![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
দুপুর, কোথাও আলসেমি আবার কোথাও ব্যস্ততা।
ঘড়ির কাঁটা একটা পেরিয়েছে সবেমাত্র, টিনের চালের উপর ভাতঘুম দিচ্ছে বিড়াল সমাজ। পাশের চারতলা দালানের জানালা থেকে নিয়মিত খাবার নিচে পড়ে, সবাই ভাগে পায়। তাই খেয়ে দেয়ে এখন সব গা এলিয়ে দিয়েছে টিনের চালের ছায়ায়।
বসন্তের শুরুতে গাছগুলোতে স্থান করে নিচ্ছে নতুন পাতা। সবুজ কচি পাতাগুলো দুপুরের রোদে ঝলমল করে। নতুনদের জায়গা করে দিতে শুকনো পাতারা ঠাই নেয় টিনের চালে। বিড়ালগুলোর সঙ্গে শুয়ে থাকে তারা।
কানা বিড়ালটার পাশেই ঘুমাচ্ছে কালো রঙের হুলো, একই ভঙ্গিতে গা এলিয়ে দেয়া দুজনকে দেখে কে বলবে প্রতিদিন তাদের ঝগড়া লাগে!
বড়দের খাওয়া শেষে এখন জায়গা পেয়েছে বাচ্চা বিড়ালটা।
শুরু থেকে মায়ের সঙ্গে এসে বসে থাকতো সে, তখনও দুধ ছাড়ে নি।
মাকে দেখেছে করুণ সুরে ডাকতে, দালানের সেই তিনতলা জানালার দিকে তাকিয়ে।
এখন মায়ের স্থান তার, কচি গলায় সে যখন ডাকে, তিনতলার লোকটা দেরি না করে খাবার ছুঁড়ে দেয়। মাঝে মাঝে হুলো দুটোর সঙ্গে খাবার নিয়ে লড়াই করতে হয় তাকে, এখনও গায়ে শক্তি হয়নি লড়াই জেতার।
তবে বেঁচে থাকার হিসাব নিকাশটা বুঝে গেছে সে।
মোটা লোকটা তাকে একটি নাম দিয়েছে, ‘বাচ্চা’।
বাচ্চা শব্দের মানে কী সে জানে না, তবে বাচ্চা যে তার নাম তা জানে।
মা আসে এখনও, তবে আগের মত খেতে পায় না।
টিনের চালের নিচের উঠানে দেখা যায় ছোট মেয়ে দুটিকে, সদ্য গোসল করা ভেজা চুল আঁচড়ে আরেকটু খেলার সময় বের করার চেষ্টায় রত। এখনই ভাত খেতে ডাক পড়বে, তার আগের সময়টুকু ান্ধবীর সঙ্গে কাটানো।
মেয়ে দুটো একে অপরের চাচাতো বোন। ফর্সা মেয়েটি রুগ্ন, প্রায়ই জ্বর হয় তার। খেতে ভালো লাগে না, মা তাকে খাইয়ে দেয়। আরেকজন শ্যামলা, এ বয়সেই সে ঝাল খেতে পারে। তাকে কেউ খাইয়ে দেয় না, বড়দের মত অল্প সময়েই খাওয়া শেষ করতে পারে সে।
দুই বোন গাছের পাতা কুড়িয়ে রান্নাবাটি খেলে।
মাঝে মাঝে বাড়িতে বড় ভাইয়ারা আসে, তখন ফর্সা মেয়েটি কেন জানি লজ্জা পায়। তার খুব ইচ্ছা করে ভাইয়াদের সঙ্গে কথা বলতে, কিন্তু মা বকা দেয়। শ্যামলা মেয়েটি ঠিকই কথা বলে, তার লজ্জা লাগে না। বড় ভাইয়া তো বড় মানুষ।
বালতি ভরে কাপড় নিয়ে এসেছে এক বড় আপু। ভেজা চুলের গামছা খুলে চুল শুকানোর সময় তার শরীর থেকে সাবানের গন্ধ বের হয়, ফিনফিনে সুতির সালোয়ার কামিজ ভেদ করে দেখা যায় তার সাদা রঙের ব্রা। ফর্সা মেয়েটি ভাবে, কবে সে আপুর মত বড় হবে। কবে ভাইয়ারা তাকে নারী হিসেবে দেখবে, শিশু হিসেবে নয়।
ান্ধবী নতুন পাতা খুঁজে পেয়েছে, এই পাতাগুলোকে মাছ বানানো যাবে। ঠিক করা হল, আজ বিকালে ‘মাছ ভাজা মাছ ভাজা’ খেলা হবে। এখন শুধু তাড়াতাড়ি খেয়ে একটু ঘুমিয়ে নিলেই হল, খেলার সময় আসতে দেরি হবে না।
তিনটা বাজে।
রাস্তার পাশের বাজারে ব্যস্ততা এখন খানিকটা কম। দুপুরের খাওয়া শেষে চায়ের জন্য অপেক্ষা করছে দোকানিরা। কিছুক্ষণ পর দেখা গেল অনেকগুলো কাপ হাতে ব্যস্ত ভঙ্গিতে ভিড় ঠেলে আসছে এক বালক। মোড়ের শপিং মলের সামনে ভিড় কখনওই কমে না, দুই পা পঙ্গু ফকিরটা ভিড়ের মধ্যে রাস্তার মাঝে শুয়ে ভাতঘুম দিচ্ছে। তার নগ্ন বুকের উপর এক মগ চা রাখা, খানিকটা খাওয়া হয়েছে। কাছা দেয়া লুঙ্গির নিচে, হাটু থেকে কাটা দুই পা’র পাশে রাখা ভিক্ষার বাটিতে খুচরা পয়সা জমা করা। ফকিরকে ডিঙ্গিয়ে যাচ্ছে ব্যস্ত শহরের নাগরিকরা, কারও বাস ধরতে হবে, কেউবা ছুটছে ভাতের হোটেলে।
টিএনটি মাঠের পাশের ফুটপাথের বাজারে ব্যস্ততা আরও কম। শাকসবজির পসরা সাজিয়ে আধশোয়া হয়ে ঘুম দিচ্ছে সবাই। দুপুরের রোদে আরও লাল দেখাচ্ছে টমেটোগুলোকে।
ভ্যানের আনারসগুলোকে ছাতার ছায়ায় রেখে মাটিতে বসে ভাত খেতে দেখা গেল আনারস বিক্রেতাকে, দেখে মনে হচ্ছে লুকিয়ে লুকিয়ে খাচ্ছে। এই সময় আনারসের বিক্রি হয় খুব। ছোট ছোট আনারস ছিলে বিট লবণ মেখে হাতে ধরে কামড়ে খাওয়া, পথচারীর জন্য ক্ষুধা মেটানোর ভালো উপায়।
কাস্টমার ছাড়া যাবে না, তাই কোনমতে চারটা ভাত খেয়ে আবার কাজে ফেরার তাড়া।
বাসগুলো এখন প্রায় খালি। স্বাভাবিকের চেয়ে একটু বেশি সময় মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকে বাস, চলতে থাকে যাত্রী তোলার চেষ্টা। রাস্তার ওপারে বিশাল সাইজের ব্যানারে চোখে পড়ে পেট্রল বোমা হামলায় দগ্ধ মানুষের বীভৎস সব ছবি, নিচে দেখা যায় এক নেত্রীর মুখকে আনাড়ি হাতে ডাইনি বানানোর চেষ্টা। অনেকক্ষণ ডাকাডাকি করে শেষমেশ রোদে পোড়া কয়েকজন বিরক্ত যাত্রী নিয়েই রওনা দেয় বাস।
স্কুল ছুটির পর বেণি দুলিয়ে মায়ের হাত ধরে বাসে উঠার যুদ্ধে নামে এক ছোট্ট মেয়ে। মেয়েটির ঘেমে যাওয়া মুখের ঠিক পেছনে দেখা যায় ব্যানারের সেই দগ্ধ শিশুটির যন্ত্রনাকাতর চেহারা, এক মুহূর্তের জন্য দুজনকে একই মানুষ মনে হয়। চলন্ত বাসের উঁচু সিঁড়িতে ভারী ব্যাগ নিয়ে উঠতে কষ্ট হয় তার, মা বুঝে না, পেছন থেকে তাগাদা দেয়। দেরি করলে মহিলা সিট সব ভরে যাবে যে।
মেয়েটির মুখে ক্লান্তির ছাপ, শুকনো ঠোঁটগুলো জানান দিচ্ছে সে ক্ষুধার্ত। আপাতত কুড়মুড়ে আলু ভাজা খেয়ে খালি পেটকে সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে।
চৈত্র মাসের তপ্ত নগরীর রাজপথে এখন ট্রাফিক জ্যাম। শত শত গাড়ির ধোঁয়া বাতাসে ইলিউশন সৃষ্টি করে, দূর থেকে দেখলে টলটলে পানির মত লাগে গাড়িগুলোর ছবি।
চোখে রঙচঙে ফ্রেমের চশমা পড়ে মহিলা সিটের সুন্দর মেয়েটির পাশে বসেছিল এক ছাত্র। মেয়েটির চুল থেকে সুন্দর গন্ধ আসছে, ভেজা চুল বাতাসে খানিকটা এসে পড়ছে ছেলেটির মুখে। প্রচণ্ড গরমেও নিজেকে আকর্ষণীয় দেখানোর চেষ্টা চলছিল, কখনও চুলে হাত বুলিয়ে কখনও বা স্মার্টফোনটি পকেট থেকে বের করে।
যুবকটির বাড়া ভাতে ছাই দিতে হাজির এক মুরুব্বী।
হাতে ভারী ব্যাগ নিয়ে বাসে ঝুলতে ঝুলতে চোখের দৃষ্টি দিয়ে তিনি বুঝিয়ে দিলেন, ছেলেটির সিট ছেড়ে দিয়ে তাকে বসতে দেয়া উচিত।
এ যাত্রা আর মেয়েটির সঙ্গে কথা বলা হল না।
রিক্সা স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে থাকা রিকশাওয়ালারা আবার কাজে নেমেছে। গোসল আর খাওয়াদাওয়া শেষে কেউ কেউ পান চিবাতে চিবাতে যাত্রী ডাকতে ব্যস্ত। দুপুরের শেষ প্রহরের সোনালী রোদে তাদের তেল দেয়া চুল ঝিলিক মারে।
রিকশায় চলতে চলতে দেখা যায় অফিস পাড়ার আলস্য। রাস্তায় লোকজন কম, বড় দালানের দারোয়ানদের হাতে চায়ের কাপ, চলছে গল্পগুজব।
নির্মাণাধীন এক দালানের দেয়ালে লাগানো পোস্টারে ভারতীয় নায়কের মুখ, সৈনিক হলে মুক্তি পাচ্ছে কয়েক বছরের পুরনো এক হিন্দি সিনেমা।
নায়কের পাশে হাস্যজ্জল নায়িকার মুখ তেমন বুঝা যায় না, তবে চকচকে ব্লাউজ ঢাকা এক স্তন আলাদাভাবে চোখে পড়ছে।
কাছের এক সরকারি কলেজ থেকে শোনা যাচ্ছে মিছিলের অস্পষ্ট স্লোগান। মিছিলের খবর টের পেতেই সতর্ক হয়ে বসে আসে পাশের দোকানি আর দারোয়ানরা।
মিছিল এগিয়ে যায়, বুক ফুলিয়ে হাঁটা যুবকগুলোর চোখে হিংস্রতা চারপাশের সতর্কতা যেন আরেকটু বাড়িয়ে দেয়। সূর্যের উজ্জ্বলতা কমতে থাকে, দিগন্তের পানে ছুটে অগ্নিপিণ্ডটি। বিকেল হতে চলল, এবার শুরু হবে নতুন ব্যস্ততা।
ছবিঃ আমার গ্র্যানীর বাড়ির বারান্দা
©somewhere in net ltd.