![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
‘শাক মুঠা কত?’
ব্যস্ত দোকানিকে দাম জিজ্ঞেস করছে মধ্যবয়স্ক লোকটা। তার ডানহাতে ডিমের ঠোঙা। সবেমাত্র ইফতার শেষ হয়েছে, বাজারে ভিড় বাড়ছে।
এক পশলা বৃষ্টি শেষে নতুন করে মেঘ সাজাচ্ছে সন্ধ্যার কালো আকাশ।
‘এক দাম দশ টাকা।’ হাতের তালু দেখিয়ে দোকানির সাফ জবাব।
এক আঁটি পালং শাক হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখল লোকটা। আঁটির ভেতরে চুপ করে শুয়ে থাকা বিছাটি অস্বস্তিতে পড়ল।
‘দুই মুঠা পনেরো টাকায় দিয়ে দাও।’
বিক্রেতা আর দামাদামি না করে দুই আঁটি পালং শাক রশি দিয়ে বেঁধে দিলো। পাঁচ টাকার জন্য ঝগড়া করার সময় এখন নাই, আরও কাস্টমার আসতেছে।
এক হাতে ডিমের ঠোঙা আর আরেক হাতে রশি বাঁধা শাক নিয়ে মধ্যবয়স্ক লোকটা হাঁটা দিল বাড়ির উদ্দেশ্যে। গলির মাথায় বসে থাকা রিকশার চাকার সঙ্গে ধাক্কা লেগে খানিকটা কাদা লাগলো তার প্যান্টে, মেজাজ খিঁচড়ে গেল। সেদিন মাত্র বায়তুল মোকাররমের ফুটপাত থেকে কেনা হয়েছে প্যান্টটা। বাড়ি গিয়ে কাদার জায়গাটি ধুতে হবে, স্ত্রীকে বলা যাবে না, আজকাল পত্নীর মেজাজ সারাক্ষণই চড়ে থাকে।
এর মধ্যে আঁটি ভেতরের বিছাটি বের হওয়ার চেষ্টা করে আরও একবার ব্যর্থ হল।
বাড়ির সামনের চায়ের দোকানে কিছু লোকের জটলা দেখা যায়। গেটের কাছে যেতে না যেতেই পেছন থেকে একজন ডেকে থামাল লোকটাকে।
‘দাদা, কি খবর আপনার? ইদানীং দেখা যায়না আপনাকে।’
‘এই তো বেঁচে আছি আর কী।’
লোকটার মুখে ভদ্রতাসূচক হাসি, ল্যাম্পপোস্টের সাদা আলোয় মুখের খোঁচা খোঁচা পাকা দাড়ি চকচক করে। কপালে আবারও ঘাম জমতে শুরু করেছে।
‘পরিবার ভালো আছে? ছেলেটা কি করে? চাকরি বাকরি কিছু ধরেছে?’
‘না রে ভাই, এখনও কিছু করে না। কী যে করবো ছেলেটাকে নিয়ে।’ চোখের দৃষ্টিতে অসহায়ত্ব লুকানোর বৃথা চেষ্টা করে মধ্যবয়স্ক। অল্প কথায় বিদায় নিতে চায়।
‘আর মেয়েটা? ওর পড়াশুনা শেষ?’ চায়ে চুমুক দিয়ে নড়েচড়ে দাঁড়ায় আগন্তুক, তার গল্প করার ইচ্ছা।
চোখ নামিয়ে মাথা নেড়ে লোকটা বলে, ‘এই তো পড়াশুনা প্রায় শেষ। পাশাপাশি একটি চাকরি করছে।’
আগন্তুক—‘তা, মেয়েকে বিয়ে দিবেন কবে? বয়স তো কম হল না।’
চশমার উপরের ফাঁক দিয়ে আগন্তুকের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দেখা যায়, আরেকবার চায়ে চুমুক।
লোকটা--‘হ্যাঁ ভাই দেখি, নিজে একটু সোজা হয়ে নেই। সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছি, মেয়ে বিয়ে দিতে খরচ তো কম লাগে না।’
আগন্তুক—‘সেটা তো বুঝলাম ভাই, কিন্তু মেয়ে কি ঘরে বসিয়ে রাখবেন নাকি? বিয়ে তো দিতে হবে তাইনা? শুনেন, আমার বড় ভাইয়ের ছেলেটা আমেরিকা থাকে, অনেক বড় রেস্তোরাঁয় চাকরি করে। লাখ টাকা বেতন। গ্রামের বাড়িতে ঘর তুলেছে তো ও-ই, গতবছর বাপ-মায়রে ঘুরায় আনলো আমেরিকা। এক সপ্তাহ আগে দেশে আসছে মেয়ে দেখতে, বিয়া করবে। দেখবেন নাকি?’
একটানা কথাগুলো বলে আগন্তুক।
মধ্যবয়স্ক লোকটার হাতের ঝুলন্ত শাকের আঁটি থেকে খানিকটা মুখ বের করে নিচে তাকায় বিছাটি। মাটি থেকে দূরত্ব অনেক বেশি, লাফ দেয়ার সাহস নেই। ছোট্ট শরীরে ঢেউ খেলিয়ে সে ফিরে যায় শাকের ডাঁটার স্যাঁতস্যাঁতে অন্ধকারে।
মাথায় নানা ভাবনা খেলা করছে।
‘সুধিরদার ছেলে? হ্যাঁ চিনি তো। ছোটবেলায় কত দেখছি... (কিছুক্ষণ ভেবে) আচ্ছা দেখা যায়। কিন্তু ভাই মেয়ে তো বিয়ার নামই শুনতে চায় না। ছেলে বাড়ি আইসা দেখতে চাইলে সে আবার কী কান্ড করবে ঠিক নাই। এর চেয়ে বরং কোন অনুষ্ঠানে দুজনের দেখা করায় দেই। কি বলেন?’
‘ভালো কথা।’ গম্ভীর ভঙ্গীতে মাথা নেড়ে ঠোঁট দুটো চোখা করে এক টানে বাকি চা টুকু শেষ করে আগন্তুক।
কাপটা দোকানে রেখে মানিব্যাগ বের করতে করতে বলে,
‘তা এই শুক্রবার অমলের মেয়ের বিয়েতে আসতেছেন তো? মেয়েকে নিয়ে আসেন, দেখা হোক।’
লোকটা—‘আচ্ছা তাই হবে। সুধিরদাকে আমার নমস্কার দিয়েন।’
সে চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়ায়, আগন্তুক থামায়।
চায়ের দাম মিটিয়ে দোকানের ভিড় থেকে খানিকটা সরে আসে আগন্তুক, ইশারা দিয়ে ডাকে মধ্যবয়স্ককে।
ল্যাম্পপোস্টের খাম্বার পাশে দাঁড়িয়ে নিচুগলায় জিজ্ঞেস করে,
‘আপনার মেয়ের হাইট কত? সুধিরদার ছেলে কিন্তু বেশ লম্বা।’
আগন্তুকের কথা শেষ হতে না হতেই হাত নেড়ে মাথা নেড়ে তাকে আশস্ত করে লোকটা, ‘আরে হ্যাঁ ভাই, আমার মেয়ে তো অনেক টল। পাঁচ ফিটের বেশি।’
কী যেন ভাবতে ভাবতে মাথা নাড়ে আগন্তুক। ভাগ্য নির্ধারক আংটি পড়া ডান হাতের আঙুলগুলো কর্তার কাঁধে রেখে চশমার ফাঁক দিয়ে আগন্তুক প্রশ্ন করে,
‘দাদা কিছু মনে করবেন না, শুনছি মেয়ের নাকি সামনের দাঁত একটু উঁচু? খুব বেশি নাকি?’
আবছা আলোতে চকচক করে আগন্তুকের ফর্সা তেলতেলে মুখ। মোচের ফাঁক দিয়ে অদ্ভুত হাসি হাসে আগন্তুক।
অসহায়ের মত দ্রুত মাথা নাড়ে মধ্যবয়স্ক, ‘না না কী যে বলেন। আমার মেয়েকে আপনি দেখছেন না? কত সুন্দরী মেয়ে আমার। নিজের মেয়ে দেখে বড়াই করতেছি না, সবাই বলে।’
আগন্তুকের কণ্ঠ আরও নিচু হয়ে যায়, ‘হ্যাঁ তা অবশ্য ঠিক। আপনার মেয়েকে অফিস থেকে আসার পথে দেখি মাঝে মাঝে। অনেক রাত করে ফিরে মনে হয়, তাইনা? রাস্তাঘাট তো ভালো না। সাবধানে চলতে বলবেন। সুন্দরী মেয়েছেলে।’
সিগারেট ধরায় আগন্তুক। টিপটিপ বৃষ্টি শুরু হয়েছে, সিগারেট ভিজে যাওয়ার আশঙ্কায় দ্রুত টান দেয় সে।
‘তা তো বটেই। কিন্তু আমার মেয়ে অনেক ভদ্র। অফিস ছুটির পর সোজা বাসায় ফিরে, রাস্তায় যতটুকু সময় লাগে আর কী।’
তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে দীর্ঘশ্বাস ফেলে আগন্তুক বলে, ‘হ্যাঁ, এখন মেয়ের চাকরি না কইরাই বা উপায় কি? ছেলে তো কিছু করে না। আপনি বুড়ামানুষ একা আর কত টানবেন। ছেলেটাকে এবার একটু কাজে লাগান দাদা…’
কাদামাটি মাখা তিনশ টাকার স্যান্ডেল সু’র দিকে তাকিয়ে আগন্তুকের কথার জবাব খুঁজছিল মধ্যবয়স্ক। এমন সময় জোরে বৃষ্টি নামল। যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল সে। এবার আর দেরি না করে যার যার গন্তব্যে ছুটল দুজন।
চারতলার সিঁড়ি ভেঙ্গে উঠে লোকটা কিছুক্ষণ জিরিয়ে নেয়, বাইরে তুমুল বৃষ্টির শব্দ শোনা যায়। কলিংবেল বাজিয়ে অপেক্ষা চলে দরজার বাইরে। বৃষ্টি আসলেই মনে পরে রান্নাঘরের উপরের চালটা ঠিক করানোর কথা, অন্যসময় মনেই থাকে না। দূর থেকে স্ত্রীর গলা শোনা যায়, হাতে চাবির ঝনঝন বৃষ্টির শব্দকে ছাপিয়ে আরও কাছে আসে। ব্যস্ত ভঙ্গীতে কী যেন বলতে বলতে দরজা খোলে স্ত্রী।
চাবির গোছা গেটের তালার সঙ্গে ঝুলিয়ে স্ত্রীকে দ্রুতবেগে ঘরে ঢুকতে দেখা গেল, স্ত্রী ঘরে যাওয়ার পর টেলিভিশনের সাউন্ড আরেকটু বাড়ে। অন্ধকার সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে ডিমের ঠোঙা মেঝেতে রেখে এক হাতে শাকের রশি পেঁচিয়ে গেটে তালা লাগালো লোকটা। ফ্ল্যাটের সামনের করিডর ধরে এগিয়ে যেতে দেখা যায় মোবাইল হাতে নিজের রুমে শুয়ে থাকা ছেলেকে। বাবার আগমনে খানিকটা সতর্ক হয় সে, বিরক্তি ভরা মুখে উঠে গিয়ে বন্ধ করে দেয় রুমের দরজা।
বেডরুমের টিভিতে বিজ্ঞাপনের আওয়াজ কর্তার মনে বিরক্তি ধরায়। পিঠ পর্যন্ত ছড়ানো চুল খুলে হাত পা ছড়িয়ে বিশাল সাইজের শরীর নিয়ে বিছানায় বসে টিভির দিকে এক পলকে তাকিয়ে আছে স্ত্রী। পড়নের ম্যাক্সির নিচ থেকে উঁকি দিচ্ছে মোটা মোটা ফর্সা পা, পায়ের নখের নেইলপলিশ খানিকটা উঠে গেছে। স্ত্রীর এক সময়ের সুন্দর চেহারার উপর ছোপ ছোপ দাগগুলো টিভির আলোতে কেমন যেন দেখায়।
লোকটা ঘরে ঢুকতে তার হাতের দিকে স্ত্রীর নজর পড়ে, ‘শাক আনছো কেন? কে বাছবে? কতবার বলছি শাক-টাক আনবা না। খালি ঝামেলা করো।’
বিছানার পাশের পুরনো রংচটা ওয়াড্রোবটার উপর যিশুখ্রিস্টের একটা ছবি রাখা, তার পাশে নষ্ট হয়ে যাওয়া ক্যাসেট প্লেয়ারটা। সুতি শাড়ি কাটা কাপড় দিয়ে ঢাকা ক্যাসেট প্লেয়ারের পাশে ডিমের ঠোঙা আর শাকের আঁটি রেখে কাদামাখা স্যান্ডেল খুলতে বারান্দায় গেল মধ্যবয়স্ক। স্ত্রীর কথার উত্তর দেয় না সে।
স্যান্ডেল খুলে লোকটা সোজা বাথরুমে ঢুকে, কল ছেড়ে এক পা এগিয়ে দেয় পানিতে। শাক আর ডিম হাতে বাথরুমের দরজায় এসে দাঁড়াল স্ত্রী।
‘কি ব্যাপার কথা বল না কেন? শাক যে নিয়া আসেছ এখন শাক কুটবে কে?’
বাথরুমের কমলা আলোতে পা ঘষে কাদা তুলতে তুলতে লোকটা বলে, ‘বুয়াকে বইল বেছে দিতে। বাজারে নতুন উঠছে দেখে নিয়া আসলাম। অনেকদিন পালং শাক খাই না।’
স্বামীর উত্তরে বিরক্তি কমে না স্ত্রীর। রান্নাঘরে যেতে যেতে সে বলতে থাকে, ‘বুয়াকে তুমি বইল। একটা বাড়তি কাজ করানো যায় না তাকে দিয়া, গাল ফুলায়। আমি পারবো না শাক টাক বাছতে। সারাটা দিন খাইট্টা মরি। এখন রাত বারোটা পর্যন্ত শাক বাছুম! আর জানে কুলায় না।’
বাথরুম থেকে বের হয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে গামছায় ভেজা হাত-মুখ মুছতে মুছতে লোকটা দেখে স্ত্রী বিরক্ত হয়ে চুলে খোঁপা করছে। রান্নাঘরের এক পাশে রাখা খাবার টেবিলের উপর শাকের আঁটিতে তখন বিছাটি সতর্ক ভঙ্গীতে বাইরের দিকে এগোচ্ছে।
রাতের খাবারের প্রস্তুতি নিচ্ছে স্ত্রী। ভাত-ডালের চামচের টুংটাং আওয়াজ একটু আশ্বস্ত করল বিছাকে। গিন্নি ব্যস্ত আছেন কাজে, এই ফাঁকে বেরিয়ে পড়া যায়।
‘মারিয়া কই? অফিস থেকে আসে নাই?’ বাইরের কাপড় ছেড়ে লুঙ্গি পেঁচাতে পেঁচাতে রান্নাঘরে ঢুকে কর্তা স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করে।
‘আসছে, সে তো অফিস কইরাই টায়ার্ড। শুইয়া আছে।’ চুলায় তরকারি গরম করতে করতে পেছন ফিরে তাচ্ছিল্যের ভঙ্গীতে উত্তর দেয় স্ত্রী।
বলে চলে, ‘ঘরের একটা কাজেও সাহায্য করে না। সকালে অফিসে যায়, সন্ধ্যায় ফিরে। অন্তত রাতের ভাতটা তো রানতে পারে। আর মানুষ চাকরি করে না! সব তারে রেডি কইরা দিতে হবে।’
লোকটা গলা নামিয়ে বলে, ‘আচ্ছা শুনো, এই শুক্রবার অমলের মেয়ের বিয়েতে মারিয়াকে নিয়া যাইতে হবে। ওর জন্য একটা ভাল প্রস্তাব আসছে। সুধিরদার ছেলে, বুঝছ? ওকে বলার দকার নাই, শুধু বিয়েতে নিয়া গেলেই হবে।’
চুলায় তরকারি নাড়া থামিয়ে চোখ বড় বড় করে স্বামীর দিকে তাকায় স্ত্রী, ‘সুধিরদার ছেলের জন্য? এ তো খুব ভালো কথা! সুধিরদা তো এইবার আমাগো সংঘের প্রেসিডেন্ট হবে। তাগো সঙ্গে আত্মীয়তা করতে পারলে তোমার আর পিছন ফিরা তাকানো লাগবে না। তোমারেও সেক্রেটারি-মেক্রেটারি বানায় দিবে দেইখো। আচ্ছা সুধিরদার ছেলে না বিদেশে থাকে শুনছিলাম?’
‘হ্যাঁ, আমেরিকায় থাকে। ঐখানে এক রেস্টুরেন্টে চাকরি করে, অনেক পয়সা কামায় শুনলাম। গ্রামে বিল্ডিং উঠাইছে, সুধিরদা আর বউদিকে আমেরিকা ঘুরায় আনছে।’ লোকটা বলে।
স্ত্রীর মুখ আরও উজ্জ্বল হয়—‘বাহ মারিয়ারে আমেরিকা নিয়া গেলে তো আমরাও যাইতে পারবো! আমার যে কত শখ আমেরিকা দেখা! বিয়া হইলে আমাদের ছেলেটারেও ঐখানে পাঠায় দিবো, একটা না একটা ব্যবস্থা করবেই সুধিরদার ছেলে।’
কর্তা-গিন্নির আলাপ চলে, এই ফাঁকে শাকের আঁটি থেকে ধীরে ধীরে নিজের পুরো শরীরটা বের করে বিছা। এনার্জি লাইটের উজ্জ্বল আলোয় চকচক করে তার কালচে শরীর, শত জোড়া পা নিয়ে কিলবিল করে বিছা ছোটে স্যাঁতস্যাঁতে জায়গার খোঁজে।
‘জাম্প...জাম্প...জাম্প কেডস...এয়ারটেল নিয়ে এসেছে নতুন অফার...চুলে পুষ্টি যোগায়......মুঠোয় মুঠোয় সময় পার’ পুরনো টিভি কার্ডের লালচে হয়ে যাওয়া সাদা রিমোটের একটি বোতামে আঙুলের চাপ পড়ছে একটু পরপর। হার্ডবোর্ডের অপর পাশে মারিয়া একটি রগরগে উপন্যাসে মন দেয়ার চেষ্টা করছে কিন্তু পারছে না।
‘সাউন্ডটা একটু কমাও!’ ভাইয়ের উদ্দেশ্যে চিৎকার করে মারিয়া, কণ্ঠে ঝরে একরাশ বিরক্তি।
‘পারুম না কমাইতে, তুমি কানে তুলা দাও!’ আক্রোশ নিয়ে পাল্টা জবাব আসে হার্ডবোর্ডের ওপার থেকে, গজগজ করে আরও কী কী যেন বলে ছেলেটা।
মারিয়ার হঠাৎ খুব ক্লান্ত লাগে, ক্লান্তির সঙ্গে যোগ হয় হতাশা। বই খোলা অবস্থায়ই চোখ বন্ধ হয়ে যায়। চোখ বন্ধ হওয়ার পর সবকিছু যেন নীরব হয়ে এলো। নীরবতা খানখান করে বেজে উঠে পাশে রাখা ফোন।
‘বলেছ তোমার বাবাকে?’ মোবাইলের অপর পাশ থেকে যুবক কণ্ঠ জানতে চায় মারিয়ার কাছে।
ঘুম ভেঙ্গে আরও একবার অস্বস্তিতে পড়ে মারিয়া, ‘না, এখনও সময় সুযোগ পাচ্ছি না। পেলেই জানাবো।’
‘প্লিজ তাড়াতাড়ি জানাও, আমার আর দেরি করতে ইচ্ছা করছে না।’ প্রেমিক যুবকের কণ্ঠে ব্যাকুলতা ঝরে পড়ে।
হঠাৎ করে কেন জানি যুবকের উপর ভয়ানক রাগ হয় মারিয়ার। সারাদিনের ক্লান্তি, বিরক্তি, দুই রুমের কান ঝালাপালা করা টিভির সাউন্ডের সঙ্গে যোগ হয়েছে ভয়ানক কোমর ব্যাথা। গত কয়েকদিনে কাজের চাপ বেড়েছে অনেক। যুবকের উপর সব রাগ একসঙ্গে বের হয়, ‘বলছি তো জানাবো, এতবার বলার তো দরকার নাই।’
রাতের খাওয়া শেষে বিছানায় বসে রিমোট চাপছে স্ত্রী, সামনের এক চিলতে মেঝেতে শাক বাছতে বসেছে মধ্যবয়স্ক লোকটা। দুই পায়ের ফাঁকে পুরনো এক স্টিলের ট্রেতে শাকগুলো বিছিয়ে রাখা, চশমা চোখে একটা একটা ডাঁটা ছিঁড়ছে লোকটা, পাশে রাখা ছুরি। খবরের চ্যানেলে এসে রিমোট থেকে স্ত্রীর আঙুল সরলো।
‘অমলের মেয়ের জামাই তো ইটালি থাকে, শুনছো?’ স্ত্রী বলে লোকটাকে।
‘হ্যাঁ। অমলের তো ভাগ্য খুইলা গেল।’
‘কোথাকার কোন মুদি দোকানদার অমল, মাইয়া বিয়া দিয়া উপরে উইঠা গেল। মেয়ে তো মনে হয় ইন্টার পাশ, কোনদিন ভাবছে একদিন ইটালি যাইব?’ নিজের পায়ের আঙুল টিপতে টিপতে বলে স্ত্রী।
মধ্যবয়স্ক--‘বিয়ার অনুষ্ঠানও তো দিছে হাইফাই জায়গায়। দুপুরে গির্জায় বিয়া, রাতে ট্রাস্টে খাওয়া।’
স্ত্রী—‘কত লোক খাওয়াবে? দুই পার্টি মিল্যা করবে নাকি?’
মধ্যবয়স্ক ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়ে—‘তাই তো মনে হয়। অমলের কি এতো সামর্থ্য আছে নাকি। শুনছি মাইয়ারে বাড়ির জমিও দিবে।’
স্ত্রী—‘মাইয়া আর জমি নিয়া করবে কী, এখন তো তার জীবন শুরু হবে ইটালিতে। ইংলিশও বলতে পারে কীনা কে জানে, যাবে ইটালি। সবই কপাল!’
‘এখন আমাগো মাইয়ারটা হয়া গেলেই হয়। ওরে সুন্দর কইরা সাজায় নিয়া যামু।’ আনমনে বলতে থাকে স্ত্রী।
লোকটা মাথা নেড়ে বলে, ‘আরে ওরটা তো হইয়াই আছে। সুধিরদার ছেলে ওরে দেখছে তো, পছন্দও করছে। আর মেয়ে তো আমাগো কম সুন্দর না। লম্বা চওড়া, ফর্সা, দেখতে ভালো। পছন্দ না হইয়া যায় কই।’
স্ত্রীর চোখ চকচক করে, ‘আমগো মারিয়ারে কিন্তু বিদেশেই মানাইব। ওরে শার্ট প্যান্ট পড়লে যা সুন্দর লাগে, স্লিম তো। আবার ফর্সা, চুলগুলাও লালচে ধরণের। জ্যানেটরা তো আগেই বলছে আমারে, ওর জন্য আমেরিকা পারফেক্ট। জ্যানেট ঐখানে ওর জন্য ছেলে খুঁজতে চাইছিল। ও আমেরিকা গেলে ভালই হবে, বড় বোন হিসাবে জ্যানেট আছে। কোন সমস্যা হইলে জ্যানেটই দেখবে।’
শাক হাতে ঝিমিয়ে পড়ছিল মধ্যবয়স্ক।
হঠাৎ জেগে উঠে বলল, ‘জ্যানেট কে?’
‘জ্যানেট কে মানে?’ খেকিয়ে উঠলো স্ত্রী।
‘জ্যানেটরে চিনো না, না? আমার বোন নাইজেলাদির মেয়ে, বড়টা। গত বড়দিনে না দেশে আইসা ঘুইরা গেল, তুমি ওদের বাড়ি গিয়া কত নাচানাচি করলা। ভুইলা গেছ?’ স্বামীর দুর্বল স্মৃতিশক্তি দেখে হতাশা নিয়ে প্রশ্ন করে স্ত্রী।
‘অ্যাঁ! ও ওই জ্যানেট!’
‘কোন জ্যানেট কও তো? তুমি মনেই করতে পারো নাই। বুঝছি তোমার ঘুম পাইছে। যাও তো রাখো এগুলা, ঘুমাইতে আসো। সকালে বুয়া আসবে আমার শুইতে হবে।’
বিনা বাক্য ব্যয়ে ক্লান্ত পায়ে শাক বিছানো ট্রে খানা রান্নাঘরে রেখে আসলো লোকটা।
পরদিন ভোরবেলা।
আচমকা ঘুম ভেঙ্গে গেল মারিয়ার, ঘড়ির দিকে চেয়ে দেখে পাঁচটা বাজে। হার্ডবোর্ডের ওপাশ থেকে শোনা যাচ্ছে বিজ্ঞাপনের শব্দ। কয়েকদিন ধরে ঠিক এই সময় তার ঘুম ভেঙ্গে যাচ্ছে। ঘুম ভাঙ্গার আগ মুহূর্তে মারিয়া স্বপ্ন দেখছিল সেই বুড়ো লোকটার সঙ্গে তার বিয়ে হয়ে গেছে। বুড়ো লোকটাকে সে কেন পছন্দ করে না তা অনেকবার বুঝানোর চেষ্টা করার পরেও বাবা-মাকে সে বুঝাতে পারেনি। বরং তারা বলছে, ওই লোককে মিথ্যা অপবাদ দিয়েছে মারিয়া। আর তাই এর খেসারত হিসেবে বুড়ো লোকটার বউ হতে হবে তাকে।
ঘুমের মধ্যে মারিয়ার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল। মনে পড়ছিল গাড়ির ভেতরের সেই মুহূর্তগুলো। এসির কনকনে হাওয়া, বুড়ো লোকটার জোর করে তাকে চুমু খেতে চাওয়া, দানবের মত ঠোঁট কামড়ে ধরে বুকে হাত চেপে বসা, অসহায়ের মত হাত পা ছোঁড়াছুঁড়ি।
‘আমি আপনাকে পছন্দ করি না।’
‘তুমি বাচ্চা মেয়ে, পছন্দ অপছন্দের কি বুঝ? আমার বউ হলে তোমার জীবন কিভাবে পাল্টে যাবে জানো তুমি? বাস্তবতা সম্পর্কে কোন জ্ঞান নেই তোমার। সবে মাত্র ভার্সিটিতে উঠেছ।’
পালানোর পথ খুঁজে ব্যর্থ হওয়া।
মাথার উপর ফ্যানের ঘড়ঘড়, বিজ্ঞাপনের শব্দ ছাপিয়ে আবারও সবকিছু নীরব হয়ে যায়……মারিয়া নিজেকে অন্য একটি রুমে আবিষ্কার করল, অন্য কারও খাটে। মারিয়া দেখে বুড়ো লোকটা মুখ চেপে ধরে তার উপর উঠে শুয়ে আছে। চারিদিক থেকে হাসিমুখে হাততালি দিচ্ছে তার পরিবারের সবাই, সবার পড়নে জমকালো পোশাক। মারিয়া অসহায়ের মত বলার চেষ্টা করে, এটা ঠিক না। সবাই হাসে, যেন তাকেই ব্যঙ্গ করে। বুড়োর হাত তার মুখের উপর আরও চেপে বসে, নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাচ্ছে……বাঁচাও! বাঁচাও!
এরপর আর কিছু মনে নেই।
অবচেতন মনেও মারিয়া বুঝতে পারছিল এগুলো শুধুই স্বপ্ন, কিন্তু স্বপ্নটাও অনেক বাস্তব মনে হচ্ছিল তখন। জোর করে নিজের চোখ খুলল মারিয়া, বুক ভোরে নিঃশ্বাস নিল। রুমের ভারী পর্দা ভেদ করে আসছে ভোরের আলো, হার্ডবোর্ডের ওপারে বিজ্ঞাপনের শব্দ স্তিমিত হয়ে এসেছে। ভাইয়ের ঘুমানোর সময় হয়েছে, মারিয়া অফিস থেকে ফেরার পর দেখা যাবে সে দাঁত মাজছে।
জোর করে উঠে বসে মারিয়া নিজেকে ধাতস্থ হতে সময় দিল, আবছা আলোতে অবাক হয়ে দেখলো পায়ের আছে ছোট্ট একটি বিছা। দ্রুত পায়ে তার দিকেই আসছে। পা সরিয়ে মারিয়া যখন ভাবতে লাগলো কী করা যায়, তখন বিছাটি তার পায়ের কাছের চাদরের ভাঁজে ঢুকে গেল। বিছাকে পেটানোর জন্য কোন লাঠিও নেই হাতের কাছে, তাছাড়া ছোট্ট একটা প্রাণীকে মারার ইচ্ছাও নেই মারিয়ার। কি করা যায়? বিছা নিয়ে তো ঘুম আসবে না। বাকি কয়েক ঘন্টা না ঘুমিয়েই কাটিয়ে দিতে হবে। পরে সারাদিন ঝিমুতে হবে। মারিয়া শেষমেশ দুই আঙুলে ধরে সতর্কভাবে চাদরটা বারান্দায় রেখে এলো।
সকাল দশটা।
মারিয়া অফিসে, আজও না খেয়ে গেছে।
না খেয়ে থাকতে থাকতে কয়দিন পর বুড়িদের মত দেখাবে, তখন কে আসবে তাকে বিয়ে করতে?
এলোমেলো রুমের কাপড় গুছাতে গুছাতে মারিয়ার মা ভাবছে, মেয়েটা একটু পরিপাটি হয়ে অফিসে যেতে পারে না! যদি রাস্তায় সুধিরদার পরিবারের কারও সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। কত যে বলি একটু চোখে কাজল দে, হালকা করে লিপস্টিক লাগা……তার শুধু অফিসে লেট হয়ে যাবে।
কাপড় গুছিয়ে মারিয়ার ড্রয়ারে রাখার সময় রুমের দরজায় বুয়া এসে দাঁড়ালো ঝাড়ু হাতে।
‘খালাম্মা সরেন, ঝাড়ু দিতাম না?’ বুয়ার উচ্চকণ্ঠে ব্যস্ততা, ১১টা থেকে হিন্দু বাসায় কাজ আছে তার। দেরি করে গেলে গিন্নি বকা দেয়।
মারিয়ার মা আঁতকে উঠে হার্ডবোর্ডের দিকে তাকায়, হাত নেড়ে বুয়াকে চুপ করতে বলে। ফিসফিস করে বলে, ‘আরে আরে আস্তে বল, এত চিল্লাও কেন? আমার ছেলে ঘুমায়। উইঠা গেলে তোমার খবর আছে।’
হার্ডবোর্ডের ওপার থেকে বিরক্তিভরা গোঙানি শোনা যায়।
মারিয়ার মা আরও সতর্ক হয়।
‘অদ্ভুত এক মেয়ে আমার, শাড়ি-চুড়ির প্রতিও কোন আগ্রহ নাই। মেয়েরা এমন হলে কি চলে?’ ভাবতে ভাবতে বারান্দায় রাখা চাদরটা গায়ে দেয় মারিয়ার মা। হঠাৎ করে সে ভেবে পায় না, বিছানা থেকে তুলে চাদর এখানে কেন রাখল মারিয়া? মনে হয় রোদে দেয়ার জন্য। আমেরিকান জামাইয়ের কথা ভাবতে ভাবতে চাদরের ভাঁজ খুলে রোদে ছড়িয়ে দেয় গিন্নি।
‘আজকেই বলব।’ সকালে দেখা দুঃস্বপ্নটার কথা ভাবতে ভাবতে যুবককে বলে মারিয়া। দুঃস্বপ্নের কথা অবশ্য বলা হয়নি ওকে, বললে ঐ বুড়োকে খুঁজে বের করে তুলকালাম কান্ড বাঁধিয়ে দিতে পারে। এই রিস্ক নেয়া যাবে না।
মারিয়ার দিকে নরম চোখে তাকায় যুবক, টেবিলে রাখা মারিয়ার ফর্সা হাতে হাত রাখে। ‘কী বলবে মনে আছে তো?’
‘হ্যাঁ।’ অন্যদিকে তাকিয়ে মগের দামি কফির গন্ধ নেয় মারিয়া, কফির নির্যাস তার মস্তিষ্ককে অনেকটাই শান্ত করে। যুবকের হাত চেপে ধরে সে।
‘আমি ভালোবাসি তোমাকে।’ বলে যুবক।
‘জানি আমি।’ মারিয়ার কাছে সবকিছু অপার্থিব লাগে। রেস্তোরাঁর মিটিমিটি আলো, বাইরের চলমান গাড়ির ব্যস্ততা, পাশের টেবিলে বসা সুন্দরী মেয়েটার সেলফি তোলা, প্রেমটাও।
কীভাবে যেন মারিয়ার চোখ দেখেই সব বুঝতে পারে যুবক, ক্লান্ত মুখটিতে হাত বুলিয়ে দেয়। তাদের মাঝে কোন কথা হয় না, শুধু দৃষ্টির মাধ্যমে বিনিময় হয় রাজ্যের ভরসা।
বৃহস্পতিবার একটু আগেই ফেরে মারিয়া। ফিরে এসেই গল্পের বই নিয়ে বসে, বই পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে যায় আজও। ঘুমের ঘোরে মারিয়া ব্যান্ডপার্টির আওয়াজ শুনতে পায়। পাড়ায় আজ কারও বিয়ে, কার বিয়ে? ঐ মেয়েটার নাম যেন কী………ঘোরের ভেতর চেহারাটা মনে পড়ে কিন্তু নাম যে মাথায় আসে না। ঐ যে…...একবার সেকেন্ড হইছিল দেখে অনেক কাঁদছিল যেই মেয়েটা……।
মারিয়ার রুমের দরজা খোলাই ছিল, মা ঢুকলেন শপিং ব্যাগ হাতে।
‘মারিয়া নাও তো, কাল বিয়েতে এই ব্রা-টা পইড়ো। শাড়ির সাথে একটু মোটা ব্রা না হলে ফিগার ভালো দেখায় না।’
মারিয়া বই রেখে উঠে বসে বিছানায়। মায়ের হাতে একটি প্রমাণ সাইজের ব্রা, কালোর মধ্যে গোলাপি পলকা ডট প্রিন্ট। ফিতার রঙ উজ্জ্বল গোলাপি, কোনভাবে পোশাকের ভেতর দিয়ে যদি কাঁধের ফিতা বের হয় যায়, সবার নজর আগে ওটাই কাড়বে। ব্রা-টা একদম নতুন নয়, আবার পুরনোও নয়, কারও ব্যবহার করা, বুঝা যাচ্ছে। ব্রা কাপের ফোমের উপর সেলাই করে ডবল ফোম লাগানো, আনাড়ি হাতের সেলাই।
‘এইটা কার ব্রা? কোত্থেকে আনলে?’
‘কার ব্রা জেনে কি করবে? পড়তে বলছি পড়, নাইলে না পড়।’ মারিয়ার এই প্রশ্নের উত্তর দিতে রাজি নন মা।
মারিয়া কিছু বলার আগেই দ্রুত ব্যাগ থেকে একটা ব্লাউজ বের করলেন মা। বড় গলার লো কাট ব্লাউজটা দেখে বুঝতে অসুবিধা হল না মারিয়ার, এসব আসলে কার জিনিস।
পিঠ খোলা এই ব্লাউজের সঙ্গে ফিনফিনে শাড়ি পড়ে গতবার বড়দিনের অনুষ্ঠানে ছেলেদের মাথায় আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল মারিয়ার মাসতুতো বোন প্রিয়াঙ্কা। তাকে দেখতে খুবই সুন্দর লাগছিল, কিন্তু মা-মাসীরা তাকে কলঙ্কিনীর খেতাব দিতে ছাড়েনি। অবশ্য তাতে কখনওই কিছু যায় আসে নি প্রিয়াঙ্কার। সে নিজের সৌন্দর্য দেখাতে পছন্দ করে, মডেল বলে কথা।
কিন্তু আজ তার সেই বিতর্কিত শাড়ি মায়ের হাতে কেন? তাও আবার আমাকে পড়তে বলছে? এই শাড়ি নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা চলল ইস্টার পর্যন্ত। এক মাস যেতে না যেতেই শাড়ির কদর বাড়ল কিভাবে? মারিয়া হতবাক।
আরও একবার মারিয়াকে কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে মা বলে চললেন, ‘দেখো মারিয়া, তোমার বাবা বলে দিয়েছেন এই বিয়েতে ঘরের সবাইকে যেতে হবে। সেদিন রাতে কোন রান্না হবে না। আমরা খেয়ে আসবো। ডেলি ডেলি রান্না থেকে একটু মুক্তি চাই আমি। আমাকে তো হেল্প করার কেউ নাই, সকালে বুয়া দুইটা কাজ করে যায়, বাকি সব আমার।’
‘আর অমল আংকেল খুব করে বলেছেন তোমাকে নিয়ে যেতে। তার মেয়ে একসময় তোমার ক্লাসমেট ছিল, তোমাকে যাইতেই হবে। আমি শাড়ি ঠিক করে রাখছি, তুমি নেলপালিশ লাগায় রাখো। কাল সময় পাবা না। চুলে শ্যাম্পু কইর সকালবেলা।’
কথা শেষ করে মা হাঁটা দিলেন।
ঘুম থেকে উঠে ঘোর লাগা অবস্থায় মায়ের বেশিরভাগ কথাই মাথার উপর দিয়ে গেল। মারিয়া আজকে উপন্যাসটির শেষ পর্যায়ে আছে, একটার পর একটা টুইস্ট চলছে, সে বইয়ে মন দিল, গল্পটা শেষ করতে হবে।
আবার ফোন বাজে।
‘কি করো?’ যুবকের কণ্ঠে আহ্বান স্পষ্ট।
‘বইটা পড়ছিলাম, ঐ যে যেইটার কথা বললাম। শেষের পথে।’
‘মারিয়া তোমার লেখালেখির কি অবস্থা?’
এক লাফে মারিয়ার মেজাজটা চড়ে গেলো। চাকরি নেয়ার পর থেকে মারিয়ার লেখালেখির অভ্যাসটা প্রায় চলেই গেছে। একসময় দুজন মিলে কম্পিটিশন দিয়ে লিখত, নিজের লেখা পড়ে নিজেই অবাক হত মারিয়া। এখন সারাদিন পর ক্লান্তির কাছে হার মানে সবকিছু। এই নির্মম সত্য এড়িয়েই চলে সে।
‘তুমি জানো না আমি এখন সময় পাই না? এসব জিজ্ঞেস করো কেন?’
আরও একবার মারিয়ার মনে হল, সংসার চালানোর চাপটা না থাকলে পত্রিকায় লিখেই দিন কাটিয়ে দিত। পাশাপাশি নিজের লেখাও চলত। এমনই তো প্ল্যান ছিল জীবন নিয়ে। বাড়ি-গাড়ির স্বপ্ন কোনদিনও নেই মারিয়ার, বড় কিছু বলতে শুধু ঘুরে বেড়ানোর ইচ্ছা আছে। এছাড়া জীবনকে তো সাদামাটাভাবেই চায় সে।
যুবক বুঝতে পেরেছে এই প্রসঙ্গ তোলা ঠিক হয়নি। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, ‘সরি। আমি জানি তোমার উপর কত চাপ পড়ছে। কিছু মনে করো না, মারি। আর ক’টা দিন কষ্ট করো।’
কিছুক্ষণ পর রান্নাঘরে পানি খেতে গিয়ে মারিয়ার মনে পড়ল গতকাল রাতের বিছার কথা। সারাদিনের ব্যস্ততায় মা’কে বলা হয়নি, বিছা লুকিয়ে থেকে কাউকে কামড় দিতে পারে।
‘মা আমার ওই চাদরটা কই?’
‘চাদরটা তো রোদে দিছিলাম। অনেকদিন ধরে ধোয়াও হয় না। ধুয়ে দিবো এখন অন্য চাদর নাও লাগলে।’ ব্যস্ত ভঙ্গীতে মা ভাত নাড়ে খুন্তি দিয়ে।
‘না, লাগবে না। শুনো তোমাকে বলতে মনে ছিল না, ওই চাদরে কাল রাতে একটা বিছা ঢুকে গেছিল। তাই তো বাইরে এনে রাখলাম। তুমি পাইছো নাকি?’
মেয়ের কথা শুনে আরেকটু হলেই খুন্তি হাত থেকে পড়ে যাচ্ছিল মার।
তাড়াতাড়ি গা ঝাড়া শুরু করলেন তিনি।
‘তুই আমাকে আগে বলবি না? আমি আরও চাদরটা গায়ে দিয়ে ঘুরছি সকালে!’
শুক্রবার সকাল।
মারিয়ার বাবা আজ বাড়িতে।
নাস্তার পর্ব শেষে অলস ভঙ্গীতে রিমোট চাপছেন।
বুয়া বিদায় করে চুলায় দুপুরের ভাত চড়িয়েছেন মা, এই ফাঁকে মারিয়ার শাড়িটা নেড়েচেড়ে দেখছেন।
মারিয়া নিজের রুমে চুপচাপ বসে আছে,
মাথার ভেতরে চলছে ভাবনার ঝড়। জানালা দিয়ে আকাশ দেখা যায়, বৃষ্টিভেজা স্যাঁতস্যাঁতে দিন। এরকম দিন মারিয়ার খুব ভাল লাগে। সারাদিন বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছা করে। মাত্র ৫ বছর আগেও এমন বৃষ্টির দিনে বসে বসে কবিতা লিখত সে, সামনে পড়ার বই খুলে রেখে।
তখন জীবন কত সহজ ছিল, মারিয়া ভাবে। এখন যেন এক সঙ্গে একগাদা জটিলতা ঘিরে ধরেছে তাকে। জীবনের এই দ্রুত পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলাতে গিয়ে বরাবরই বেশামাল হয়ে যায় মারিয়া। নাহ, আজ বলতেই হবে। বলে ফেললেই ঝামেলা শেষ। এরপর যা হবার হোক, এই ফাঁড়াটা তো কাটুক। এক প্রকার জোর করে নিজেকে বিছানা থেকে উঠায় মারিয়া, ঠিক যেমন জোর করে চোখ খুলেছিল ঐ দুঃস্বপ্ন দেখার পর। মাঝে মাঝে নিজের উপর জোর করা ভাল।
মারিয়া বাবা-মায়ের ঘরের সামনে দিয়ে পায়চারি করছে। বাবা জোরে সাউন্ড দিয়ে খবর দেখছেন। মারিয়ার হাত পা কাঁপছে, কীভাবে শুরু করবে বুঝতে পারছে না।
‘লন্ড্রিতে ব্যাটারা একটা শাড়িও আয়রন করতে জানে না।’ শাড়ির পাড়ের কাছের হালকা ভাঁজ দেখে রাগ হচ্ছে মারিয়ার মার। আজকে রাতে শেলির বিয়ে। (হ্যাঁ! ওর নাম শেলি! এই তো মনে পড়েছে!) অন্যদিন শুক্রবার সকাল থেকেই মারিয়াকে রান্নাঘরে ডাকতে থাকে মা, আজকে তাকে একবারও ডাকা হয়নি ভেবে মারিয়ার অবাক লাগছে।
‘মা রান্নাঘরে কিছু করতে হবে?’ মারিয়া জিজ্ঞেস করে।
মা মুখ তুলে তাকিয়ে বলে, ‘না না, আজকে তোমার কিছু করতে হবে না। আজকে তুমি রেডি হও। নেলপালিশ লাগানো শেষ? মুখটা এমন লাগছে কেন?’
‘বিয়ে তো সন্ধ্যায়, এখন রেডি হবো কেন?’ মারিয়া পাল্টা প্রশ্ন করে।
‘এত কথা বল কেন? নেলপালিশ লাগানোর পর শুকাইতে একটু টাইম লাগবে না? প্রস্তুতি এখন থিকাই নিতে হবে তো, নাইলে পরে তাড়াহুড়া লাগবে। তোমার বান্ধবীর বিয়া তুমি একটু ভাল কইরা সাজবা না!’
মারিয়া মাকে থামিয়ে দিল, ‘ও আমার বান্ধবী না মা। আমরা একসঙ্গে পড়তাম।’
‘ঐ যাই হোক। শুনো, দুপুরে খাওয়ার পর একটা ফ্রেশ ঘুম দিবা। তাইলে মুখটা সুন্দর লাগবে। ভাত প্রায় হইয়া গেছে, খাইয়া ঘুমাইতে যাও।’
মারিয়া বিরক্ত হয়, ‘কি বল এইসব? এখন মাত্র সকাল এগারোটা বাজে। এখন ভাত খেয়ে ঘুমাবো?’
মারিয়ার মা আরও বিরক্তি ঝরায় কন্ঠে, ‘যাও তো, মুখে মুখে তর্ক না কইরা যাও নেলপালিশটা লাগাও।’
শাড়িটা রেখে মেয়ের জন্য লাল লিপস্টিকটা খুঁজতে লেগে গেলেন তিনি। গতকাল থেকে লিপস্টিকটা পাওয়া যাচ্ছে না। সময়মত এই ঘরে কিচ্ছু পাওয়া যায় না।
এক ঘন্টা পর।
টিভিতে বিজ্ঞাপন চলছে, মধ্যবয়স্ক লোকটা শূন্য দৃষ্টিতে টিভিপর্দায় তাকিয়ে রয়েছেন, মন অন্যখানে। মারিয়ার মা কানেগলার সেট খুঁজতে ব্যস্ত, কুন্দনের ভারী একটা হার বের করে মেলে ধরলেন তিনি। মেয়ে আজকে যতই বিরক্ত হোক এটা ওকে পড়িয়েই নিবো বিয়েতে, যা মানাবে মেয়েটাকে। সুধীরদার ছেলে তো পাগলই হয়ে যাবে! ভাবতে ভাবতে উত্তেজনার স্রোত বয়ে গেল তার মোটা শরীরে। এবার কপালের টিপ খোঁজার পালা………।
‘বাবা, তোমার সঙ্গে একটু কথা ছিল আমার।’
এতক্ষণ মারিয়ার উপস্থিতি লক্ষ্য করেননি বাবা-মা কেউই।
বাবা কৌতূহল নিয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘কি কথা?’
মারিয়া কাঁপা হাতে রিমোট ধরে টিভির সাউন্ড কমায়, তার ফর্সা চিকন চিকন আঙুলে লাল নেইলপলিশ দারুণ মানিয়েছে।
‘আমি একজনকে পছন্দ করি। সমস্যা হল সে খ্রিস্টান না, মুসলিম। কিন্তু আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি তাকেই বিয়ে করবো।’
রুদ্ধশ্বাসে কথাগুলো বলে ফেলে মারিয়া।
এক মুহূর্তের জন্য সবকিছু যেন থেমে গেল।
কারও মুখে কোন কথা নেই, সবাই চুপ।
মূর্তি হয়ে আছেন মারিয়ার বাবা-মা। টিভির সাউন্ড কমানো, পর্দায় কোমর দুলাতে দেখা গেল অচেনা এক নায়িকাকে। মধ্যবয়স্ক লোকটার হতভম্ব চোখের মণিতে প্রতিফলিত হচ্ছে রঙিন পোশাক পড়া নায়িকার নাচ, তার শূন্য দৃষ্টির সামনে যেন সবকিছু আজ অতিপ্রাকৃত মনে হয় মারিয়ার।
অবশেষে নীরবতা খানখান করে বেজে উঠলো মায়ের তীক্ষ্ণ কণ্ঠ,
‘আমি জানতাম, আমি জানতাম মেয়ের ঘরে বিছা পাওয়া কোন ভালো লক্ষণ না!’
মারিয়া আর কোন কথা না বলে চুপচাপ নিজের রুমে চলে গেল।
ছবিঃ স্টেফানি অ্যালিসন
http://stephallison.blogspot.com/2011_01_01_archive.html
২| ০২ রা এপ্রিল, ২০১৮ সকাল ১১:৫৮
মূর্ধণ্য ষ বলেছেন: বাহ! অতি চমৎকার লেখা। ভালো লেগেছে খুব!
©somewhere in net ltd.
১|
১০ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ দুপুর ১:১৬
হেফাস্টাস বলেছেন: ওটা বিছা না, চ্যাল্লা ছিলো।