নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

স্রোতের বিপরীতে নৌকা ভাসানো এক বোকা মাঝি!

আহাম্মেদ সকাল জিকু

আহাম্মেদ সকাল জিকু › বিস্তারিত পোস্টঃ

ওয়ান মিনিট আইসক্রিম (ছোট গল্প)

১৭ ই জুলাই, ২০২০ সন্ধ্যা ৬:৩০

সকাল আট টা বাজে প্রায়। অথচ এখনো কাওরানবাজারের জ্যামটাই ছাড়তেই পারলাম না। সকাল আট টার লঞ্চ আজ আর পাচ্ছি না এটা নিশ্চিত! নীরা নিশ্চয়ই ওদিকে লালকুঠি ঘাটে বসে বসে বিরক্ত হচ্ছে আমার উপর!! রেগে বোম হয়ে বোধহয় সুইচ অফ করে রেখেছে! ফোনে পাচ্ছি না, অনেকক্ষন ধরে!
আমার আর কি দোষ!!
কাল রাতে বারবার করে বললাম, তাড়াতাড়ি ঘুমাই।
না ঘুমালে সকাল সকাল উঠাটা আমার জন্য মুস্কিল হয়ে পড়বে। কে শুনে কার কথা....
না, উনি আরও কিছুক্ষণ নেটে থাকবেন!
নেট যখন ছেড়ে গেল, ঘড়িতে তখন রাত দু'টো প্রায়।
আগামীকাল নির্ঘাত ধরা খেতে হবে! তখনই বুঝে গিয়েছিলাম!

শুক্রবার আজ।
ছুটির সকাল হলেও এখানে ছোটখাটো একটা জটলা আছেই।
যদিও এখানে জ্যামটা নিত্যকার চিত্র। দেশের বৃহত্তম পাইকারি বাজার বলে কথা!

নীরা অনেকদিন ধরেই বলছিলো, চাঁদপুরের বিখ্যাত ওয়ান মিনিট আইসক্রিম খাওয়ার কথা। আমি আজ এখানে তো, কাল ওখানে গ্রুপ নিয়ে, ট্যুরে ব্যস্ত! সময় করে উঠতে পারিনা খুব একটা!!
এ নিয়ে নীরারও অভিযোগের অন্ত নেই।

এই সপ্তাহে কোন ট্যুর নেই। নেই বলতে ইচ্ছে করেই ইভেন্ট রাখিনি। আজ নীরার জম্মদিন। জম্মদিনে তাকে সারপ্রাইজ দেওয়া উচিত মনে হতেই হুটহাট সিদ্ধান্ত নিয়েছি। নীরা কে জানালাম গতকাল সন্ধ্যায়!
শুনে একবার বেশ উচ্ছাস প্রকাশ যদিও করেছিলো, পরক্ষনেই কেমন যেন দমে গেল!
বরাবরই নীরা অমন। মাঝে মধ্যেই কেমন যেন উদাস হয়ে যায়। হঠাৎ করেই চুপসে যাওয়ার অভ্যাসটা তার সাথে পরিচয়ের শুরু থেকেই দেখছি। তবে ইদানীং সমস্যাটা বেড়েছেই।কোন একটা বিষয় নিয়ে নীরা প্রায়শই মনমরা হয়ে থাকছে ...

নীরার মুখে শুনলাম, তাঁর স্বামীকে নাকি দু'একবার অফিসের সামনের রাস্তায় ঘুরাঘুরি করতে দেখেছে সে!
সেইবার সাঈদা আপার জোর প্রচেষ্টায় জেল হয়েছিলো শয়তানটার। অসভ্য জানোয়ার টা জামিন পেলো কি না, কে জানে! বাড়ীওয়ালার নেশাখোর ছেলেটাও ইদানিং তার পিছু নিয়েছে! বাড়ীওয়ালা খুবি ভালো মানুষ। ছেলেকে ঢেকে শাষিয়ে দিয়েছেন। এরপর থেকে অবশ্য বাড়ীওয়ালার ছেলেকে আর দেখেনি সে।

নীরার সাথে পরিচয় বছর তিনেক আগে।
নীলক্ষেতের বাকুশাহ মার্কেটের ডিজিটাল প্রিন্টের দোকানে একটা জরুরি ব্যানার ডিজাইনের কাজ করাচ্ছিলাম। পরদিনই গ্রুপ নিয়ে রাঙ্গামাটি ট্যুরে যাওয়ার কথা। কাজটা ধরা মাত্র বিদ্যুত চলে গেল। বিকল্প ব্যাবস্থা না থাকায়, অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোনো উপায়ও ছিলোনা। বিদ্যুৎ না থাকায় ঘরময় চার্জ লাইটের আলো জলছিলো। এদিকটায় জেনারেটরের ব্যবস্থা থাকলেও একটা নির্দিষ্ট সময় শেষে সেটির সার্ভিস বন্ধ করে দেওয়া হয় বলে আপাতত চার্জলাইটই ভরসা।

ভ্যাপসা গরমে এদিক ওদিক তাকিয়ে একটি হাত পাখার সন্ধান করতেই সোফার এক কোনে বসে ঘামতে থাকা নীরার দিকে চোখ পড়লো। ওটাই ছিলো নীরাকে আমার প্রথম দেখা! পরে জানলাম স্কুলের কি যেন ডিজাইন করাতে এসে সেও আটকা পড়েছিলো! বাদামী রঙের তাঁতের শাড়ী পরনে, হালকা-পাতলা গড়ন, খুব একটা ফর্সা না হলেও ছিমছামের মধ্য বেশ গুছালো বলে বেশ ভালোই দেখাচ্ছিলো!
নাকের উপর লেপ্টে থাকা সাদা ফ্রেমের চশমা মেয়েটির সৌন্দর্যে যেন অন্য এক মাত্রা যোগ করলো!

হঠাৎ করেই নীরা অন্যমনস্কতা ভেদ করে আমার দিকে তাকাতেই চোখাচোখি হয়ে গেল। আমি একটু ভড়কে গিয়ে চোখ নামিয়ে নিলাম! সেদিন ও পর্যন্তই থাকলেও, পরের সপ্তাহে আবারো দেখা মার্কেটের ভেতরের দিকের গলীতে কাশেম মামুর ছোট্ট চা দোকানটার বেঞ্চে।
সেদিন দোকানে কিছুটা ভীড় ছিলো। এমনিতে এই মার্কেটে কাশেম মামুর হাতে বানানো চায়ের আলাদা একটা সুনাম।তাই দোকানে হরদম ভীড় লেগেই থাকে। একটা ব্যাঞ্চ ফাঁকা থাকলেও সেটাতে এক মহিলা বসা দেখে বসলাম না। চায়ের অর্ডার দিয়ে বন্ধুর সাথে দাঁড়িয়ে আলাপ করছি, এমন সময় ডাকটা এলো।

-আরে আপনি!!!
মেয়েলী কন্ঠে আওয়াজ শুনে সামনে তাকাতেই দেখি টুলে বসা মেয়েটি আর কেউ নয়, নীরা।
একরকম আশ্চর্য হয়েই তাকিয়ে আছে আমার দিকে!
হাতে চায়ের কাপ।
আমিও ততোধিক আশ্চর্য হয়ে-
-আমার ও তো একই প্রশ্ন! আপনি এখানে??
-আমি কিছু বই নিতে আসছিলাম, ভাবলাম একটু চা খেয়েই যাই।তাই বসলাম এখানে। পরিচিত কন্ঠ শুনে পেছন ফিরে দেখি আপনি।

আমি -ও হ্যাঁ!
এদিকেই আসছিলাম একটা কাজে। আর এদিকে আসলেই মামার হাতে এককাপ চা-না খেলে মনে হয় কিছু একটা অপূর্নতা থেকে যায়।
-তাই বলুন। বসুন আপনারা। দাঁড়িয়ে কেন...!!??
একটুখানি সরে আমাদের জায়গা দিলো বসতে।
সেদিন চা খেতে খেতে অনেক গল্প হয়েছিলো।
ঘন্টা খানেকের আড্ডায় যেন অনেক আপন হয়ে উঠেছিলো নীরা। এর পর থেকে প্রায়ই ফোনে কথা হতো কিম্বা তার স্কুলের কাছের টং দোকানটায় আড্ডা জমতো বেশ।

কথা প্রসঙ্গে জানলাম, নীরা একটি বিদেশী সংস্থা কর্তৃক পরিচালিত বুদ্ধি প্রতিবন্ধীদের স্কুলে শিক্ষকতা করে।
এও জেনেছিলাম, তাঁর জীবনের অনেক কষ্টময় এক অতীতের কথা। কিশোরী বয়সে বিয়ে, স্বামী-শাশুড়ীর নির্যাতন, অকাল গর্ভপাত সহ কোন কিছুই বাদ যায়নি সেখানে!
এনজিও পরিচালিকা সাঈদা আপা না থাকলে ওই মৃত্যুপুরীতেই হয়তো তিলে তিলে শেষ হয়ে যেত কিশোরী নীরা...
সাঈদা আপা যখন তাঁকে উদ্ধার করে নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য বাড়ী ফেরার কথা বললো, এক বাক্যে না করে দিয়েছিলো নীরা। কি হবে আর বাড়ী ফিরে গিয়ে!! ঘরে আরও দুই দু'টি সোমত্ত বোন। এমনিতেই তাঁদের বিয়ে হচ্ছে না বলে বাবা-মা প্রতিনিয়ত যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে দিন কাটাচ্ছে। সে গিয়ে সেটা আরও বাড়াতে চায় না।

অনার্স পরীক্ষার শেষদিনই যখন সাঈদা আপা ফোন করে জানিয়েছেন স্কুলের এই চাকুরীটার কথা। সেদিন সত্যিই হাঁফ ছেড়ে বেঁছেছিলো নীরা। সাঈদা আপার সহযোগীতায় ঢাকায় এসে বন্ধ হওয়া পড়াশুনা আবার চালু করা। থাকা-খাওয়ার যাবতীয় বন্দোবস্তও আপা করে দিয়েছিলো বলে আবার ঘুরে দাঁড়ানোর সাহস পেয়েছিলো সে।

ইন্টার পরীক্ষার পর থেকেই পার্টটাইম কাজ করা ধরেছিলো নীরা। নিজের পড়াশুনা ও থাকার খাওয়ার খরচ যোগাতে এটির বিকল্পও কিছু ছিলো না। অবশ্য তার আগ পর্যন্ত সাঈদা আপায় চালিয়ে এসেছিলেন সকল খরচ। এই মানুষটার ঋণ সত্যিই ভুলার নয়।

এতটুকু বয়সে তাঁর উপর এতো ধকল গেছে, বাইরে থেকে বুঝার কোন উপায় নেই। ভেতরে ভেতরে যতোটাই সে নরম, বাইরে ঠিক ততটাই ইস্পাত কঠিন মনোবল।
-মামা নামবেন না??? সদরঘাট আইস্যা পড়ছি তো!!
হেল্পারের কথায় সম্বিত ফিরে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখি সত্যি বাহাদুর শাহ পার্কের সামনে দাঁড়ানো বাস।

বাস থেকে নেমে দ্রুত পা চালালো প্রত্যয়।
তাড়াতাড়ি ঘাটে পৌঁছাতে হবে। নীরা এতোক্ষণ কি করছে কে জানে!! ঘড়ির কাঁটা সাড়ে ন'টা ছুঁই ছুঁই! ইতিমধ্যে রোদের তেজটাও বেশ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। ক'দিন ধরেই গুমোট আবহাওয়া। বৃষ্টি হবে হবে ভাব, কিন্তু হয়না। কোথাও একটুখানি বাতাসের আলামত নেই।
লালকুঠি ঘাটে পৌঁছে ঘাটের পরিবেশটা একটু অন্যরকম লাগছে আজ। প্রচুর মানুষের জটলা। জটলা এমনিতেই থাকে সবসময়। কিন্তু আজ একটু ব্যতিক্রম! বেশ ক'টা পুলিশ আর মিডিয়ার গাড়ীও দেখা যাচ্ছে!

ভীড় ঠেলে সামনে এগুতেই শুনতে পেল, কারা যেন একটা মেয়েকে নৃসংসভাবে কুপিয়ে রেখে গেছে। আরেকটু কাছে যেতেই দেখে রক্তমাখা বিভৎস লাশটা উপুড় হয়ে পড়ে আছে ৪ নাম্বার গেইটের মুখেই। রক্তে কিছুই বুঝা যাচ্ছিলো না...।
লাশের পাশে চোখ পড়তেই কেঁপে উঠলো প্রত্যয়! সেই পরিচিত সাদা ফ্রেমের চশমা, সেই পরিচিত পার্স। পরনে সেই বাদামী কালারের শাড়ী রক্তে যেটা কমলা বর্ন ধারন করেছে! মুহুর্তে তার পুরো পৃথিবী দুলে উঠলো যেন!
তবে কি...তার সাবেক স্বামী??? নাকি বাড়ীওয়ালার নেশাখোর ছেলে!!!
কে করতে পারে এই কাজ??
নাহ...আর ভাবতে পারছেনা সে!!
চিৎকার করে কাঁদতে গিয়েও গলা থেকে কোন আওয়াজ বের হলোনা, শুধু অস্ফুট স্বরে গোঙ্গানি ছাড়া! কেউ যেন গলাটা চেপে ধরেছে তার, নিঃশ্বাস ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে আসছিলো যেন...চোখের সামনে!

হঠাৎ কারো ধাক্কায় লাফিয়ে উঠলো সে।
-মামা। ও মামা?? কি হইছে আপনের??? ঘুমের ভেতর এমুন কইরা চিল্লানি দিয়া উঠলেন?? আমি তো ভয়েই শেষ! খারাপ কুনো স্বপ্ন দেকতাছিলেন বুঝি???
চোখ মেলতেই নিজেকে বিছানায় আবিস্কার করে প্রত্যয়।
সামনে ভয়াতুর জিজ্ঞেসু দৃষ্টিতে বুয়াকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলো সে! তার মানে ঘুমের ভেতর স্বপ্ন দেখছিলো!
পুরো শরীর ঘেমে অস্থির অবস্থা!! শরীরের কাঁপুনিটা এখনো থামতেই চাইছেনা যেন....
প্রশ্নের জবাব না পেলেও বুয়া বোধহয় বুঝতে পেরেছিলো ব্যাপার টা। তাই আর প্রশ্ন না করে নিজের কাজে মনোনিবেশ করলো!

ঘড়িতে চোখ পড়তেই চমকে উঠলো, প্রত্যয়!
৭টা বাজে প্রায়। দ্রুত বের হতে হবে।
দূরে কোথাও থেকে অনবরত কাঁকের কর্কস আওয়াজ কানে বাজছিল খুব! কাঁকের আওয়াজ শুনে বুকের ভেতরে কোথাও যেন কূ ঢেকে উঠলো! দ্রুত তৈরি হয়ে পা চালালো প্রত্যয়! নীরা কে বলেছিলো, ঠিক আটটায় ঘাটে থাকবে সে....

(ছবিঃ সংগৃহীত)

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.