আমার সাথে একজন কনস্টেবল দিলেন। আমাকে গার্ড অব অনার দেবার জন্য নয়, আমার ঠিকানা সঠিক কিনা তা যাচাই করার জন্য। নিজেকে চড় মারতে ইচ্ছে করছে। কনস্টেবলের সামনে কাজটা ঠিক হবে না মনে হওয়াতে এযাত্রায় গালটা লাল হওয়া থেকে বেঁচে গেলো।
বাইরে প্রচণ্ড রোদ। আকাশ ভেঙ্গে বৃষ্টি ঝরে, আকাশ ভেঙ্গে আজ যেনো আগুন ঝরছে। দোজখের কোন দরজা খুলে গেলো নাকি? গাছের নীচের বেঞ্চে বসেও গরমের আঁচটা টের পাচ্ছি। ভুলে থাকার জন্য কি করা যায় ভাবছি। এমন সময় পার্কের গেটের সামনে বড়সড় একটা গাড়ি থামলো, প্রাইভেট কার। ড্রাইভারের পাশের কালো কাঁচ নামাতেই অসম্ভব রূপবতী একজন মহিলা বাইরে উঁকি দিয়ে কি যেন দেখলেন। বুঝা গেলো রূপবতী মহিলা নিজেই গাড়ি চালাচ্ছেন। পিছনের গ্লাস নামিয়ে বয়স্ক একজন মহিলা নির্দিষ্ট একটা স্থান আঙ্গুল দিয়ে ইশারা করে রূপবতী মহিলাকে দেখাচ্ছে। আমি চুপচাপ তাদের কাণ্ডকারখানা দেখছি। দরজা খুলে নামতে গিয়েও কি মনে করে রূপবতী মহিলা গাড়ি থেকে নামলেন না। দ্রুত গাড়ি চালিয়ে দিলেন। যতদূর চোখ যায় আমি অবাক হয়ে চলন্ত গাড়ির দিকে তাকিয়ে রইলাম। কেন যেন মনে হচ্ছে কাল সকালেই মনির সাহেবের সাথে দেখা করাটা অত্যন্ত জরুরী। আমি আমার মনের ‘হঠাৎ কিছুর তাগাদা’টা কখনও অবহেলা করিনি। অবচেতন মনটা আজ পর্যন্ত আমাকে ধোঁকা দেয়নি।
সকাল দশটা। আমি দ্বিতীয়বারের মতো প্রাসাদতুল্য বাড়ির লাইব্রেরী রুমে মনির সাহেবের মুখোমুখি বসে আছি। ভদ্রলোক চমৎকারভাবে নানা বিষয়ে কথা বলে যাচ্ছেন। আমিও মুগ্ধ শ্রোতার অভিনয় করে যাচ্ছি। আজকে আসাটা কি ভুল হলো। শফিকের কাছে যেতে হবে। কিছু টাকার দরকার। মজিদ মিয়া বাকি টাকার জন্য বেশ কয়েকবার তাগাদা দিয়েছে।
এসময় বেশ উত্তেজিতভাবে একজন মহিলা ঘরে প্রবেশ করলেন। আরে, এইতো সেই রূপবতী মহিলা! মহিলা আমার দিকে ভ্রূক্ষেপই করছেন না। এমনকি আমার উপস্থিতিটাও তার কাছে ধরা পরেছে বলে মনে হচ্ছে না। রূপবতী মহিলাটি মনির সাহেবের দিকে অগ্নি দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন। এসি রুমের হিমশীতল আবহাওয়াটাও মনে হয় তপ্ত হয়ে উঠেছে। মনির সাহেবকে একটু বিচলিত মনে হচ্ছে। মনির সাহেব ক্ষীণ কণ্ঠে বলে উঠলেন,
মা আয়েশা, তোর কি হয়েছে। এমনভাবে তাকিয়ে আছিস কেন? ঘরে একজন মেহমান আছে।
মহিলার নাম তাহলে আয়েশা? আমি খুব আগ্রহ নিয়ে বাবা, মেয়ের নাটকীয়তাপূর্ণ আলাপচারিতায় মনোযোগ দিলাম।
আয়েশা বেগম বলে উঠলেন, মিঃ মনির, আজ থেকে আমাকে আর মেয়ে বলে পরিচয় দেবেন না।
আপনি একটা পাপী, মহাপাপী। আপনার পাপের বোঝাটা এতো ভারী যে, আপনাকে বাবা বলে মনে হচ্ছে না। মনে হচ্ছে ভারবাহী একটা গাধা।
হাততালি দেব কিনা ভাবছি। কঠিন ডায়ালগ!
মনির সাহেবের কণ্ঠ আরও ক্ষীণ হয়ে গেলো, মা’রে কি হয়েছে। হঠাৎ করে এতো উত্তেজিত হয়ে পরেছিস কেনো?
আয়েশা বেগম একটানা বলে যেতে লাগলেন, তুমি আমার বিয়েটা মেনে নিতে পারনি, ঠিক আছে। কিন্তু আমাকে ফাঁকি দিয়ে, বিয়ে মেনে নেবার ভান করে, আমার বাচ্চাকে কোথায় ফেলে দিয়েছিস? হাসপাতালের ডাক্তারদের সাথে মিলে তিনদিন অজ্ঞান করে রেখে বলেছিস আমার মরা বাচ্চা হয়েছে। কবর দেওয়া হয়ে গেছে। আমি সব খবর নিয়েছি। তুই আমার বাচ্চাকে এনে দে। আয়েশা বেগম হিংস্র বাঘিনীর মতো গর্জন করে যাচ্ছেন। একটানা কথা বলতে বলতে আয়েশা বেগম কেমন যেনো হাঁপিয়ে উঠলেন। ধপ করে সোফায় বসে পরলেন।
মনির সাহেব মাথা নীচু করে বসে আছেন। সাদা পাঞ্জাবীর উপর কয়েক ফোঁটা চোখের জল পরছে বলে মনে হলো। দু’জনকে একটু চমকে দিয়ে আমি বললাম, তিনদিন পর আমি আসবো। আমি বাচ্চাটাকে সাথে নিয়েই আসবো। বাপ, মেয়ের হতকচিত চেহারা দেখার সময় কই আমার। দ্রুতপায়ে প্রাসাদ থেকে বের হয়ে আসলাম। আমার সামনে আরেকটি বন্ধন ছেঁড়ার দুরূহ কাজ।
ঠিক তিনদিন পর মনির সাহেবের সাথে দেখা করতে আসলাম। মুখবন্ধ একটা খাম আর পুরানো পেপার দিয়ে লাইফ সাইজের একটা ছবি আমার সাথে। লাইব্রেরী রুমে মনির সাহেব, আয়েশা বেগম দু’জনেই বসে আছেন। আমাকে দেখেই দু’জনে উঠে দাঁড়ালেন। আশ্চর্য্যতো! এদিক ওদিক তাকিয়ে রাস্তায় ফেলে দেওয়া বাচ্চাটাকে খুঁজছেন মনে হয়।
আমি দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিনা। অবাধ্য চোখের জলকে কোনভাবেই আটকাতে পারছিনা। বাবা আর মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললাম, মনির, তুই প্রথমে এই চিঠিটা জোরে জোরে পড়বি। পুরোটা পড়তে হবে এবং কিছু প্রতিজ্ঞা করবি। তারপরেই আমি বাচ্চাটাকে ফেরত দেবো। আমি মনির সাহেবকে তুই তুকারি করছি সেদিকে কোন খেয়াল নেই। মনির সাহেব খপ করে আমার কাছ থেকে চিঠিটা নিয়ে খামের মুখ খুললেন। জোরে জোরে পড়তে লাগলেন,
সাদেক, পাগলা ভাই আমার,
তুইতো দুইমাস যাবত চুপ করে আছিস। আমি বলি আর তুই শুধু চুপ করে শুনে যাস। তোর সাথে কথা বলতে না পেরে আমার যে দমবন্ধ হয়ে যায় রে পাগলা। চারদিন আগে তোর মা’কে দেখলাম। দামী গাড়ি করে কয়েক ঘণ্টা বয়সী তোকে যে জায়গায় ফেলে রেখে গিয়েছিল, ঠিক সেই জায়গাটা একজন বয়স্ক মহিলা তাকে দেখিয়ে দিচ্ছিল। কি বললি, আরে না, রহিমা বেগম না। যে তোকে দীর্ঘ নয়টি মাস নিজের শরীরের ভিতর জায়গা দিয়েছিলো। তোকে নিয়ে কত স্বপ্ন বুনে রেখেছিলো। তুই বড় হবি, অনেক বড়। তোর ছোট ছোট দুই হাতে পৃথিবীর সকল সুখ ধরিয়ে দেবার জন্য সমস্ত কিছু যে ত্যাগ করতে পারে, সেই মা আয়েশা বেগম। আমি বুঝলাম কিভাবে, সে তোর মা? আরে পাগলা, তোর না এতো বুদ্ধি? তুই হচ্ছিস তোর মায়ের জেরক্স কপি। কি অদ্ভুত মিল! হাসলে তোদের মা, ব্যাটার দু’জনের বাম গালে টোল পরে। যদিও আমি তোর মা আয়েশা বেগমকে হাসতে দেখিনি। অনুমান করে বলেছি শুধু। তবে হাসলে তার বাম গালে টোল পরেই পরে। কি হাসছিস কেন? তুইকি বলতে চাস আমি বোকা? মনে হয় সত্যিই আমি অনেক বোকা। নইলে তোর নানা, যে তোকে চালবাজি করে একজন মহিলাকে দিয়ে পার্কের পাশে ফেলে রেখে দিয়েছিলো তাকে কেন রক্ত দিয়েছিলাম- যদিও তখন মনে হচ্ছিল এই লোকটা আমার শত্রুদের একজন। এমন এক শত্রু যার কারনে তোকে পেয়েছিলাম আবার তার কারনেই তোকে দ্বিতীয়বারের মতো হারাতে হবে। যাক তোর সাথে আমার আত্মার বন্ধন। ওদের কাছে কিছুদিন থাক। মনের সাথে অনেক যুদ্ধ করতে হচ্ছে রে। খালি স্বপ্ন দেখি, মা, লালী, কালী, বড় ধারালো ছুরি। ওদের কাছে গেলেও তুই আমার মধ্যে বসবাস করতে শুরু করে দিয়েছিস রে পাগলা। ওখান থেকে আমি চাইলেও তোকে সরাতে পারবোনা। তবে তোকে ফেরত দেবার জন্য একটা শর্ত দেবো তোর মা আর নানা কে। তুই তোর স্বল্প জীবনে বিশাল দুইটা ভালো কাজ করেছিসরে পাগলা; রহিমা বেগমের মতো মহিলা তোর জন্য তার নষ্ট জীবনটাকে গুছিয়ে নিয়েছিলেন। তোর অজান্তেই তুই তাকে পবিত্র করেছিস। আর আমার জন্য কি করেছিস তাতো তুই নিজেই জানিস। একাকী জীবনে তুই আমাকে ঘুরে দাঁড়াতে সাহায্য করছিলি। আর লিখতে পারছিনারে ভাই। তোরতো অনেক বুদ্ধি। আমার কষ্টটা ঠিকই বুঝবি ......।
আয়েশা বেগম আর মনির সাহেব প্রচণ্ড আকাঙ্ক্ষা নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। শুনা যায় কি যায় না এমনভাবে মনির সাহেব আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি চাও? আমি বললাম, এই ছবিটা এখন থেকে সারাক্ষণ দেয়ালে টানানো থাকবে। যে কেউ আপনার প্রাসাদে ঢুকলেই যাতে ছবিটা দেখতে পায় এমন জায়গায় টানাবেন। ছবির ব্যাপারে কেউ জিজ্ঞেস করলে সঠিক ঘটনা বলবেন। আর হ্যাঁ, আপনার মেয়ে আর নাতির সামনে আমি আপনার দু’গালে কষে দু’টি চড় দেবো। এখন পেপারটা ছিঁড়ে ছবিটা বের করুন।
মনির সাহেব তক্ষুনি পুরানো পেপার ছিঁড়ে ছবি বের করলেন, অবাক বিস্ময়ে ছবিটার দিকে তাকিয়ে রইলেন। ছবির সাথে টাইপ করা এক টুকরা কাগজ নিয়ে পড়লেন-
“নাম- মোঃ সাদেকুর রহমান
পিতা- অজ্ঞাত
মাতা- অজ্ঞাত
জন্ম তারিখ- ১৪/আগস্ট /২০০১,
মৃত্যুর তারিখ- ১৪/ফেব্রুয়ারী/২০১৫
মৃত্যুর কারন- সড়ক দুর্ঘটনা।”
আয়েশা বেগম পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছেন। মনির সাহেব একটু এগিয়ে এসে আমার সামনে দাঁড়ালেন। চোখে, মুখে চড় খাবার তীব্র আকাঙ্খা। এমন তীব্র আকাঙ্ক্ষা অপূর্ণ রাখার ক্ষমতা সৃষ্টিকর্তা মানুষকে দেননি।
২| ০২ রা অক্টোবর, ২০১৭ রাত ১০:৪২
আলমগির কবির বলেছেন: অতঃপর অনেক সুন্দর
৩| ০৩ রা অক্টোবর, ২০১৭ দুপুর ২:৫১
হুয়ায়ুন কবির বলেছেন: ধন্যবাদ আলমগির কবির।
৪| ০৬ ই অক্টোবর, ২০১৭ বিকাল ৪:৫১
আলমগির কবির বলেছেন: You are most welcome
৫| ০৭ ই অক্টোবর, ২০১৭ সকাল ১০:৪৬
আলমগির কবির বলেছেন: আপনাকেও স্বাগত
৬| ০৯ ই অক্টোবর, ২০১৭ সন্ধ্যা ৭:২৪
আলমগির কবির বলেছেন: আরও লেখা চাই।
©somewhere in net ltd.
১|
০২ রা অক্টোবর, ২০১৭ বিকাল ৩:৫২
হুয়ায়ুন কবির বলেছেন: শুরু, মধ্যম, অতঃপর ...............।।