নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

শুধু দেখি আর লিখি, কী আছে আর জীবনে!

জেডিপি

লিখতে ভালোবাসি, প্রকৃতি ও প্রাণীপ্রেমী।

জেডিপি › বিস্তারিত পোস্টঃ

চলচ্চিত্র চর্চাঃ রশোমন

০১ লা নভেম্বর, ২০১৭ সকাল ১১:৫১



মানবজাতির সবকিছুই নির্ভর করে তার অস্তিত্বের উপর, অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখার জন্যই তার যত চেষ্টা। অস্তিত্বে আঘাত লাগলে অন্য যেকোনো প্রাণীর মত মানুষও পড়ে নেয় আত্মরক্ষার বর্ম। সন্দেহের তীরকে নানা মিথ্যার মিশেলে সংশয়ে পরিণত করতেও পিছপা হয় না সে, এ যে প্রাণী হিসেবে তার সহজাত প্রবৃত্তি!

‘রশোমন’ সিনেমার কাহিনী আবর্তিত হয়েছে একটি ঘটনাকে ঘিরেই, কিন্তু পাত্রপাত্রীর বলার ভঙ্গীর কারণে মনে হতে পারে যেন আমরা শুনছি অনেকগুলো গল্প। একই ঘটনা বিবরণের এই ভিন্নতা আসে শুধুমাত্র দৃষ্টিভঙ্গির কারণে, পাশাপাশি কাজ করে ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের গা বাঁচানোর প্রবণতা।

শুরুতেই আমরা দেখি ঝুম বৃষ্টির মধ্যে কোন এক পুরনো মন্দিরে এসে আশ্রয় নিয়েছে তিন ব্যক্তি—এক কাঠুরে, এক পুরোহিত এবং এক সাধারণ গ্রামবাসী। বৃষ্টিভেজা সেই বিষণ্ণ দিনে হতাশ হয়ে মন্দিরের সিঁড়িতে বসে থাকতে দেখা যায় কাঠুরে লোকটিকে, বিধ্বস্ত মন্দিরের দৈন্যদশা যেন তার মনের অবস্থাকেই ইঙ্গিত করে। পুরোহিতের সঙ্গে সে কোন একটা ঘটনা নিয়ে আলোচনায় মত্ত হয়, কাঠুরের হতাশা ছুঁয়ে যায় তাকেও। ঘটনাটি কী, তখনও জানা যায় না। কিন্তু একে যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ, মহামারি এমনকি ডাকাতির চেয়েও ভয়ঙ্কর বলে অভিহিত করে পুরোহিত লোকটি।

সিনেমার এই পর্যন্ত দেখলে মনে হতে পারে যেন বৃষ্টির মধ্যে আটকে পড়া লোকগুলো সময় কাটানোর জন্য একটি তুচ্ছ ঘটনাকে বড় করে আলোচনার খোরাক যোগাচ্ছেন। তবে কাহিনী যত এগিয়ে যায়, দর্শকের মনে তার অজান্তেই সংশয়ের ধোঁয়ার সৃষ্টি হয় একটু একটু করে। সিনেমাটির সঙ্গে দর্শক আরও সম্পৃক্ত হয়, কারণ শুরু থেকেই এখানে দর্শকের ভূমিকা নিশ্চিত করেন পরিচালক। ভূমিকাটি হল, একজন পর্যবেক্ষকের।

গল্প শুরু হয় কাঠুরের বর্ণনায়। দর্শক হিসেবে ততক্ষণে আমরা জেনে ফেলি, প্রবেশ করছি এক গোলকধাঁধায়। কাঠুরের কুড়াল অনুসরণ করেই আমাদের দৃষ্টি প্রবেশ করে ঘন জঙ্গলে। কুড়াল নিয়ে যখন কাঠুরে গহীন বনে হেঁটে যায়, তখন পাতার ঘন বুনটের ফাঁক দিয়ে উঁকি মেরে রহস্যময় আবহের সৃষ্টি করে মধ্যগগণে তাকিয়ে থাকা সূর্য। উঁচু গাছের উপর থেকে ধারণ করা ডাচ শট তুলে ধরে এই বিশাল জঙ্গলে বুকে কাঠুরের একাকীত্ব। তবে দর্শকের নড়েচড়ে বসার সময় আসে গাছের পাতায় লটকে থাকা এক মহিলার টুপির সন্ধান পাওয়ার পর। কাঠুরের বর্ণনাতেই আসে সিনেমার প্রথম চমক, সামুরাইয়ের মরদেহ।

‘রশোমন’এ একই গল্পকে ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তির বর্ণনায় বলা হয়েছে, যার প্রভাব দেখা যায় এর চিত্রায়নেও। কাঠুরে যখন সামুরাইয়ের মৃতদেহের বর্ণনা দেন, তখন আমরা তা দেখি ভৌতিকভাবে। আবার যখন একই বর্ণনা শুনি ডাকাতের মুখে, তখন সামুরাইয়ের ব্যর্থতা আর দুর্বলতা ফুটে উঠে।

একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয় ডাকাতের হাতে সামুরাইয়ের ধর্ষণের ঘটনাকে কেন্দ্র করে। ডাকাতের ভাষ্যে, প্রথমে রাজি না হলেও পরে স্বেচ্ছায় নিজেকে সঁপে দেন সামুরাই পত্নী। তবে এই কথা পুরোপুরি অস্বীকার করে ধর্ষণের স্বীকার হওয়ার অভিযোগ আসে নারীটির কাছ থেকে।

নিজেকে বাঁচিয়ে দোষারোপের খেলায় মেতে উঠে প্রতিটি চরিত্র, বাদ যায় না পরপার থেকে ডেকে আনা নিহত সামুরাইয়ের আত্মাও। ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে, এই প্রবাদটা যেন অক্ষরে অক্ষরে মিলে যায় ‘রশোমন’এর গল্পের সঙ্গে।

‘রশোমন’এর গল্পটাই এমন, যে দর্শককে শুরু থেকে আটকে রাখে সংশয়ের মায়াজালে। তাহলে এখানে পরিচালক হিসেবে আকিরা কুরাসাওয়ার কারসাজিটা আসলে কোথায়? উত্তর হল, পুরো সিনেমাতেই। তার কৃতিত্ব যেখানে আসে, তার নাম চলচ্চিত্রের ভাষা। একটি সাদাকালো সিনেমায় গল্প বলার জন্য গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হয়ে দাঁড়ায় আলো, আর ‘রশোমন’এ প্রাকৃতিক আলোর ব্যবহার হয়েছে দৃষ্টান্তমূলক ভাবে।

সামুরাইয়ের স্ত্রীর বর্ণনা দিতে গিয়ে ডাকাতটি বলেছিল যেন সে দেখেছে কোন দেবীকে। সামুরাইকে ফুঁসলিয়ে দূর করার পর জলের ধারে একাকী বসে থাকা তার স্ত্রীকে যখন পাহাড়ের উপর থেকে দেখে ডাকাতটি, তখন গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে পড়া রোদে তাকে দেবীর মতই দেখায়। আমরা বুঝতে পারি যে তাকে আমরা দেখছি ডাকাতের দৃষ্টিভঙ্গী থেকে।

পাহাড়ের উপর থেকে মহিলাটিকে ডাকাতের লুকিয়ে লুকিয়ে দেখার ভঙ্গীতে এক ধরণের পাশবিক লোভেরও পরিচয় পাওয়া যায়। যা পরবর্তীতে তার চরিত্রে ফুটে উঠে। যখন তাকে আক্রমণ করে ডাকাত, তখন ধস্তাধস্তির এক পর্যায়ে হার মেনে নেয় সামুরাই পত্নী। জ্বলন্ত সূর্যের দিকে তার অসহায় দৃষ্টি দেখে মনে হয় যেন বাঁচার শেষ আশা খুঁজছেন তিনি।

চরিত্রদের বলার ধরণ অনুযায়ী শুধু কম্পোজিশনই বদলেনি, বদলেছে ফ্রেম ও ক্যামেরা অ্যাঙ্গেলও। ফলে কে সত্যি বলছে, তা বুঝতে দর্শককে কোন সুযোগ দেন না কুরাসাওয়া। সংশয় থেকে যায় শেষ অবধি।

‘রশোমন’ বলেছে মানব মনের সেই অন্ধকার দিকগুলোর গল্প, যা আমরা প্রতিনিয়ত নিজের ভেতর নিয়ে বয়ে বেড়াই, কিন্তু নিজের কাছেই স্বীকার করতে চাই না। এই দ্বন্দ্ব, আত্মরক্ষার যুদ্ধ আমাদেরই। দিনশেষে আমরা অন্যের অপরাধ নিমেষেই দেখি, ততোটা সহজে নিজের দোষ দেখতে পাই না।









মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.