![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
এখনও সন্ধ্যা হতে ঢের বাকি। বদরুল সাহেব অফিস থেকে আজ আগে আগে ফিরছেন, গলির মাথার আমগাছের ফাঁক দিয়ে গলে পড়া সূর্যের আভা তার পরচুলাতে প্রতিফলিত হয়ে চায়ের ঘন লিকারের মত রঙ সৃষ্টি করছে। বড় সাইজের কাঁচের চশমার ভেতর দিয়ে বদরুল সাহেবের চোখদুটো বড় ক্লান্ত দেখাচ্ছে। তার আঙুলে এক ডজন কলা রশি দিয়ে বাঁধা, হাঁটার সময় কলাগুলো নির্দিষ্ট তালে তালে দুলছে। বাসার সামনের গলিতে সাতচাড়া খেলছিল তার ছেলে বদিরুদ্দিন, কপাল কুঁচকে চিন্তিত ভঙ্গীতে যন্ত্রের মত হেঁটে হেঁটে অসময়ে পিতার বাড়ি ফেরা দেখে অজানা আশঙ্কায় কেঁপে উঠে বদিরুদ্দিনের ছোট্ট বুক। খেলার উত্তেজনাময় মুহূর্তকে বলি দিয়ে সোজা বাড়ির দিকে রওনা দেয় সে।
পিতা বাড়ির চৌকাঠ পেরোনর আগেই বদিরুদ্দিন হাতমুখ ধুয়ে বই খুলে বসেছে, দরজার অপরপাশে রান্না ঘরে তার মা কী যেন করছেন বিরক্ত মুখে, বাতাসে চায়ের সুবাস ছড়িয়েছে।
বদিরুদ্দিনের পড়ার টেবিলের পাশের চৌকিতে খালি গায়ে ঘুমাচ্ছিল ফজলু, প্রচণ্ড গরমে সারা গায়ে চিটচিট করছে ঘাম। তোষকের উষ্ণতায় গা জ্বালা করে। শেষমেশ উঠে গিয়ে প্যান্টটা পড়ে বাইরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করল সে। দরজা খোলাই ছিল, ভাবী ফজলুকে তৈরি হতে দেখে রান্নাঘর থেকে হাঁক দিলো, ‘ফজলু সাব আইজকা এট্টু পরে বাইর হন, আপনার ভাইজান আসতেছে আপনার লগে কী নিয়া জানি আলাপ করব।’
সাইজে ছোট হয়ে যাওয়া শার্টটির বোতাম লাগাতে গিয়ে ভাবীর কথা শুনে এক মুহূর্তের জন্য থমকে গেলো ফজলু, এরপর আবার বোতাম লাগানো শেষ করল।
ফজলু জানে তার বড়ভাই আজ কী নিয়ে কথা বলবেন। বড়ভাইয়ের সঙ্গে তার দেখা হয় খুব কম, যখন হয় তখন তারা গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করে। কখনও ফজলুর ডিগ্রি পরীক্ষা নিয়ে, কখনও বা বদরুল সাহেবের দূর সম্পর্কের ভায়রা ভাইয়ের পরিচিত কোন কোম্পানির চাকরি নিয়ে (যেখানে ট্রেনিং চলাকালীন থাকা-খাওয়া ফ্রি), কিন্তু কোনটাই ফলপ্রসূ হয় না।
আজকের ঘটনা একটু ভিন্ন, তবে গুরুত্ব সমান। গতকাল রাতে বদরুল সাহেব যখন ভাত না খেয়ে শুয়ে পড়েছিলেন, তার স্ত্রী যখন রান্নাঘরে বাসনকোসন গুছাতে ব্যস্ত ছিল, তখন পা টিপে টিপে ভাইজানের মশারি টাঙ্গানো খাটের পাশে গিয়ে ফজলু বলেছিল, ‘ভাইজান আমি বিয়ে করবো।’
এরপর অনেকক্ষণ ফ্যানের শব্দ ছাড়া কিছুই শোনা যায়নি, বাতি নিভানো থাকায় ভাইজান আদৌ শুনেছেন কীনা তাও বুঝতে পারেনি ফজলু। কয়েক মিনিট অপেক্ষা করে দরজার দিকে এগিয়ে যাওয়ার সময় ফজলুকে পেছন থেকে ডাক দেয় তার ভাইজান।
‘ফজলু, আজকে আমি খুব টায়ার্ড। কালকে এই ব্যাপারে কথা কমু। আজকে যা।’ চোখ বন্ধ করে কথাগুলো বলে পাশ ফেরে শোয় বদরুল সাহেব। পরচুলা ছাড়া অন্ধকারে তার টাকমাথা থেকে অন্যকেউ মনে হয়েছিল সেদিন ফজলুর।
‘ফজলু, এইখানে বস।’ হাত দিয়ে চৌকি দেখায় বদরুল সাহেব।
বদরুদ্দিনকে রুম থেকে বাইরে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে, তার পড়ার টেবিলের পাশের চেয়ারে এসে পা ছড়িয়ে বসেছেন বদরুল সাহেব। বইটা বন্ধ করে রুম থেকে যাওয়ার সময় নিজেকে অনেক ভারমুক্ত মনে হচ্ছিল বদরুদ্দিনের, সে কোন দোষ করেনি, আব্বার মেজাজ খারাপ ফজলু কাকার উপর।
ফজলু ভাইজানের দেখানো জায়গায় এসে বসলো। ভাইজানের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার সময় বরাবরই ভয়ে সিটিয়ে থাকে সে, কিন্তু আজ তার ভয় লাগছে না। ফজলুর ভয়গুলো যেন বাষ্প হয়ে এই ছোট্ট রুমের ভেতর ঘুরে বেড়াচ্ছে, গুমোট ভাবটা আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে, কিন্তু তার গায়ের স্পর্শ করতে পারছে না।
‘তুমি বিয়া করতে চাও, ভালো কথা। কিন্তু বউরে নিয়ে থাকবা কই, খাওয়াইবা কি, এগুলা কি ভাবছ? আমার ঘরে তো বউ নিয়া থাকতে পারবা না, তোমার ভাবী অ্যালাউ করবো না।’ একনাগাড়ে কথাগুলো বলে একটা সিগারেট ধরালেন বদরুল সাহেব।
অফিস থেকে ফিরে কাপড়চোপড় ছেড়ে ফ্যানের নিচে বসার পর খানিকটা সতেজ দেখাচ্ছে বদরুল সাহেবকে। তিনি বরাবরই শান্ত, এরপরও তার পুরো পরিবার তাকে ভয় পায়। দরজা ভেড়ানো ছিল, ফাঁক দিয়ে কাপ পিরিচ নিয়ে প্রবেশ করলেন তার স্ত্রী।
ফজলু অবাক হয়ে খেয়াল করল, আজকে তার জন্যেও গোপালি ফুল আঁকা কাঁচের কাপ পিরিচে চা আনা হয়েছে। এটায় সাধারণত মেহমানদের আপ্যায়ন করা হয়। ভাবী সসংকোচে বদরুদ্দিনের পড়ার টেবিলের উপর চায়ের কাপ দুটো রেখে চলে গেলেন।
‘নাও চা খাও, আর বল তোমার প্ল্যান কি?’ ধোঁয়া উঠা চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে প্রশ্ন করলেন ভাইজান। তার মোটা হাতের ফাঁকে ছোট্ট চায়ের কাপটা খেলনার মত লাগছে। প্রতিদিনের রুটিন অনুযায়ী খোলা কাঠের জানালা দিয়ে ধীরগতিতে এঁকেবেকে এগিয়ে আসে জেলেপাড়ার আঁশটে গন্ধ, সারা ঘরে নোনা স্বাদ ছড়িয়ে দিয়ে পাড়ি দেয় নতুন গন্তব্যে। আজ এই গন্ধও স্পর্শ করে না ফজলুর ইন্দ্রিয়কে।
ফজলুর কোন প্ল্যান নেই, সে জানে না স্ত্রীকে নিয়ে কই যাবে, এরপরও সে বিয়ে করতে চায়। এমন নয় যে তার হবু স্ত্রীর পরিবার থেকে বিয়ের চাপ দেয়া হচ্ছে, তারা চাইলে পরেও বিয়ে করতে পারত, কিন্তু তারা এখনই বিয়ে করতে চায়।
ফজলু কোন কথা না বলে চুপ করে রইল। মাথা নিচু করে চা খেতে থাকলো।
ভাইজান বললেন, ‘দেখো ফজলু, বিয়া করলে কইরো কিন্তু এট্টু সবুর করো। আগে একটা চাকরি পাইয়া লও, তারপর ভাড়া বাসায় উইঠা যাইও বই নিয়া। বয়স মাত্র বাইশ, এদ্দুরি বয়সে কোন ব্যাডায় বিয়া করে শুনি? এখনও তোমার বহুত টাইম আছে। মাইয়া চইলা গেলে যাক, আমি তোমারে বিয়া দিমু।’
ফজলু মিনমিন করে বলল, ‘না ভাইজান, আমি এখনই বিয়া করুম।’
খেলনা চায়ের কাপটা জোরে শব্দ করে পিরিচের উপর রেখে বদরুল সাহেব গর্জে উঠলেন, ‘তাইলে এক্ষুনি ঘর থিকা বাইর হইয়া যা হারামজাদা। তরে পালতাছি অহন তোর বউরেও পালুম, কাইল তোর পোলাপানও পালন লাগবো। এক্ষনি যা, বাইরে গিয়া যা খুশি কর, আর আইবি না এই ঘরে।’
ফজলু রোবটের মত মাথা নিচু করে সোজা বাইরের দিকে হাঁটা দিল।
রাস্তায় ঝিরিঝিরি বাতাস বইছে, গুমোট ভাবটা চলে গেছে। পাড়ার ছেলেদের সাতচাড়া খেলা জমে উঠেছে, বদরুদ্দিনকেও সেখানে দেখা গেলো। বামদিকে একাধারে বসানো টিনশেড বাড়িগুলোর পাশের গলিতে কয়েকজন মহিলা দাঁড়িয়ে গল্প করছে, হঠাৎ শোনা গেল অজানা কারণে তাদের সম্মিলিত হাসি।
করিম সাহেবের কিশোরী মেয়েটি তার ছোটবোনকে নিয়ে রাস্তার এক পাশে দাঁড়িয়ে সাতছাড়া খেলা দেখছে। তার পড়নের ফ্রকের ভেতর দিয়ে দেখা যায় ছোট ছোট বাড়ন্ত স্তনের আভাস, চোখে এখনও শিশুসুলভ সারল্য। সাতচাড়া খেলার প্রবল আগ্রহে সে বারবার অংশগ্রহণ করতে চাইছে, কিন্তু কোন মেয়েকে নিতে রাজি নয় ছেলেগুলো।
ফজলু হাঁটছে, গলি পেরিয়ে এখন রাস্তায়। দুপাশে সবুজ গাছের ছায়াঘেরা পিচঢালা পথে সাই সাই করে চলে যাচ্ছে পিকআপগুলো। পিকআপের পেছনে টুকরিতে রাখা রুপালি রঙের শত শত মাছ গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে সূর্যের আলোর সঙ্গে লুকোচুরি খেলতে খেলতে যায়। তাদের সবার গন্তব্য আছে, ফজলু বেরিয়েছে নতুন গন্তব্যের খোঁজে।
ফজলু রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে যখন বন্দরে এসে পৌঁছাল, ততক্ষণে আকাশ মেঘে ঢেকে গেছে। ঝলমলে বিকেল যেন মুহূর্তের মধ্যে রঙ পাল্টে ধূসর হয়ে গেল, উত্তুরে বাতাসে ঝড়ের আশঙ্কা। বন্দরের বেশিরভাগ মাছ ধরার নৌকা বেঁধে রেখে জেলেরা বাড়ি চলে গেছে, কয়েকজন তড়িঘড়ি করে বাড়ি ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছে। তাদের নৌকার পাটাতনে বাঁধা ছোট্ট লাল পতাকাগুলো বাতাসের তীব্রতা জানান দেয়, ডিঙ্গি নৌকাগুলো দোল খায় জোরে জোরে। দূরে কোথাও সাইরেন বাজছে, বেজেই চলেছে।
বন্দরের কাঠের পাটাতন ধরে এলোমেলো পায়ে হাঁটা দিল ফজলু, আকাশে মেঘের গর্জন। বাতাসটা বড় ভাল লাগছে, আরও হালকা মনে হচ্ছে নিজেকে। সারিবদ্ধ জেলে নৌকাগুলো পার করে কিছুদূর গিয়ে ফজলু পাটাতনের এক পাশে পা ঝুলিয়ে বসে পড়ল। সবাই বাড়ি ফিরে যাচ্ছে, সে বাড়ি থেকে সবেমাত্র বের হয়ে এসেছে, তার কোন তাড়া নেই।
পাশেই এক জেলে নৌকা বেঁধে পাটাতনে পা রাখল, ঝুড়ি ভর্তি কালচে কাঁকড়া উঠিয়ে আনলো নৌকা থেকে, কাঁকড়াগুলো এখনও নড়ছে। তাকে এভাবে বসে থাকতে দেখে জেলেটি বলে গেল জলদি কোন বাড়ির ভেতর ঢুকতে, অনেক বৃষ্টি নাকি হবে আজ। তিন নম্বর বিপদ সংকেত দিয়েছে।
ফজলু যেন শুনেও শুনলো না। দিগন্ত বিস্তৃত পানির দিকে তাকিয়ে থাকলো শূন্য দৃষ্টিতে, আকাশ এবং পানি দুটোর রঙই এখন ধূসর।
বাতাস ধীরে ধীরে বাড়তে শুরু করল, শীত লাগছে।
হাফহাতা সুতির শার্টের ভেতর দিয়ে ফিনফিনে বাতাস অদ্ভুত রকমের শিহরণ জাগাচ্ছে।
আকাশে তখন অস্তগামী সূর্যের লাল আভাকে সরিয়ে চলছে ধূসর কালো মেঘের জায়গা দখলের লড়াই। আবির রাঙা দিগন্তের দিকে তাকিয়ে প্রেমিকার কপালের সিঁদুরের কথা মনে করার চেষ্টা করে ফজলু। মেয়েটি বলে, মাঝে মাঝে যখন বাড়িতে কেউ থাকে না, তখন মায়ের সিঁদুরের কৌটা থেকে চুরি করে ফজলুর নাম নিয়ে সিঁদুর পড়ে সে। ছোট্ট আয়নায় নিজেকে দেখে নাকি বিবাহিত নারী মনে হয় তার।
ফজলুর ইচ্ছা হল মেয়েটিকে ঘর থেকে নিয়ে এসে এখানে বসে থাকতে, ঝড় শুরু হলে রাতটা নাহয় কোন নৌকার ভেতর কাটানো যায়। জেলেরা তো আজ আর ফিরবে না, ঝড়কে তারা অন্যভাবে ভয় পায়। বাইরে চলবে ঝড়ের তান্ডব, দোল খাওয়া নৌকার কেরসিনের চুলায় ভাত ফুটবে, ঠান্ডা হাওয়ায় একেঅপরের মাঝে উষ্ণতা খুঁজবে দুই মানব-মানবী।
হঠাৎ ফজলু আবিষ্কার করল সে একা নয়।
তার পাশে এসে বসেছে পেটমোটা এক বুড়ো লোক। কান পর্যন্ত ছড়ানো তার চুলগুলো সব ধবধবে সাদা, চোখে পুরু ফ্রেমের কালো চশমা, পড়নে হাফহাতা সাদা চেক শার্ট এবং খাকি প্যান্ট।
তাকে দেখে মনে হচ্ছে অনেকক্ষণ ধরেই বসে আছে, কিন্তু ফজলু এতক্ষণ টের পায়নি।
‘তুমি বিয়ে করতে চাও?’
লোকটার প্রশ্নে ফজলু চমকে উঠলো, এই লোক কিভাবে জানে? সে কি আমাকে চিনে? আমি তো তাকে চিনি না।
তার চমকে উঠা দেখে মুচকি হেসে লোকটি বলল, ‘আমিও তোমার বয়সে থাকতে বিয়ে করেছিলাম। তখন আমার কিছুই ছিল না, বাবা-মায়ের বাড়ি থেকে বের হয়ে এসে বন্দরে কাজ নেই, জাহাজে মাল তোলার কাজ। এখানেই একটি বাড়িতে স্ত্রীকে নিয়ে আমি থেকেছি প্রায় ৪০ বছর।’
ফজলু কোন উত্তর দিলো না।
‘তোমাকে দেখে আমার নিজের কথা মনে পড়ে গেল, তাই জিজ্ঞেস করলাম।’
বাতাসে লোকটির সাদা চুল উড়ছে, ঝড় ধেয়ে আসছে উপকূলে।
‘সেই ছোট্ট বাড়িটিতে আমরা এখন আর থাকি না।’ বলে চলল লোকটি।
‘কিন্তু বাড়িটা বিক্রি করার মানুষও পাচ্ছি না। এখানকার জেলে পরিবারগুলো এত ছোট ঘরে থাকতে চায় না। অবশ্য ঘর ছোট হলেও চালিয়ে নেয়া যায়, এমন কত টর্নেডো সহ্য করল আমাদের ছোট্ট বাড়িটা।’
উঁচু ঢেউ এসে ফজলুর ঝুলানো পা ভিজিয়ে দিয়ে গেল।
শান্তস্বরে ফজলু বলল, ‘কিন্তু আমার কাছে কোন টাকা নেই, আমি তো বাড়ির দাম দিতে পারবো না। ভাড়াও না।’
‘বাড়িটা এত ছোট আর পুরনো, এই আমলে এসে তোমার কাছ থেকে কতখানি টাকা নিবো এই বাড়ির জন্য, আমি নিজেও জানি না। আমি এখন এটা বিনামূল্যে কাউকে দিয়ে দিতে চাই। এমন কাউকে যে যত্ন করতে পারবে, এতে আমার এবং আমার স্ত্রীর অনেক স্মৃতিবিজড়িত আছে। একে জেলেদের মদ-জুয়ার আড্ডা হতে দিতে চাই না, এই আর কী।’
ফজলু বুঝতে পারছে না কী বলবে।
ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছে এক ঘণ্টাও হল না, এখনই তাকে বিনামূল্যে বাড়ি সাধছে এক বুড়ো। সবকিছু স্বপ্ন স্বপ্ন মনে হচ্ছে।
‘দেখবে নাকি? চল দেখাই তোমাকে। এই ঝড়ের মধ্যে এখানে বসে থেকে মরবে তো।’ লোকটি ব্যস্ত ভঙ্গীতে উঠে দাঁড়ালো।
ফজলুও উঠে তার পেছন পেছন হাঁটা দিল, ঘোর লাগা নেশাগ্রস্ত মানুষের মত করে। এরই মধ্যে সন্ধ্যা নেমে গেছে, বাতাসে শোঁ শোঁ শব্দ।
বেশিদূর হাঁটা লাগলো না, একটু পরেই দেখা গেল বাড়িটা। বন্দরের পাশের রাস্তায় অনেকগুলো বাঁশঝাড়ের মাঝে দাঁড়িয়ে আছে ছোট্ট একটি কাঠের বাড়ি, অনেক আগে করা সাদা রঙ এখন মলিন হয়ে লালচে ভাব সৃষ্টি করেছে। বাড়িটা একেবারে উপকূলের পাশে, পেছনে সমুদ্র দেখা যায়।
লোকটা পুরনো জং ধরা তালা খুলে ফজলুকে নিয়ে ভেতরে ঢুকল, ঢুকেই বোঝা গেল বাড়িতে অনেকদিন ধরে কারও প্রবেশ নেই। ঘরের ভেতর পুরনো কাঠের স্যাঁতস্যাঁতে গন্ধ গুমোট ভাব সৃষ্টি করেছে। আকাশে বিদ্যুতের ঝলকানি বেড়েছে, শোনা যাচ্ছে মেঘের গর্জন। বাড়ির ভেতর ঢুকলে ছোট একটি রুম, মাথার উপর কম পাওয়ারের হলদে বাতি ঝুলছে, বাতাসের তোপে মনে হচ্ছে তার ছিঁড়ে পড়েই যাবে।
লোকটা ফজলুকে বসতে বলে ভেতরে গেল। কিন্তু ঘরে কোন আসবাবপত্র নেই, শুধু এক কোনায় প্লাস্টিকের একটা পিঁড়ির মত আসন দেখা যাচ্ছে। টকটকে লাল জিনিসটা কোন মেয়ের হাতের পার্সের মত, তাও আবার লিপস্টিক লাগানো কোন বড় ঠোঁটের মত। এই পুরনো ধূসর কাঠের বাড়িতে বড় বেমানান, আবছা আলোতেও জ্বলজ্বল করছে। কিছু না পেয়ে ফজলু লাল ঠোঁটের উপরেই বসে থাকল, মনে হল তার পাছায় চুমু খাচ্ছে রাঙা ঠোঁটের কোন অচেনা নারী। অস্বস্তি ঘিরে ধরল তাকে।
লোকটা ভেতর থেকে একটা হারিকেন আর ম্যাচ এনে রাখলো সামনে, তাকে দেখে খুব উৎসাহী মনে হচ্ছে।
‘এমন ঝড়ের দিনে যেকোনো সময় বিদ্যুৎ চলে যায়, তাই আগে থেকে ব্যবস্থা করে রাখা ভালো।’ হারিকেন আর ম্যাচটা মেঝেতে রাখলো লোকটা। আবার ঘরের ভেতর গিয়ে কী কেন করতে শুরু করল ব্যস্ত ভঙ্গীতে, ফজলু চুপচাপ বসে বসে চুমু খেয়ে যাচ্ছে। কয়েক সেকেন্ড নীরবতার পর ফজলুর মনে হল বাড়িটা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা দরকার।
লোকটি হাত থেকে ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তে মুখে উজ্জ্বল হাসি নিয়ে ফজলুর কাছে ফিরে এসে বলল, ‘তাহলে তো তুমি বাড়িটা নিচ্ছ?’
ফজলু কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু সে মুখ খোলার আগেই বিকট শব্দে বাজ পড়ল, কারেন্ট চলে গেল। ঘরের ভেতর এখন কালিগোলা অন্ধকার, বিদ্যুতের ঝলকানিতে মাঝে মাঝে কিছুটা দেখা যাচ্ছে।
‘চল, অন্ধকারে এখানে থেকে কী হবে। আমরা বরং মিষ্টি কিনে এই সময়টুকু উদযাপন করি। আমার ঘরটা ভাল কাউকে দেয়া গেলো, আর তুমিও একটা বাড়ি পেলে বউ তোলার জন্য।’ ফজলুকে কোন কথা বলতে না দিয়ে হাত ধরে টেনে বাইরে নিয়ে এলো লোকটি।
বৃষ্টি একটু একটু পড়া শুরু হয়েছে। ঘড়ির কাঁটায় এখনও সন্ধ্যা নামেনি, কিন্তু সবকিছু কেমন যেন অপার্থিব করে তুলেছে এই ঝড়। উপকূলের ঢেউগুলোর তেজ এখন অনেক বেশি। বাড়ি থেকে বের হয়ে বাঁশঝাড়ের দিকের মেটে রাস্তা ধরে হাঁটা দিলো দুই প্রজন্মের দুই পুরুষ।
‘বুঝলে, আমি তোমার বয়সে থাকতে বেশ কয়েক বছর জাহাজে মাল তোলার কাজ করেছি। পরে এক জাহাজে নাবিকের চাকরি পাই, জাহাজটা তখন একদম নতুন। সেই জাহাজেই পার করেছি বাকি জীবন, সাগরের যে কত রূপ দেখলাম।’ লোকটা একাই সব কথা বলে।
‘আমাদের সংসার ভাল চলছিল, শুধু একটাই দুঃখ, আমাদের কোন ছেলেমেয়ে হয়নি। তাই জীবনের বেশিরভাগ সময় ঐ ছোট্ট বাড়িতেই কাটিয়ে দিয়েছি, বড় বাড়ি নিয়ে কি করবো? দুজন মানুষ আমরা। এখন রিটায়ার করার পর স্ত্রী বলল, নতুন কোন বাড়িতে উঠবে। ছোট হোক, তাও যেন নতুন হয়। সারাজীবন তার সব সাধ পূরণ করেছি, এই সাধটা অপূর্ণ রাখি কি করে? তাই নতুন বাড়িতে উঠে গেলাম।’ বলে চলছে লোকটা।
বাঁশঝাড় পেরিয়ে মেইন রাস্তায় পা রাখতেই কোত্থেকে যেন দৌড়ে এলো কয়েকটি বাচ্চা ছেলে। ‘দাদু আজকে মিষ্টি আনবে! দাদু আজকে মিষ্টি আনবে!’ বলে লোকটিকে ঘিরে ধরল তারা, যেন দাদুর মিষ্টি আনার ব্যাপারটি আগে থেকেই জানতো। স্কুল ড্রেস পড়া ছেলেগুলো, শার্টের ইন খুলে রেখেছে, গায়ে মাটি-কাদা লাগানো।
‘হ্যাঁ হ্যাঁ আমি মিষ্টি আনতেই যাচ্ছি, চল আমার সঙ্গে তোরা।’ বলল লোকটা। পেছন ফিরে ফজলুর দিকে তাকিয়ে সে বলল, ‘আমার স্ত্রী সেন্ট জুডসে পড়াত, রিটায়ার করেছে গত বছর। তারই ছাত্র এরা।’
ফজলু শুনে যাচ্ছে। হঠাৎ খেয়াল হল, লোকটির নাম জানা হয়নি। কিন্তু এখন জিজ্ঞেস করতে আলসেমি লাগছে, বাড়িতে উঠার সময় তো নাম জানাই যাবে, এত তাড়া কিসের।
কিছুদূর এসে লোকটি থেমে গিয়ে ফজলুকে বলল, ‘আমার একটু বাসায় যাওয়া লাগবে, টাকা আনতে ভুলে গেছি। বুড়ো হয়ে গেছি তো, এখন কিছু মনে থাকে না। স্ত্রীর কাছ থেকে টাকা নিয়ে আসি, তুমি একটু দাঁড়াও।’
ফজলু মন্ত্রমুগ্ধের মত নির্বিকারভাবে মাথা ঝাঁকালো। লোকটা আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথ বেয়ে সোজা নিচে নেমে গেল। রাস্তার পাশে অগভীর খাদ, নিচে একটি কাঠের বাড়ি দেখা যাচ্ছে। ছোট্ট বাড়ির চারপাশে শুধু সবুজ আর সবুজ, বন্ধ জানালার ফাঁক গলে চুইয়ে পড়ছে হলদে আলো। এদিকটায় বসতি নেই বললেই চলে, পাহাড় কেটে দুএকটা কুঁড়ে বানানো। বর্ষার সময় ঢল নামে বলে এদিকে ঘর তুলতে ভয় পায় লোকে।
এক মিনিটের মধ্যেই ব্যস্ত ভঙ্গীতে পেটটা দুলিয়ে দুলিয়ে হেঁটে আসতে দেখা গেল লোকটিকে। বিকট শব্দে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে একটু পরপর, রাস্তায় কেউ নেই। সব ঘরবাড়ির জানালা বন্ধ, দোকানপাট বন্ধ, বিদ্যুৎ নেই তাই ল্যাম্পপোস্টের আলোও জ্বলছে না। অদ্ভুত রকমের নীল এবং ধূসর আলো এখন আকাশে, সবকিছু আবছা দেখা যায়।
পাহাড়ের ঢাল বেয়ে হাঁটছে ফজলু, বৃদ্ধ এবং একদল স্কুলড্রেস পড়া বাচ্চা ছেলে, রাস্তায় আর কোন জনমানব নেই। কিছুক্ষণ পর মোড়ের একটি দোকানে এসে থামল তারা। ততক্ষণে মুষলধারে বৃষ্টি নেমেছে। বৃষ্টি শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাচ্চাগুলো তুমুল উৎসাহে নাচতে লাগলো। লোকটা দোকানের ভেতর ঢুকল। ফজলু বাইরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে, বৃষ্টিটা ভাল লাগছে।
ছোট্ট পুরনো একটি মিষ্টির দোকান। দোকানের ভেতর সামনে ইজিচেয়ারে বসে পেয়ালাতে চা পান করছে এক থুত্থুড়ি বুড়ি, তার প্রাচীন চোখে ঘোলাটে দৃষ্টি। পড়নে ফ্লানেলের হালকা রঙের নাইটগাউন, কোঁকড়ানো চুল সব পেকে সাদা, গলার রগগুলো দৃশ্যমান, ইজিচেয়ারে বসে পা দুটো ঝুলছে তার। তাকে দেখে বিদেশিনী মনে হয়। বৃষ্টির ঝাপটা এসে লাগছে বৃদ্ধার মুখে, তার কোন ভ্রূক্ষেপ নেই।
দোকানের এক কোণায় দাঁড়িয়ে কাপড় ইস্ত্রি করছে অসম্ভব রুগ্ন ফর্সা এক বুস। তার মুখে মোটা চুরুট, ভক ভক করে ধোঁয়া বের হচ্ছে। খোঁচা খোঁচা সাদা দাঁড়িওয়ালা মুখ, মাথায় চে গুয়েভারার টুপি সামনের দিকে বাঁকানো, পড়নে পাতলা একটা মলিন সাদা স্যান্ডো গেঞ্জি আর জলপাই রঙের প্যান্ট। তার পেছনে কাঠের শোকেসে সুইস রোল এবং সাদা রঙ্গের নাম না জানা কেক দেখা যাচ্ছে। পুরনো একটা রেডিও বাজছে, তাতে কেনেডির ভাষণ শোনা যায়। কেনেডির ভাষণ এখন কেন শোনা যায়? এটা কত সাল?
কেনেডির ভাষণ শুনতে শুনতে হঠাৎ ফজলুর মনে হল সে পার্ল হারবার দ্বীপে পৌঁছে গেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে, তবে জাপানিদের অ্যাটাক এখনও হয়নি, কাল পরশুর মধ্যেই হবে। পার্ল হারবারের এক পানশালায় সাদা সাদা পোশাক পড়া মার্কিন নাবিক আর তাদের নার্স প্রেমিকাদের উদ্দাম জ্যাজ নৃত্য চলছে। বাইরের বৃষ্টি, হাড় কাঁপানো ঠান্ডা তাদের সরগরম সন্ধ্যায় কোন প্রভাব ফেলছে না।
হুইস্কির কড়া গন্ধ, সিগারেটের ধোঁয়া আর তপ্ত হতে থাকা স্যাক্সোফোনের হইচইয়ের মাঝে উঁকি মারছে শাঁখা সিঁদুর পড়া এক তরুণী মেয়ে, ঘোমটা টেনে করুণ দৃষ্টিতে অপেক্ষা করছে ফজলুর………সেন্ট জুডস না পাঁচ বছর আগে বন্ধ হয়ে গেছে?
‘ঐ মিয়া, ঐ!’ কনুইতে ঝাঁকি লাগার পর ফজলুর চমক ভাঙল। অবাক হয়ে নিজেকে দোকানের ভেতর আবিষ্কার করল সে।
‘কি চান আপনি? ভ্যান্দার মত দাঁড়ায় আছেন, কিছু কিনবেন নাকি না?’ বিরক্ত ভঙ্গীতে ফজলুকে জিজ্ঞেস করছে চুরুট খাওয়া বুড়ো।
ফজলু বুঝতে পারছে না সে দোকানের ভেতর কখন এলো, সে তো বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল। চারপাশে তাকাল, সেই লোকটিকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। ইজিচেয়ারে বসে এখনও পা ঝুলিয়ে ঝুলিয়ে চা খাচ্ছে বৃদ্ধা। মনে হচ্ছে সবকিছু ঘোর লাগানো, বৃদ্ধার দৃষ্টির মতই সব ঘোলাটে।
ফজলু বুড়োর কথার উত্তর না দিয়ে বাইরে চলে এল। ঐ বাচ্চাগুলো কোথায়? দাদুর সঙ্গে মিষ্টি খেতে যারা এসেছিল?
মুষলধারে বৃষ্টি পড়ছে, আবছা অন্ধকার। বিদ্যুৎ ঝলকানিতে ছেলেটি দেখল, যেখানে বাচ্চাগুলো দাঁড়িয়ে ছিল সেখানে ৪-৫টা কুকুরছানা খেলা করছে। ছোট্ট ছোট্ট কুকুরছানা, তুমুল বৃষ্টির মধ্যে রাস্তায় জমা পানির উপর দৌড়ে বেড়াচ্ছে। আশেপাশে কোথাও মা কুকুরের চিহ্ন নেই। কেমন যেন অদ্ভুত সব, হিসাব মেলে না কোথায় যেন।
ফজলু রাস্তা ধরে সেই কাঠের বাড়ির দিকে হাঁটা দিল। কেন জানি তার সবকিছু ভাল লাগছে, এই বৃষ্টি, অচেনা একটা লোক, পাঁচ বছর আগে বন্ধ হয়ে যাওয়া সেন্ট জুডসের কয়েকজন ছাত্র, মিষ্টির দোকান, কাঠের বাড়ি, সবকিছু ভাল লাগছে। বৃষ্টি আর বাতাসের তোপে বাড়ির দরজাটা একবার বন্ধ হচ্ছে একবার খুলছে, ভেতরটা অন্ধকার। লোকটা দরজায় তালা দেয়নি আর। ফজলু ঘরের ভেতর ঢুকল, হারিকেন জ্বালাল। হারিকেনের হলদে আলোতে জ্বলজ্বল করে উঠলো অচেনা মহিলার লাল টুকটুকে ঠোঁটের মত পিঁড়িটা। হারিকেন নিয়ে ফজলু সোজা রান্নাঘরে চলে এলো।
ফজলু স্টোভের চুলায় লোহার কেটলিতে চা বসালো, দুটো কাঁচের পেয়ালা বের করল শেলফ থেকে। ফজলু আগে কখনও এই বাড়িতে আসেনি, কিন্তু কেন যেন তার মনে হচ্ছে সেই এই বাড়ির সবকিছু চিনে। অনেক বছরের পরিচিত সব। সোনালি কারুকাজ করা চায়ের কাপগুলো লন্ডন থেকে আসা জাহাজ থেকে কেনা হয়েছিল, অনেক দাম ছিল সেটটার। বউ খুব যত্ন করে রাখত এগুলো—দেখে যেন নস্টালজিয়া হচ্ছে ফজলুর।
এক প্রকার ঘোরের মধ্যে সে দুটো পেয়ালাতে চা ঢালল। সামনের রুমটায় কোনাকুনি করে দুটো আরাম কেদারা রাখা, জানালার দিকে ফিরিয়ে। বড় জানালা দিয়ে দেখা যায় ঝড়ে উত্তাল সমুদ্র আর আকাশের আঁকাবাঁকা বিদ্যুৎ রেখা। চেয়ারের সামনে ছোট্ট টেবিলে পেয়ালা দুটো রেখে আরাম করে বসলো সে, বৃষ্টিতে ভেজা পোশাকে শীত শীত লাগছে। হারিকেন নেভানোর পর কালিগোলা অন্ধকার পেয়ে বসলো তাকে।
হঠাৎ বিকট শব্দে বাজ পড়ল, এক সেকেন্ড পরে বিদ্যুতের ঝলক। সেই আলোতে দেখা গেল ফজলুর পাশের চেয়ারে বসে আছে সেই লোকটা, হাতে আরেকটি চায়ের পেয়ালা।
লোকটা বলল, ‘বাড়ি পছন্দ হয়েছে? এবার ঘরে বউ নিয়ে এসো।’
আরও একটি বাজ পড়ল।
©somewhere in net ltd.