নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

সাহিত্যকর্মী, সংবাদকর্মী এবং শ্রমজীবী।

জায়েদ হোসাইন লাকী

সাহিত্যকর্মী, সংবাদকর্মী এবং শ্রমজীবী

জায়েদ হোসাইন লাকী › বিস্তারিত পোস্টঃ

ডায়োজিনিস অব সিনোপি, এক উন্মাদ দার্শনিকের স্বাধীনতার মহাকাব্য।

২৫ শে অক্টোবর, ২০২৫ দুপুর ১:০৯



প্রাচীন গ্রীসের দার্শনিক ইতিহাসে ডায়োজিনিস এমন এক নাম, যিনি প্রচলিত জ্ঞানের কাঠামো ভেঙে জীবনকে দর্শনের মঞ্চে পরিণত করেছিলেন। যেখানে সক্রেটিস যুক্তি শেখালেন, প্লেটো আদর্শ রাষ্ট্র গড়লেন, অ্যারিস্টটল সৃষ্টি করলেন যুক্তিবিদ্যার কাঠামো, সেখানে ডায়োজিনিস বললেন, ‘সত্য কোথাও বাইরে নেই, এটা লুকিয়ে আছে তোমার সরলতার ভেতরে’। তিনি ছিলেন এমন এক মানুষ, যিনি বলতেন, ‘আমি সভ্যতাকে না বলেছি, কারণ প্রকৃতি ইতিমধ্যেই আমাকে যথেষ্ট দিয়েছে’। এই প্রবন্ধে আমরা বিশ্লেষণ করব, কীভাবে এক নির্বাসিত নাগরিক, যিনি ব্যারেলের ভেতরে বাস করতেন, তিনি হয়ে উঠলেন স্বাধীনতার প্রতীক, নৈতিকতার বিপ্লবী, এবং আজকের ভোগবাদী যুগেও প্রাসঙ্গিক এক দার্শনিক।

প্রাচীন গ্রীস ছিল চিন্তার উন্মেষভূমি। এখানে যুক্তি, রাষ্ট্র, নৈতিকতা ও মানব আত্মা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল। সক্রেটিস, প্লেটো, অ্যারিস্টটল, সবাই যুক্তি ও জ্ঞানের কাঠামো নির্মাণ করেছিলেন। কিন্তু ডায়োজিনিস বললেন, ‘জ্ঞান নয়, আত্মনির্ভরতা দরকার। সিনোপ ছিল এক বন্দরনগরী , বাণিজ্যে পরিপূর্ণ, বিলাসে ভরা। সেখানকার মানুষ অর্থকেন্দ্রিক ছিল। ডায়োজিনিসের পিতা ছিলেন মুদ্রা নির্মাতা। কিন্তু একদিন যখন ‘মুদ্রা বিকৃতি’র অভিযোগে তাঁরা অভিযুক্ত হন, ডায়োজিনিস নির্বাসিত হন এবং উপলব্ধি করেন, ‘অর্থের ভেতরেই সমাজের সবচেয়ে বড় জালিয়াতি লুকিয়ে আছে’।

এথেন্স ছিল তখন দার্শনিক বিতর্কের কেন্দ্র। সক্রেটিসের মৃত্যুর পর সমাজে নৈতিক অস্থিরতা। ডায়োজিনিস এই শহরে এসে দেখলেন, মানুষ সত্যের কথা বলে, কিন্তু বিলাসে ডুবে আছে। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, দর্শন হবে জীবন, বক্তৃতা নয়। অ্যান্টিসথেনিসের শিষ্যত্বে তিনি প্রবেশ করেন। এই ধারাই ‘সিনিকিজম’ নামে পরিচিত হয়, যেখানে মানুষ প্রকৃতির নিয়মে বাঁচবে, সমাজের ভণ্ডামি, ধর্মীয় আচার, ভোগ, ক্ষমতা, সব প্রত্যাখ্যান করবে।

ডায়োজিনিস বসবাস করতেন এক মাটির পাইপে, যা তাঁকে আশ্রয় ও প্রতীক হিসেবে পরিচিত করেছে, তিনি বলেন, ‘আমি কমের মধ্যেই সম্পূর্ণ’। তিনি দিনে ভিক্ষা করতেন, রাতে শুয়ে থাকতেন আকাশের নিচে। তাঁর জীবনের সরলতা দর্শনের ঘোষণা হয়ে ওঠে। ডায়োজিনিস এর কিছু কাজ, একটি ছেলেকে হাত দিয়ে পানি খেতে দেখে নিজের বাটি ফেলে দেওয়া। তিনি লণ্ঠন হাতে নিয়ে দিনের বেলায় মানুষ খুঁজতেন। তিনি বলেন, ‘আমি একজন সৎ মানুষ খুঁজছি’। দাসত্বে গিয়েও স্বাধীন থাকা প্রসঙ্গে তিনি বলতেন, ‘আমি নেতা হওয়ার যোগ্য’। তাঁর চরম আচরণ ছিল একধরনের সামাজিক চিকিৎসা। তিনি সমাজের ভণ্ডামি প্রকাশ করতেন ‘শক থেরাপি’র মতো করে মানুষকে অস্বস্তিতে ফেলে ভাবতে বাধ্য করতেন। তিনি ছিলেন প্রথম ‘অ্যানার্কিস্ট দার্শনিক’ যিনি বলেছিলেন, ‘রাষ্ট্র হলো কৃত্রিম দাসত্ব’। তাঁর বিশ্বনাগরিক ধারণা আজকের মানবাধিকার চিন্তার পূর্বসূরী।মহান আলেকজান্ডার যখন তাঁকে বললেন, তুমি যা চাও বলো? তিনি বললেন, আমার রোদটা ঢেকে রেখেছো, তুমি সরো। এই কথায় আলেকজান্ডার নত হয়ে বললেন, যদি আমি আলেকজান্ডার না হতাম, আমি ডায়োজিনিস হতাম। এখানে ‘রোদ’ মানে স্বাধীনতা, যা রাজাশক্তিও কেড়ে নিতে পারে না।

অনেকে ভাবেন তিনি সমাজবিরোধী ছিলেন। আসলে তিনি সমাজের রোগ নির্ণয় করতেন। তাঁর ব্যঙ্গ ছিল অস্ত্র, ধ্বংস নয়। তিনি শেখাতে চেয়েছিলেন, নৈতিকতা মানে অন্তরের শুদ্ধতা, বাহ্যিক ভদ্রতা নয়। তিনি প্রকৃতির সঙ্গে বাঁচতেন, মিথ্যা সামাজিক লজ্জাকে উপেক্ষা করতেন, স্বাধীন ও সততা বজায় রাখতেন। তাঁর এই জীবন আসলে ছিল মানবতার আসল রূপে ফেরার আহ্বান। তিনি মনে করতেন, মানুষ কৃত্রিম সমাজ তৈরি করেছে, যেখানে বিলাস, আইন, ধর্ম সবই প্রকৃতিকে দূরে সরায়। ডায়োজিনিসের মতে, ‘যা প্রকৃতি শেখায়, সেটাই সত্য ধর্ম’। তিনি প্রস্তাব করেছিলেন, প্রকৃতি যেমন সহজ, জীবনও তেমন হোক। অতিরিক্ত কিছুই স্বাধীনতার শত্রু। তাঁর দর্শনের কেন্দ্রবিন্দু ‘Autarkeia’, অর্থাৎ স্বনির্ভরতা ও আত্ম-সংযম। একজন স্বাধীন মানুষ সেই, যে নিজের প্রয়োজন নিজেই নির্ধারণ করে। তিনি বলতেন, ‘যার কিছুই লাগে না, সে-ই সর্বশক্তিমান। ডায়োজিনিস ছিলেন বিশ্বের প্রথম ‘পারফরমেন্স ফিলোসফার’। তিনি নিজের জীবনকে রূপ দিয়েছিলেন এক জীবন্ত নাটকে, যেখানে প্রতিটি কাজ ছিল শিক্ষা। যেমন, নগ্ন থাকা → সমাজের মুখোশ উন্মোচন। রোদে বসা → প্রকৃতির সঙ্গে সখ্য। ভিক্ষা করা → প্রয়োজনের পুনঃসংজ্ঞা।

স্টোইকরা (Epictetus, Seneca, Marcus Aurelius) ডায়োজিনিস থেকে আত্মনিয়ন্ত্রণ ও প্রাকৃতিক নৈতিকতার শিক্ষা নেন। তাঁরা তাঁর ধারণাকে যুক্তি ও নীতিতে রূপান্তরিত করেন। আজকের ভোগবাদী, বিজ্ঞাপন-নির্ভর, সামাজিক মিডিয়ার যুগে ডায়োজিনিসের কণ্ঠ এখনো গর্জে ওঠে, ‘তুমি যত দেখাও, তত হারাও’। তিনি শেখান, সরলতা মানে সাহস, ন্যূনতম মানেই স্বাধীনতা, আত্মসম্মানই সর্বোচ্চ সম্পদ। সার্ত্রে বা কামুর মতো অস্তিত্ববাদীরা যেমন বলেছিলেন, ‘মানুষ নিজের অর্থ নিজেই তৈরি করে’। তেমনি ডায়োজিনিস বলেছিলেন, প্রকৃতি তোমাকে যা দিয়েছে, তাতেই তুমি পূর্ণ।’

হেনরি ডেভিড থরো তাঁর Walden-এ প্রকৃতিনির্ভর জীবন বেছে নিয়েছিলেন। মহাত্মা গান্ধী ডায়োজিনিসের মতোই সরলতা ও আত্মসংযমে বিশ্বাস করতেন। নিতশে তাঁকে বলেছিলেন ‘প্রথম ইউরোপীয় বুদ্ধিবিদ্রোহী’। ডায়োজিনিসের জীবন ছিল এক দার্শনিক কবিতা, যেখানে প্রতিটি কাজ ছিল এক আহ্বান, ‘তুমি নিজেকে মুক্ত করো’। তিনি দেখিয়েছিলেন, রাষ্ট্র, ধর্ম, সমাজ, অর্থ, সবই কৃত্রিম দেয়াল। মানুষ প্রকৃতির সন্তান, তাই প্রকৃতি ছাড়া সে অর্থহীন। যে নিজেকে সামলায়, সে-ই রাজা। আজকের ভোগবাদ, রাজনৈতিক ভণ্ডামি, সোশ্যাল মিডিয়ার মিথ্যা সুখের যুগে ডায়োজিনিস যেন ফিসফিস করে বলেন, ‘তুমি যত কম চাও, তত বেশি পাও। ডায়োজিনিস ছিলেন না রাজা, না শিক্ষক, না লেখক, তবু তাঁর দর্শন টিকে আছে ২৪০০ বছর ধরে, কারণ তিনি নিজেকে সত্যের প্রমাণে পরিণত করেছিলেন। তিনি আমাদের শিখিয়েছিলেন, মুক্তি বাহিরে নয়, ভিতরে, জ্ঞানের শুরু আত্মনির্ভরতা থেকে, প্রকৃতি কখনো মিথ্যা বলে না। এভাবেই ডায়োজিনিস হয়ে উঠেছিলেন সভ্যতার আয়নায় ভাঙচুর করা এক মুক্ত আত্মা। তিনি মারা যান করিন্থে (৩২৩ খ্রিঃপূঃ)। কেউ বলে কুকুরের মতোই মরেছিলেন, যেন জীবন ও মৃত্যু উভয়েই দর্শন। তাঁর সমাধিতে কুকুরের মূর্তি ছিল, মানুষ যে প্রকৃতিরই অংশ, তার প্রতীক হিসেবে।

জায়েদ হোসাইন লাকী
সম্পাদক, সাহিত্য দিগন্ত পত্রিকা
ঢাকা।

মন্তব্য ৪ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (৪) মন্তব্য লিখুন

১| ২৫ শে অক্টোবর, ২০২৫ দুপুর ১:৫৪

হুমায়রা হারুন বলেছেন: চমৎকার।
" ডায়োজিনিস বাস করতেন এক মাটির পাইপে" -এক্ষেত্রে 'পাইপ' না বলে মাটির 'কালভার্ট ' বললে বুঝতে সুবিধা হতো।

২| ২৫ শে অক্টোবর, ২০২৫ বিকাল ৪:১৬

জেনারেশন একাত্তর বলেছেন:



আপনার তো ভালো চাকুরী আছে; দিগন্তে কারা লেখে?

৩| ২৫ শে অক্টোবর, ২০২৫ বিকাল ৪:৩১

এইচ এন নার্গিস বলেছেন: চমৎকার ! দার্সনিক ডায়োজিনিস এর জীবন আর তার দর্সন জানানোর জন্য অনেক ধন্যবাদ ।

৪| ২৫ শে অক্টোবর, ২০২৫ সন্ধ্যা ৭:৪২

কামাল১৮ বলেছেন: দর্শন এখন বিজ্ঞানের বিষয়।ভাববাদী দর্শন এখন বাদ।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.