নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

সাহিত্যকর্মী, সংবাদকর্মী এবং শ্রমজীবী। facebook.com/Lucky.Jayed.Husain

জায়েদ হোসাইন লাকী

সাহিত্যকর্মী, সংবাদকর্মী এবং শ্রমজীবী

জায়েদ হোসাইন লাকী › বিস্তারিত পোস্টঃ

আরতীর সূবর্ণ জয়ন্তী

২৭ শে আগস্ট, ২০১৮ দুপুর ১:৪০

আরতীর ঠোঁটের ঠিক মাঝখানে কালো একটি তিল। আরতী যখন কারোদিকে চোখ তুলে তাকিয়ে হাসে তিলটি তখন ঠিক বৃষ্টির মত করে আছড়ে পড়ে আরতীর দুঠোঁটের উপরে নিয়ত জ্যোৎস্নার মতই। সুবর্ণ আরতীর এই অদ্ভুত আর অলৌকিক মায়াবী তিলটির জন্যই তাকে ভালবেসে ফেলে চিরকালের জন্য অন্ধ পাগলের মত।

আরতীরকে ভালবেসে সুবর্ণ এখন অদ্ভুত এক স্বপ্নাবেশে আবেশিত হয় নিত্য দিন, নিত্য রাতে। সুবর্ণ আরতীকে বুকের মধ্যে করে জড়িয়ে নেয়, মুখটিকে দুহাতে আজলা করে ধরে তারপর ঠোঁট দিয়ে সে আরতীর মায়াবী তিলটিকে চুমোয় চুমোয় ভরিয়ে দেয়। আদরে আদরে সুবর্ণ আরতীকে ভরিয়ে তুলতে থাকে অকৃত্রিমভাবে দারুণ দক্ষতায়। আরতীর দুচোখ তখন স্বপ্নচাষে পরাগায়নের ক্ষেত। সুবর্ণকে ভালবেসে আরতীও নিজেকে নিক্ষেপ করে নতুন করে অন্য এক অদ্ভুত জীবনে। আরতী প্রতিনিয়তই সুবর্ণকে আবিষ্কার করে কিছু নির্দিষ্ট সময়ে। এ সময়গুলো শুধু তাদের নিজেদের জন্য করেই সৃষ্টিকর্তা তৈরি করে দিয়েছেন একান্ত নিজস্বভাবে সনাতন নিয়মে। রাত যতো গভীর হয়, ওরা একে অন্যকে ঠিক ততোটাই দৃঢ়তার সাথে চিনতে থাকে, বুঝতে থাকে, খুব ধীরে ধীরে। আরতীর শরীরের সব অলি গলি, রাজপথ, মানচিত্র সুবর্ণ একেবারে মুখস্থ করে নেয়। দু-পায়ের সন্ধিস্থল থেকে শুরু করে স্তন, ওষ্ঠ, ললাট, এমন কি সে আরতীর জরায়ুর প্রতিটি ভাঁজে ভাঁজেই রেখে দেয় বিশ্বস্ততা আর দক্ষতার দারুণ দাপট। আরতীও তখন সুবর্ণকে তার শরীরের অন্তর্গত সবগুলো প্লোটোপ্লাজম আর শরীরের বাহ্যিক সব রসনাস্বাদের আস্বাদন থেকে বঞ্চিত করে না একদমই। আরতী জানে যে, যাকে ভালবাসতে হয়, যাকে ভালবাসা যায়, তাকে সবকিছুই উজাড় করে বিলাতে হয়। তাছাড়া মধ্যযুগীয় কোন ফতোয়া তাকে টলাতে পারে না একদমই সুবর্ণ বিষয়ক ব্যাপার স্যাপারগুলোতে। তাইতো সে নিজস্ব স্বকীয়তায় নিজেকে উজাড় করে বিলায় নিঃসংকোচে সুবর্ণের আহ্বানে অনন্তকালের জন্য। আরতী প্রতিটি রাতেই সুবর্ণকে সুখ দেয় মনপ্রাণ উজাড় করে, ভালবাসা দিয়ে, শরীর দিয়ে, নয়তো তার উত্তালতা দিয়ে সে সুবর্ণকে সুখি করে তোলে তার একান্ত নিজস্ব সময়গুলোতে। আরতী তার নিজের শরীর আর সত্তা যৌবনকে এভাবে প্রতিরাতে দুহাতে তুলে দেয় সুবর্ণের হাতে তৃপ্ত আহ্লাদে। নিজের যৌবনকে অন্যের হাতে তুলে দিয়ে নারী যেভাবে সংকুচিত হয় ধর্ম আর সমাজের ভয়ে, আরতী ঠিক তার উল্টোরথে চলে.......। নিজের জীবন-যৌবনকে সুবর্ণের হাতে তুলে দিয়ে বেশ তৃপ্ত আর নিশ্চিন্ত সে। নিশ্চিন্ততার দারুণ আমেজে আরতী সুবর্ণকে জাপটে ধরে আদরে-আহ্লাদে ভরিয়ে তুলতে থাকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা...... লক্ষ সেকেন্ড, নয়তো অযুত লক্ষ রাত। অতঃপর, একে অন্যকে পরিপূর্ণ করে তোলে ওরা সুখের সাগরে স্নাত হয়ে সকল কষ্ট যাতনা আর দুঃখ-যন্ত্রণাকে দু’পায়ে মাড়িয়ে। নষ্ট দহন তখন আর ওদের দুজনকে তাড়া করে ছুঁতে পারে না একদমই...।

সুবর্ণ আরতীর বুকে মাথা রেখে মাঝে মাঝে ফিরে যায় তার আগের জীবনে। যে জীবন ছিল তার অনিন্দিতা বিষয়ক এক দুঃস্বপ্নের রাতের মত নিদ্রাহীন জীবন। ফেলে-আসা জীবনের কথা ভেবে ভেবে সে আরতীর বুকের উপরে নিঃশব্দে অশ্র“পাত করে দীর্ঘক্ষণ। আরতী তখন সুবর্ণের মাথায় হাত রেখে তার চুলে বিলি কেটে দেয় আর নীরবে কেঁদে কেঁদে চোখ ফুলায় সুবর্ণের দৃষ্টির আড়ালে...।
সুবর্ণ আগে কখনোই কবিতা পছন্দ করতো না। নয়তো গল্প, নয়তো গান। নিরেট এক কাঠখোট্টা গোছের জীবন ছিল তার। ইদানীং এসবে তাকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে খাক করে দেয়। জীবনের তীব্র দূষণ আর কঠিন দরিদ্রতায় সুবর্ণ অনেকটা সময় নিজের জীবন থেকে বঞ্চিত থেকেছে নিজের কাছেই। বাস্তবতার তীক্ষè ধারালো তীর তাকে বারেবারেই ঋদ্ধ করেছে যাপিত জীবনে। কবিতাই এখন তাকে বাঁচিয়ে রেখেছে কষ্টের দাবানল থেকে। এখন সুবর্ণ কবিতা লেখে। এক একটি কবিতা তার এক একটি দীর্ঘশ্বাসের মতো।


খুব সামান্য একটি চাকরির জন্য সুবর্ণ নিজের পায়ের তলার চামড়া ক্ষয় করে ছুটে গিয়েছে এক অফিস থেকে অন্য অফিসে, এখান থেকে ওখানে। এক মানুষ থেকে অন্য মানুষের কাছে দ্বারস্থ হয়েছে সে খুব, খুবই সামান্য একটি চাকরির জন্য। দুহাত তুলে আল­াহ্র কাছে সে একটি চাকরি ভিক্ষা চেয়েছে অনেকবার, অনেক দিন, পাঁচটি বছর। কেউই তাকে একটি চাকরি দেবার জন্য ডাকেনি একবারও। এমনকি সৃষ্টিকর্তাও তাকে সে সময় করুণা করেননি একদমই। অনিন্দিতাকে বেকার অবস্থায় সুবর্ণ ভালবেসে ছিল। দীর্ঘ তিনটি বছর তারা সম্পর্ক টিকিয়ে রেখেছে দৃঢ়ভাবে। দুজন দুজনকে ভালোবেসেছে নিজের জীবনের চাইতেও বেশি। একে অন্যকে ছাড়া থাকতে পারেনি একটি দিনও। বন্ধুরা ওদের এই প্রগাঢ় প্রেম দেখে বানিয়েছে কত নতুন রূপকথার গল্প। একদিন ওরা হুট করে কাজী সাহেবের অফিসে গিয়ে বিয়ে করে বসে। অনিন্দিতা মেনে নিয়েছিল সুবর্ণের এই দারুণ বেকার জীবন। তাছাড়া কিই বা কারার ছিল তার। ভালবাসার কাছে বেকারত্বকে কোন বাধা বলেই যে মনে হয়নি সেদিন। তাইতো অনিন্দিতা স্বাচ্ছন্দ্যে মেনে নিয়েছিল তার এই যতেœ গড়া নিজের ভাগ্যকে। সুবর্ণ মেস জীবন সমাপ্তি করে ছোট এক কামরার একটি বাসা ভাড়া নেয় যাত্রাবাড়ীর এক নিভৃত এলাকায়। সময় যাচ্ছিল ওদের দুঃসময়। রাত জেগে জেগে অনিন্দিতা সেই দুঃসময়ে সুবর্ণের মাথাটাকে নিজের কোলের উপরে তুলে নিয়ে শুনিয়েছে কত মনময়তার গল্প, প্রেরণার গান, সাফল্যের গাথা। লেপোলিয়নের বীরত্বের গল্প অনিন্দিতা সুবর্ণকে সে সময় শুনিয়েছে কতলক্ষ বার......। সুবর্ণকে সে প্রেরণা দিয়েছে বেঁচে থাকার জন্য, উপার্জন করার জন্য, জীবনকে গুছিয়ে নেয়ার জন্য। জাগ্রত করতে চেয়েছে সে সুবর্ণকে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে ওঠার জন্য। স্ট্রাগল করে নিজের জীবন তৈরি করে নেয়ার জন্য অনিন্দিতা সুবর্ণকে প্রতিটি পদে পদেই প্রেরণা যুগিয়েছে। কিন্তু হয়নি সে তা। হয়নি সুবর্ণের খুব সামান্য একটি পিয়ন, চাপরাশির চাকরিও। শক্ত হয়ে উঠে দাঁড়াবার জন্য সে নিজেকে সঁপেছে সৃষ্টিকর্তার দরবারে, পীর, আউলিয়ার মাজারে মাজারে ধরনা দিয়েছে প্রতিনিয়তই। তবুও বেকারত্ব তাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খেয়েছে ইবলিসের মত।


সময় পেরিয়ে যায় দ্রুত গতিতে। পার হয়ে যায় একটি বছর। এরই মাঝে সুবর্ণ আর অনিন্দিতার দাম্পত্য জীবন আলো করে পৃথিবীতে আসে তাদের কন্যা সন্তান প্রাণবন্ত পৃথিলা। পৃথিলার মুখটি কী অদ্ভুত সুন্দর আর নিষ্পাপ। কোন দহন, কোন যন্ত্রণা, নয়তো কোন বেকারত্বের উগ্রছাপ নেই সেই ফুটফুটে মেয়েটির সুন্দর মুখের আদলে। নেই কোন কষ্টের প্রলেপ। সুবর্ণ মেয়েটির মুখের দিকে তাকিয়ে মাঝে মাঝে অদ্ভুতভাবে কাঁদে। কাঁদে যন্ত্রণায়, জীবনের তীব্র যাতনায় সে নিজের মেয়েকে বুকে আঁকড়ে ধরে আর্তনাদ করে কেঁদে কেঁদে বলে ওঠে,
-আমাকে একটি চাকরি দাও......
মেয়েটির বেঁচে থাকার জন্য আমাকে সামান্যতম বেতনের হলেও একটি কাজ দাও.......

সুবর্ণের সে আর্তনাদ শহরের ইটের দেয়াল ভেদ করে কোন মিল মালিকের কানেই পৌঁছায়নি এতটুকুও। সৃষ্টিকর্তাও সে সময় সুবর্ণের উপর থেকে তুলে নিয়েছেন তার দয়া ও আশীর্বাদের হাত। বাবা-মায়ের অনুমতি না নিয়ে সুবর্ণ অনিন্দিতাকে বিয়ে করার দায়ে একদিন সে বঞ্চিত হয় তার পিতার ঔরস থেকে, সম্পদ থেকে, স্বীকৃতি থেকে, মা, ভাই-বোনদের আদরস্নেহ থেকে। এখন সুবর্ণ ফুটপাতে পড়ে থাকা এক অবাঞ্ছিত মানুষের মতই কোন পিতৃ পরিচয়হীন জারজ যেন। এভাবে কেটে যায় অনেকগুলো বছর। সময় চলে যায় তার নিজস্ব নিয়মে।


একদিন সুবর্ণ শাহবাগ থেকে পায়ে হেঁটে পল্টন যাচ্ছিল। তার হাতে ছিল একটি জীর্ণ রজনীগন্ধার স্টিক। পকেটে তার পয়সা ছিল না পর্যাপ্ত। বাড়তি কিছু পয়সা থাকলে অনেকগুলো রজনীগন্ধা কিনে নিতো সে। এ দিনটি ছিল তাদের তৃতীয়তম বিবাহ বার্ষিকী। অনিন্দিতাকে এ দিনটিতে কিছু দেবার মত মন থাকলেও সামর্থ্য ছিলনা সুবর্ণের একদমই। তাই সিগারেটের পয়সা বাঁচিয়ে সুবর্ণ কিনতে এসেছিল একটি রজনীগন্ধার স্টিক। মধ্য বয়সী ফুল বিক্রেতা তার কাছে থেকে একটি রজনীগন্ধার স্টিকের কোন দাম নেয়নি। বরং সুবর্ণের দিকে তাকিয়ে দোকানি বলেছে,
-স্যার, লন একটা স্টিক, কুন পয়সা লাগব না!

দোকানি হয়তো বুঝতে পেরেছিল যে সুবর্ণের পকেটে কোন পয়সা নেই। সুবর্ণ লোকটিকে ধন্যবাদ দিলো স্টিকটি তাকে মাগনা দেয়ার জন্য। আবার মুখটিপে সে নিজে নিজে মুচকি হাসলো এই ভেবে যে, দু’পয়সার ফুলের দোকানদার সেও আজ আমাকে করুণা করে দয়া দেখাচ্ছে। সুবর্ণের নিজের উপরে এখন প্রচণ্ড রাগ আর ঘৃণা তার। তাছাড়া অনেক বছর বেকার থাকতে থাকতে সুবর্ণের সেই আবেগী মনটাতে আজ পোকা ধরেছে। সন্দেহ, ক্ষোভ, হতাশা আর হীনম্মন্যতা তার এখন যেন নিত্য সহচর। নিজেকে ছোট ভাবতে ভাবতে সুবর্ণের এখন সত্যিই যেন অনেকটা নিচে নেমে যাওয়ার উপক্রম প্রায়। সুবর্ণ ভাবছে আগামী মাসে সে আরেকটি বাড়তি টিউশনি যোগাড় করে নেবে। তখন সেই বাড়তি রোজগারের টাকা দিয়ে সে ওই দোকানির কাছ থেকেই এক গাদা রজনীগন্ধা কিনবে। সুবর্ণ হাঁটছে আর ফেলে আসা কিশোরবেলার সেই নিদারুণ সুখময় দিগুলোর কথা ভাবছে। মেয়েটাকে সে এখন কি খাইয়ে বাঁচাবে? কি করে তার পড়ালেখার খরচ চালাবে এসব কথা ভেবে সুবর্ণ কেমন নিজের ভেতরেই কুঁকড়ে যাচ্ছে। একরাশ দুশ্চিন্তা এখন তার মাথার ভিতরে ঘুরপাক খাচ্ছে। চারিদিকে এখন তার শুধু অন্ধকার। গুচ্ছ গুচ্ছ অন্ধকার ক্রমশই গ্রাস করছে তাকে। চোখে সে যেন শর্ষে ফুল দেখতে শুরু করেছে। একরাশ হতাশা আর কষ্টের বোঝা মাথায় করে সে হাঁটছে রাজধানীর সব চাইতে ব্যাস্ততম রাস্তার ফুটপাত ঘেঁষে। সামনে ডানে প্রেসক্লাব। বামে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের চৌহদ্দি প্রাচীর। সুবর্ণ হাঁটছে আর ভাবছে সামনে পল্টন মোড় থেকে সে বাসে উঠে দুই টাকা ভাড়া বাঁচাবে। তাছাড়া এতদূর পথ আর পায়ে হেঁটে পাড়ি দেয়া যাবে না। এদিকে অনিন্দিতাও পথ চেয়ে বসে আছে তার আগমনের জন্য। সুবর্ণ ভাবছে আর হাঁটছে, আর ভাবছে......। হঠাৎ বিকট শব্দ করে একটি আট নম্বর লোকাল বাস খুব দ্রুত এসে পেছন থেকে সজোরে ধাক্কা দেয় সুবর্ণকে। বাসটির ধাক্কা লেগে হুমড়ি খেয়ে ফুটপাতে আছড়ে পড়ে সুবর্ণ। তার হাত থেকে দশহাত দূরে ছিটকে পড়ে অনিন্দিতার জন্য আনা সেই রজনীগন্ধার স্টিক। খুব দ্রুত লোকজন জড়ো হয় সেখানে। এরপরে যা হবার ঠিক তাই হয়। নিজেকে আবিষ্কার করে সুবর্ণ হাসপাতালের ফ্লোরে। ডান পাশের একটি পা সম্পূর্ণই হারায় সুবর্ণ চিরকালের জন্য।


অনিন্দিতা হাসপাতালে সুবর্ণের সিটের পাসে বসে নীরবে দু’চোখে অশ্র“ ঝরায়। ভালবেসে বেকারকে বিয়ে করার প্রতিদান সৃষ্টিকর্তা তাকে এভাবে দেবে তা অনিন্দিতার ভাবনার অনেক বাইরে ছিল। অজানা এক ভয়ংকর ভবিষ্যতের কথা কল্পনা করে সে কেঁদে কেঁদে বুক ভাসায়। সুবর্ণের মুখটাকে জড়িয়ে ধরে সে অঝরে কাঁদতে থাকে অনেকক্ষণ। সুবর্ণ ফ্যাকাসে চোখে তাকিয়ে থাকে সিলিংয়ে ঝোলানো ফ্যানের দিকে। মুখ দিয়ে তার কোন কথা বেরুতে চায় না। মেয়েটিকে নিয়ে ভাবতে ভাবতে সুবর্ণ মরে যেতে চায়। পৃথিলার মুখের দিকে তাকিয়ে সে বারে বারেই অচেতন হয়। জীবনের উপরে তীব্র ঘৃণা এখন তার দ্বিগুণ, তিনগুণ, চারগুণ হারে বাড়ে। স্বাধীনদেশে একজন শিক্ষিত বেকারের খেয়ে-পরে বাঁচার অধিকার নেই এটা ভেবে সুবর্ণ পুনরায় মূর্চ্ছা যায়। অনিন্দিতা তার জীর্ণ শাড়ির আঁচল দিয়ে সুবর্ণের ভেজা চোখ মুছিয়ে দেয়। তার মাথাটিকে অনিন্দিতা নিজের কোলের উপরে তুলে নিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। সান্ত্বনা দেয় সে বর্তমান অবস্থাকে মেনে নেয়ার জন্য। প্রেরণা দেয় সে সুবর্ণকে পুনর্বার নতুন করে বাঁচার জন্য, নতুন করে জীবন শুরু করার জন্য। অনিন্দিতা নিজের অন্ধকার ভবিষ্যতের কথা ভেবে অজানা এক ভয়ে হাউ মাউ করে কেঁদে ওঠে সুবর্ণের হাত ধরে।

বাস্তবতাকে মেনে নিতে হয় বলেই এভাবে পঙ্গুজীবন নিয়ে কোনভাবে বেঁচে যায় সুবর্ণ। একটা পা তার কেটে বাদ দিতে হয় অনন্ত কালের জন্য। কিইবা করার আছে তার। সুবর্ণ ঘরের কোণে পেতে রাখা চৌকিটায় শুয়ে মনে মনে এসব কথা ভাবে আর নিয়তির প্রতি অবজ্ঞা ভরে মুচকি হাসি দেয়। অনিন্দিতা সুবর্ণকে একলা ফেলে রেখে পৃথিলাকে নিয়ে চলে গেছে বাবার বাড়িতে। এ যাওয়া তার চিরকালের জন্য। হয়তো পৃথিলার ভবিষ্যতের কথা ভেবেই অনিন্দিতা এই কাজটা করেছে। নয়তো নতুন জীবন তাকে হাতছানি দিয়ে ডেকে ছিল বলেই তার এই চলে যাওয়া। অনিন্দিতার মতে,
-পঙ্গু বেকার স্বামীর সাথে আজীবন সংসার করার চেয়ে মৃত্যুও ভালো।

সুবর্ণ প্রথম প্রথম অনিন্দিতার পালিয়ে যাওয়ার বিষয়টিকে নিয়ে অনেক ভাবতো। অনেক কাঁদত, অনেক কষ্ট পেত। এখন আর সে এসব ভাবে না। কষ্ট পায় না, বা কাঁদেও না। সুবর্ণ নিজেকে সান্ত্বনা দেয় এই ভেবে যে, সেতো অনিন্দিতাকে সুখি করতে পারতো না। খাওয়াতে পরাতে পারতো না। চাল চুলোহীন এক পঙ্গু মানুষ সে। তার চেয়ে চলে গিয়ে অনিন্দিতা বরং ভালোই করেছে। সুবর্ণ নিজের মত করে নিজেকে সান্ত্বনা দেয় আর দুহাতে দুচোখ মুছে। অনিন্দিতার উপরে তার এখন আর কোন ক্ষোভ নেই। শুধু পৃথিলার জন্য সুবর্ণ এখন প্রতিদিন এক বেলা করে কাঁদে। মেয়েটির কথা মনে হলেই তার মনটা একেবারে কুঁকড়ে যায় কষ্টের নীল লোবানে। সুবর্ণ কতদিন হয় পৃথিলাকে দেখে না, আদর করে না। বুকে তুলে নিয়ে চুমো খায় না। মেয়েটিকে বুকে তুলে নিয়ে আদর করার জন্য সুবর্ণের মনটা ব্যাকুল হয়ে থাকে সারাক্ষণ পাগলের মত। অনিন্দিতা ও পৃথিলার সাথে হয়তো সুবর্ণের আর এ জীবনে কোন দিনও দেখা হবে না। তাছাড়া ওরা এখন কোথায় আছে তাও সুবর্ণ জানে না। অনেক দিন আগে সুবর্ণ হাসপাতালে চেকআপ করাতে যাওয়ার সময় পান্থর সাথে দেখা হয়েছিল। পান্থ তাকে জানিয়ে ছিল যে, অনিন্দিতার নাকি পুনরায় বিয়ে হয়েছে অন্য এক বড় ঘরের বড় মানুষের সাথে। পান্থ এখন প্রবাসী হয়েছে সৌদি আরবের কোন এক মরুভূমির শহরে। পান্থর মাধ্যমে যেটুকু খোঁজ পাওয়া যেত সেটুকুও আর এখন অবশিষ্ট নেই। সুবর্ণ সয়ে নিয়েছে তার স্বজন হারানোর বেদনা, ভালবাসা হারানোর যাতনা আর পা হারানোর কষ্ট।


আরতী হিন্দুর মেয়ে। দেখতে শরতের চাঁদের মতো সুন্দর। অদ্ভুত রূপে সাজিয়েছেন সৃষ্টিকর্তা তাকে। কৈশোর থেকে সবেমাত্র যৌবনে পা রাখা এক সদ্য ফোটা হাসনাহেনা যেন। মফস্বলের সবুজ প্রকৃতির সাথে মিতালী করে শিশির স্নাত হয়ে, সকালের সোনা রোদের সাথে পাল্লা দিয়ে বড় হয়েছে আরতী। তার সেই সোনাঝরা স্বপ্নীল জীবনেও আছে সুবর্ণের চাইতেও ভয়নাক আর হৃদয় বিদারক এক নিষ্ঠুর ধর্ষিত ইতিহাস। ফরিদপুরের এক নিভৃত গ্রামের মেয়ে সে। বাবা মুদি দোকানের ব্যবসা করে কোন রকমে জীবন চালাত। সংসারে তাদের অভাব ছিল নিত্যদিনের। পাঁচ ভাইয়ের একমাত্র বড়বোন হওয়ার সুবাদে আরতী অভাবের তাড়নায় লেখাপড়া বাদ দিয়ে সংসার যাপনে মগ্ন থাকতো সারাক্ষণ। তবুও, শত অভাবেও দিন ওদের নিত্য কষ্টে মধ্যে কেটে যাচ্ছিল। সরকার বদলের পর হঠাৎ একরাতে ক্ষমতাসীন দলের রোষানলে পড়ে আরতী চৌদ্দ-পনের জন যুবক কর্তৃক গণধর্ষণের স্বীকার হয়েছিল রাতভর। তার একটিই দোষ ছিল, তারা হিন্দু। আরতীর বাবা নৌকায় ভোট দিয়েছে, এটা তাদের অনেক অপরাধের মধ্যে একটি। অথচ কি অদ্ভুত ব্যাপার ছিল যে, আরতীর বাবা তার নিজের ভোটটিও দিতে পারেনি। তার ভোট নাকি অন্য কেউ জাল করে দিয়েছে।

আরতীর ধর্ষিতা হওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। সংবাদপত্রে হেডলাইন হয় ‘নৌকায় ভোট দেয়ার কারণে গণধর্ষণ’। শুধু ধর্ষণ করেই ক্ষান্ত হয়নি পশুরা। আরতীর বাবাকে চৌরাস্তায় উলঙ্গ করে দাঁড় করিয়ে ভৌতিক নৃত্যে মেতে ওঠে পশুর দল। থানায় তখন কোনো মামলা নেয়নি। আরতী মৃত্যুর জন্য নিত্যপ্রহর গুনে হাসপাতালের বেডে। আরতী মরতে চায়। পুরো এক শিশি স্যাভলন পান করে সে। মৃত্যুর জন্য আরতীর তখন সে কি ব্যাকুলতা। মৃত্যু কারো এভাবে কাম্য হতে পারে তা আরতীর প্রতিবেশীরাও তখন ভাবতে পারেনি। অথচ, আরতীর ভাগ্যদেবতা সব সময়ই উল্টোরথে চলে। মরে মরে বেঁচে যাওয়া তখন আরতীর আর হয়ে উঠল না। জীবন তাকে আলিঙ্গন করে নেয় নতুন করে প্রদীপ্ত সাহসে। তার এই নতুন করে পুনর্বার বেঁচে উঠতে বাদ সাদে এই সা¤প্রদায়িক সমাজ। আরতীর বাবা-মাকে সমাজপতিরা বাধ্য করে মেয়েকে বাড়ি থেকে বের করে দিতে। একরাতে আরতী পুনরায় আবার গলায় ওড়না বেঁধে আত্মহত্যা করার চেষ্টা করে। কিন্তু এবারও সে পারে না মরতে। বাবা তার দু’পা ধরে কেঁদে কেঁদে তাকে বাঁচতে আহ্বান করে। মা আর ভাইয়েরা তাকে দূরে পালিয়ে গিয়ে বাঁচার জন্য কাকুতি মিনতি করে। আরতী বাঁচার স্বপ্ন দেখতে শুরু করে আবার। নিজের সাথে বোঝাপড়া করে সে সারারাত। অতঃপর, সমাজের মুখে থুথু ছিটিয়ে আরতী সবার অগোচরে পালিয়ে আসে গোয়ালন্দের পতিতা পল্লীতে। এখানে এসে শুরু হয় তার আরেক নতুন জীবন। এ জীবন নিষিদ্ধ হলেও তার কাছে সিদ্ধ বলে মনে হয় এজন্য যে, এখানে অন্তত চৌদ্দ-পনের জন তো আর তাকে একসাথে ধর্ষণ করবে না। কিঞ্চিৎ স্বাধীনতার স্বাদ পেয়ে আরতী এখানে আজীবন থেকে যাবে বলে মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয়। আবার অন্যভাবে নিজেকে সান্ত্বনা দেয় এই ভেবে যে, এ জগৎ ছাড়া তো তার আর যাওয়ার মত অন্য কোন জায়গা নেই। ঠাঁই নেই তার সভ্য সমাজে। এখানে এসে আরতী খুঁজে পায় তার মত অনেক ভাগ্যবঞ্চিত হতভাগিনীদের। একদিন রশিদ নামের এক দালালের হাত ধরে আরতী গোয়ালন্দ পতিতা পল্লী থেকে পালিয়ে চলে আসে রাজধানী শহর ঢাকায়।

ঢাকা এসে শুরু হয় তার আরেক নতুন জীবন। শহরের কিছু কিছু আবাসিক হোটেলে ভ্রাম্যমাণভাবে শারীর বৃত্তীয় ব্যবসার কাজ পায় আরতী। দালালের মাধ্যমে একসময় একটি নামকরা হোটেলে সে পার্মানেন্ট হয়ে যায়। মাঝে মাঝে আরতী শহরের আবাসিক এলাকার কিছু কিছু ফ্ল্যাট বাড়িতেও শরীর বেচতে যায়। এমনি একটি বাড়ির গেটের পাসে এক রাতে আরতী একজন মানুষকে উবু হয়ে পড়ে থাকতে দেখে। সামনে গিয়ে সে মানুষটিকে হাত দিয়ে তুলে উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করে। সুবর্ণ তখন কাঁপছিল প্রচণ্ড জ্বরে। উঠে দাঁড়াবার মত সামান্যতম শাক্তি ও সামর্থ্য তার তখন ছিল না। তাছাড়া সুবর্ণকে পড়ে থাকতে দেখে, তার কাঠের ক্রাচটিও কোন এক টোকাই চুরি করে নিয়ে গেছে। আরতী সুবর্ণকে দু’হাত দিয়ে ঠেলে তুলে দাঁড় করায়। কোন কিছু ভাবতে পারে না আরতী আশপাশে কোন লোক নেই যে, ওকে তুলে হাসপাতালে নিয়ে যাবে। অচেনা অসুস্থ একজন লোককে নিয়ে এখন আরতী কী করবে ভেবে পায় না। অতঃপর সাহস করে রিকশা ডেকে আরতী সুবর্ণকে নিয়ে চলে আসে তার নিজস্ব জগতে। ওষুধপত্র আর প্রগাঢ় আন্তরিকতায় আরতী সুস্থ করে তোলে সুবর্ণকে। সুবর্ণের কাছ থেকে শুনে নেয় আরতী সুবর্ণের জীবনের সকল পরাজয়ের গাথা। আরতী আপন করে নেয় সুবর্ণকে। এভাবে একদিন সুবর্ণও নিশ্চিত আশ্রয় পেয়ে থেকে যায় সে নিষিদ্ধ জগতে আরতীর নিজস্ব সম্পদ হয়ে। সমাজ থেকে বিতাড়িত হয়ে আজ আরতীর ঠাঁই হয়েছে সমাজপতিদেরই বুকের নিচে। সে সমাজ কর্তৃক বিতাড়িত হয়েছে। আবার সেই সমাজেরই নাম করা নামিদামী সব মানুষগুলোও তার কাছে এসে এখন নষ্ট হচ্ছে রোজ। পুরুষের নষ্ট হওয়ার এই আদিম প্রক্রিয়া দেখে আরতীর এখন সে যে কী এক দারুণ আহ্লাদ। প্রতিশোধের নেশায় আরতী তলে তলে বীরাঙ্গনা হয়ে এখন সে ফুলন দেবী যেন। এক একজন পুরুষকে নষ্ট করে আরতী এখন বিজয়ের হাসি হেসে চিৎকার করে ওঠে জয়ের নেশায়। পুরুষের প্রতি এখন তার দারুন ক্ষোভ আর তীব্র ঘৃণা। শুধু সুবর্ণের বেলায় আরতী এখন যথেষ্ট উদার। যদিও সুবর্ণ একজন পুরুষ বৈ কি। তবুও তার সাথে আরতী নিজের জীবনের কোন এক সূক্ষ মিল খুঁজে পেয়েছে বলেই, সুবর্ণের উপরে নেই তার কোন রাগ, ক্ষোভ, দুঃখ, নয়তো ঘৃণার আচরণ। দু’জন দু’জনকে এখন বিশ্বাস করে, নির্ভর করে চিরকালের আপন ভেবে। হোক না তারা একে অপরে পরস্পর বিরোধী এক অন্য ধর্মের, ভিন্ন গোত্রের। আরতী সুবর্ণের এই ব্যর্থ জীবনকে নিজ জীবনে বন্ধু মেনে নিয়েছে শুধু মানুষ বলে। তাছাড়া ওদের দু’জনের তো আর এখন কোন ধর্ম নেই, গোত্র নেই, জাত নেই। নেই কোন বিবাহ নামক ধর্মের সনাতন নিয়ম। ধর্মের নামে এখন ওরা দু’জন আর কোন নিয়ম রেশালাত একদমই মানে না, মানতে পারে না। ওরা এখন শুধু মানুষ, শুধুই মানুষ। মানুষের পরিচয়েই ওরা এখন জীবনের বাকিটা সময় বেঁচে থাকতে চায় সব কষ্টের তীব্রতা ভুলে একে অন্যের হাতে হাত রেখে।


সুবর্ণ এখন আরতীর বুকে মাথা রেখে আগামী দিনের কথা ভাবছে। আরতী দু’হাত দিয়ে সুবর্ণকে ঝাপটে ধরে ঘুমিয়ে আছে পরম শান্তিতে, দারুণ নির্ভরতায়। সুবর্ণ আরতীর নিষ্পাপ মুখের দিকে তাকিয়ে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে নিয়তির সেই নিষ্ঠুর খেলার কথা মনে করে। আরতী সুবর্ণের এই অষ্ফুট হাসির বিকট আভায় দ্রুত ঘুম থেকে জেগে দু’হাত দিয়ে চোখ কচলাতে কচলাতে বলে,
-কি হয়েছে দেবরাজ?
তুমি এভাবে পাগলের মত করে হাসছো ক্যানো?

দূরের এক বাতিঘর থেকে তখন সিডি প্লেয়ারে ভেসে আসছে ফরিদা পারভীনের গাওয়া লালন ফকিরের সেই বিখ্যাত গান-
“গোপনে যে বেশ্যার ভাত খায়, তাতে ধর্মের কি ক্ষতি হয়...... জাত গেল জাত গেল বলে একি আজব কারখানা...........!
গানের সুরে সুবর্ণ আর আরতী পুনরায় খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে কী এক দারুণ স্বর্গীয় আভার নিষ্পাপ প্রগলভে।

মন্তব্য ৩ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (৩) মন্তব্য লিখুন

১| ২৭ শে আগস্ট, ২০১৮ বিকাল ৪:২৫

রাজীব নুর বলেছেন: প্রেম। আপনার লেখা মানেই প্রেম আর প্রেম।

২৮ শে আগস্ট, ২০১৮ রাত ২:২২

জায়েদ হোসাইন লাকী বলেছেন: হাহাহাহাহাহা

২| ২৯ শে আগস্ট, ২০১৮ সকাল ১১:৫৫

মোঃ ফখরুল ইসলাম ফখরুল বলেছেন: প্রেমময় :-/

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.