![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
বিকাল থেকেই মোটর সাইকেল নিয়ে ডলপিন গলিতে।প্রায় সন্ধ্যা হতে চললো,একটা যাত্রীর দেখা নেই! করোনার ছোবলে পুরো দেশের মতো রাজধানী ঢাকা জুড়েও যেন মৃত্যুর আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। এই সময়টাতে রাস্তায় মানুষজনের চলাচল অনেকটা তাই কমই বলা চলে। যারা বের হয়েছে, তাদের বেশিরভাগই জীবিকার তাগিদে ঝুঁকি নিয়ে অনেকটা বাধ্য হয়েই বেরিয়েছে।
প্রত্যয়ও বের হওয়ার কথা ছিলো না। অনেকটা বাধ্য হয়েই বের হতে হয়েছে তাকেও। বাসায় বাজার নেই গতকাল থেকে। অরনীর ওষুধও শেষ হয়ে গেছে। এমনিতে গতকাল ওষুধ মিস হয়েছে। আজ কোন মতেই ঔষুধ মিস করা যাবেনা।
অরনীটাও আজকাল চাপা স্বভাবের হয়েছে। কষ্ট করবে, কিন্তু মুখ ফুটে কিছু বলবে না। আমি বিচলিত হবো বলে আমাকে একবারও বলেনি ঔষধের কথা। আজ যখন ঔষধের বাক্স চেক করতে গেলাম, তখনই চোখে পড়লো বিষয়টা। অরনীকে কে জিজ্ঞেস করতেই এড়িয়ে গেল। কিন্তু, চোখের কোনায় লুকানো অশ্রু বিন্দুটা লুকাতে পারেনি কিছুতেই।
আজ যখন বাইরে বের হচ্ছি, তখন বাঁধা দিয়েছিলো অরনী।
তাঁর আমাকে নিয়ে বড় ভয়। স্বপ্নে নাকি আজকাল কিসব উল্টা পাল্টা দেখে! কিন্তু বের না হয়ে উপায় কি!!? বিয়ের পাঁচ বছর পর অরনী এই প্রথম মা হতে চলছে। আমাদের একমাত্র সন্তানকে উপহার দিতে যাচ্ছে। এই সময়ে কোথায় তাকে ভালোমন্দ খাওয়াবো, ঠিকমতো যত্ন নিবো! তা আর হয়ে উঠছে কোথায়...!!
লকডাউনের শুরুতেই চাকুরিটা গেল। বাসায় টুকটাক জমানো যা ছিলো, সব শেষ। শেষে বাধ্য হয়ে মটরসাইকেলে যাত্রী পরিবহনের কাজ শুরু করতে হলো। কোন মতে জীবনটাই যদি বাঁচে! বাড়িওয়ালা নেহায়েত ভালো মানুষ বলেই দুই মাসের ভাড়া বাকি সত্ত্বেও কিছু বলেনি এখনো! কিন্তু, কতোদিনই বা তিনিও চুপ থাকবেন!! নাহ...আজকে যেভাবেই হোক, একটা কিছু ব্যবস্থা না করে ফিরবে না বাসায়! অরনীর শুকনো মুখের দিকে তাকালে হৃদয়ের গহীনে কোথায় যেন হু হু করে উঠে!
বড় লোক বাবার একমাত্র কন্যা,অরনী।
ফরিদপুর শহরে নিজেদের পাঁচতলা বাড়ী। অরনীর বাবা প্রানতোশ রায়ের মূল শহর থেকে কিছুটা দূরে, কানাইপুরের কাছেই দু- দু'টো ইটভাটা। হাঁটের ভেতরেই পাটের বড় গোডাউন। বেশ রমরমা কাজকারবার। অথচ সেই প্রানতোশ সাহেবের মেয়ে কি না, আজ ঢাকা শহরে ভাড়া বাসায় খেয়ে না খেয়ে দিন কাটাচ্ছে! অবশ্য দোষটা প্রত্যইয়ের-ই।
অরনী যখন অন্য ধর্মের মেয়ে হয়ে তার প্রতি দূর্বল হয়ে উঠেছিলো, সে তখন তাতে সাড়া না দিলেও পারতো। কি থেকে কি হয়ে গেল, সে নিজেই বুঝতে পারেনি। অথচ কলেজ লাইফে পাশের বাসার নীরা টা কতই না পাগল ছিলো তার জন্য! অরনী কে বিয়ে করার পরেই তার পাগলামী থেমেছিলো। থেমেছিলো বলতে কোথায় যেন হাওয়া হয়ে গিয়েছিলো!
হঠাৎ করে রাস্তার উল্টোদিকে চোখ যেতেই চমকে উঠলো সে। নীরার মতই লাগছে যেন ভদ্র মহিলাকে!! ঘড়িতে বারবার সময় দেখছে আর এদিক ওদিক তাকাচ্ছে।
আজকাল ঢাকা শহরে মানুষের যেন অভাব নেই।
কত চেহারার, কত রকমের মানুষ। এর ভেতর দু'একজনের চেহারা কাকতালীয় ভাবে মাঝে মধ্যে মিলেও যায়!
-এই যাবেন???
মহিলা কন্ঠে হঠাৎ করে হকচকিয়ে উঠলো প্রত্যয়।
তাকিয়ে দেখে সেই ভদ্র মহিলাটাই! যাঁকে ওপারে দেখে নীরা ভাবছিলো....
মুখে মাস্ক থাকায় ঠিকমতো চেনা যাচ্ছে না।
-কি হলো?? যাবেন??? আবারও প্রশ্ন। এইবার একটু বিরক্তি নিয়ে।
আমি তাড়াতাড়ি স্যরি বলে ভদ্র মহিলাকে ম্যানেজ করার দিকে মনযোগী হলাম। এই যাত্রী কোনরকমে হারানো চলবেনা। তিনঘন্টার বেশি বসে আছি। কোন যাত্রী নেই।মনে মনে বললাম--
স্যরি ম্যাডাম! শুনতে পাইনি তাই...কোথায় যাবেন বলুন??
এইবার মুখোমুখি তাকাতেই ভদ্র মহিলা চমকে উঠলো।
আরে প্রত্যয় তুমি এখানে???
আমাকে চিনতে পারছো না...!!!
আমি এইবার শিউর, ও নীরা।
চিনেও না চেনার ব্যর্থ চেষ্টা করতে গেলাম।
এখনো চেনো নি?
আমি নীরা....তোমাদের পাশের বাসায় থাকতাম।
এইবার আর উপায় না দেখে আমিও একটু কৃত্রিম আশ্চর্য হওয়ার ভান ধরে বললাম-
ওহ...নীরা!!!
তুমি হঠাৎ এইদিকে???
-আমার অফিস তো এখানেই।
এতোদিন চট্টগ্রামের একটা ব্রাঞ্চে ছিলাম। গতকালই ট্রান্সফার হয়ে ঢাকায় আসা। ওপারে অনেক্ষন ধরে গাড়ির জন্য অপেক্ষা করছিলাম। কোন গাড়ীই পাচ্ছিলাম না। রাইড শেয়ারিং অ্যাপসেও কোন গাড়ী পেলাম না।
শেষে এইদিকে তাকাতেই তোমার বাইকটি চোখে পড়লো।
দেখে মনে হলো শেয়ারিং রাইড।
তাই ভাবলাম, রাইডেই চলে যাই।
যদিও দূরে থেকে চেনা যায়নি।
তা আমার কথা ছাড়ো...তোমার চেহারার এই হাল কেন??
আর এখানেই বা কি করছো???
তোমার বউ মানে আমাদের ভাবী কেমন আছে???
এক নিঃশ্বাসেই যেন সব বলে গেল, নীরা......
আমি থতমত খেয়ে কি বলবো বুঝে উঠতে পারছিলাম না।
নীরা সম্ভবত বুঝতে পেরেছিলো আমার অপ্রস্তুত হওয়ার ব্যাপারটি। দ্রুত পাশ কাটিয়ে বললো, থাক আর উত্তর দিতে হবে না। আমাকে একটু মিরপুর নামিয়ে দিয়ে এসো! ওখানে গিয়ে তোমার সব কথে শুনবো।
আমিও না করতে পারলাম না। মোটরসাইকেলে স্ট্যার্ট দিয়ে বাড়তি হেলমেট টা তার দিকে বাড়িয়ে দিলাম। ইশারায় বললাম পেছনে উঠে বসতে। মটর সাইকেল স্ট্যার্ট দিয়েই যেন, চিন্তা গুলো আরো বেশি মাথায় চেপে বসলো।
যাহ শালা...আজকে বুঝি সময়টাই মাটি!
অরনীর ঔষধ গুলো বোধ হয় আজও নেওয়া হবে না!
কার মুখ দেখে যে বেরিয়েছিলাম আজ!
নীরার কথায় আবার ভাবনা থেকে বাস্তবে ফিরতে হলো।
কি ব্যাপার প্রত্যয়!!! সেই শুরু থেকে দেখছি, তুমি কিছুটা অন্যমনস্ক! আমি আবার তোমাকে বিপদে ফেললাম না তো...??
আমিও মুখে কৃত্তিম হাসির রেস টেনে বললাম, কই না তো...
উত্তরে নীরা সন্তুষ্ট হতে পেরেছিলো কিনা বুঝা গেলো না!
উত্তর দিতে গিয়ে লুকিং গ্লাসে তাকিয়ে দেখি, আমার দিকেই তাকিয়ে আছে সে।
সেই চাহনী...সেই একই ভঙ্গী!
পরিবর্তন শুধু শরীরটা একটু ফ্যাটি হয়েছে। আর চোখে সাদা ফ্রেমের চশমাটা তাকে একটু বয়সীই বানিয়ে দিলেও সৌন্দর্য টা যেন আরও ঝাপি খুলে বসেছে। অবশ্য আগেও কম সুন্দরী ছিলো না, নীরা...মহল্লার কত ছেলে তাঁর জন্য দেওয়ানা ছিলো!!
কলেজ লাইফে প্রায়ই আমাদের বাসায় আসতো। নোট নেওয়ার কথা বলে কারনে অকারনে সর্বক্ষণ থাকার চেষ্টা করতো। যদিও আমি তেমন বাসায় থাকতাম না। ক্লাস শেষে বন্ধুদের সাথে আড্ডা আর বিকেলে দু'টো টিউশনি শেষ করে বাসায় যখন ফিরতাম, তখন হয়তো সে আমাদের বাসা থেকে বের হচ্ছে। বাসার সবাই কে কিভাবে যেন আপন করে নিয়েছিলো নীরা।
বিশেষ করে আম্মা তো...সারাক্ষণ তার গুনগান নিয়েই ব্যস্ত।
কথা প্রসঙ্গে আকারে ইঙ্গিতে এটাও বুঝিয়ে দেন যে, নীরা কে বউ হিসেবে তাঁদের খুবই পছন্দ!
মিরপুর মডেল থানার উল্টো দিকের সিগনালে পৌঁছাতেই ফোন টা পেলাম। খবরটা শুনেই যেন মাথায় বাজ পড়লো!!
বাড়িওয়ালা আন্টি ফোন দিয়েছেন, তাঁরা হাসপাতালে আছেন। দ্রুত আমাকে সেখানে পোঁছাতে বললেন। অরনী বার্থরুমে পা পিছলে নাকি পড়ে গিয়েছে! কি অবস্থা, এখন কেমন আছে, এসব জানার আগেই লাইনটা কেটে দিলো...
শরীরের এই অবস্থায় পড়ে যাওয়াটা শুনেছি মারাত্নক বিপদজনক। বাচ্চা এবং মা দুজনেরই প্রান সংশয়ের আশঙ্কা থেকে যায়!
অরনী বা আমাদের অনাগত সন্তানের খারাপ কিছু কল্পনা করতেই গলা যেন শুকিয়ে আসলো। উফফ... আর ভাবতে পারছি না.....
নীরা কে এখানেই নামিয়ে দেওয়া দরকার।
দ্রুত হাসপাতালে যেতে হবে।
অরনীর কি অবস্থা এখন কে জানে...!!!
ফোনের অপর প্রান্তে কথা বলে, চুপসে যাওয়া এবং চেহারায় তার বাজে এফেক্ট বোধহয় নীরার চোখ এড়ায় নি!
আরেকটু শিউর হতে প্রশ্নই করে বসলো...
-কি হয়েছে?? কোন সমস্যা?? জরুরি কিছু হলে আমাকে এখানেই নামিয়ে দাও। বাকি পথটুকু রিক্সায় চলে যেতে পারবো। তাছাড়া খালার বাসাও বেশি দূরেও নয়! নীরা বললো......
-না কিছু না! বাড়ীওয়ালা আন্টি ফোন দিয়েছিলেন!
দ্রুত যেতে বললেন! কি নাকি কাজ আছে!!
ইচ্ছে করেই অরনীর বিষয়টা এড়িয়ে গেলাম আমি...
অরনীর আর আমাদের সমপর্ক কে কেন্দ্র করে, নিজের পরিবারের লোকজনই যেখানে দূরে ঠেলে দিয়েছে, সেখানে আজ এতগুলো বছর পর নীরাকেও কেন যেন এর ভেতরে জড়াতে মন সাই দিলোনা।
নীরার কথামতো তাকে সেখানে নামিয়েই দ্রুত হাসপাতালের পথে বাইকটিকে ঘুরালো প্রত্যয়! বাড়িওয়ালা আন্টি তেমন কিছু খুলেও বললেনও না। শুধু বললেন, দ্রুত হাসপাতালে যেতে। টেনশন করতেও না করলেন। বললেন, উনারা স্বামী-স্ত্রী দু 'জনেই আছেন অরনীর পাশে!! যা যা করা দরকার উনারা করছেন!
পকেটের যা অবস্থা, কেমনে কি করবে বুঝে উঠতে পারছিলোনা প্রত্যয়! হসপিটালের খরচই বা কেমন হবে, কে জানে!! নীরার জোর করে পকেটে গুঁজে দেওয়া টাকাটাই একমাত্র সম্বল। এটা দিয়ে কিছুই হবেনা এটা নিশ্চিত। বিকল্প কোন ব্যবস্থা না হলে, যদি দরকার হয় তাইলে মটর সাইকেল টাই শেষমেষ বিক্রি করে দিতে হবে।
চাকুরি যাওয়ার পর এই বাহনটাই তার সংসারের হাল ধরতে সহায়তা করেছিলো। এটা বিক্রি করে দিলে, নিশ্চিত আয়ের পথটাই যে অনিশ্চয়তায় ঢেকে যাবে! তা, প্রত্যয়ের চেয়ে ভালো আর কে জানে!!
বাকি দিনগুলো কিভাবে টেনে নিবে সেটা জানে না। এই মুহুর্তে তার একমাত্র কাজ আরনীর পাশে দাঁড়ানো! ভাবতে ভাবতে অরনীর মায়াবি মুখ খানা ভেসে আসছিলো চোখের সামনে! ঠিক প্রথম দেখায় যেমন টা দেখেছিলো!!
সব ছেড়ে দিয়ে একদিন যে মেয়েটা তার হাত ধরেছিল, সেই ধরে থাকা হাত টাকে সারা জীবন সে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চায়। মনে মনে উপরওয়ালার কাছে সে অরনী কে ভিক্ষা চাইছিলো। তিনি যেন অরনী কে এবং তার অনাগত সন্তান কে তার কাছে ফিরিয়ে দেন! তাদের ছাড়া যে প্রত্যয়ের পৃথিবীটা অন্ধকারে ঢেকে যাবে। পরিবার পরিজন কেউই তো থেকেও নেই। তারাও না থাকলে সে কাকে আঁকড়ে ধরে বাঁচবে??
বলতে বলতে হাসপাতালের কাছাকাছি প্রায় চলে এসেছে।
দূরে থেকে অন্ধকারের জন্য কিছু পরিস্কার দেখা যাচ্ছেনা।
সরকারী হাসপাতাল গুলো বোধহয় এমনি হয়। ভেতরের দিকে কিছু আলো জ্বললেও গেটের লাইটগুলো কেনো যেনো বন্ধ হয়ে আছে! হয়তোবা ফিউজ হয়ে যাওয়ার পর কেউ এদিকটাতে নজর দেয় নি!
আজ পুর্নিমা রাত।
আকাশে কোথায় জোছনারা মাখামাখি করার কথা!
অথছ পুরো আকাশ জুড়ে ভুতুড়ে অন্ধকার!
তবে কি আজ পৃথিবীর বুকে চাঁদেরও গ্রহনকাল চলছে...!!!
যেভাবে চলছে তার জীবনেও..
(শেষ)
#ছোট_গল্পঃ
#গ্রহনকাল
(ছবিঃ সংগৃহিত)
©somewhere in net ltd.