নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

সাহিত্যকর্মী, সংবাদকর্মী এবং শ্রমজীবী।

জায়েদ হোসাইন লাকী

সাহিত্যকর্মী, সংবাদকর্মী এবং শ্রমজীবী

জায়েদ হোসাইন লাকী › বিস্তারিত পোস্টঃ

জুবিন গার্গ: জীবন, সংগীত ও সাংস্কৃতিক পুনর্জাগরণের প্রতীক।

১৩ ই নভেম্বর, ২০২৫ দুপুর ২:২৩


সুরের নদীতে এক অনন্ত যাত্রা
যে ভূমিতে ব্রহ্মপুত্র নদ প্রবাহিত, সেই ভূমিতে সুরও যেন নদীর মতোই প্রবাহিত হয়। আসাম, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের এই রাজ্যটি শুধু ভৌগোলিক সৌন্দর্যের নয়, সংগীতেরও এক মায়াবী উৎস। এখান থেকেই জন্ম নিয়েছিলেন এমন এক শিল্পী, যিনি সীমানা, ভাষা, ধর্ম, সবকিছুর গণ্ডি পেরিয়ে মানুষের হৃদয়ে পৌঁছে গেছেন সুরের জাদু দিয়ে। তাঁর নাম জুবিন গার্গ (Zubeen Garg)। তিনি গায়ক, সুরকার, সংগীত পরিচালক, অভিনেতা, চিত্রনির্মাতা, কবি, সবকিছুর এক অদ্ভুত সমন্বয়। তাঁর গান শুধু শোনার জন্য নয়, অনুভব করার জন্য। কারণ তাঁর কণ্ঠে আছে জীবনের বেদনা, প্রেমের তীব্রতা, প্রতিবাদের আগুন, এবং আত্মার মুক্তির সুর।

জন্ম ও শৈশব, যেখানে সুরের বীজ বপন হয়
১৮ নভেম্বর ১৯৭২ সালে ভারতের আসাম রাজ্যের তেজপুরে জন্মগ্রহণ করেন জুবিন গার্গ। তাঁর পিতা নবীন চন্দ্র গার্গ ছিলেন একাধারে সংগীত শিক্ষক, তবলা বাদক এবং শাস্ত্রীয় সংগীতের অনুরাগী। মাতা ইলাবতী গার্গ ছিলেন শাস্ত্রীয় সংগীতে প্রশিক্ষিত এক স্নিগ্ধ কণ্ঠশিল্পী। ফলে ছোটবেলা থেকেই তাঁর জীবন ছিল সুরে মোড়ানো। শিশু বয়সে ঘরে চলত রবীন্দ্রসংগীত, ভজন, আসামি লোকগীতি, ভাওনা (আসামের ধর্মীয় নাট্যরূপ)। এই পরিবেশই তাঁকে গড়ে তোলে এক সংবেদনশীল শিশুতে। তিনি স্কুলে পড়তেন Tezpur Academy-তে। ছোটবেলায় গানের প্রতিযোগিতায় প্রায়ই পুরস্কার পেতেন।

শৈশবের সংগীত অনুশীলন
জুবিন প্রথম সংগীত শিক্ষা নেন পিতার কাছ থেকেই। তিনি তবলা বাজানোয় ছিলেন পারদর্শী। পরে হারমোনিয়াম, বাঁশি, গিটার, সব কিছু শিখে ফেলেন। তাঁর বয়স যখন মাত্র আট বছর, তখনই তিনি নিজের লেখা একটি গান স্থানীয় অনুষ্ঠানে গেয়ে সবাইকে অবাক করে দেন। কৈশোরে তাঁর সঙ্গীত জীবনকে প্রভাবিত করেন আসামের দুই কিংবদন্তি, ভূপেন হাজারিকা ও জয়ন্ত হাজারিকা। তাদের মতোই তিনি বিশ্বাস করতেন, ‘সংগীত শুধু শিল্প নয়, এটি মানুষের অস্তিত্বের প্রতিবাদ ও প্রার্থনা।’

আসামি সংগীতে উত্থান, এক আঞ্চলিক বিপ্লব
প্রথম অ্যালবাম ‘Anamika’ (১৯৯২)। ১৯৯২ সালে মাত্র ২০ বছর বয়সে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম আসামি অ্যালবাম ‘Anamika’। এটি আসামি সংগীতের ইতিহাসে এক নতুন যুগের সূচনা করে। এখানে লোকসংগীতের ঘ্রাণ মিশে গেছে আধুনিকতার সুরে, গানের কথায় আছে প্রেম, ব্যথা ও সামাজিক অনুরণন। এই অ্যালবামের গানগুলো দ্রুতই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। বিশেষত ‘Anamika’ নামের টাইটেল ট্র্যাকটি তরুণ প্রজন্মের মধ্যে একধরনের আবেগ সৃষ্টি করে।

ধারাবাহিক সাফল্য
এরপর তিনি একের পর এক অ্যালবাম প্রকাশ করেন,
১ ‘Chandni Raat’ (১৯৯৪)
২ ‘Asha’ (১৯৯৫)
৩ ‘Jibon’ (১৯৯৭)
৪ ‘Maya’, ‘Nayak’, ‘Shure Shure’ (২০০০-এর দশক)
এইসব অ্যালবামে তিনি নিজের কণ্ঠে ও সুরে এক নতুন ধারা সৃষ্টি করেন। গানগুলোয় মিশে ছিল পপ রিদম, আসামি লোকসংগীতের মেলোডি, আর রক মিউজিকের উচ্ছ্বাস।

গানের বিষয়বস্তু ও দর্শন
জুবিনের গানে শুধু প্রেম নয়, ছিল মানুষের বেদনা, সামাজিক অবিচার, রাজনীতির অসারতা, এমনকি প্রকৃতির সঙ্গে সম্পর্কও। তিনি লিখেছিলেন, ‘আমি গান গাই প্রেমের জন্য, কিন্তু প্রেম শুধু রোমান্স নয়, এটা মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক।’ এই সময়েই তিনি আসামি চলচ্চিত্রে গান গাওয়া শুরু করেন। যেমন, Hiya Diya Niya, Dinabandhu, Mone Mur Prem, Mission China, Kanchenjunga, এইসব সিনেমার সুর ও সংগীত তাঁরই সৃষ্টি। আসামের মানুষ তাঁকে তখনই ডাকা শুরু করে, ‘Asomiya Xuror Raja’ (আসামি সুরের রাজা)।

বলিউডে প্রবেশ, দেশজ সুর থেকে বিশ্বমঞ্চে
প্রথম পদক্ষেপ, ১৯৯৫ সালে তিনি সংগীত পরিচালক হিসেবে বলিউডে কাজ শুরু করেন। কিন্তু তাঁর কণ্ঠে প্রথম বড় ব্রেক আসে ২০০৬ সালে, যখন মহেশ ভাটের চলচ্চিত্র Gangster-এ তিনি গাইলেন কিংবদন্তি গান ‘Ya Ali’। এই গানটি মুহূর্তেই ভারতের সীমানা ছাড়িয়ে বিশ্বজুড়ে আলোড়ন তোলে। গানের সুফি সুর, আরবি মেলোডি, ও তাঁর কণ্ঠের গভীর বেদনা শ্রোতাদের হৃদয়ে স্থায়ী জায়গা করে নেয়।

পরবর্তী হিট গানসমূহ
বলিউডে এরপর তিনি একে একে উপহার দেন অসংখ্য জনপ্রিয় গান, Tera Mera Rishta Purana , Awarapan (২০০৭), Dil Tu Hi Bataa , Krrish 3 (২০১৩), Yaad Aa Raha Hai , Kasak (২০০৫), Bhool Jaa , Kasak, Tu Hi Meri Shab Hai (Unplugged) , Gangster, তাঁর কণ্ঠে প্রেমের ব্যথা, আধ্যাত্মিক সুর ও মানবিক মমতা মিশে এক অনন্য মাত্রা পায়।

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
Ya Ali গানটি মধ্যপ্রাচ্য, বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফ্রিকার দেশগুলোতেও জনপ্রিয় হয়। কাতার, দুবাই, ওমান, এসব জায়গায় তাঁর লাইভ কনসার্টে হাজারো মানুষ উপস্থিত হয়। এক আরবি সংগীত সমালোচক বলেছিলেন, ‘Zubeen Garg sings like a man who has seen pain and still believes in love.’

সংগীতদর্শন ও মানবিক সত্তা
জুবিন গার্গের সংগীত কেবল পেশা নয়, তাঁর জীবনদর্শনের প্রতিফলন। তাঁর মতে, ‘সংগীত হলো আত্মার ভাষা। এটা ধর্ম, জাতি, ভাষার ঊর্ধ্বে’। তাঁর গানে আমরা দেখি তিনটি মূলধারা, ১, মানবিক ঐক্য ও ভালোবাসা, ২, প্রকৃতি ও মাটির সঙ্গে সংলাপ, ৩, আত্মিক মুক্তির অনুসন্ধান। তাঁর কণ্ঠের গভীরে এক ব্যথা আছে, যেন জীবনের অসংগতি, সামাজিক অন্যায়, প্রেমের ক্ষয়, সবকিছুর সুররূপ।

সমাজ ও সংস্কৃতিতে ভূমিকা
জুবিন গার্গের একটি বড় ভূমিকা হলো আসামি ভাষা ও সংস্কৃতি রক্ষায় তাঁর কাজ। তিনি নিজের সংগীতের মাধ্যমে তরুণ প্রজন্মকে স্থানীয় ভাষা ও ঐতিহ্যের দিকে ফিরিয়ে এনেছেন। তাঁর সামাজিক অবদানও গভীর। তিনি প্রতিষ্ঠা করেন Zubeen Garg Foundation, যা দরিদ্র শিল্পী, শিক্ষার্থী ও অসহায় মানুষদের সহায়তা করে। তিনি নিয়মিত অংশ নেন রক্তদান ক্যাম্প, বন্যা ত্রাণ কার্যক্রম, মাদকবিরোধী প্রচারণা, আত্মহত্যা প্রতিরোধ প্রভৃতিতে। মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে সচেতনতা তৈরির জন্যও তিনি কাজ করেন।

প্রতিবাদী শিল্পী
জুবিন গার্গ রাজনৈতিকভাবে স্বাধীন চিন্তার মানুষ। তিনি আসামের নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল (CAA)-এর বিরুদ্ধে স্পষ্ট অবস্থান নেন এবং গণআন্দোলনে অংশ নেন। এ নিয়ে বহু বিতর্কও হয়, কিন্তু তিনি বলেন, ‘শিল্পী যদি অন্যায়ের বিরুদ্ধে চুপ থাকে, তবে তার গান মৃত’।

সিনেমা, অভিনয় ও পরিচালনা
জুবিন শুধু সংগীতেই নয়, চলচ্চিত্রেও সমানভাবে সক্রিয়। তিনি অভিনয় করেছেন এবং পরিচালনাও করেছেন একাধিক চলচ্চিত্র, Mission China (২০১৭)। এটি তাঁর পরিচালিত ও অভিনীত সবচেয়ে সফল আসামি চলচ্চিত্র। Kanchenjunga (২০১৯), Rowd, Dinabandhu, Tumi Aahibaane, Kanchanjangha প্রভৃতি। Mission China আসামে রেকর্ড আয় করে এবং এটিকে ‘আসামি সিনেমার পুনর্জাগরণ’ বলা হয়। চলচ্চিত্রের গল্পে তিনি তুলে ধরেন আসামের সামাজিক বাস্তবতা, যুবসমাজের বিভ্রান্তি, ও দেশপ্রেমের পুনর্ব্যাখ্যা।

বিতর্ক, চ্যালেঞ্জ ও ব্যক্তিগত দর্শন
একজন খোলামেলা শিল্পী হিসেবে জুবিন বহু বিতর্কের মুখোমুখি হয়েছেন, কখনো তাঁর রাজনৈতিক বক্তব্য, কখনো সামাজিক সমালোচনা, কখনো ব্যক্তিগত মন্তব্য নিয়ে। তবে তিনি কখনো আপস করেননি। তিনি বলেন, ‘আমি জনপ্রিয় হওয়ার জন্য গান গাই না, সত্য বলার জন্য গান গাই’। তাঁর জীবনেও এসেছে সংকট, মানসিক চাপ, ও একাধিক দুর্ঘটনা। তবুও তিনি সব সময় ফিরে এসেছেন সুরের কাছে। তিনি বিশ্বাস করেন, ‘যতক্ষণ গান গাইতে পারি, আমি বেঁচে আছি।’

পুরস্কার ও স্বীকৃতি
জুবিন গার্গ তাঁর অসাধারণ অবদানের জন্য পেয়েছেন অসংখ্য সম্মাননা,
১) Filmfare Award (2007) , Ya Ali গানের জন্য
২) Assam State Film Award , শ্রেষ্ঠ সংগীত পরিচালক
৩) Prag Cine Award , একাধিকবার
৪) GIMA Award , শ্রেষ্ঠ আঞ্চলিক শিল্পী
৫) Voice of Northeast Award , আসামি সংস্কৃতির দূত হিসেবে
৬) ‘Xuror Xeh’ (Voice of Music) Award , আসামের তরুণ সংগীতপ্রেমীদের কাছ থেকে প্রাপ্ত এক বিশেষ সম্মান

উত্তরাধিকার ও প্রভাব
জুবিন গার্গ আসামি সংগীতকে ভারতীয় মূলধারায় প্রতিষ্ঠা করেছেন। তাঁর প্রভাব আজকের তরুণ প্রজন্মের অনেক শিল্পীর মধ্যে স্পষ্ট, যেমন পাপন (Angaraag Mahanta), Kalpana Patowary, এমনকি বাংলাদেশের তরুণ শিল্পীরাও তাঁর গান কাভার করেন। তিনি প্রমাণ করেছেন, সংগীত কখনো আঞ্চলিক নয়; এটি সার্বজনীন। আসামের সুরকে বিশ্বমঞ্চে পৌঁছে দেওয়া তাঁরই কৃতিত্ব।

এক অনন্ত সুরের মানুষ
জুবিন গার্গ শুধু একজন গায়ক নন; তিনি এক যুগের প্রতিনিধিত্ব করেন। তাঁর কণ্ঠে মিশে আছে প্রেম, প্রতিবাদ, প্রকৃতি ও প্রার্থনা। তিনি দেখিয়েছেন, একজন শিল্পী কেমন করে সমাজের আয়না হয়ে উঠতে পারে। আজও তাঁর কণ্ঠে যখন ধ্বনিত হয়, ‘Ya Ali rehem Ali…’ তখন মনে হয়, মানুষের সমস্ত বেদনা, সমস্ত ভালোবাসা, সমস্ত মুক্তি, একসাথে সুর হয়ে উড়ে যাচ্ছে আকাশের দিকে। তিনি সীমানাহীন এক শিল্পী, যাঁর গান প্রমাণ করে, সংগীতই সর্বশেষ ধর্ম, এবং ভালোবাসাই তার একমাত্র প্রার্থনা।

জায়েদ হোসাইন লাকী
(লেখক, গবেষক)
সম্পাদক, সাহিত্য দিগন্ত
ঢাকা, বাংলাদেশ।

তথ্যসূত্র : ইন্টারনেট ও বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা।

মন্তব্য ২ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ১৩ ই নভেম্বর, ২০২৫ সন্ধ্যা ৬:০০

রানার ব্লগ বলেছেন: একজন শিল্পী কেবল নিজের জন্য নয়। তিনি রাস্ট্রিয় সম্পদ। শিল্পী কে নিজের যত্ন নিতে জানতে হয়।

১৩ ই নভেম্বর, ২০২৫ রাত ৮:৫৯

জায়েদ হোসাইন লাকী বলেছেন: একদম। অযত্নে, অবহেলায় নিজের হাতে জুবিন নিজের জীবন উড়িয়ে দিলেন। নেশা তাঁকে খুবলে খেয়েছে।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.