নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

পৃথিবীকে যেমন দেখার প্রত্যাশা করি, সে প্রত্যাশার আগে নিজেকে তেমন গড়তে চাই। বিশ্বাস ও কর্মে মিল স্থাপন করতে আজীবন যুদ্ধ করতে চাই নিজের সাথেই।

হিমন

ভিন্নমত সহ্য করতে পারা এক বিরাট গুণ। সকল ভিন্নমত উদার দৃষ্টিতে দেখার চেষ্টায় আছি।

হিমন › বিস্তারিত পোস্টঃ

জঙ্গিবাদ ও জাহান্নামের রুপকথা

১২ ই জুন, ২০১৬ ভোর ৪:৩৬

পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সী আসিয়া বিবি পাকিস্তানের পাঞ্জাবি খ্রিষ্টান কৃষাণী। ২০০৯ সালে একটি কূপ থেকে পানি খেয়ে আসিয়া বিবি পানি দূষিত করেছেন—এই অভিযোগ তুলেছিলেন তাঁর দুই মুসলিম প্রতিবেশী নারী। ঝগড়ার পর তাঁর বিরুদ্ধে তারা ব্লাসফেমির (ধর্মদ্রোহীতা) মিথ্যা অভিযোগ তোলেন। আসিয়া ঝগড়ার এক পর্যায়ে নবীজীকে(সাঃ) নিয়ে বাজে কথা বলেছেন এই হল কথিত অপরাধ। ধর্মীয় গোষ্ঠীরা ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানায়। পুলিশ আসিয়াকে গ্রেপ্তার করে। পরবর্তীতের তাঁর বিরুদ্ধে মৃত্যুদন্ডের রায় হয়।

পাঞ্জাবের গভর্নর সালমান তাসির শুধু বলেছিলেন, ব্লাসফেমি আইন সংশোধন দরকার এবং আসিয়া বিবি নির্দোষ, তাকে যেন ক্ষমা করে দেয়া হয়। জেলখানায় তাকে দেখতেও যান গভর্নর। এই অপরাধে (!) তারই দেহরক্ষী মুমতাজ হুসাইন কাদরি ২০১১ সালের জানুয়ারীতে উনত্রিশটি গুলি করে হত্যা করে সালমান তাসিরকে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, তাসিরকে হত্যার দুই মাসের মাথায় পাকিস্তানের তৎকালীন একমাত্র খ্রিস্টান মন্ত্রী শাহবাজ ভাট্টিকে গুলি করে হত্যা করা হয়। গভর্নর সালমান তাসিরের পুত্রকে ২০১১ সালের আগস্ট মাসে লাহোরে অপহরণ করা হয় যার খোঁজ আজও মেলেনি।



মুহুর্তের মধ্যে খুনী কাদরি পাকিস্তানের জাতীয় বীরে পরিণত হন। ২০ জানুয়ারী ২০১১ তে লন্ডন রিভিউ অব বুকস জার্নালে পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ সাংবাদিক তারিক আলী একটি নিবন্ধে বলেন, "কাদরি এখন পাকিস্তানের জাতীয় বীর হয়ে ওঠার পথে। প্রথমবার আদালতে নিয়ে যাওয়ার সময় ফুলবর্ষণ করে তাঁকে অভ্যর্থনা জানান ইসলামাবাদের আইনজীবীরা। তাঁরা বিনা পারিশ্রমিকে তাঁর পক্ষে লড়তে রাজি। কারাগারে ফেরার পথে সমর্থকদের উদ্দেশে ভাষণ দেওয়ার সুযোগ তাঁকে দেয়।" এমনকি একজন মানুষকে খুন করার পর এই খুনীর নামে পাকিস্থানে একটি মসজিদের নামকরণ করা হয়। মৃত্যুর আগে জেলে থাকা অবস্থায় সাধারণ মানুষ যেত দেখা করতে, আশীর্বাদ নিতে। যে বিচারক তার মৃত্যুর রায় দিয়েছিল প্রাণভয়ে তাকে বিদেশে পাড়ি দিতে হয়েছে। সভ্য দুনিয়ার মানুষের কাছে এসব নিশ্চই রুপকথার মত শোনাবে।

বহু সংশয় সত্বেও চলতি বছরের ২৯ ফেব্রুয়ারীতে বিচার শেষে মুমতাজ হুসাইন কাদরির মৃত্যদন্ড কার্যকর হয়। 'বীরের' মৃত্যু মেনে নেয়া অতি বেদনার। খুনী বীরের মৃত্যুতে শোকে মূহ্যমান গণমানুষ ভীড় করেছিল মুমতাজ হুসাইন কাদরির জানাজায়। পাকিস্তানের জাতির পিতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেনজীর ভুট্টোর পরেই এটি ছিল পাকিস্তানের ৭০ বছরের ইতিহাসে তৃতীয় বৃহত্তম জানাজা। কাদরির জানাজার পর গভর্নর সালমান তাসিরের কন্যা আতীশ তাসির প্রখ্যাত নিউইয়র্ক টাইমসে নিবন্ধ লিখে হাহুতাশ করেন। গত ১১ মার্চ "My Father’s Killer’s Funeral" শিরোনামের লেখায় তিনি বলেন, 'জিন্নাহ ও বেনজীরের জানাজা ছিল সরকারীভাবে আয়োজিত কিন্তু কাদরির জানাজায় উপস্থিত মানুষেরা এসেছিল স্বতস্ফূর্তভাবে মিডিয়ার তেমন প্রচারণা ছাড়াই।'




কাদরির ফাঁসির পর তার হাজার হাজার সমর্থক সুন্নী তেহরিক এবং তেহরিক-ই-লাব্বায়েক ইয়া রাসুলের ব্যানারে ইসলামাবাদে সংসদের সামনে এক অসহযোগ আন্দোলন শুরু করে। তাদের দশটি দাবির অন্যতম হল, সারাদেশে আটক সকল সুন্নী অপরাধীকে মুক্তি দিতে হবে, সালমানের খুনী কাদরিকে শহীদ ঘোষণা করতে হবে, কাদরি যে জেলখানায় বন্দী ছিল সেই 'আদিয়া' নামের বন্দীশালাকে জাতীয় ঐতিহ্য হিসেবে ঘোষণা করতে হবে, ব্লাসফেমি আইনে কোন ক্ষমার বিধান রাখা যাবেনা, সরকারী বেসরকারী সকল উচ্চপদে আসীন আহমদীয়া গোষ্ঠীর সবাইকে সরি‍য়ে দিতে হবে।


অপরদিকে সালমান তাসিরের জানাজা নিয়ে হয়েছিল ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ্য ঠাট্টা। সেই শেষকৃত্যে লোকের সমাগম ছিল নগণ্য, সব মিলিয়ে হাজারে দু'য়েকের মতো। তিনি ছিলেন পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা তখনকার প্রেসিডেন্ট আসিফ আলী জারদারির অতি কাছের মানুষ। কিন্তু প্রেসিডেন্ট নিজেই এত ভীতসন্ত্রস্ত ছিলেন যে জানাজায় শরিক হননি। বহু সহকর্মী রাজনীতিবিদও সেখানে যাননি। একদল মোল্লা ঘোষণা করেছিল, কেউ যদি তাসিরের শেষকৃত্যে অংশ নেয়, তাহলে সে ব্লাসফেমির অপরাধে অপরাধী হবে। জানাজা পড়ানোর জন্য কোনো মোল্লাকেই পাওয়া যাচ্ছিল না। সেসময়ের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রেহমান মালিক উগ্র ধর্মান্ধ সাধারণ জনগোষ্ঠীকে সন্তুষ্ট করতে ঘোষণা করেছিলেন, কেউ ব্লাসফেমি আইন সংশোধন বা পরিবর্তন করতে চাইলে তাকে কঠোর হাতে মোকাবিলা করা হবে। নিউইয়র্ক টাইমসকে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, কেউ ব্লাসফেমি করলে তাকে তিনি নিজ হাতে গুলি করবেন। (তারিক আলী, লন্ডন রিভিউ অব বুকস, ২০১১)।

২০১৪ সালের ডিসেম্বরে পাকিস্তানের একটি সেনা নিয়ন্ত্রিত স্কুলে হামলা চালিয়ে ১৩২ টি শিশুকে হত্যা করা হয়। এরপর বহু ছোট বড় হামলা সেদেশে হয়েছে। এ বছরের সবচেয়ে বড় আর বেদনাদায়ক হামলাটি হয়েছে গত ২৭ মার্চ রোববার, যেদিন খ্রিস্টানদের ধর্মীয় উৎসব ইস্টার সানডের ছুটিতে শিশুদের নিয়ে মায়েরা গিয়েছিলেন লাহোরের একটি পার্কে। হামলায় নিহত ৭২ জনের মধ্যে ২৯জন শিশু। এই হামলার পর পাকিস্তানে ব্লাসফেমি আইন নিয়ে নতুন করে নীরিক্ষা শুরু হয়েছে। এই আইনের থাকা না থাকা নিয়ে বিতর্ক বহুদিনের। কিন্তু নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের কেউ ভোটের বাজারে এ নিয়ে কথা বলার সাহস করেনা। জনগণের মনস্তত্বে যখন এই জঙ্গিবাদিতার প্রতি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সমর্থন পরিলক্ষিত হয় তখন তার নিরাময় সুকঠিন। এই রোগের প্রতিকার তাই সুদীর্ঘ এক সংগ্রামের প্রয়োজনীয়তাকেই বড় করে তোলে।

১৩২টি শিশুকে গুলি করে হত্যার উদারহণ টেনে সালমান তাসিরের কন্যা আতীশ তাসির নিউইয়র্ক টাইমসের নিবন্ধে জনগণের প্রতি প্রশ্ন তুলেছেন, "শেষ পর্যন্ত আমজনতা উপলব্ধি করতে সক্ষম হবে কি, যারা এই আইনের দোহাই দিয়ে হত্যার খেলায় মেতে উঠে শেষ পর্যন্ত সেই আইনের প্রয়োগ নিজেদের উপরেই প্রতিফলিত হয়?"

দুর্নীতি সন্ত্রাস অপরাজনীতি, নানা অনাচার দুরাচার আমাদের উপমহাদেশের মানুষের ললাট লিখনের মত আষ্ঠেপৃষ্ঠে রয়েছে। যেকোন রাজনৈতিক দলই যারা শুধু শুধু মনভোলানো কথা বলে সব ভুলিয়ে রাখতে পটু, তাদের কেউই উল্লেখ করার মত দুদন্ড শান্তি আনতে সক্ষন হয়েছে তার প্রমাণ নেই। এসব অস্থিরতার বাইরে বাড়তি আপদ ডানপন্থী দলগুলোর ছত্রছায়াতে মৌলবাদীদের উৎপাদ। ভারতেও বিজেপি ক্ষমতাসীন হওয়ার পর ধর্মকে পুঁজি করে সংখ্যালঘু মুসলিমদের উপর খড়্গ নেমে এসেছে, হত্যা করা হচ্ছে মুক্তচিন্তক হিন্দুদের।

আমাদের সামনে মধ্যপ্রাচ্যে জঙ্গিবাদিতার দুর্ভাগ্যজনক অথচ উজ্জ্বল এক উদাহরণ রয়েছে। পাকিস্তানের ভূমি জঙ্গি উৎপাদনের উর্বর ভূমি। ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলকে ধর্মের প্রতি দূর্বলতার কারণে সমর্থন করার অর্থ ওই ভূমিকে আরো উৎকর্ষ করা। চারিদিকে ধর্মের এই নিকৃষ্ট অপব্যবহারের প্রতি সাধারণ ধার্মিক মানুষেরা যদি নাখোশ না হয়, সন্ত্রাসীদের প্রতি তাদের ভেতর গোপন সমর্থন ধরে রাখে, যদি মনে করে এসব খুন-খারাবির প্রতিবাদ করা মানে ধর্ম-অবমাননা, ধর্ম বিরোধিতাকারীকে হত্যা যদি ধর্ম পালনের অংশ হয়ে পড়ে তবে উপমহাদেশের মুসলিম শুধু নয়, সর্বসাধারণের জন্য আরো অধিক নিদারুণ দুর্ভাগ্য অপেক্ষা করছে সেটি নিশ্চিত।



কিছুকাল যাবৎ আমাদের বাংলাদেশে ভিন্নমত ও পথের মানুষকে নৃশংসরুপে হত্যার ধারা শুরু হয়েছে। একটা গোষ্ঠী, ক্ষুদ্র হলেও, ধীরে ধীরে তাদের শক্তিবৃদ্ধি করে চলেছে যারা ভাবতে শিখেছে এইভাবে- আমার পীরবাদ পছন্দ নয় বলে তাদের মেরে ফেল, আমার গানবাজনা পছন্দ নয় তাই তারা ধর্মের শত্রু, আমি শিয়া নই তাই ওরা মুরতাদ, আমার ধর্মে পুরোহিত নেই তাই ওদের গলা কাটা যায়, আমি সমকামী নই তাই ওদের স্পাইনাল কর্ড আমার চাপাতির লক্ষ্য! খুনী জঙ্গিদের প্রতি সাধারণ পাকিস্তানী জনগণের সহমর্মিতা ও দরদের পরিণাম দেখে বাংলাদেশের মানুষের দ্রুত এই সিদ্ধান্তে আসতে হবে যে তারা বাংলার ভূমিকে আফগানিস্তান-পাকিস্তান-ইরাক-সিরিয়ার মত জাহান্নামে পরিণত করবে, নাকি সকল মত সকল পথ এবং ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গ নির্বিশেষে একটি বহুত্ববাদী গণতান্ত্রিক অসাম্প্রদায়িক পরমতসহিষ্ণু সমাজ গঠনের লক্ষ্যে ওই খুনী-জঙ্গিদের প্রতি সকল প্রকার সমর্থন প্রকাশ বন্ধ করবে।

ইস্টার সানডের হত্যাকান্ডের পর পাকিস্তানের সবচেয়ে পুরনো ইংরেজী দৈনিক বিখ্যাত ডন পত্রিকা গত ২০১৫ সালের জানুয়ারীতে প্রকাশিত একটি প্রবন্ধ পুনরায় প্রকাশ করেছে। আরাফাত মাজহারের লেখা সেই প্রবন্ধের শিরোনাম "দ্য আনটোল্ড স্টোরি অব পাকিস্তান'স ব্লাসফেমি ল" এবং এতে তিনি দেখাতে চেষ্টা করেছেন এই আইন তৈরির প্রেক্ষাপট এবং এতে যে দোষীকে ক্ষমা না করার কথা বলা আছে তার অসাড়তা। কোরান হাদিস ফিকার উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি বলতে চেয়েছেন, পাকিস্তান পেনাল কোডের ২৯৫-সি ধারার এই ব্লাসফেমি আইনে দোষীকে ক্ষমা করা সম্ভব ইসলামী ধারা মেনেই। পাকিস্তানের বর্তমান প্রেক্ষাপটে এই লেখা নিঃসন্দেহে একটি সাহসী উচ্চারণ। এই লেখার শেষে আয়শা নামের এক পাঠক মন্তব্য করেছেন, পাকিস্তানের কেউই সাধারণ আইন বিন্দুমাত্র মেনে চলেনা, কিন্তু ব্লাসফেমি আইনের এই কঠোর প্রয়োগ খুবই আশ্চর্য্যের ব্যাপার। এটি অবশ্যই বাতিল করা উচিত ( Nobody follows a single law in Pakistan except for the blasphemy law. Strange. This law should be removed)। কিন্তু এই ধরণের সুচিন্তা, শুভ চিন্তার মানুষের সংখ্যা পাকিস্তানে খুবই কম। কিন্তু ভারত বাংলাদেশের কি অবস্থা?



লাহোরে ২৭ মার্চের হামলায় অতি অসহায় যে নারী শিশুরা শহীদ হয়েছে, যারা রাজনীতির কূটচাল বোঝেনা, ধর্মকে শুধুমাত্রই শান্তির উদ্দেশ্যে পালন করে, বাংলাদেশে যেসকল নিরাপরাধ মানুষেরা নিজদের মত প্রকাশের দরুণ নির্মম হত্যার শিকার হচ্ছে একের পর এক, আমার এই নগন্য হৃদয়ের সবটুকু ভালবাসা তাদের জন্য আমি উৎসর্গ করে দিলাম।


জাহিদ কবীর হিমন
মাস্টার ইন ইন্টারনেট টেকনোলজিস এন্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস
লাইবনিজ ইউনিভার্সিটি হ্যানোভার

মন্তব্য ২ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ১৬ ই মে, ২০২১ রাত ২:৪৭

রাজীব নুর বলেছেন: ইজরাইল। ফিলিস্তানি সমস্যা নিয়ে কিছু লিখুন।

১৭ ই মে, ২০২১ রাত ২:৩৫

হিমন বলেছেন: ধন্যবাদ ভাই। ইচ্ছা আছে লেখার। লিখবো একদিন!

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.