নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আমাকে খুঁজে ফিরি

হুয়ায়ুন কবির

হুয়ায়ুন কবির › বিস্তারিত পোস্টঃ

স্কুল ব্যাগ, বোতাম ও আমরা ........................।।

০৫ ই অক্টোবর, ২০১৭ বিকাল ৫:৫৫



এতো সকালে নাস্তা না খেয়ে কোথায় যাচ্ছ? ছালাম সাহেব প্যান্টের চেইন টানতে টানতে বললেন, কোম্পানির বড় স্যার আজ একটু আগেভাগেই অফিসে যেতে বলেছেন। তার ছোট ছেলে আজ অফিসে আসবে। তাকে নিয়ে ঘুরতে বের হতে হবে।

আচ্ছা যাও বলে স্বামীর পাঁশে এসে দাঁড়ালেন। মায়াবী দু’টি হাতে স্বামীর শার্টের বোতামগুলি লাগিয়ে দিলেন। প্রেম করে বিয়ে। বিয়ের পর থেকেই এই অভ্যাসটা হয়ে গেছে। গত সাত বছরে এমন কোনদিন নেই, যেদিন অফিসে যাবার প্রস্তুতি পর্বে মরিয়ম বেগম স্বামীর শার্টের বোতামগুলি নিজ হাতে লাগিয়ে দেননি। অফিসের কাজের ব্যস্ততার জন্য কোনদিন ছালাম সাহেবের প্রতি তার কোন আক্ষেপ নেই। ছোট চাকুরী। কর্তাদের খুশি করার মতো চাপার জোর তার নেই সেটা মরিয়ম বেগম ভালো করেই জানেন। তাই সময়ানুবর্তীতা ও কাজ এ দু’টোর বলেই তার যোগ্যতা প্রমাণ করতে সচেষ্ট থাকেন সবসময়। অবশ্য অফিসের ব্যাপারে মরিয়ম বেগম তেমন কিছুই জানেন না। শুধু জানেন তার স্বামী একটা বড় কোম্পানিতে ছোট চাকুরী করেন। স্বামীর অফিস যাত্রার এই সময়টুকু তার অনেক ভালো লাগে। একান্ত নিজের কারো প্রতি শার্টের বোতাম লাগানোর মতো তুচ্ছ কাজের মধ্যেও যে অফুরান ভালোবাসা লুকিয়ে থাকে সেটা তিনি তীব্রভাবে অনুভব করেন। কি যে ভালো লাগে এই সময়টা।

ছালাম সাহেব রোজকার অভ্যাসমতো স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু খেলেন। তাদের তিনজনের সংসারের বন্ধনটা বড়ই বিচিত্র ও শক্ত। অবসর পেলেই তিনজন মিলে আড্ডা আর আড্ডা। আড্ডায় মেয়ের অদ্ভুত অদ্ভুত সব কথা আর তর্কের ধরন দেখে ছালাম সাহেব হেসেই খুন। বাপ, বেটির এই গল্পগুজব ও তর্কের মাঝে মরিয়ম বেগম শুধুই মুচকি মুচকি হাসেন।

দরজার চৌকাঠ পেরুতেই মরিয়ম বেগম স্বামীকে উদ্দেশ্য করে বললেন, তোমার আদরের মেয়ে স্বপ্নার জন্য আজ কিন্তু নতুন ব্যাগ কিনে আনবে। তোমার সোহাগী মেয়ে বায়না ধরেছে নতুন ব্যাগ ছাড়া স্কুলে যাবেনা। বলেই জিহবায় কামড় দিলেন। মা বলতেন, পুরুষ মানুষ কাজে বেরুবার সময় পেছন থেকে ডাকতে নেই, এতে অমঙ্গল হয়। ও আল্লাহ্‌ তুমি আমাকে মাফ করে দাও। মনে মনে আল্লাহ্‌’র কাছে মাফ চাইছেন আর স্বামীর দিকে তাকিয়ে আছেন। আজ ছালাম সাহেব কেমন যেন ন্যুজ হয়ে হাঁটছেন। ব্যাপারটা বেশ অদ্ভুত। কেন যেন হঠৎ মরিয়ম বেগমের মনটা বিষণ্ণ হয়ে উঠলো। মনে মনে বললেন, আল্লাহ্‌ তুমি সহায়।

অফিসে যাবার পথে দোকান থেকে মেয়ের জন্য নতুন স্কুল ব্যাগ আর কিছু খাতা আর পেন্সিল কিনলেন। রাতে বাড়ি ফেরার সময় দোকান খোলা থাকে কিনা কে জানে। অফিসে গিয়ে ছালাম সাহেব হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। যাক, স্যারের আগেই পৌঁছাতে পেরেছেন।

তিনি যে কোম্পানিতে চাকুরী করেন সেটা মফস্বল এলাকায়। গ্রাম্য ভাবটা এখনও প্রকট। ইদানীং এই এলাকায় ছেলেধরার জোর গুজব উঠেছে। এলাকার মোটামুটি সবাই এ বিষয়ে নানা মতামত ব্যক্ত করছে। কিন্তু কোথায়, কিভাবে ঘটনাগুলো ঘটছে, কোন বাচ্চা হারানো গেছে বা চুরি হয়েছে কিনা এর সঠিক কোন তথ্য কেউ কাউকে দিতে পারছে না। বিষয়টি ছালাম সাহেবের কাছে গুজব বলেই মনে হচ্ছে। তিনি দেখলেন অফিসেরও অনেকেই ছেলেধরার বিষয়টি নিয়ে আগামাথাহীন আলোচনা করছে।

ঘণ্টাখানেক পর কোম্পানির এম.ডি. হাফিজ উদ্দিন সাহেব তাঁর আট বছর বয়সী ছেলেকে সাথে নিয়ে আসলেন। বেশ রাশভারী লোক তিনি, কিন্তু প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী- কর্মকর্তাদের প্রতি তাঁর প্রচণ্ড মায়া। তাঁর স্ত্রীও বেশ ভালো। কোন অহংকার বা আলগা ভাব নেই। ছালাম সাহেব ভাবছেন, এমন ভালো মানুষদের প্রতি আল্লাহ্‌‘র কি অবিচার! তাঁদের একমাত্র ছেলে নেহাল শারীরিক প্রতিবন্ধী। সারাক্ষণই মুখ দিয়ে লালা ঝরছে। হাফিজ সাহেব আর তাঁর স্ত্রীকে কখনও ছেলে নেহালকে নিয়ে বিব্রত বা ভ্রুকুটি করতে দেখেননি। আদর্শ মা-বাবা মনে হয় ওনাদেরকেই বলে।

ঘণ্টাখানেক পর এম.ডি. সাহেব ছালাম সাহেবকে তাঁর রুমে ডেকে পাঠালেন। বললেন, ছালাম সাহেব, আজ হঠাৎ করেই মিটিং করা জরুরী হয়ে পরেছে। কখন শেষ হয় বলা মুশকিল। নেহালকে নিয়ে ঘণ্টাখানেক ঘুরে ওকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে নিজ বাসায় চলে যান। আজ আর অফিসে আসতে হবেনা। আমি ড্রাইভার জাকিরকে ছোট ট্যাক্সিটা নিয়ে বের হতে বলে দিচ্ছি। ওটা নিয়ে যান।

ছালাম সাহেব মেয়ের জন্য কেনা স্কুলের ব্যাগ সহ নেহালকে নিয়ে পিছনের সিটে বসলেন। নেহাল জানালায় উঁকি দিয়ে আশেপাশের দৃশ্য দেখছে। মুখ দিয়ে অনবরত লালা ঝরছে। খুব করুণ এক দৃশ্য। রাজপুত্রের মতো চেহারা, অথচ কি কুৎসিত একটা ব্যাপার! ইতিমধ্যে ছালাম সাহেব তার রুমাল দিয়ে বেশ কয়েকবার নেহালের মুখের লালা মুছে দিয়েছেন।

অনেকক্ষণ চলার পর সামনে একটা বাজার। সকালের বাজার। বহু লোকের ভিড়। হঠাৎ ভিড়ের মধ্য থেকে চিৎকার করে কেউ একজন বলে উঠলো, ঐ যে ছেলেধরা। স্কুলের একটা ছেলেকে ঘুমের ঔষধ খাওয়াইয়া ধইরা নিয়া যাইতাছে। ছেলেটা কি স্কুলে পড়ে? কেউ একজন উত্তর দিলো, হ স্কুলে পড়ে। ঐ যে দেখেন না স্কুলের ব্যাগ।

হুজুগে বাঙ্গালী চরিত্র। বাজারের ব্যাগ, সদাইপাতি সব রেখে গাড়িটাকে আটক করে ড্রাইভার এবং ছালাম সাহেবকে টেনে হিঁচড়ে গাড়ি থেকে টেনে নামিয়ে পশুর মতো পেটাতে শুরু করলো। ছালাম সাহেব প্রচণ্ড মারপিটের মধ্যেও বিষয়টি ব্যাখ্যা করতে চাইলেন। কিন্তু ছালাম সাহেব আর ড্রাইভার জাকির এখন উত্তেজিত জনতার কাছে মানুষখেকো পশুর মতো। এসব জানোয়ারদের প্রতি মমতা দেখানোর কোন প্রশ্নই আসেনা। ছালাম সাহেব আর জাকিরকে পিছমোড়া করে বেঁধে রেখে স্থানীয় প্রভাবশালী মাতব্বরকে জানাতে কয়েকজন তার বাড়িতে ছুটে গেলো। কিছুটা শুনেই আয়েশ করে চা খেতে খেতে ঘোষণা করলেন, মাগীর পুতেগো খালে নিয়া শেষ কইরা দে। গণপিটুনিতে মারা গেছে বললেই হবে। থানা পুলিশ কিছু করতে পারবোনা।

মাতব্বরের ঘোষণা বাজারে প্রচার হতেই ছালাম সাহেব আর জাকিরকে পশুর মতো টেনে হিঁচড়ে ২০০ গজ দূরের মরা খালের উপর ধাক্কা দিয়ে ফেলে বাঁশ, ইট; যার হাতে যা ছিল তাই দিয়ে অমানুষিকভাবে পেটাতে শুরু করলো। ছালাম সাহেব খালের কাদার উপর উপুড় হয়ে অর্ধ অচেতন অবস্থায় পরে আছেন। অচেতন অবস্থায়ই মরিয়মের মায়াবী মুখ, স্বপ্নার দু’হাত বাড়িয়ে ‘বাবা’ বলে ছুটে আসা দৃশ্যগুলি চোখের সামনে ভেসে বেড়াতে লাগলো। এতো মারছে, প্রথমে প্রচণ্ড ব্যাথা পেলেও এখন কেমন যেন অনুভূতিগুলি ভোঁতা হয়ে গেছে। কি হচ্ছে কিছুই অনুভূত হচ্ছে না। মার খাওয়ার মাঝেই হঠাৎ মনে হলো খালের পাড়ে লোকজনের ভিড়ে মরিয়ম দাঁড়িয়ে আছে। আর তাঁর কলিজার টুকরা স্বপ্না দু’হাত বাড়িয়ে আছে বাবার বুকে আসবে বলে। এটা কি বিভ্রম? ইংরেজীতে কি যেন বলে, ও হ্যা ‘Hallucination’। তিনি ঘাড় ফেরাতে চেষ্টা করলেন। তার পিঠের উপর বসে ঘাড়ে, মাথায় ঘুষি মারতে থাকা পনেরো কি ষোল বছরের একটা ছেলে এই সময় চিৎকার করে উঠলো, হালার পুতে এহনও মরে নাই। আমারে একটা ইট দে। কে যেন কাদা মাড়িয়ে একটা দশ ইঞ্চি ইট এনে ছেলেটির হাতে দিলো। ইটটি নিয়ে কিশোর বয়সী ছেলেটি ছালাম সাহেবের মাথাটা থেতলে দিতে থাকলো; যেন কেউ পুতা দিয়ে পাটার উপর রাখা আদা বা মরিচ গুঁড়া করছে। ছালাম সাহেবের চোখে অন্ধকার নেমে আসছে। অন্ধকার; আলকাতরার মতো ঘন অন্ধকার।

বাজারে ছালাম সাহেব আর জাকিরকে বেঁধে রাখার সময় ছালাম সাহেবের শার্টের দু’টি বোতাম মাটিতে পরে ছিল। সাত আট বছরের একটি ছেলে কোন এক রহস্যময় কারনে সেগুলো কুড়িয়ে নিজের পকেটে রেখে দিলো।

দিন পনেরো পর মরিয়ম আর তার কন্যা স্বপ্না ছালাম সাহেবকে যে খালে ফেলে নির্মমভাবে খুন করা হয়েছিল সেখানে আসলেন। সেই ছোট ছেলেটিও ঐদিন খাল পাড়ে বসে ছিল। ঘটনার দিন থেকে ছোট ছেলেটার মনে কি এক অপার্থিব রহস্য কাজ করে যাচ্ছে। দিনের অধিকাংশ সময়ই খাল পাড়ে এসে বসে থাকে। নির্বাক চেয়ে থাকে ঠিক ঐ জায়গাটিতে যেখানে দু’জন মানুষকে অমানুষের মতো খুন করা হয়েছে। মরিয়ম বেগম ও তার মেয়েকে দেখে ছেলেটি জিজ্ঞেস করলো আপনারা কারা? কি দ্যাহেন? মরিয়ম বেগম বজ্রাহতের মতো দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি যে বেঁচে আছেন এর একমাত্র প্রমাণ অপ্রতিরোধ্য চোখের জল। যে জায়গায় দাঁড়িয়ে নিষ্ঠুর মানুষগুলি ছালাম সাহেবকে পশুর মতো হত্যা করতে দেখেছে সেই জায়গায় দু’গাল ছাপিয়ে টপ টপ করে চোখের জল ঝরছে। ছেলেটি মরিয়ম বেগমের দিকে এগিয়ে গিয়ে মুষ্টিবদ্ধ হাত খুললো। ছেলেটির হাতের তালুতে ছালাম সাহেবের শার্টের দু’টি বোতাম।

মন্তব্য ৬ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (৬) মন্তব্য লিখুন

১| ০৫ ই অক্টোবর, ২০১৭ বিকাল ৫:৫৬

হুয়ায়ুন কবির বলেছেন: স্কুল ব্যাগ, বোতাম ও আমরা ........................।।

২| ০৬ ই অক্টোবর, ২০১৭ বিকাল ৪:৪৯

আলমগির কবির বলেছেন: All the best

৩| ০৭ ই অক্টোবর, ২০১৭ সকাল ১০:৪৪

আলমগির কবির বলেছেন: যতবার পড়ি ততবারই ভাল লাগে।

৪| ০৯ ই অক্টোবর, ২০১৭ সন্ধ্যা ৭:২৩

আলমগির কবির বলেছেন: আরও লেখা চাই।

৫| ১২ ই অক্টোবর, ২০১৭ রাত ৮:৪৫

আলমগির কবির বলেছেন: যতবার পড়ি ততোই ভালো লাগে। ধন্যবাদ ।

৬| ১৯ শে অক্টোবর, ২০১৭ রাত ৯:৩৫

আলমগির কবির বলেছেন: আপনাকে আবারও ধন্যবাদ জানাচ্ছি

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.