![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
লেখাটির শুরুতে কিছু কথা বলে নেয়া দরকারঃ
এই গল্পটির সঙ্গে আমার 'ক্রিসেন্ট রোড' সিরিজের কোন সম্পর্ক নেই। ওই সিরিজের বাইরে বেশ কয়েকটি গল্প আমি তৈরি করেছি, সময়ের অভাবে লেখা হয়নি। এই গল্পটি হারুকি মুরাকামির লেখার ধাঁচে লিখেছি, ওনার লেখা এতোটাই সাবলীল যে লোভ সামলাতে পারলাম না। এভাবে প্রিয় লেখকদের অনুকরণ করে যাচ্ছি এই আশায়, হয়ত একদিন লিখতে লিখতে আমারও নিজস্ব স্টাইল বের হয়ে আসবে। না লিখলে তা আসার সম্ভাবনা নেই। সম্প্রতি আমি কোরিয়ান এক অভিনেতার প্রেমে পড়েছি, তাকে নিয়েই গল্পটি লেখা। আমি কখনও এরকম তারকাদের প্রেমে পড়ি না, এগুলো আমার কাছে অবাস্তব মনে হয়। কিন্তু লেখালেখি শুরু করার পর কল্পনার দ্বার খুলে গেছে, তাই এখন অবাস্তবকে বাস্তবে রূপ দিতে ভালই লাগে। নিজের জন্য লিখেছিলাম, আশা করছি আরও অচেনা কেউ লেখাটি পড়বেন আর জানাবেন কেমন লাগলো।
এক
প্রায় দশ বছর আগের কথা।
সেদিন খুবই নার্ভাস ছিলাম, ক্যারিয়ারের প্রথম বড় এসাইনমেন্ট। এত বড় দায়িত্ব কখনও পাবো ভাবিনি। চ্যানেলের সিনিয়র রিপোর্টার আজ অসুস্থ না থাকলে এই সুযোগ আসতো না কপালে। এদিকে আমার ভয়াবহ ইন্ট্রোভার্টেড মন বলছে, ‘ভালই হত এই সুযোগ না এলে, এখন এত বড় এক লোকের সাক্ষাৎকার নিতে হবে। একটু প্রিপারেশনেরও সুযোগ পেলাম না।‘
মনকে যতই বুঝাই, সুযোগ হঠাৎ করেই আসে, সে কি আর শোনে! মনের কান্নাকাটি অবস্থা থেকে মাথা কিছুটা নিকোটিন চেয়ে বসল, মাথা ঠান্ডা হলে মনও শান্ত হবে। তাই ক্যামেরা সেটাপ করতে থাকা আজিম ভাইকে জানিয়ে একটু ব্রেক নিলাম। হাঁটতে হাঁটতে চলে এলাম হোটেলের অন্য পাশে। এত বড় হোটেলটা! একপাশ থেকে অপর পাশে গেলে মনে হয় অন্য এলাকায় চলে এসেছি।
লোকজন কম থাকায় বুঝলাম এটা ভিআইপি জোন। স্মোকিং এরিয়াতে কেউ নেই এই সময়টায়। খোলা ব্যালকনি থেকে বিকেলের সাগর দেখা যাচ্ছে। অস্তগামী সূর্য পুরো সাগরটাকে যেন গলানো স্বর্ণের রূপ দিয়েছে। সাগর আজ অন্যান্য সময়ের চেয়ে উত্তাল। আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখলাম তিনি মেঘ সাজাতে ব্যস্ত। দিনের শেষটায় সবাইকে ভিজিয়ে দিয়ে যাওয়ার পাঁয়তারা করছে। দূর সাগরে কয়েকটি জেলে নৌকাকে ব্যস্ত ভঙ্গীতে সৈকতে ফিরে আসতে দেখলাম। সিগারেট মুখে দিয়ে ব্যাগ হাতিয়ে বুঝলাম লাইটার নেই।
ঠিক ওই সময়ে কেউ একজন লাইটার জ্বালিয়ে হাত বাড়িয়ে ইংরেজিতে বলল, ‘সিগারেট খাওয়া কিন্তু ভাল অভ্যাস নয়, সিনোরিতা।‘
চোখ তুলে দেখলাম স্প্যানিশ নয়, এক এশিয়ান ভদ্রলোক, মঙ্গোলিয়ান চেহারা। জাপানিদের মত খাটো নয়, বিশাল লম্বা। অন্তত ৬ ফুট হবে। চীনাদের মত নাক বোঁচাও লাগছে না। কপালের উপর ছড়িয়ে দেয়া এলো চুল। বয়স বুঝা যায় না। ৩০ হতে পারে, ৪০ ও হতে পারে। সাদা স্যুট আর প্যান্টে তাকে সাক্ষাৎ দেবদূতের মত লাগছে। আমি ইংরেজিতে বললাম, ‘সিগারেট খাওয়া ভাল না হলে আপনি লাইটার নিয়ে ঘুরছেন কেন?’
জবাব শুনে হেসে দিলেন তিনি। তার হাসি দেখে কেন যেন আমি একটা ধাক্কা খেলাম। এক মুহূর্তের জন্য ভুলে গেলাম আমি কোথায় এসেছি, কেন এসেছি। পর মুহূর্তে নিজেকে সামলে নিলাম, চোখ রাখলাম উত্তাল সাগরে। আকাশের মেঘ সাজানো শেষ, হাওয়ার গতিবেগ পালটে যাচ্ছে। মনের উপর রাগ হল, এসবের কোন মানে হয়? বাচ্চাদের মত আচরণ আমাকে মানায়?
‘আমি আসলে সিগারেট ছেড়েছি কয়েক মাস হল।‘ বিদেশি বলে চলল। ‘নিজেকে পরীক্ষা করার জন্য পকেটে একটা লাইটার রাখি। সিগারেট তো কেনাই যায়। তারপরও নিজেকে কতখানি আটকাতে পারি তা পরীক্ষা করে দেখছি।‘
‘পরীক্ষার ফল কেমন হচ্ছে?’ আমি কৌতূহলী হলাম।
‘এখন পর্যন্ত পাশের খাতায় আছি।‘
এবার দুজনেই হাসলাম। এরপর কয়েক সেকেন্ড নীরবতা। অচেনা বিদেশি এক লোকের সঙ্গে কী বলা উচিত আমি ভেবে পাচ্ছিলাম না। নীরবতা তিনিই ভাঙলেন।
‘এখানে কি কোন কাজে এসেছেন?’
‘হ্যাঁ।‘ আমি বললাম। ‘এক মন্ত্রীর সাক্ষাৎকার নিতে হবে। জীবনে প্রথম এত বড় এসাইনমেন্ট পেয়েছি।‘
‘তাই নাকি? কংগ্রাচুলেশনস! ক্যারিয়ারের প্রথম বড় এসাইনমেন্ট হলে তো খুশি হওয়ার কথা। আপনাকে দেখে তো খুব একটা খুশি মনে হচ্ছে না।‘
‘আমার আসলেই খুশি লাগছে না।‘ দীর্ঘশ্বাস ফেলে আমি বললাম, ‘খুব নার্ভাস লাগছে। আমি লিখতে পছন্দ করি, অনেক আগে থেকে পত্রিকায় লিখতাম। ওখান থেকেই সাংবাদিকতা পেশায় এসেছি। তবে রিপোর্টিং আমার খুব একটা পছন্দ নয়। আমাদের সিনিয়র রিপোর্টার অসুস্থ, তাই আমাকে পাঠালো।‘
‘আপনি লেখালেখি করেন বুঝি?’
আমি একটু লজ্জা পেলাম। বললাম, ‘না ওরকম কিছু না। ছোটগল্প লিখতে আমার ভাল লাগে।‘
‘তাই? কি ধরণের লেখা লিখেন আপনি?’ বিদেশির খুব কৌতূহল।
‘আমার চোখের সামনে যা দেখি আমি তাই লিখে ফেলি। আমার কাউকে ভাল লাগলে আমি তাকে নিয়ে গল্প লিখতে পছন্দ করি।‘
‘বাহ, মজার তো। গল্পের চরিত্র হয়ে তাদের কেমন লাগে?’
‘সবাই ব্যাপারটা ভাল ভাবে নেয় না শুরুতে। আসলে আজকাল আমাদের জীবন এতই জটিল, সবার সঙ্গে সম্পর্ক ধরে রাখা সম্ভব হয় না। কিন্তু সেই মানুষগুলোকে আমাদের মনে পড়ে। তাই আমি আমার পছন্দের মানুষগুলোকে আমার গল্পের মাধ্যমে চিরকাল আমার কাছে রেখে দিতে চাই।‘
‘আপনার কথা শুনে তো আমার এখন আপনার গল্পের চরিত্র হতে ইচ্ছা করছে। হাহাহা’
আমরা হেসে উঠলাম।
আমি বললাম, ‘আপনার কথা বলুন। আপনি কোত্থেকে এলেন?’
‘আমি!’ বলে মাথা নিচু করে গলা খাঁকারি দিল সে। ‘আমি এসেছি কোরিয়া থেকে।‘
‘ও আচ্ছা! ব্যবসার কাজে বুঝি?‘
বিদেশি মুচকি হেসে বলল, ‘হ্যাঁ ওরকমই কিছু। তবে আজকাল আমার এই ব্যবসাটা আর ভাল লাগছে না। ভাবছি ছেড়ে দিবো।‘
‘কেন? ব্যবসা মন্দা যাচ্ছে?’
‘না মন্দা যাচ্ছে না। আসলে আমি অনেক ছোটবেলা থেকে এই ব্যবসায় জড়িয়ে গেছি। ক্যারিয়ার ছাড়া কখনও কিছু ভাবিনি। এখন আমার বয়স ঊনচল্লিশ, এই বয়সে এসে আমার মনে হচ্ছে আমি সাধারণ জীবন কী তাই জানি না। মাঝে মাঝে বাড়ি ফিরে যেতে ইচ্ছা করে। ওখানে গিয়ে ছোটখাটো কোন ব্যবসা করতে পারলে ভাল হত।‘
‘আরে বাহ! তাহলে দেরি করছেন কেন? তল্পিতল্পা গুটিয়ে চলে যান গ্রামের বাড়ি।‘
বিদেশি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘এত কি সহজ বলেন? আপনিও তো লেখালেখি পছন্দ করেন। আপনি কি পারবেন চাকরি ছেড়ে পুরোদস্তুর লেখক হয়ে যেতে?’
অচেনা এক বিদেশির এই প্রশ্ন আমার ঠিক বুকের মাঝখানে আঘাত করল। আমি কিছুক্ষণ কোন কথা বলতে পারলাম না। ঠিকই তো। এই স্বাধীনতা কি আমার আছে?
প্রসঙ্গ পাল্টানোর জন্য বললাম, ‘তা বাংলাদেশ কেমন লাগছে আপনার?’
‘আজ সকাল থেকে তো ভালই লাগছিল। কিন্তু এখন সাগরের রূপ দেখে একটু চিন্তায় পড়ে গেছি। আমার দেশেও বৃষ্টি হয়, তবে এত দ্রুত প্রকৃতিকে রূপ বদলাতে দেখিনি।‘
আমি হেসে উঠলাম।
‘এখন তো বর্ষাকাল, বাংলাদেশের প্রকৃতি এখন নতুন বউয়ের মত আচরণ করবে। এই রোদ এই বৃষ্টি!’
বিদেশি আমার কথা শুনে খুশি হয়ে বলল, ‘বাহ, সুন্দর উপমা দিয়েছেন তো। সত্যিই মনে হচ্ছে সাহিত্যিকের সঙ্গে কথা বলছি। হাহাহা‘
আমি আবারও লজ্জা পেলাম।
বললাম, ‘আমার সবচেয়ে বেশি ভাল লাগে বাংলাদেশের বৃষ্টি। আমার খুব ইচ্ছা, একদিন আমি এরকম বৃষ্টির দিনে সৈকতে ছাতা হাতে দাঁড়িয়ে কফি খাবো। ঝুম বৃষ্টি পড়বে, পায়ের নিচে থাকবে ভেজা বালুকাবেলা, চোখের সামনে উত্তাল সাগর আর হাতে এক কাপ কফি! সেই কফির উপর বৃষ্টির ফোঁটা পড়তে থাকবে।‘
বিদেশি মুগ্ধ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে কথাগুলো শুনলো, আমি চোখ ফিরিয়ে নিলাম উত্তাল সাগরের দিকে। টের পেলাম, আমার মন এখন এই সাগরের মতই আচরণ করছে। আমি অন্যমনস্ক হওয়ার চেষ্টা করলাম।
হঠাৎ বিকট শব্দে বাজ পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে আমার ব্যাগে রাখা ফোনটাও বেজে উঠলো। আকাশ থেকে নেমে এল ঝুম বৃষ্টি।
আমি ব্যালকনি থেকে ভেতরের করিডরে গিয়ে ফোন ধরলাম, জানতে পারলাম মন্ত্রী সাহেব আজকে সময় দিতে পারছেন না। আগামীকাল সকালে তাকে পাওয়া যাবে। আমি যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। আজকের দিনটা তাও সময় পাওয়া গেল। ক্যামেরাম্যান আজিম ভাইকে জানিয়ে দিলাম।
হঠাৎ মনে পড়ল সেই বিদেশির কথা, ভাবলাম বৃষ্টি দেখে হয়ত চলে গেছে। ব্যালকনিটা কিছুক্ষণ খালি পাওয়া যাবে, চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকবো। গিয়ে দেখি, আগের জায়গাতেই দাঁড়ানো বিদেশি। খোলা ব্যালকনি ছাপিয়ে বৃষ্টির ঝাপটা তার ছিপছিপে গড়নের দেহকে পুরো ভিজিয়ে দিচ্ছে। এলো চুলগুলো ভিজে একাকার। সাদা শার্টের বোতাম বুক পর্যন্ত খোলা, গলা দিয়ে নেমে পড়ছে বৃষ্টির পানি। তার কোন ভ্রূক্ষেপ নেই। তার দৃষ্টি দূরের কোন জেলে নৌকার দিকে আবদ্ধ।
আমাকে পাশে এসে দাঁড়াতে দেখে বিদেশি বলল, ‘আসলেই আপনাদের এখানকার বৃষ্টি অদ্ভুত সুন্দর। আমি কখনও বৃষ্টিকে এভাবে দেখিনি। আমার তুষার খুব পছন্দ। আমার জন্ম হয়েছে বুসান শহরে, ওখানে খুব সুন্দর তুষার পড়ত। বৃষ্টি কখনও আমার এত ভাল লাগেনি। আজ আপনার কথা শুনে অন্যভাবে বৃষ্টিকে অনুভব করছি। ভালই তো!‘
আমি কী মনে করে যেন বললাম, ‘তাহলে চলুন এই সুযোগে আমরা সৈকতে গিয়ে কফি খেয়ে আসি। যাবেন?’
বিদেশি একটু অবাক হল, কিন্তু খুশিও হল।
‘অবশ্যই যাবো। তবে এক মিনিট অপেক্ষা করতে হবে, আমি একটা ফোন করে আসছি।‘
‘ওকে।‘ আমি বললাম।
কিছুদূর গিয়ে কোরিয়ান ভাষায় ফোনে কী কী যেন বলল বিদেশি। এরপর আমাকে এসে বলল, ‘চলুন তাহলে। আমি লবিতে কফি অর্ডার করে দিয়েছি। এতক্ষণে চলে আসার কথা।‘
‘বাহ! ভাল তো। কিন্তু আপনার কাছে ছাতা আছে? আমার তো একটাই ছাতা।‘
কালো মেঘের অন্ধকারে বিদেশি আমার গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বলল, ‘আমাকে নাহয় আপনার ছাতার নিচে একটু জায়গা দিলেন, দিতে পারবেন সিনোরিতা?’
আমি হাসলাম, এক মুহূর্তের জন্য লোকটাকে আর অচেনা লাগলো না। মনে হল অনেকদিনের চেনা কেউ।
দুই
দুজন দুটি কফির কাপ হাতে নিয়ে যখন এক ছাতার নিচে দাঁড়িয়ে ছিলাম তখন বাতাসের তোড় এত বেশি, যে আমাদের প্রায় উড়িয়ে নিয়ে যাবে। সাথে বৃষ্টির ঝাপটা তো আছেই। সাগরের দ্বারে দাঁড়িয়ে বৃষ্টির মধ্যে কফি খাওয়াকে যতটা রোমান্টিক ভেবেছিলাম, এখন আর ততটা লাগছে না।
সৈকতে একটা প্রাণীও নেই, শুধু আমরা দুজন। ঠকঠক করে কাঁপছি। বাতাসের শো শো শব্দে কিছু শোনা যায় না। চিৎকার করে বিদেশিকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনার কেমন লাগছে?
’আমার খুবই ভাল লাগছে। মনে হচ্ছে আমি আমি নই, অন্য কেউ। এই আমি যা মন চায় করতে পারবো। আমি চাইলে এই সৈকতে দৌড়ে বেড়াতে পারবো। কেউ আমাকে কিছু বলবে না, আমার কোন নিয়ম কানুন মানতে হবে না।‘ বিদেশি গড়্গড় করে এত্তগুলো কথা একবারে বলে ফেললো।
তার কথা শুনে আমি কিছুই বুঝলাম না। তিনি তো শিশু নন, যে কেউ আটকে রাখবে। তারপরও আমার লোকটার জন্য খুব মায়া হল। আমি তাকে বললাম, ‘চলুন তাহলে, সৈকতে দৌড়ে আসি।‘
বিদেশি এবার খুবই অবাক হল। বলল, ‘এখনই? না থাক।‘
স্রোতের উদ্দাম নাচন নাকি ঠান্ডা আবহাওয়া, ঠিক কী কারণে জানি না আমার ভেতর অদ্ভুত উত্তেজনা ভর করেছে। আমার মনে হচ্ছে আজ সৈকতের তীর ঘেঁষে এক দৌড় দিতে না পারলে আমার জীবন বৃথা। আমি ছাতা বন্ধ করে ছুঁড়ে ফেললাম। কফির কাপ সৈকতে রেখে দিলাম দৌড়। কিছুদূর গিয়ে পেছন ফিরে দেখি কাকভেজা বিদেশি ঠকঠক করে কাঁপতে কাঁপতে আমার দিকে তাকিয়ে হাসার চেষ্টা করছে।
আমি দৌড়ে এসে তার হাত ধরে টেনে আবার দৌড় দিলাম।
দুজনে অনেকক্ষণ দৌড়ে নিজেদের আবিষ্কার করলাম ঝাউবনের ভেতর। দুজন হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাচ্ছি, কেন জানি না। বৃষ্টি ততক্ষণে ধরে এসেছে।
বিদেশি কাছে এসে বলল, ‘আপনাকে অনেক ধন্যবাদ, এত চমৎকার অভিজ্ঞতার জন্য। আমি কখনও ভাবিনি এমন অভিজ্ঞতা হবে আমার।‘
আমি বললাম, ‘আমি সারাজীবন এমন দৃশ্য কল্পনাই করে গেছি, কখনও ভাবিনি সত্যি সত্যি একদিন এভাবে কফি খাওয়া হবে। তাও আবার এক অচেনা বিদেশির সাথে!’
‘কিন্তু জানেন, আপনাকে আমার একেবারেই অচেনা মনে হচ্ছে না। আপনি কি কখনও কোরিয়াতে গিয়েছিলেন?’
তার কথা শুনে আমি হেসে ফেললাম, ‘আমি দেশের বাইরেই কোনদিন যাইনি। যাওয়ার ইচ্ছা আছে অবশ্য, টাকা জমিয়ে উঠতে পারিনি।‘
বিদেশি আমার খুব কাছে এসে বলল, ‘এত সুন্দর অভিজ্ঞতার জন্য আমি আপনার প্রতি কৃতজ্ঞ থেকে গেলাম। আপনাকে একদিন বুসানের তুষার দেখাবো। ওয়াদা রইল।‘
ঝাউবনে তখনও ঝিরিঝিরি বৃষ্টি। আকাশ পরিষ্কার হচ্ছে, শেষ বিকেলে নীলচে আভা ছড়িয়েছে সবখানে। সবকিছু স্বপ্ন স্বপ্ন লাগছিল। বিদেশি আমার চোখে চোখ রাখলো, আমার গালে হাত রেখে এগিয়ে দিল তার ভেজা ঠোঁট।
আমি পিছিয়ে গেলাম।
আজ যদিও মনে হয় সেদিন পিছিয়ে যাওয়াটা ঠিক হয়নি, অচেনা বিদেশির ঠোঁটে ঠোঁট রাখলে কীইবা এমন ক্ষতি হত।
বললাম, ‘সরি। আমি একটু সেকেলে, এতোটা আধুনিক নই। অচেনা বিদেশিকে চুমু খাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়।‘
বিদেশি লজ্জা পেল, ‘আমি সত্যিই দুঃখিত। আপনি কিছু মনে করবেন না প্লিজ। আমার কী যেন হয়েছিল হঠাৎ।‘
‘না না, ইটস ওকে।‘
হোটেলে ফেরার সময় পুরোটা পথ আমরা কোন কথা বললাম না, অস্বস্তিকর নীরবতা আমাদের ঘিরে রইল।
হোটেলের গেটের কাছাকাছি যখন আমরা চলে এসেছি, ততক্ষণে দিগন্তে উঁকি দিয়েছে বিদায়ী সূর্য। নীলচে আভা সরে গিয়ে কিছুটা কমলা হয়ে উঠেছে চারপাশ। আমি নীরবতা ভেঙ্গে বললাম, ‘জানেন, আজকে আমার জন্মদিন।‘
বিদেশি অবাক হল, ‘তাই নাকি? এতক্ষণ বলেননি কেন?‘
আমি হাসলাম, ‘আমি জন্মদিন সেভাবে পালন করতে পছন্দ করি না। সবাই আমাকে শুভেচ্ছা জানালে আমার খুব লজ্জা লাগে।‘
বিদেশি হো হো করে হেসে উঠলো, ‘যাক বাঁচা গেল, আমি আপনাকে হ্যাপি বার্থডে বলে লজ্জায় ফেলিনি তাহলে!’
আমরা হাসলাম।
বিদেশি বলল, ‘আচ্ছা আপনার নামটাই তো জানা হল না!’
আমি আমার নাম বললাম, তার নাম জানলাম।
ভেজা এলো চুলগুলো কপাল থেকে সরিয়ে বিদেশি আমার চোখে চোখ রাখলো, তার মুখে দিনের শেষ সূর্যের আভা দেখে আমি আবারও সমুদ্রের দিকে তাকাতে বাধ্য হলাম।
বিদেশি জিজ্ঞেস করল, ‘আচ্ছা আপনার কি উপহার পেতেও লজ্জা লাগে?’
আমি বললাম, ‘আপনার সাথে পরিচয় এবং কফি খাওয়া আমার জন্য খুব সুন্দর উপহার ছিল। আর উপহারের প্রয়োজন নেই।‘
বিদেশি বলল, ‘আমি আজ রাতের ফ্লাইটে সিউল চলে যাচ্ছি। যদি কিছু মনে না করেন, আমার সাথে ডিনার করবেন?’
সেদিন আর আমাদের ডিনার করা হয়নি।
ফেরার পথে আমার এক আগের পুরনো পত্রিকার কলিগের সাথে দেখা। কিছুক্ষণ আলাপ করে জানতে পারলাম, বাংলাদেশে প্রথমবারের মত এক কোরিয়ান অভিনেতা এসেছেন আজ। সকালে প্রেস কনফারেন্স ছিল। সবকিছু শুনে আমার কিছুক্ষণ মাথা ঘুরালো। আমি নিজেকে সামলে আমার কলিগের কাছে ছবি দেখতে চাইলাম। ছবি দেখার সময় আমার কলিগ জানালো অভিনেতাকে দুপুরের দিকে এক বাঙালি মেয়ের সঙ্গে সৈকতে দেখা গেছে। এটা নিয়ে এখন কোরিয়ান পত্রিকাগুলো মাতামাতি করছে, কারণ তিনি বিবাহিত!
সেদিন সন্ধ্যায় আমি চুপচাপ রুমে ফিরে এসেছিলাম। এরপর আর কখনও কফি খেতে পারিনি, আজও শুধু চা খাই।
তিন
বিদেশি লোকটাকে এর পরের কয়েক বছরে অনেকবার নিউজে দেখেছি। অস্বস্তি আর কৌতূহল নিয়ে। অনেক বছর পর আজ মনে হয় সেই দিন, সেই মুহূর্তটা হয়ত স্বপ্ন ছিল। ধীরে ধীরে লোকটা আমার চোখের সামনেই স্ত্রীকে ডিভোর্স দিল। একের পর এক প্রেম করল। তার চামড়ায় ভাঁজ পড়ার পর আজকাল তাকে অভিনয় করতে কম দেখা যায়। এদিকে আমি সাংবাদিকতা ছেড়ে দিয়ে পুরোদস্তুর লেখক হয়ে যাই আরও পাঁচ বছর পর। ইংরেজি ভাষায় লেখার কারণে আজকাল আমার বই বিশ্বব্যাপী অনেকেই পড়ে। মাঝে মাঝে বুক ট্যুরে যেতে হয় বিভিন্ন দেশে।
গত সপ্তাহে এক সন্ধ্যায় জাপান যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছি, পরের দিন ফ্লাইট। হঠাৎ দরজায় শব্দ। খুলে দেখি আমার এজেন্ট। হাতে মিষ্টির বক্স। উত্তেজিত ভঙ্গীতে ভেতরে ঢুকে বলল, ‘আপা, একটা চরম সুখবর আছে।‘
আমার এজেন্ট সবকিছুকে একটু বাড়িয়ে বলে, অল্পতেই খুশি হওয়া তার স্বভাব। আমি অবাক হলাম না।
জিজ্ঞেস করলাম, ‘কি খবর?’
‘কোরিয়া থেকে এক এজেন্ট আমাকে নক করেছে গতকাল। আপনার পার্সোনাল ঠিকানা জানতে চায়। আপনার উপন্যাসের উপর সিনেমা বানাবে মনে হয়। মিষ্টি খান আপা।‘
আমার দিকে মিষ্টি এগিয়ে দিতে আমি হাতের ইশারায় টেবিলে রাখতে বললাম। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কোন বইটার গল্পের উপর বানাতে চায় কিছু বলেছে? আপনি কি ঠিকানা দিয়েছেন?’
এজেন্ট উত্তেজিত হয়ে মিষ্টি খেতে খেতে বলল, ‘বলেছে আপনার সাথে পার্সোনালি যোগাযোগ করবে। এখন শুধু একটা ইমেইলের অপেক্ষা।‘
আমি হতাশ ভঙ্গীতে মাথা নাড়লাম, ‘মিষ্টিটা আরেকটু পরেই আনতে পারতেন।‘
জাপান থেকে ফিরতে ফিরতে এক সপ্তাহ পার হয়ে গেল। সাকুরার মৌসুমে গিয়েছিলাম, উৎসব শেষ না করে আসতে ইচ্ছা করেনি। এসে দেখি আমার লেখার টেবিলের উপর একটা চিঠি, আন্তর্জাতিক মেইলের সিল মারা। প্রেরকের ঠিকানায় শুধু লেখাঃ বুসান, কোরিয়া।
বুসান? আমার বুকটা কেঁপে উঠল। অনেকদিন পর পুরনো এক অনুভূতির স্বাদ পেলাম। চুপচাপ চিঠিটা খুললাম। হাতে লেখা চিঠি, ভাষা ইংরেজি।
‘ইয়োনোসেও সিনোরিতা!
এত বছর পর আমার কথা মনে আছে কী না আমি জানি না। তবে আপনার কথা আমি কখনও ভুলতে পারিনি। আপনার ঠিকানা যোগাড় করার অনেক চেষ্টা করেছি এত বছর। বাংলাদেশে পরিচিত কেউ ছিল না, তারপরও চ্যানেলগুলোতে খোঁজ নিয়েছি। অবশেষে জানতে পারলাম আপনি চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন। এরপর হতাশ হয়ে ভেবেছিলাম আর কোনদিনও আপনার খোঁজ পাবো না। বছর খানেক আগে টোকিওর এক বুকস্টোরে আপনার ছবি দেখে চমকে যাই। আপনি লেখালেখিকে পেশা হিসেবে নিয়েছেন জেনে সেদিন খুবই ভাল লেগেছিল। আপনি জেনে খুশি হবেন, আপনার লেখক হওয়ার খবর জানার পর আমার মধ্যে আমূল পরিবর্তন আসে। আমিও রিটায়ার করেছি এর পরের বছর। অবশ্য বয়স বাড়ার কারণে অনেকদিন ধরেই অভিনয় কম করতাম, প্রযোজনাতেই বেশি থাকতাম। তাও ছেড়ে দিয়েছি আজ দুই বছর হল। বুসানে নিজের বাড়িতে এসে একটা রেস্তোরাঁ দিয়েছি। জানেন, আমার রেস্তোরাঁ পুরোটা আমি কাঁচের দেয়াল দিয়ে সাজিয়েছি। যেন তুষার পড়লে দেখা যায়। এখানে বৃষ্টিতেও খুব সুন্দর লাগে। আপনি বিশ্বাস করবেন কীনা জানি না, মাঝে মাঝে বৃষ্টির দিনে কফি খেতে খেতে আমি আপনার কথা ভাবি।
আপনি সেদিন রাতে ডিনারে কেন আসেননি আমি বুঝতে পেরেছিলাম। আমি অনেকক্ষণ অপেক্ষা করেছিলাম। আমার খুব খারাপ লেগেছিল, কিন্তু আপনাকে দোষ দিতেও পারিনি। হয়ত আমারই আপনাকে নিজের পরিচয় দেয়া উচিত ছিল। ভেবেছিলাম ডিনার করতে করতে বলবো, কিন্তু সেই সুযোগ আর পেলাম কই!
আপনার কথা আমার এত বেশি মনে পড়ে কেন জানেন? কারণ আপনি আমাকে একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে দেখেছিলেন, কোন অভিনেতা বা তারকা হিসেবে নয়। আমি খুব ছোটবেলায় অভিনয় ক্যারিয়ার শুরু করেছিলাম, এরপর থেকে কোনদিনও আমাকে কেউ সাধারণ মানুষ হিসেবে দেখেনি। খ্যাতি আমার ভালই লাগতো। কিন্তু নিজের মধ্যে স্থায়ী এক জড়তা চলে এসেছিল। আমি অনেকদিন রাস্তায় নিজের ইচ্ছামত হাঁটতে পারিনি। কিন্তু আপনার সাথে অচেনা দেশের অচেনা শহরে এভাবে পাগলামি করতে খুব ভাল লেগেছিল। ওইটাই আমার প্রথম এবং শেষ পাগলামি ছিল। ওই একটি দিনের জন্য আমি আপনার প্রতি চিরকাল কৃতজ্ঞ।
আপনার কাছে আমার একটা ডিনার কিন্তু পাওনা রয়ে গেছে। আমি জানি না আপনার জীবন এখন কেমন, হয়ত আপনার এখন নিজের পরিবার আছে। তারপরও একদিন পুরনো বন্ধুর সঙ্গে ডিনার খেতে খেতে তুষার দেখাই যায়, কি বলেন?
এবারের বড়দিনে বুসানে আপনার আমন্ত্রণ রইল। ইচ্ছা হলে আসবেন। অপেক্ষায় থাকবো।
আমার ঠিকানাঃ
(ঠিকানা দেয়া)
কামসাহমনিদা!
শেষ কথাঃ
বড়দিনের কিছু আগেই বুসান গিয়েছিলাম। রাতের ফ্লাইটে নেমেছিলাম শহরটায়, তুষারে ঢাকা রাতের বুসান দেখতে আসলেই অদ্ভুত সুন্দর। হোটেলে চেকইন দিয়ে হাঁটতে বের হয়েছিলাম। বিদেশির দেয়া ঠিকানা ধরে যেতেই দেখেছিলাম, রাস্তার ওপারে একটা সুন্দর ক্যাফে। অনেক রাত তখন। ক্যাফের লাইট বন্ধ করে শাটার নামিয়ে একটা লোককে বের হয়ে আসতে দেখলাম। কুঁচকে যাওয়া চামড়ায় সেই আগের জৌলুস চোখে পড়ে। ঠিক আগের মতই এলো চুল কপালে ছড়ানো। লম্বা ছিপছিপে শরীর।
কখন যেন হাঁটতে হাঁটতে আমি রেস্তোরাঁর দরজায় চলে যাই। লোকটা সিগারেট ধরিয়ে লাইটার খুঁজছিল।
আমি লাইটার ধরিয়ে সামনে গিয়ে বলেছিলাম, ‘সিগারেট খাওয়া কিন্তু ভাল অভ্যাস নয় সিনর।‘
সমাপ্ত!
©somewhere in net ltd.