নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আমাকে খুঁজে ফিরি

হুয়ায়ুন কবির

হুয়ায়ুন কবির › বিস্তারিত পোস্টঃ

অন্ধকার ও দেয়াল

২৮ শে জানুয়ারি, ২০১৮ বিকাল ৫:৫৫



অন্ধকার ও দেয়াল
(হুমায়ুন কবির)

অতি সাধারন আর দশটা বস্তি এলাকার মতোই এলাকাটি। এখানকার বাসিন্দারা কেউ ইচ্ছের টানে বস্তিবাসী হয়নি। দারিদ্রতার কষাঘাতে রক্তাক্ত হতে হতে প্রায় রক্তশূন্য হয়ে যাবার পর এখানে কোনভাবে মাথার উপর একটা চালাঘর খুঁজে নেয়। এখানে জীবনযাপনের শুরু আছে, কিন্তু শেষে আলোর দেখা পাওয়ার নিশ্চয়তা নেই। এখানে স্থবিরতা আর স্তব্ধতা যেমন আছে, অতি তুচ্ছ কোন বিষয়ে প্রচণ্ড আলোড়নও আছে। এখানে চাঁদের আলোতে উৎফুল্ল হবার লোক খুব বেশি একটা নেই- চাঁদের আলো হঠাৎ হঠাৎ অভিশাপ হয়ে এখানকার মানুষদের শরীরকে পাথর করে দেয়। আবার এই অভিশাপের আলোতে নেশাগ্রস্ত কিছু মানুষ মনে মনে নিজেকে রাজা, বাদশাহ বানিয়ে রাজ্য শাসন করতে থাকে। ঘোর বা মোহের প্রদীপটা নিভে যেতে খূব বেশি সময় নেয় না অবশ্য। আসক্তি কেটে যাবার পরপরই ধুলোমলিন পথগুলি যেন উপহাসের উচ্চহাসিতে ফেটে পড়ে। এখানে অদ্ভুত এক নির্লিপ্ততার মাঝেও চমকে ওঠার পিপাসায় ছটফট করতে দেখা যায় অনেককে।

অনাবৃষ্টিতে ধুলোবালির অবাধ বিচরণ, বৃষ্টির পানি আর প্যাচপ্যাচে কাদার ঔদ্ধত্য এখানে সীমাহীন। বাঁশের বেড়ার আবরণ দেয়া ঘরগুলোতে ধুলোর আস্তরণ। ঘরগুলোর ভিতর বিলাসিতার সামান্য চিহ্নমাত্র নেই। ক্ষুন্নিবৃত্তির জন্য নিরন্তর আবরণহীনতা, আত্মসম্মানবোধের মহা-আকালের মাঝেও ছোটখাটো আনন্দের উন্মত্ততায় মাঝে মধ্যে ভেসে যায় মানব প্রাণগুলি।

এই পরিবেশে প্রায় চার বছরের বাসিন্দা খলিল এক বিকেলে বেশ ভয়ে ভয়ে নিশির ঘরের দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়ে ডাকতে থাকে- আপা, ও নিশি আপা, ভিতরে আসব?

দরজাতো খোলাই আছে, ডাকাডাকি করস ক্যান। ভিতরে আয়।

নিশি আপার চোখগুলি ফোলা ফোলা মনে হচ্ছে। মনে হয় সদ্য ঘুম থেকে উঠেছেন।

আমারে একটা অংক বুঝাইয়া দিবা আপা?

আমি কি মাস্টার, আমি অংকের কি জানি? তোদের স্কুল থেকে কিছু শিখায় না?

হালকা ধরনের কথায় খলিল আশ্বস্ত হয়। যাক, আপার মনটা আজকে ভাল মনে হচ্ছে।

শিখায়। কিন্তু যেদিন এই অংকগুলি করায় ঐ দিন আমি স্কুলে যাই নাই, জ্বর আছিল। তুমি না আই.এ. পাস করছ? তোমার মাথায় অনেক বুদ্ধি আপা। তুমি পারবা। বলেই খলিল মুচকি মুচকি হাসতে থাকে।

এই বয়সেই পাম মারা শিখে গেছিস। আবার দাঁত কেলিয়ে হাসে। কানের নীচে এমন একটা কষা বন দিমুনা; দাঁত সব খুলে পড়ে যাবে।

আপা, বন মানে কি?

বন মানে সুন্দরবন, বেটা ইডিয়ট। বস্তিতে থাকিস বন চিনিস না। বন মানে জোরে থাপ্পর দেওয়া।

দূর তোমার কথার মাথামুণ্ডু কিছু বুঝিনা। আমারে অংকগুলি বুঝাইয়া দাও।

শোন সরল অংক, গরল অংকে কোন সমস্যা নাই। কিন্তু তেল মাখা বাঁশে বান্দর উঠাইতে চাইলে সেইটা পারুম না। ওহ, তুইতো ক্লাস ফোর এ পড়িস। তোর এই ঝামেলা নেই। বান্দর তেল মাখা বাঁশে উঠুক আর মান্দার গাছে উঠুক, তাতে আমাগো কি?

হুম আপা, আমাগো কি?

স্বল্প সময়ের মধ্যেই নিশির বুঝানোর দক্ষতা আর খলিলের মেধার সমন্বয়ে অংক সমস্যার সমাধান হয়ে যায়।

নিশি আপাটা কেমন যেন। এই ভাল, এই মন্দ। মাঝে মাঝে খুব ভয় লাগে; এমন অশ্লীল ভাষায় কথা বলেন যে, দু’কান হাত চাপা দিয়ে রাখতে হয়। আবার কখনো ওনার আদরের কথা শুনে চোখে পানি এসে যায়। মাঝে মাঝে বইয়ের ভাষায় কথা বলে, আবার বস্তির মানুষের মত আমাগো, তগো এসব বলেন। নিশি আপাটা পাগলাটে আছে।

আপা, ঘরে তুমি একা একা থাক, তোমার ভয় লাগেনা?

কিসের ভয়?

রাতে যদি চোর আসে তখন?

আমার ঘরে কি আছে যে চোর আসবে? আর রাতে আমিতো চোরদের সাথেই থাকি। চোর, ডাকাত, পেট্রোল বোমার ওস্তাদরা আমার দোস, বন্ধু, মানে ক্লোজ ফ্রেন্ড। জানিস, আমার দোস্তদের মধ্যে দেড় হাত লম্বা দাড়িওয়ালা হুজুরও আছে।

কথা বলতে বলতে নিশির চোখ দু’টি টকটকে লাল হয়ে যায়। এতক্ষন খলিল খেয়াল করেনি। হি হি হি হি- নিশি আপা হাসতে লাগলেন; পাগলের মত একটানা হেসেই চলছেন। হাসতে হাসতে হয়ত মাটিতে গড়াগড়ি শুরু করে দেবেন এক্ষুনি।

তুমি কি হাত দিয়া দাঁড়ি মাপছ? ঠাট্টার কথাটা বলতে গিয়েও নিশি আপার চোখের দিকে তাকিয়ে সাহস পেলনা।

খলিল একরাশ অস্বস্তি নিয়ে প্রায় দৌড়ে নিজের ঘরের দিকে রওনা দিল।

ঘর খালি। বাবা গ্রামের বাড়িতে গেছেন। এখন ধান কাটার মৌসুম। বাবা আগে রিক্সা চালাতেন। বেশ কয়েকমাস থেকে রিক্সা চালাতে গেলেই হাঁপিয়ে উঠেন। মনে হয় বাতাসের অভাবে দম বন্ধ হয়ে গেছে, প্রচণ্ড বুক ব্যথা শুরু হয়ে যায়। এমন অবস্থায় কঠিন পরিশ্রমের কাজ করতে গেলে কখন কি হয়ে যায়! ধান কাটাও সহজ কাজ নয়। তারপরও স্ত্রীর শত বাঁধা সত্ত্বেও হাফিজ মিয়া গ্রামের বাড়িতে ধান কাটতে চলে গেলেন।

প্রচণ্ড ক্ষুধায় মাথাটা ঝিম ঝিম করছে। মা আসতে আসতে সন্ধ্যা পার হয়ে যাবে। ঐ বাড়িতে সকাল সাতটা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বুয়ার কাজ করতে হয়। প্রচণ্ড পরিশ্রম। ঘর ঝাড়ু দেয়া থেকে রান্নাবান্না, কাপড় ধোয়া সবই করতে হয়। বেতন অবশ্য ভাল। আর গৃহকর্ত্রী বেঁচে যাওয়া খাবার ফেলে না দিয়ে জাহেদা বেগমকে দিয়ে দেন। মাঝে মাঝে জাহেদা বেগম অনেক ভাল ভাল খাবার নিয়ে আসে। খাওয়ার সময় খলিলের উজ্জ্বল মুখটা দেখতে এত ভাল লাগে জাহেদা বেগমের। মনে মনে বলেন, ও আল্লাহ্‌, আপনি আমার ছেলেটাকে ভাল রাখেন। আপনের কাছে আর কিছুই চাইনাগো আল্লাহ্‌।

মুড়ির কৌটাটা তাক থেকে নামিয়ে খলিল মুঠোখানেক মুড়ি দেখতে পেল। মুড়িগুলি ন্যাতা ন্যাতা হয়ে গেছে। ওগুলি খেয়েই পেট জামিন দিতে হবে। আচ্ছা ‘জামিন’ কি জিনিস? খুব ভাল কিছু বলেইতো মনে হয়। এই যেমন একমুঠ মুড়ি খেয়ে ক্ষুধাটা কমে গেছে, ভাল লাগছে। জামিন পেলেও মনে হয় এমন ভাললাগার মতো কিছু হয়। নিশি আপাকে একদিন জামিন কথাটার অর্থ জিজ্ঞেস করতে হবে।

সন্ধ্যার আগ মুহূর্তে বস্তির মধ্যে বিশাল এক ঘটনা ঘটে গেল। এই সময় ওয়ায়াসার দুইটি কলই ব্যস্ত থাকে। একযোগে সবাই থালা-বাটি ধোয়া, খাবার পানি সংগ্রহের জন্য ঝাপাঝাপি, ধ্বস্তাধস্তি শুরু করে দেয়। নিশি আপা মাঝখান থেকে এসে আরেকজনের কলস সরিয়ে তার বালতিটা কলের নীচে রাখতেই কলসির মালিক মাজেদা খালা তেড়ে উঠলেন। খিস্তি, খেউর চরমে উঠে গেছে। মাজেদা খালার সমর্থনে আরো কয়েকজন লিলি আপার সাথে বাকযুদ্ধে অংশগ্রহন করতে এগিয়ে এসেছে। হট্টগোলের মধ্যে খলিল মোটামুটি ভদ্র বিচ্ছিন্ন কিছু কথাবার্তা শুনতে পেল, “ ... মাগীর ঢং কি! যাবিতো শইল বেচতে, গোসল কইরা লাঙ্গেগো কাছে যাইতে হইব ......”। এর মধ্য থেকেই বিকট আর্তচিৎকার কানে এল- ‘ও বাবাগো, ও মাগো, আমারে মাইরা ফালাইল গো।’

খলিল বাইরে এসে দেখে মনু মিয়ার লুঙ্গির উপর দিয়ে কিছু একটা চেপে ধরে আছে তার স্ত্রী। মনু মিয়া খুব জোরে স্ত্রীর চুলগুলি মুঠো করে ধরে আছে।

আর যাবি ঐ মাগীর কাছে?

নারে বইন, আর যামু না।

আমারে আর মারবি? ঠিকমত কাম করবি, খাওন দিবি?

কাম করমু, খাওন দিমু। তরে আর মারমু না। এইবার ছাড়।

লুঙ্গির উপর দিয়ে চাপটা মনে হয় একটু বেশিই পড়েছে। ব্যথায় মনু মিয়ার চোখ কোটর ছেঁড়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে। চেহারাটাও বিকৃত হয়ে গেছে। জড়ো হওয়া মানুষগুলি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তামাশা দেখছে। কেউ কেউ চাপা হাসিকে আরও উচ্চ নিনাদে নিয়ে গেল। যেন মজার কোন সার্কাস হচ্ছে। ভাবটা এমন, মজাদার সার্কাসটা আরও কিছু সময় চলুক। এমন ঘটনা সাধারনত ঘটে না। আচানক নিশি আপা ভিড় ঠেলে এগিয়ে এসে মনু মিয়ার স্ত্রীর গালে প্রচণ্ড চড় মারেন। এতো দূর থেকেও চড় মারার শব্দটা স্পষ্ট শুনতে পাওয়া গেলো। এক চড়েই সবকিছু ছেঁড়েছুড়ে মনু মিয়ার স্ত্রী মাটিতে শুয়ে পরে মাটি চাপড়ে কাঁদতে লাগলেন। অভিযোগের উত্তাপ আর ধিক্কারের বর্ষণ একসময় শেষ হয়। এরই মধ্যে নিশি আপা কোথায় যে চলে গেলেন!

সবাই যার যার কাজে লেগে যায়। কিছুক্ষণ পর মনু মিয়াকে স্ত্রীর কাঁধে হাত রেখে অদ্ভুত ভঙ্গিতে ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে ঘরের দিকে রওনা হতে দেখা গেল। ব্যাথায় মনু মিয়ার মুখটা এখনও বিকৃত হয়ে আছে। কে যেন হঠাৎ করে বলে উঠল- মনু রে তর একমাস বন্ধ।

আশপাশের সবাই হাসিতে ফেটে পরে। খলিল কিছুই বুঝতে পারছে না। একমাস কি বন্ধ, আর এতে হাসির কি আছে? দু’একজন মহিলা মুখে আঁচল চাপা দিয়ে হাসি লুকাতে চেষ্টা করতে লাগলেন।

সন্ধ্যা পেরিয়ে গেছে। মা’র আসতে এত দেরি হচ্ছে কেন? ক্ষুধায় পেট পাকিয়ে উঠছে। এক গ্লাস পানি খেয়ে বিছানার উপর পড়তে বসল খলিল। আগামীকাল “তোমার জীবনের লক্ষ্য কি” রচনা লিখতে হবে। শফিক স্যার খুব রাগী। ঠিকঠাক না লিখতে পারলে পুরো ক্লাসের সময়টাতে নীল ডাউন হয়ে থাকতে হবে। সবাই মিলে স্যারের একটা ডাক নাম দিয়েছে “চ্যাতা স্যার”। হা হা হা, চ্যাতা স্যার। সারাক্ষণ রাগ দেখায় বলেই এই নাম। খলিলরা একবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল স্কুলের দেয়ালে বড় করে “চ্যাতা স্যার, শফিক স্যার, ওর পাছায় লাথি মার”- ওর বন্ধু সুমনের মন্তব্য হচ্ছে, স্যারদের সাথে এমন তামাশা করা ঠিক না, এতে নাকি বেয়াদবি হয়। স্যারদের সাথে বেয়াদবি করলে বা তাদের অপমান করলে জীবনে উন্নতি করা যাবে না।

মা এখনো ফিরেনি। খলিলের খুব দুশ্চিন্তা হচ্চে, মা’তো এত দেরি করেন না। চিন্তার একরোখা আবরণটা বেধ করে নাকে তীব্র ঝাঁঝালো একটা গন্ধ এসে ধাক্কা দেয়। পাশের ঘরে রহমত চাচা নিশ্চিত গাঁজা খাচ্ছেন। মাঝে মাঝে চকলেটের মতো ঘ্রাণও পাওয়া যাচ্ছে। মা-বাবা বেশ কয়েকবারই রহমত চাচাকে ঘরে বসে গাঁজা খেতে নিষেধ করেছেন। খলিলের কথা ভেবেই হয়তো বলেছেন।

রহমত চাচার ঘরের হুল্লোড় শুনে মনে হচ্ছে ইয়ার দোস্তদের ছোটখাটো দল নিয়ে আসর জমিয়েছেন আজ। বাঁশের বেড়ার ফাঁক দিয়ে ধোঁয়াগুলি জায়গা বদলে খলিলদের ঘরে ঢুকছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই কেমন যেন ঘোর ঘোর লাগা শুরু হয়ে গেল। মাথাটা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। খলিলের কাছে মনে হতে লাগলো যেন সে আকাশে উড়ে বেড়াচ্ছে। ক্ষুধাবোধটাও উবে গেছে। কোন সময় যে অংকের খাতা আর পেন্সিল হাতে নিয়েছে টেরই পেলনা।

ঘরে ফিরতে ফিরতে রাত প্রায় দশটা বেজে যায় জাহেদা বেগমের। বড়সড় পোটলার ভেতরে বেশ যত্ন করে খাবার নিয়ে এসেছে। আজ সাহেবের বড় মেয়ের বিয়ের কথাবার্তা পাকাপাকি হয়েছে। ধুম খাওয়া দাওয়া। বড়লোকের সবকিছুতেই কেমন যেন বাড়াবাড়ি। দশজন মানুষের জন্য বিয়ে বাড়ির মতো আয়োজন। সোনা মিয়া নামের এক বাবুর্চিকে ডেকে রান্না করা হয়েছে। খুব নাকি নামী বাবুর্চি। অনেক খাবার বেঁচে গেছে। খলিলের বাবা ঘরে থাকলে তিনজনে মিলে খাওয়া দাওয়া করলে ভাল হতো। লোকটার ভাল খাবারের দিকে খুব ঝোঁক। বড় একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে দরজার বেড়াটা ধাক্কা দিয়ে ঢুকতেই ভক করে তীব্র কটু গন্ধটা নাকের ভিতর দিয়ে মাথার মধ্যে ঢুঁকে গেল। খলিল কেমন করে যেন ঘুমিয়ে আছে। হাতে পেন্সিল ধরা, একপাশে ছন্নছাড়ার মতো অবহেলায় সাদা খাতাটা পরে আছে। ওর উপর কিসের যেন ছবি আঁকা। জাহেদা বেগমের বুঝতে বাকি রইলনা। বেড়ার ফাঁক দিয়ে রহমত মিয়ার ঘরে উঁকি দিলেন। শুন্য ঘর। এখানে, ওখানে সিগারেটের টুকরা পরে আছে। চৌকির একটা পায়ার সাথে কল্কের অবয়বটাও চোখ এড়ালোনা। ঘরের মধ্যে ধোঁয়ার মেঘটা এখনও কাটেনি। এর একটা সমাধান করতেই হবে। হোক দ্বন্ধ আর কলহ- গাঁজাখোরের কারনে ছেলেটার একি হাল হলো।

জাহেদা বেগম অনেক কষ্টে ছেলেকে বিছানায় বসালেন। ছেলেটা গপগপ করে খেয়েই যাচ্ছে। ক্ষুধার জন্যই শুধু একটানা খেয়ে যাওয়া। পেটের মধ্যে যেন একটা ক্ষুধার্ত রাক্ষস বসে আছে। আজ ছেলেটা একাই দু’জনের খাবার খেয়ে নিল। একবারও বললোনা, মা, খাবারটা খুব টেস্ট হয়েছে। ভাল খাবার খেতে খেতে খলিল মাঝে মাঝে খুব টেস্ট হয়েছে বলে। ছেলের মুখে ইংরেজী শুনতে ভালই লাগে জাহেদা বেগমের। ভয় আর উদ্বেগ নিয়ে ঘুমন্ত ছেলের মাথার কাছে বসে রইলেন।

ছেলেটাকে নিয়ে অনেক আশা জাহেদা বেগম আর হাফিজ মিয়ার। ছেলেকে মানুষ করবেন। বস্তির এই দমবন্ধ পরিবেশ থেকে দূরে অনেক দূরে চলে যাবেন। ঝঞ্ঝাটমুক্ত স্বাভাবিক, আনন্দময় একটা জীবন। মাঝে মাঝে মনে হয় স্বপ্নটা কখনও বাস্তবতার রোদেলা আলোয় উজ্জ্বল, উচ্ছল হয়ে উঠবে না। গতর খেটে বেঁচে থাকা মানুষের স্বপ্নগুলি বুঝি এমনই হয়। স্বপ্ন দেখাতেও সন্দেহ, অবিশ্বাসের ঠাসা বুনন।

সারাবেলাই ঘরের বাইরে খাটতে হয় যার, ছেলে মানুষ করার স্বপ্নের মাঝে কাঁটা বিছানো পথে তাকে হাঁটতে তো হবেই। ছেলেটা অবশ্য লেখাপড়ায় ভালো। নিশি মেয়েটা স্বভাব, চরিত্রে খারাপ হলেও শিক্ষিতা। খলিলের লেখাপড়ায় আন্তরিকতার সাথে সহযোগিতা করে। জাহেদা বেগম নিজের অজান্তেই নিশি মেয়েটার জন্য সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করতে লাগলেন। এতো বছর হয়ে গেল পাশাপাশি আছে। তারপরেও কখনো ওর সম্পর্কে কিছু জিজ্ঞেস করা হয়নি বা জিজ্ঞাসা করার ইচ্ছে বা সুযোগটা তৈরি হয়নি।

সকালবেলা মায়ের বেড়ে রাখা ভাত আর আলু ভর্তা দিয়ে খাওয়া শেষ করে ব্যাগটা কাঁধে ফেলে স্কুলের দিকে রওনা দেয় খলিল। দুলতে দুলতে পায়ের নিচের ধুলা আর ছোট ছোট ইটের টুকরোগুলি ফুটবলের মতো লাথি মারতে বেশ মজা লাগে। বস্তির প্রায় শেষ মাথায় প্রায় বিচ্ছিন্ন এক দ্বীপের মতো বৃদ্ধ নিখিল বাবুর দোকান ঘর। দোকানটিতে পণ্যের কমতি নেই। কলা, রুটি, চাল, তেল নুনের সাথে সাথে ওরস্যালাইন, প্যারাসিটামল জাতীয় ঔষধও মিলবে। চেনাজানা চিমসেমুখো ছেলেছোকড়া থেকে শুরু করে বুড়োরাও গোপনে কি যেন কিনে নেয়। সবাই জানে, বুঝে- চুপি চুপি কি নেয় ওরা। তারপরেও এসব নিয়ে কোন উচ্চবাচ্য হয় না। মাঝে মাঝে পুলিশ আসে। চা টা খেয়ে মুঠো করে হপ্তা নিয়ে যায়। বুড়োর পোষা কুকুরটি সারাক্ষণই দোকানের চারপাশে ঘোরাফেরা করে। ওটাকে দেখলেই খলিলের মাথার ভিতর কি যে হয়ে যায় ! দূর থেকে কুকুরটাকে দেখতে পেলেই ছোট একটা ইটের টুকরা তুলে নিয়ে একেবারে ওটার সামনের পায়ে ছুঁড়ে মারে। কুকুরটা ব্যাথা বা ভয়ে কুই কুই করে উঠলে অদ্ভুত এক ভালোলাগায় মনটা ভরে যায়। তখন বুড়োটা একটা চ্যালাকাঠ নিয়ে দোকান থেকে তেড়েফুঁড়ে উঠে আসে। আজ বুড়োটা ওকে আগেই দেখে ফেলেছে। চেঁচিয়ে বলতে থাকে-

খবরদার হাফিজ্জার পুত। আইজকা যদি মতিরে ঢিল মারস, তয় তোর বাপের নাম ভুলাইয়া দিমু।

নিষেধাজ্ঞা অমান্য করার তীব্র উত্তেজনায় খলিল বেশ জোরেই ঢিলটা ছুঁড়ে মারে। ঠিক জায়গামতো ঢিলটা লাগাতে পেরে আর উচ্চস্বরে কুকুরের কুই কুই আওয়াজটা শুনতে পেয়ে আনন্দে মনটা ভরে উঠে খলিলের। বুড়োকে লাঠি হাতে তেড়ে আসতে দেখে ভোঁ দৌড় দেয় খলিল। পিছনে উচ্চকণ্ঠের অকথ্য গালিগালাজ আর অভিসম্পাতগুলি ওর খুশির নদীতে যেন বান ডেকে যায়।

আজ আবার কি জন্য এসেছিস? এতদিন কোথায় ছিলি?

খলিল লজ্জিত ভঙ্গিতে মাথা নিচু করে আছে।

কি সমস্যা? অংক না ইংরেজি?

না আপা, ওসব কিছু না। তোমাকে একটা জিনিস দেখাতে এসেছি।

নিশির ঠোঁটে কৌতুকের হাসিটা বিস্তৃত হবার আগেই একটা খাতা ওর বিছানার উপর রেখে খলিল এক দৌড়ে চলে আসে।

নিশি অবাক হয়। খাতাটা তুলে একটার পর একটা পাতা উল্টাতে থাকে। কোন পাতায় অংক, কোনটায় ইংরেজি, বাংলা- সব স্কুলের লেখা। পাতা উল্টাতে উল্টাতে চোখে পড়ে পেন্সিল দিয়ে আঁকা ছবিটার দিকে। চমকে উঠে লক্ষ্য করে এটা ওর চেহারা। কি সুন্দর করে এঁকেছে ছেলেটা। থুঁতনির নিচের কালো তিলটাও এতো স্পষ্ট! শুধু চোখগুলিতে কেমন যেন বিষণ্ণতার ছোঁয়া। এই বয়সে খলিলের মতো অল্প বয়সী একটা ছেলে কিভাবে এতো সুন্দর ছবি আঁকে? নিষ্পাপ মন নিয়ে এমন নিখুঁত মুখের আদল ফুটিয়ে তোলা কিভাবে সম্ভব? ছবির একেবারে নীচে, নিশ্চয়ই ছবি আঁকার অনেক পরে বলপয়েন্ট কলম দিয়ে গোটা গোটা অক্ষরে একটিমাত্র বাক্য লেখা- ‘ছবিটা কি ভাল হয়েছে আপা?’

রাত প্রায় দু’টা। বস্তির দৈন্যতা আড়াল করতেই যেন চারিদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। গাঢ় অন্ধকারের সাথে প্রতিযোগিতা করতে করতে ক্লান্ত ল্যাম্পপোস্টের ম্রিয়মাণ আলোগুলি প্রাণপণ চেষ্টা করে যাচ্ছে। বাতিগুলির আপ্রান চেষ্টার ফলে কিছুটা দূরের চলাফেরার পরিচিত ভঙ্গি দেখে অনুমান করে নেয়া যায় মানুষটা কে।

স্তব্দ রাতের স্থির সময়ে হঠাৎ করেই চিৎকার, চেঁচামেচি, ত্রস্ত দৌড়ঝাঁপ আর হুইসেলের তীব্র আওয়াজে চঞ্চল হয়ে উঠলো প্রায় সত্তরটির মতো বেড়ার আবরণে ঢাকা জীর্ণ বস্তি ঘর। হাতে হ্যান্ডকাফ আর সফেদ পাঞ্জাবির উপর একহারা গড়নের শরীর; কোমরে দড়ি দিয়ে বাঁধা একটি মানুষকে প্রায় টানতে টানতে পুলিশের গাড়ির দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। লোকটা শান্ত আর দৃঢ়তার একটা কঠিন মূর্তি যেন। তার শরীরটাকে নড়ানো যাচ্ছে কিন্তু শান্ত মুখ থেকে সুস্থির হাসিটাকে রুখে দিতে পারা যাচ্ছে না। চোখের দৃষ্টিটা যেন কেমন! চারিদিকে জড়ো হওয়া বস্তির শত শত মানুষের দিকে তাকিয়ে হাসলেন। সেই হাসিতে প্রতিবেশীর কাছে লজ্জা পাবার কোন ক্রিয়া বা প্রতিক্রিয়া নেই- অনেকটা যুদ্ধক্ষেত্রে যাবার আগে আপনজনের দিকে তাকিয়ে স্বান্তনার হাসি দেয়া; অবিচল, নিশ্চিত ব্যস্ততার মাঝে দপ করে জ্বলে উঠা সুখ-স্মৃতি কাতরতার একটা ঢেউ হাসির ফোয়ারা নিয়ে তীরে আছড়ে পড়ছে। ভিড়ের মাঝে গুঞ্জনটা বেশ জোরালো হতে শুরু করেছে। সাব-ইন্সপেক্টর সাহেব বুঝেতে পারছেন, গুঞ্জন থেকে কেউ একজন হঠাৎ করেই স্ফুলিঙ্গ তৈরি করে দেবে। জড়ো হওয়া মানুষগুলি তখন অকারনেই ক্ষ্যাপা জানোয়ারের মতো পুলিশের দলটার উপর ঝাপিয়ে পড়বে। পুলিশ অফিসার আত্মপক্ষ সমর্থনের শব্দে আর তীক্ষ্ণ কণ্ঠের সংমিশ্রণে বলতে থাকেন-

এই লোকটা একজন খুনের আসামী। সে এক সাথে একই পরিবারের দুই দুইজন নীরিহ লোককে খুন করেছে। আমরা ওকে একবছর যাবৎ খুঁজছি। আপনারা সরে দাঁড়ান। আমাদের কাজ করতে দিন। পুলিশের কাছাকাছি থাকা হালকা পাতলা একটা লোক সুরুৎ করে নিজেকে অন্ধকারের আড়ালে হাঁটিয়ে নিয়ে চলল। অনেকেই ব্যাপারটা লক্ষ্য করল। সে হচ্ছে হোসেন মিয়া- পুলিশের সোর্স।

কথার চতুরতার ফাঁদে পড়েই হোক অথবা একজন খুনীর চেহারা দেখার অনিচ্ছার আকুলতায় জমাট ভিড়টা খুব দ্রুতই পাতলা হয়ে যায়। পুলিশের গাড়ি খুনের আসামিকে গাড়িতে তুলে থানার দিকে রওনা দেয়। দশ মিনিটও পার হয় না। বস্তির ঘরগুলো অন্ধকারের মাঝে আবারো নিজের ঠাই খুঁজে নেয়। কৃষ্ণপক্ষের অন্ধকারকে আলোকিত করতে ল্যাম্পপোস্টের ম্রিয়মাণ আলোরা প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকে।

জাহেদা বেগমের ভিতরটা থরথর করতে থাকে অজানা এক ভয়ে। গত এগারো বছরের মধ্যে কবে, কখন হিংস্রতায় ভয় তার অন্তরাত্মাকে কাঁপিয়ে দিয়েছে ঠাহর করতে পারছেন না। খাবার খেতে থাকা ছেলের দিকে তাকিয়ে অভিমান ভরা কণ্ঠে বলতে থাকেন-

তোর বাবার কাণ্ডটা দেখছস? আজ বিশ দিন হইয়া গেলো কোন যোগাযোগ নাই। নিশির নাম্বারে একটা ফোন দিয়া জানাইতে পারতো লোকটা কেমন আছে, কি অবস্থা। তুই কাল নিশির কাছে একটু জিগাইসতো তোর বাবা কোন যোগাযোগ করছে কিনা?

নিজেকে মিথ্যা স্বান্তনা দিতেই হয়তো কথার মালায় আরেকটা বাক্য যোগ করলেন,

‘নিশিকে ফোন দিয়েছিল ঠিকই, ও হয়তো জানাতে ভুলে গেছে।’

জাহেদা বেগমের চোখের দু’কোণে অভিমান, দুশ্চিন্তার ছায়াগুলো বাস্প হয়ে ঘুরে বেড়াতে থাকে। বাষ্প থেকে মেঘ হতে খুব সময় নেবে না। জাহেদা বেগম ছেলের দিক থেকে মুখ সরিয়ে চোখে আঁচল চাপা দেন। খলিল লক্ষ্য করে মায়ের শরীরটা ক্ষণে ক্ষণে কেঁপে কেঁপে উঠছে। অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখার চেষ্টা করতে থাকে মায়ের আঁচলে ঢাকা মায়াময় মুখটা।

সারাদিনের হাড়ভাঙ্গা খাটুনির পর মনের গভীরে লুকিয়ে থাকা কথাগুলি বলতে বা শুনতে পাবার ইন্দ্রিয়গুলি প্রচণ্ড বিদ্রোহী হয়ে উঠে। খুব অল্পতেই হার মেনে নেয়। জাহেদা বেগমের ক্লান্ত শরীরটা এলিয়ে পরে ঘুমে। খলিল জেগে থাকে। আস্তে আস্তে মায়ের পাশ থেকে উঠে বাতি জ্বালায়। সাদা কাগজের উপর বাবার একটা নিখুঁত ছবি আঁকার প্রচণ্ড আকাঙ্ক্ষায় চোখ থেকে ঘুমটা অনেক আগেই ক্রোশ দূরে হারিয়ে গেছে।

বেলা শেষে বস্তির সরু পথটার দুইপাশে ধুলোমলিন কয়েকটা ঘর পার হতে হতে কতকিছু যে চোখে পড়ে খলিলের। সংকীর্ণ পথের খুব কাছেই বড় রাস্তায় পৃথিবীর বিচিত্র কিছু রহস্য যেমন চর্মচক্ষুতে দৃশ্যমান হয়, তেমনি শুনতেও পাওয়া যায়। ব্যস্ত রিকশা খুব দ্রুত পার হয়। আরোহীর মাথাগুলি কেমন যেন অদ্ভুতভাবে রিকশার সাথে তাল মিলিয়ে দুলতে থাকে। হাতের জ্বলন্ত সিগারেট দুই ঠোঁটের মাঝখানে নিতেও কত কসরত! রাস্তার আলো-আঁধার আর ধোঁয়া ভরা বাতাসের বুক চিরে তীব্র কণ্ঠে চিৎকার করে উঠে কেউ কেউ। সরুপথ ছাড়িয়ে বড় রাস্তায় ভদ্রবেশী ভদ্রলোকের সন্তানেরা রাস্তার পাশে গোল হয়ে বসে ফিসফিসিয়ে কেমন যেন ষড়যন্ত্রের জাল বুনে যায়। রাস্তার এইসব রূপ আর শব্দকে দেখে দেখে চোখসহা, কানসহা হয়ে গেছে বস্তির অতি সাধারন মানুষদের।

বৈশাখী জ্বালাভরা আক্রোশের আঁচ এখনও মলিন হয়নি। নিশি আপার ঘরে একটা টেবিল ফ্যান আছে। এর পাশে বসেই ছোট আয়নাটির দিকে তাকিয়ে অপরিচিত, অনাত্মীয়, অনাকাঙ্ক্ষিত কারো জন্য নিজেকে সাজিয়ে নিচ্ছে।

নিশি আপা, আসবো?

এত ঢং করিস ক্যান, আয় ভিতরে আয়।

খলিল ঘরের ভিতর ঢুঁকতেই নজরে পড়ে নিশির গলা পেঁচিয়ে ধরা ঝকঝকে সরু চেইনটি। সাজগোজের বাহারি রুপময়তার মাঝেও নিশির চেহারাটা কোন এক অজানা কারনে বিষণ্ণ হয়ে আছে। অভিমানের ভারটা অবিচল পাথরের মতো মনের ভিতর চেপে বসে আছে। কে আছে এমন, যার কাছে মনের সব গ্লানি, যন্ত্রণা আর মুক্তির অনাবিল সম্ভাবনা নিয়ে আলাপ করবে।

আপা, বাবা তোমার কাছে ফোন করছিল?

চমকে ঘোর ভাঙ্গে নিশির- নাতো।

বিষণ্ণ কণ্ঠে খলিল বলে, বাবা ধান কাটতে দেশের বাড়ি যাবার সময় মা তোমার নাম্বার দিয়েছিল। বাবা ফোন করলে আমাকে জানিও। কি এক অদ্ভুত আশার জোরে খলিলের চোখ জোড়া চকচক করে উঠে।

ঠিক আছে জানাবো। দাদা কবে দেশে গেছে?

পনেরো–বিশ দিন হবে।

ভাঙা ভাঙা কণ্ঠে মনের সব জোর একত্র করে নিশি স্বান্তনা দেবার চেষ্টা করে, ছেলেটার ভয়কে ভেঙ্গে দিতে চায়- হয়তো নাম্বার হারিয়ে ফেলেছে। চিন্তা করিস না। তোর মাকে চিন্তা করতে না করিস।

ছেলেটাকে আশ্বস্ত করতে গিয়ে নিজেই অজানা এক আশংকায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে নিশি। খলিল এর বাবার সাথে ওর এমন কোন সম্পর্ক নেই যে, পনেরো–বিশ দিন যাবৎ খবরহীন একজন মানুষের জন্য হাত-পা ছড়িয়ে কাঁদতে হবে। তবে হারানোর যন্ত্রণার কষ্ট ওর চেয়ে বেশি আর কে বুঝবে। অবুঝ প্রায় ছেলেটার প্রতি আশ্চর্য এক মমতার টান, খলিলের বাবার নির্বিরোধ চলাফেরা আর ওর মায়ের স্নেহ, করুণা বা সহমর্মিতার দৃষ্টিটা নিশির মাঝে একধরনের উদ্বিগ্নতার প্রশ্ন জন্ম দিয়ে যায়- লোকটার কোন বিপদ হয়নিতো ? পোড় খাওয়া বিশ বছর বয়সী একজন তরুনী সৌভাগ্য আর নিশ্চিতকে বিশ্বাস করার মনের জোর প্রায় হারিয়ে ফেলতে বসেছে।

এরপরে দু’জনের মাঝে আর কথাবার্তা এগুয়না। বিষণ্ণতার কালো অন্ধকারে কতক্ষণ আর কথা চালাচালি করা যায়।

আজ দুই মাসের মতো হলো হাফিজ মিয়ার কোন খবর নেই। জাহেদা বেগম একবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন গ্রামের বাড়ির দিকে খোঁজ নিতে যাবেন। কিন্তু কর্মস্থলের পূর্বনির্ধারিত বিয়ের আয়োজন, খলিলের পরীক্ষা আর নানা উটকো ঝামেলায় কেমন করে যেন এতগুলো দিন পার হয়ে গেলো। ধান কাঁটার সময়ও শেষ। এখনও হাফিজ মিয়া ফেরেনি, এমনকি কোন খোঁজও জানায়নি।

সেদিন সকালে কাজের বাড়িতে যাবার সময় গ্রামের বাড়ির ছালামত মিয়ার সাথে দেখা। কি’গো খলিলের মা, হাফিজ মিয়ারে দেহি আইজকাইল একেবারেই দেহা যায়না। গত হপ্তায় দেশে গেছিলাম। অইহানে ধান কাটতে যাওয়ার কথা আছিল, যায় নাইক্কা। বিষয়টা কি খলিলের মা। সব ঠিক আছেতো।

জাহেদা বেগমের হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে আসছে। কোনমতে জিজ্ঞেস করলেন, খলিলের বাপে ধান কাটতে যায় নাই?

না।

এই ‘না’ শব্দটি জাহেদা বেগমের শরীর, মন অবশ করে দেয়। ছালামত মিয়া হাত পা নেড়ে আরও কি কি বলে গেলো কিছুই শুনছে না বা দেখতে পারছেনা। কিভাবে, কখন যে বিশাল বাড়িটার ভিতরের রান্নাঘরে এসে হাজির হয়েছে সে তাও টের পেলনা।

জাহেদা, তোমার স্যারকে চা দিয়ে এসো- কথাটা কানে পৌঁছাতে নিজেকে একটু ফিরে পেলো যেন। স্বল্প সময়ের মধ্যে কয়েকটি অযাচিত, অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটে গেলো- কাপে চা ঢালতে গিয়ে পুরো চায়ের লিকার নিজের বাম হাতের উপর ফেলে দিলো, অথচ একটুও ব্যাথার অনুভূতি হলোনা। থালা, বাসন ধুতে গিয়ে দুইটা কাঁচের বাসন ভেঙ্গে ফেলল, বসার ঘর ঝাড়ু দিতে গিয়ে দামি ফুলদানিটা ভাঙ্গল, দুই বছর বয়সী সাহেবের নাতির গায়ে ঝাড়ুর বাড়ি লাগলো। হয়তো আরও কিছু ঘটতে পারতো। নাতির তীক্ষ্ণ চিৎকারে দাদী মমতাজ বেগম ছুটে এসে জাহেদা বেগমের সামনে এসে দাঁড়ালেন। চোখে চোখ পড়তেই কে যেন ধাক্কা দিয়ে মমতাজ বেগমকে দু’হাত পিছনে ঠেলে দিলো। শান্ত, সাধারন, অতি সাধারন এই মেয়েটার চোখের শুন্য দৃষ্টির মাঝে কি এক আক্রোশ ফুটে উঠেছে। মমতাজ বেগমকে দেখে স্বভাবজাত হাসি দেবার চেষ্টা করে জাহেদা বেগম। বিনয় আর আন্তরিকতার বিগলতার বিপরীতে ক্রুর আর বীভৎসতার হাসি।

মমতাজ বেগমের কাছে পুরো বিষয়টাই দুর্জ্ঞেয় রহস্য মনে হচ্ছে। এমন ভাল মেয়েটা কোন ভয়ানক অভিশাপে উদ্ভ্রান্ত হয়ে গেলো? তিনি কাজের ছেলে আবুল মিয়াকে দিয়ে জাহেদা বেগমকে তার বস্তিতে পাঠিয়ে দিলেন।

জাহেদা বেগমের জীবনের আলোটা ধীরে ধীরে ম্রিয়মাণ হয়ে আসছে। হাফিজ মিয়ার নিরুদ্দেশ এই ছয়মাস ক্ষমাহীন, নিষ্ঠুর অভিশাপ হয়ে মা-ছেলের জীবনের গতিপথটাকে সম্পূর্ণ পাল্টে দিয়েছে। জাহেদা বেগম এখন একেবারেই নিথর। নিশ্চূপতার মোড়কে আবদ্ধ করে নিয়েছেন নিজেকে। কিসের অসুখ; এটা একটা দুর্বোধ্য রহস্য। ক্ষুধাবোধশূন্য, পাথরের মতো অবিচল নির্লিপ্ততার মাঝেই স্থির সময় পার করছেন তিনি। শূন্য দৃষ্টিতে আপনজনকে ফিরে পাবার অপেক্ষাতে ধ্যানমগ্ন কোন সন্ন্যাসী যেন। তার জীবনে গর্ভজাত সন্তান খলিলেরও অস্তিত্ব বিলীন। মাঝে মাঝে কান পেতে থাকেন অন্য কোন জগৎ থেকে প্রিয় মানুষের কণ্ঠস্বর শোনার আশায়।

সন্ধ্যার ঠিক আগে আগে নিশি খলিলদের ঘরে আসে। দরজার উল্টোদিকে পিঠ দিয়ে থাকা খলিল থালা থেকে খাবার নিয়ে ক্লান্তিহীনভাবে চেষ্টা করে যাচ্ছে মায়ের মুখে তুলে দিতে। জাহেদা বেগম একটা জেদি ভাব ধরে বারবার মুখ সরিয়ে নিচ্ছে। ক্ষুধার্ত মায়ের মুখে খাবার তুলে দেবার আকুতির যন্ত্রণায় জাহেদা বেগম যেন ক্ষ্যাপা বাঘিনীর রূপ ধারণ করেন। এক ধাক্কায় খাবারের থালাসহ খলিলকে মাটিতে ফেলে দিয়ে অশ্রাব্য খিস্তি খেউরের ঝড় তূলতে লাগলেন। ডাল মাখা ভাত দলায় দলায় এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে। ছড়িয়ে থাকা ভাতগুলি গোছাতে থাকে আর অদম্য চিৎকারের কান্না চাপতে গিয়ে অস্ফুট গোঙ্গানির মতো শব্দ করতে থাকে খলিল।

খলিল, এদিকে আয়তো।

অসময়ে আকস্মিক ডাকে চমকে দরজার দিকে নিশির উদ্বিগ্ন মুখের দিকে তাকায় খলিল। খলিল উঠে আসতে আসতে নিশি দেখতে পায় ছয়মাস আগের সুন্দর স্বাস্থ্যের এগারো বারো বছরের ছেলেটি কয়েকমাসের মধ্যেই করুণ আর রোগা হয়ে গেছে। টানা চোখ দু’টির তারার কালো নিবিড়তা মলিন হয়ে গেছে। ছেলেটা কি এখনও সুন্দর করে ছবি আঁকে? মনে হয়তো না। লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে সংসারের ঘানিটা কাঁধে তুলে নিয়েছে। সারাদিন টেম্পুর হেলপারি আর মায়ের যত্ন নিতে নিতে সময়, শক্তি, সামর্থ্য আর শুচিতাটাই বা থাকে কটটুকু।

দরজার কাছে আসতেই মুঠোতে ধরা কিছু টাকা খলিলের হাতে গুঁজে দিয়ে অতিদ্রুত, প্রায় ছুটে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। পিছন থেকে খলিলের ডাকটা কানে বাজতে থমকে দাঁড়ায়।

কিরে, কিছু বলবি?

নির্বাক হয়ে নিশির মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে খলিল। চোখের কোণ দুটো চিক চিক করতে থাকে। নিশি সামনে এগিয়ে এসে ওর হাত দু’টি ধরে। আগের মতো নরম নয়। পরিশ্রমের কারনে এই বয়সেই কেমন যেন শক্ত ধরনের হয়ে গেছে হাতগুলি।

শুন, একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে। কোন সমস্যা হলে আমাকে ডাকিস। বলতে বলতে নিজেই বুঝে পায়না, ওর মতো মানুষের কিইবা করার আছে ওদের জন্য।

ঘুমন্ত মায়ের দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে খলিল। পুরনো জঞ্জালের ভিড় থেকে একটা খাতা বের করে। অনেক কষ্টে খুঁজেপেতে একটা পেন্সিলও বের করে। পেন্সিলের মাথাটা ভাঙা। শার্পনারের উপর মরিচা পড়ে নষ্ট হয়ে গেছে। ব্লেডও খুঁজে না পেয়ে ঘরের কোণে রাখা বটি দিয়ে খুব সাবধানে পেন্সিল কাঁটার চেষ্টা করে যায়। ডগাটা যতটুকু চেয়েছিল ততোটা নিখুঁত হয়না। আজ বাবার একটা ছবি আঁকতেই হবে। কিছুতেই বাবার চেহারাটা পুরোপুরি মনের আয়নায় আসছেনা। কেমন যেন ঘোলাটে, অস্পষ্ট। তবু প্রাণপণে চেষ্টা করে যেতে থাকে সে।

সময়ের অদ্ভুত, রহস্যময় অমোঘ একটা শক্তি আছে, যা মানুষ সৃষ্টির সেরা হয়েও আজ পর্যন্ত পরাজিত করতে পারেনি। জাগতিক সকল সুন্দর-অসুন্দর, সুখ-দুঃখের স্থায়িত্বের বিপরীতে দুর্বার গতিতে শুধু সামনে এগিয়ে যায়। বর্তমানের টেম্পু হেলপার খলিলের প্রতি ওস্তাদের মনের মাঝে উথলে ওঠা স্নেহের কারনে আস্তে আস্তে টেম্পু চালানোটা আয়ত্ব করা শুরু করেছে। ওস্তাদের কথায় মনে হচ্ছে মাস খানেকের মধ্যেই টেম্পু চালানোটা পুরোপুরি শিখে নিতে পারবে।

সেদিন দুপুরের দিকে বিরোধী দলের কর্মী, সমর্থকরা নেতার নিঃশর্ত মুক্তির দাবিতে লাঠিসোটা হাতে জঙ্গি মনোভাব নিয়ে বুনো শূয়রের মতো যান আর জীবনের উপর হামলে পড়ে। সামনে পড়া যানবাহন বিধ্বস্ত হয়, রক্তাক্ত হয় জীবন। নিষ্প্রাণ যান আর প্রানময় নিরীহ জীবনগুলো যেন তাঁদের প্রানপ্রিয় নেতার বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে হয়রানি করে যাচ্ছে। ওদেরকে ক্ষমা করা যায় না।

ড্রাইভার বাবলু মিয়া তার যান আর যানের ভিতরের জীবনদের রক্ষার্থে নির্দিষ্ট রাস্তা থেকে পাশের প্রায় অব্যবহৃত, নিরিবিলি চওড়া রাস্তায় ঢুঁকে পড়ে। ত্রস্ত যাত্রীদের চিৎকার, চেঁচামেচিতে খলিলের অস্থিরতা ছাপিয়ে কাছেই সেই স্কুলটির স্মৃতিগুলি উচ্ছল হয়ে উঠতে থাকে। এখানেই দীর্ঘ তিনটি বছরের অনেক সময় পার করেছে। স্কুলের শিক্ষক, বন্ধু সুমন, ছালাম, মিন্টু, বিপ্লব, জামিল সবাই কেমন আছে? দ্রুতগতিতে ছুটে চলা যান, ভিতরে বসা মানুষগুলির ভয়ার্ত আচরণ সব যেন স্তব্দ হয়ে যায়। কোন এক অজানা উৎস থেকে স্কুলের ভিতরের খেলার মাঠ, ফুটবল নিয়ে দৌড়ঝাঁপ, ব্ল্যাকবোর্ড, পড়া না পারার কারনে বেঞ্চের উপর অদ্ভুত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকা মারুফ- এতোগুলি স্মৃতি এক লহমায় ওর মস্তিষ্কের প্রতিটি কোষ দখল করে নেয়। সন্ত্রস্ত অবস্থায় চ্যাতা স্যারের দিকে ভীরু পায়ে এগিয়ে যেতে থাকে। স্যারের পড়াটা দিতে পারেনি। কি শাস্তি দেয় কে জানে?

সামনের স্পীড ব্রেকারের উপর প্রচণ্ড গতিতে চলা টেম্পুর চাকা উঠে যায়। জোর ঝাঁকিতে খলিলের হাত দু’টি ছুটে যায়। রাস্তার উপর উল্টে পড়ে সদ্য কৈশোর পার করা খলিল। নিজেকে সামলে উঠার আগেই দুরন্ত গতির ট্রাকটি খলিলের দু’পায়ের উপর দিয়ে ছুটে চলে যায়। স্নায়ুগুলি অসার হয়ে গেছে। ব্যাথাবোধহীন স্থিরতার মাঝে সবকিছুই কেমন ধোঁয়াটে মনে হচ্ছে।

হাসপাতালের ট্রলির উপর শুয়ে আছে খলিল। অত্যন্ত দ্রুততার সাথে ট্রলিটা ছুটিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। খলিল অস্পষ্টভাবে শিয়রের দিকটায় নিশি আপার স্নেহভরা মায়াময় চেহারাটা দেখতে পাচ্ছে। ছুটে চলার মাঝে নিশির মোবাইল ফোনটা বেজে উঠলো। নাম্বারটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে রিসিভ করে।
আজ যেতে পারবোনা।

কিছুক্ষণ ওপাশের কথা শুনে বেশ উচ্চকণ্ঠে বলতে থাকে,

ঐ বেটা, তরে কইছিনা আজ যাইতে পারুম না। হ, আমার ছেলে। তোর কোন অসুবিধা আছে। এখন ফোন রাখ।

আবার চুপচাপ অপর প্রান্তের কথা শুনতে শুনতে রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে পাগলের প্রলাপের মতো একটানা বলতে লাগলেন-

রাখ তোর মালদার পার্টি। বেশি ঠ্যাকা পরলে তোর বউ, বোনকে পার্টির কাছে পাঠিয়ে দে। আমার ছেলের এই অবস্থায় আমি কোথাও যাবো না; কথাগুলি বলেই নিশি লাইনটা কেটে দেয়।

খলিলরা আগের বস্তিঘরেই আছে। নিশি আপাটা যে সেই কবে, খলিলের হাসপাতাল ছাড়ার কয়েকদিন পরই বস্তি ছেড়ে চলে গেলেন। আজ এতো মাস হয়ে গেলো তার কোন খবরই কেউ দিতে পারে না।

অতি ব্যস্ত মানুষের চলাচলের বড় রাস্তার পাশে রিকশার তিনটি বেয়ারিংয়ের চাকার বাহনের উপর খলিল বসে আছে। যে হাত বই, খাতা, কলম, পেন্সিলে লেখাপড়ার সাথে সাথে সুকুমারবৃত্তি চর্চায় জ্বলে উঠার কথা, সে হাত আজ ক্ষুন্নিবৃত্তির প্রাকৃতিক নিয়মের হাতে বন্দী জঠরে জ্বলে উঠা জ্বালাটাকে নেভাতে হাত পেতে থাকে।

শ্রাবণ মাসের একদিন। আকস্মিকভাবেই আকাশ ভেঙ্গে বৃষ্টির তোড়জোড় শুরু হয়ে গেলো। পথচারী যারা ছিল সবাই কাছাকাছি দোকানের সামনে আশ্রয় নিয়ে নেয়। খুব ভুল হয়ে গেছে। ঘরে পলিথিনটা রেখে এসেছে। বাহনটা সরাতে যেয়েও কিসে যেন আঁটকে আছে। খানিকক্ষণ চেষ্টা করে বিফল হয়ে বৃষ্টিতে ভিজতে লাগলো। ওর সাথে নিখিল বাবুর কুকুরটিও ভিজছে। যেটাকে খোঁড়া করে দেবার তীব্র বাসনায় প্রতিদিন ঢিল ছুঁড়ে মেরেছে, সে আজ ওর সর্বক্ষণের সঙ্গী। সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে বৃষ্টির বেগ বাড়তে থাকে। দূরের জিনিসগুলিও ঝাপসা হয়ে গেছে।

অনেকক্ষণ যাবৎ রাস্তার ওপাশে একটা সাদা দামী গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। অস্পষ্ট একটা মেয়েলী ছায়া গ্লাসের ভিতর থেকে তাকিয়ে আছে। মনে হচ্ছে খলিলের দিকেই তাকিয়ে আছে।

ছেলেটা আর ওর কুকুরটা বৃষ্টিতে ভিজে একেবারে নেতিয়ে পড়ছে। চারিদিকে এতো মানুষ অথচ কেউ একজন ওর বেয়ারিংয়ের চাকার গাড়িটাকে ঠেলে কোন এক আচ্ছাদনের নিচে নিয়ে যাবে এমন মানসিকতার পরিচয় দিতে পারছেনা। গাড়ির দরজা খোলার জন্য নিশি হাত বাড়াতেই অন্য হাতের উপর কারো শক্ত হাতের জোরালো চাপ অনুভব করে। চাপটা একটা সতর্কতা, যে সতর্কতার কঠিন নির্দেশ উপেক্ষা করা যায় না। উপেক্ষা মানেই সেই পুরনো দিনে ফিরে যাওয়া। সেই বাঁশের বেড়ায় ঘেরা ধুলোমলিন ঘর, সন্ধ্যায় সেজেগুজে শরীর বেচার অনিচ্ছাকৃত অথচ অত্যাবশ্যক তাড়া

সেই জগতে আর ফেরা যাবেনা। ওখানকার মানুষের জীবনটা বর্তমানের কঠিন শিকলে বাঁধা। পিছনে ঘনঘোর অন্ধকার। সেই অন্ধকারের ভারী পর্দায় ঢাকা অতীতের সুখকল্পনাকে চোখ মেলে দেখার সুযোগ নেই, সম্ভবও নয়। আগামী দিনের আশাগুলি কঠিন পাথরের দেয়ালে বাঁধাগ্রস্ত হয়ে আছে। সামনের উজ্জ্বল, উচ্ছল, আলোকিত স্বপ্নের পাখিরা সেই দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে খেয়ে ডানা ভেঙ্গে আছড়ে পরে ধুলোমলিন পথের উপর। কালেভদ্রে কারো জন্য সামনের দেয়ালের উপর দাঁড়িয়ে কেউ একজন হাত বাড়িয়ে দেয়। হাতটি যে শক্ত করে ধরে দেয়াল টপকাতে পারে সেই শুধু ওপারের আলোকিত দুনিয়া দেখতে পায়। আর খলিলেরা ভিজতে থাকে। পাঁশে সঙ্গী হয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে একটা কুকুর।

মন্তব্য ১ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (১) মন্তব্য লিখুন

১| ২৮ শে জানুয়ারি, ২০১৮ সন্ধ্যা ৬:০০

হুয়ায়ুন কবির বলেছেন: অন্ধকার ও দেয়াল

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.