![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
সাব্বির জাদিদের গল্পগ্রন্থ 'একটি শোক সংবাদ' সম্প্রতি আমার এক নতুনতর পাঠ-অভিজ্ঞতা । বিষয়বস্তু সাপেক্ষে গ্রন্থভূক্ত প্রতিটি গল্পই ছিল চমকপ্রদ । এসব গল্পে জনজীবনের অচ্যুত দিকগুলি উম্মোচন করার পাশাপাশি লেখক আলো ফেলেছেন এর সাথে জড়িয়ে থাকা সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক প্রচলিত সব নিয়ম-নীতি-রীতি-রেওয়াজের উপরও । যা পাঠকদের নিত্যনৈমত্তিক জীবন-পদ্ধতির বাইরে গিয়ে নতুন করে ভাবতে শেখায় ।
গল্পগুলোর বৈশিষ্ট্যপূর্ণ কতক আখ্যান শুধুমাত্র এর ব্যতিক্রমধর্মীতার জন্য পাঠকের আলাদা মনোযোগের দাবিদার ।
একইসাথে কিছু গল্পের পরিণতি এতই নাটকীয় যে, প্রাপ্তমনস্ক পাঠকরা হয়তো কিছুটা দ্বিধান্বিতভাবে এর আকস্মিকতার কথা স্বীকার করবেন, কিন্তু সাধারণ পাঠকমাত্রই সেইসব আকস্মিকতায় তীব্রভাবে আলোড়িত হবেন ।
গল্পপ্রসঙ্গে...
সাব্বির জাদিদের গল্পগুলোর ভাষা সহজ-সরল প্রাণবন্ত । তাঁর গল্পের নির্মাণশৈলী ও বর্ণনাভঙ্গি আকর্ষণীয় । যে কারণে গল্পগুলোর আঙ্গিকে, বিষয়ে বিচিত্রতা থাকলেও তা পাঠকের কাছে জটিলতর ঠেকে না ।
বইটা পড়া শুরু করেছিলাম শেষের দিক থেকে, সর্বশেষ গল্প 'পড়শি' দিয়ে ।
গল্পটি জীবনের সায়হ্নে এসে মূমুর্ষ অবস্থায় স্মৃতিচারণ করতে থাকা এক হতভাগ্য বৃদ্ধের । যে কিনা একদিকে পোড় খাওয়া জীবনের সর্বশেষ সংকটময় পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে থাকে, অন্যদিকে হন্যে হয়ে স্মৃতি হাতড়ে কি যেন খুঁজতে থাকে । এমন সময় হঠাৎ অাশ্চর্য হয়ে দেখি যে, তার মধ্যে ধর্মবোধ-ধর্মানুভূতি তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে উঠছে । ফলস্বরূপ নাজুক পরিস্থিতিতে আমরা এমন সহায়-সম্বলহীন একজন বৃদ্ধকে দেখি, যে কিনা তার আত্মিক প্রশান্তিকে ত্বরান্বিত করছে এই ভেবে যে, সে মসজিদের পড়শি হওয়ার কারণে মৃত্যুকালে হলেও আল্লাহর কালাম শুনে যেতে পারছে!
মানুষের জীবনে আধ্যাত্মিক ধ্যান-ধারণা কতোটা গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্ট হিসেবে কাজ করে এবং এর মনস্তত্বাত্ত্বিক দিকটি যে কতোটা গভীর 'পড়শি' গল্পটি পড়ে তার কিছুটা হলেও অনুমান করা সম্ভব।
'জাতক ও জন্মভূমি' এবং 'যতিচিহ্ন' গল্প দু'টির পরিণিতি গ্রন্থভূক্ত বাকী গল্পগুলির পরিণতির চেয়ে ভিন্ন । সামনে ঠিক কি হবে সেটা আগে থেকে বুঝা না গেলেও এমনকি গল্পের কাহিনির প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণ আলাদা হওয়া সত্ত্বেও গল্প দু'টির পরিণতির আকস্মিকতার দিক দিয়ে কিছুটা মিল খুঁজে পাওয়া যায় । যেমন - 'জাতক ও জন্মভূমি' গল্পে পোয়াতি নাসরিনকে নিয়ে তার পরিবারের অস্থিরতা, পারিপার্শ্বিক সংকটময় অবস্থা ও সর্বোপরি রতনের মা'র আঁতুড়ঘরে অসফল হওয়াটার সাথে নবজাতকের জরায়ুর পর্দা খামচে ধরে থাকার সম্পর্কটা যেমন অলৌকিক ও আশ্চর্যজনক ছিল, ঠিক তেমনি 'যতিচিহ্ন' গল্পের নায়ক (নাকি খলনায়ক) বাদল ওরফে বদু তার সাম্প্রদায়িক বিশ্বাস-সংস্কার-ধারণা হেতু হঠাৎ উদ্ভূত এক ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর ধর্মালয়ে বিপুল প্রভাব-প্রতিপত্তি সাথে নিয়ে যে তান্ডব চালায় তার সাথে শেষ মুহুর্তে পল্টু কর্তৃক প্রতিমা ভাঙার প্রাক্কালে বদুর চোখে সেই প্রতিমার মুখাবয়বে তার প্রেয়সী ফাতেমার মুখচ্ছবি ভেসে উঠাটা একই সাথে আমাদের জন্য সমান অলৌকিক ও আশ্চর্যজনক ছিল ।
লৌকিক-অলৌকিকতার এই সমান্তরালে চলাটা যেনবা আমাদের চোখের সামনেই!
'দূরত্ব' গল্পে দুইজন ঘনিষ্ঠবন্ধুর মাঝে তাদের মাদ্রাসার শিক্ষাজীবনকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠা ধর্মীয় গোঁড়ামি ও সংকীর্ণতার কারণে পরবর্তীতে যে শারীরিক ও মানসিক দূরত্ব সৃষ্টি হয়, তারই আখ্যান বর্ণিত হয়েছে । যে আখ্যানে রয়েছে ধর্মীয় মতে আপাত ভিন্নতা থাকার কারণে সৃষ্ট বৃহত্তর গোষ্ঠীভিত্তিক মতাদর্শিক নানাবিধ সমস্যার কথা । যেগুলো নিতান্তই হাস্যকর !
'দোলায়িত জীবনের গান' ও ' একটি পুঁজিবাদী গল্প' তে প্রকাশ পেয়েছে যথাক্রমে নাগরিক জীবনের বিপুল রহস্যময়তা, প্রাত্যহিক জীবনের অনাহুত বিড়ম্বনা আর শ্রেণীবৈষম্যের কারণে সৃষ্টি হওয়া ভেদাভেদ এক রাখালের মনে কিভাবে বিরূপ প্রভাব ফেলে তারই ইতিবৃত্ত ।
'সূর্য না উঠা জনপদের গল্প' তে অসাধারণ ইঙ্গিময়তায় সামাজিক-রাষ্ট্রিক এক কঠিন সত্যকে রূপায়ণ করেছেন লেখক তাঁর অসামান্য গদ্যভঙ্গিতে ।
পাঠককে তিনি নিয়ে গেছেন বিপর্যয়গ্রস্থ এক পৃথিবীতে । যে পৃথিবীতে স্বপ্নঘোরগ্রস্থ মানুষেরা তাদের এই সংকটমুখর ক্লান্ত জীবনকে পাশ কাটিয়ে অনিন্দ্য সুন্দর এক স্বাভাবিক-মানবিক জীবন যাপন করতে চান ।
অদ্ভূত কোমল-মায়াময় এক অনুভূতি হয়েছিল 'যখন এসেছিলে' গল্পটি পড়ে । মন্ত্রমুগ্ধের মতো এক নাগাড়ে পড়ে শেষ করি পুরো গল্পটা । এই গল্প বাস্তবতাকে ছাপিয়ে লেখকের গভীর আখাঙ্ক্ষাকে মূর্ত করে তুলেছে প্রশ্নহীনভাবে!
এই বইয়ের অন্যসব গল্পের তুলনায় 'কুত্তা' গল্পটিকে অসম্পূর্ণ মনে হয়েছে । গল্পটিতে গ্লানিময় জীবনের একটা চিত্র পাওয়া যায় যদিও । তারপরও পড়ে তৃপ্তি পাইনি ।
বইয়ের নামগল্প 'একটি শোক সংবাদ' নিয়ে আলাদা একটা আগ্রহ ছিল । গল্পটিতে লেখক অন্যচোখে নির্মাণ করেছেন মৃত্যুবিষয়ক ধারণাকে । যা পড়ে ক্ষণিকের জন্য বিষাদগ্রস্থ হয়ে পড়ি ।
শেষকথা...
সমাজবাস্তবতার পাশাপাশি মানুষের বিচিত্র সব মনোভঙ্গি বহুমাত্রিকভাবে চিত্রিত হয়েছে এই বইয়ের গল্পগুলোতে । যাতে ক্রমশ দৃশ্যমান হয়েছে নানাবিধ সমস্যা-জর্জরিত তৃতীয় বিশ্বের একটি ক্ষুদ্রতম দেশের অন্ত্যজ মানুষদের ভাগ্যাহত, যন্ত্রণাদগ্ধ তীব্র সংকটময় বিপন্ন সব মনোভূবনের করুণ প্রতিচ্ছবি ।
বই সম্পর্কে ~
নাম - একটি শোক সংবাদ
লেখক - সাব্বির জাদিদ
প্রচ্ছদ - কাজী জুবাইর মাহমুদ
প্রকাশক - ঐতিহ্য
মূল্য - ১৫০ টাকা
©somewhere in net ltd.