নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

শুধু দেখি আর লিখি, কী আছে আর জীবনে!

জেডিপি

লিখতে ভালোবাসি, প্রকৃতি ও প্রাণীপ্রেমী।

জেডিপি › বিস্তারিত পোস্টঃ

খেয়ালির খেয়ালিপনা

১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২০ দুপুর ১:১৬

১০১, ক্রিসেন্ট রোডের তৃতীয় গল্প

নারীমহলে খেয়ালি হিসেবেই পরিচিত ছিল সে। ক্রিসেন্ট রোডের শেষ মাথায় মেহেদি দেয়া লাল চুলের রাগি মহিলার পুরোনো বাড়িটির সিঁড়িঘরের চূড়ায় বসে একা একা গান গেয়ে কাটিয়েছে পুরো বসন্ত। তার গান শুনে কে না মজেছে! চড়ুই সমাজের মহিলাদের মনেও একবার ইচ্ছা জেগেছিল, ইশ! যদি তারা দোয়েল হত! খেয়ালি দোয়েলের গানের তালে তালে তারা নেচে বেড়াতো। কে জানে, হয়ত খেয়ালির সুনজর পড়ত তাদের দিকেও। ফাল্গুনের বিকালে উষ্ণ বাতাসে ফুলের সুবাসের মত ছড়িয়ে পড়ত খেয়ালির মিষ্টি গান, এলাকার কোকিলরা শুধু চৈত্রের দুপুরগুলোতে সুযোগ পেত নিজের কণ্ঠ ঝালানোর, বাকিটা সময় দখল করে থাকতো খেয়ালি দোয়েল। এইটুকু সময়ও কোকিলদের কণ্ঠ ছাপিয়ে ক্লান্ত স্বরে নিজের উপস্থিতি জানান দেয় এক দাঁড়কাক। জ্যৈষ্ঠের গরমে ওষ্ঠাগত প্রাণ এলাকাবাসীর গ্রীষ্ম উদযাপন যেন পূর্ণতা কার্নিশে বসা কা কা কা শুনে।

কিন্তু খেয়ালির গিন্নি তার খামখেয়ালি স্বামীকে চোখে চোখে রেখেছে পুরোটা সময়। খেয়ালির তীক্ষ্ম কণ্ঠের সুর যখন ক্রিসেন্ট রোডের দালানগুলোর থাই গ্লাসে প্রতিফলিত হয়ে ছড়িয়ে পড়ত এলিফেন্ট রোড পর্যন্ত, তখন সেই ধ্বনি অনুসরণ করলে এলাকার লোকজনের চোখে পড়ত সিঁড়িঘরের চূড়ায় বসা খেয়ালির ঠিক পেছনে লোহার পানির পাইপে বসে আছে তার গিন্নি৷ কখনও সিঁড়ির চূড়ায় বসে গাইতে গাইতে ক্লান্ত হয়ে প্রাইম ব্যাংকের কাছে বন্ধক দেয়া নীল চুনকাম করা নয়তলা বাড়ির চিলেকোঠায় বানানো লাউয়ের মাচার উপর গিয়ে আসর জমাতো খেয়ালি। গ্রীষ্মের আগমনে তপ্ত হয়ে উঠা বিকেলগুলোতে একটু বাতাসের আশায় বারান্দায় দাঁড়িয়ে গল্প করা কিংবা জানালায় মুখ বের করা এলাকাবাসীর নজর তখন চলে যেত নীল চুনকাম করা প্রাইম ব্যাংকের কাছে বন্ধক রাখা বাড়ির চিলেকোঠায়। লক্ষ্য করলেই দেখা যেত, সাথে লাগোয়া রঙহীন এক বাড়ির সোলার প্যানেলের উপর বসে ধূসর দেহ ফুলিয়ে কাকে যেন শাসাচ্ছে গিন্নি দোয়েল।
পেটে ডিম আসার পরও গিন্নির তেজ কমেনি, কাকেরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষার নামে খেয়ালিকে গান গাইতে বন্ধ করার নোটিস বাবদ বেশ কয়েকবার ঠোকর দেয়ার চেষ্টা করলেও উল্টো গিন্নির ঠোকর খেয়ে দূরে গিয়ে বসেছে।
ষাটোর্ধ্ব ডাক্তার মহসিন তালুকদারের ছাদ বাগানে বেড়ে ওঠা চীন থেকে আনা বাঁশঝাড়ে ডালে লাগানো মাটির হাঁড়িতে খেয়ালি গিন্নি যখন ডিম পাড়ল, তখন ঘোর বর্ষা। ঝিরি ঝিরি বৃষ্টি সারাটা দিন কিছুক্ষণ পরপর সিক্ত করে দিয়ে যায় সবকিছু। শহরের ধুলো মুছে সব গাছের পাতা যখন ঝকঝকে সবুজ হয়ে মেঘ কেটে গিয়ে উঁকি দেয়া সূর্যের আলোতে ঝিলিক মারছিল, তখন হাঁড়ির পাশের পাইপে বসে গান গাইতে দেখা যায় খেয়ালিকে। বাবা হওয়ার পর খেয়ালির আমূল পরিবর্তন সবার চোখে পড়ে। এই তো সেদিনের কথা, বসন্তের শেষে তখন পুরো পাখি সমাজে বাসা খোঁজার তোড়জোড় চলছে। ডিম ঘরে তোলার কাজে ব্যস্ত সবাই। এক ঝুঁটি শালিক এসেছিল বাসা দেখতে। ঝুঁটি কি ছাই জানতো হাঁড়ির বাসা দখল হয়ে গেছে? বউয়ের পেটে ডিম আসার পর থেকে বাসা খোঁজার চাপে সে হন্যে হয়ে দিন কাটাচ্ছিল। যেই না সে বাঁশ গাছটার কাছাকাছি এল, এমন সময় কোথেকে ভোঁ করে এসে ঠোকর দিল খেয়ালি। হতভম্ব ঝুঁটি সেই যে পালালো, এরপর আর এ পথ মাড়ায়নি।

কলম করা কাঁচামিঠা আমগাছের পাতায় বসে জিরিয়ে নিতে নিতে চড়ুইরা আলাপ করে খেয়ালি দোয়েলকে নিয়ে। বটপাতায় ভেজা গা মুছে তাদের সঙ্গে আলাপ জমায় হলদে পেটের টুনটুনি।
সেদিন কার্নিশে রাখা এসির উপর বসে কী যেন চক্রান্ত করছিল দুই কাক। তাদের দেখে হাঁড়ির ভেতর থেকে স্বামীকে ডেকে কী যেন বলে ডিমে তা দিতে থাকা গিন্নি দোয়েল। গিন্নির কথাগুলো শুনে খেয়ালি কিছুক্ষণ বসে রইল। এরপর চুপচাপ পাইপ থেকে নেমে নয়নতারা ফুলের মধু খেতে আসা কালোর মধ্যে হলুদ ছোপছোপ প্রমাণ সাইজের প্রজাপতিটাকে ধরে সবার চোখের সামনে চিবিয়ে খেয়ে ফেলে পানের খিলির মত। কাকগুলো কিছুক্ষণের জন্য সেদিন কা কা করা বন্ধ করে দিয়েছিল খেয়ালির এই রূপ দেখে। বটপাতায় ভেজা গা মুছছিল হলদে পেটের টুনটুনি, খেয়ালির সঙ্গে আলাপ জমাবার ইচ্ছা ছিল তার। কিন্তু অপ্রস্তুত প্রজাপতিটির এহেন পরিণতি দেখে সুযোগ বুঝে কেটে পড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল টুনটুনিটি। এরপর বেশ কদিন ক্রিসেন্ট রোডের সেই ছাদ বাগানে প্রজাপতির আগমন দেখা যায়নি। ভ্রমররাও নাকি বেশ বুঝেশুনে আসতো।
শরতের কিছু আগেই একদিন উড়াল দেয় খেয়ালির ছেলে। এরপর শেষ বিকেলের সোনালী রোদে মাঝেমাঝে কার্নিশ ঘেঁষে বাবার সঙ্গে উড়তে দেখা যেত ছেলেটিকে। এসির বাক্সের পাশে লাফিয়ে লাফিয়ে ছেলেকে ঠোকর দেয়া শেখাতো খেয়ালি। তখন বাবা আর ছেলেকে দূর থেকে দেখত গিন্নি দোয়েল। কমলা রোদ আর আকাশে মেঘের ভেলা তখন এলাকাবাসীকে ভুলিয়ে দিয়েছিল যে খেয়ালি বেশ কদিন ধরে আর গান গায় না।
এদিকে শুক্রবার ভর দুপুরে যখন সবাই ভাতঘুম দিচ্ছিল, বিড়ালগুলোও খাওয়া শেষে টিনের চালে আয়েশ করে বসে বোঝা নামাতে ব্যস্ত ছিল, তখন অদূরে নির্মাণাধীন এক দালানের সুনসান ছাদে বসেছিল কাকদের সভা। সাপ্তাহিক এই সভায় সিদ্ধান্ত হয় আসন্ন ঘূর্ণিঝড়টা পার হলেই খেয়ালির পরিবারকে উচ্ছেদ করা হবে।
ঘূর্ণিঝড়ের পরের দিন প্রকৃতি খুবই শান্ত ছিল। কার্তিকের শেষের সেই দিনটি যখন জীবজগতের সবাই ঘূর্ণিঝড়ের তান্ডব নিয়ে আলোচনায় ব্যস্ত, সেদিন ষাটোর্ধ্ব ডাক্তার মহসিন তালুকদারের ছাদবাগান এবং তার পাশে মেহেদি লাগানো লালচুলো রাগি মহিলার বাড়ির ছাদ ভরে গেল কাকের দলে। ঝাঁকে ঝাঁকে কাক এল কাঁঠালবাগান, পান্থপথ, গ্রিনরোড, ভূতের গলি, এলিফেন্ট রোড এমনকি বকশিবাজার থেকেও। বিকেলের খবর দেখতে টিভি পর্দায় চোখ সেঁটে থাকা এলাকাবাসী কিংবা লন্ডভন্ড বাসার জন্য নতুন করে খড়কুটো যোগাড় করতে ব্যস্ত পাখি সমাজের তখন একটি দোয়েল পরিবারের কথা ভাবার সময় ছিল না।।
এরপর সেদিন কী হয়েছিল কেউ জানে না। তবে ঘূর্ণিঝড়ের খবর পুরনো হয়ে যাওয়ার পর এবং লন্ডভন্ড বাসা ঠিকঠাক করার পর যখন সবাই আবার কান পাতলো খেয়ালির গান শোনার জন্য, দেখা গেল ছাদবাগানের হাঁড়িটি খালি পড়ে আছে। কিছুদিন খেয়ালি পরিবারের নিরুদ্দেশ হওয়ার হতাশায় শরতের সকালের রোদ গায়ে মাখলো না ক্রিসেন্ট রোডের লোকজন। এরপর আবার যাপিত জীবনে ফিরে গেল তারা।
বর্ষার শেষের দিকে জরুরি কাজে এক সপ্তাহের জন্য কক্সবাজার গেলেন ষাটোর্ধ্ব ডাক্তার মহসিন তালুকদার। তখন বাগান রক্ষণাবেক্ষণের পূর্ণ দায়িত্ব পড়ল আয়নালের উপর। স্যার বাড়িতে না থাকায় বাগানের এক পাশে পুঁইশাক গাছ লাগালো আয়নাল। প্রতিদিন পুঁইশাক গাছটি একটু একটু করে বড় হতে দেখার সময় সে পুঁইশাকগুলো মাঝারি সাইজের চিংড়ি দিয়ে রান্না করে ভাত খাওয়ার স্বপ্ন দেখতে থাকে। সঙ্গে থাকবে সুগন্ধি লেবু। এই বিশেষ খানাপিনার দিন কাউকে দাওয়াত করার কথাও তার মনে হয়। আয়নাল আবিষ্কার করে অচেনা এই শহরে তার আপন বলতে আসলে কেউ নেই। তখন এক পলকের জন্য মনে পড়ে পাশের টিনশেডে বাস করা ছোট বেলার বান্ধবী ঠিকে ঝি আয়েশার কথা। মন থেকে ভাবনাটি ঝেড়ে ফেলে সে ভাবে, আয়েশাকে এক বাটি তরকারি দিয়ে আসা যাবে।
আয়নালের স্বপ্নের বুনন আরও গাঢ় হতে থাকে টানা বৃষ্টির নীল দুপুরগুলোতে। কয়েকদিন ধরে ঝুম বর্ষণে ভাত খেয়ে সিঁড়িঘরের পাশের চার ফুট বাই চার ফুট কক্ষে পাতা চৌকিতে শুয়ে লাল চিংড়ি আর সবুজ পুঁইশাকের স্বপ্ন দেখে আয়নাল।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.