![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আমি কি সংখ্যালঘু? না! আমি কি সরকারবিরোধী? না! আমি এসব কিছুই না। আমি বাসযাত্রী না, লঞ্চযাত্রী না, আমি অপরাধী না, প্রতিপক্ষ পীরের মুরিদ না, আমি নিঃসঙ্গ বিদেশিও না। এতকাল এসব ভেবে আমাদের অনেকে একধরনের স্বস্তি ও নিরাপত্তা অনুভব করতাম হয়তো! গুলশান হত্যাকাণ্ডের পর আমাদের সেই স্বার্থপর স্বস্তিবোধ বিলুপ্ত হয়েছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে জননিরাপত্তার প্রশ্নটি এখন সত্যি সর্বজনীন হয়ে উঠেছে।
আমরা সবাই এখন ঝুঁকিতে। রাষ্ট্রের কঠিন নিরাপত্তাবলয়ে থাকা গুটি কয়েক ক্ষমতাবান মানুষ ছাড়া প্রত্যেকের জীবন এখন বিপন্ন হতে পারে যেকোনো সময়। এই আশঙ্কা একটি সমাজের জন্য সবচেয়ে পরিতাপের বিষয়, একটি রাষ্ট্রের জন্য সবচেয়ে দুর্ভাবনার বিষয়।
এটি ঠিক, এমন ঝুঁকির মধ্যেও অনেক রাষ্ট্র এগিয়ে চলে প্রায় স্বাভাবিক গতিতে। ফ্রান্স, বেলজিয়াম, ইরান তার প্রমাণ। প্রতিবেশী ভারতও এর প্রমাণ। কিন্তু এসব দেশের সঙ্গে আমাদের বিরাট কিছু পার্থক্য আছে। তা হচ্ছে এসব দেশে সন্ত্রাস দমন নিয়ে কোনো নোংরা রাজনীতি নেই। সন্ত্রাস দমনে এসব দেশের সরকারের আন্তরিকতা, এমনকি অনেক ক্ষেত্রে সামর্থ্য নিয়ে মানুষের কোনো সংশয় নেই। আমাদের দেশে অধিকাংশ মানুষের মনে এটি প্রবলভাবে আছে। গুলশান হত্যাকাণ্ডের ঘটনায়, বিশেষ করে পুলিশ-র্যাব-গোয়েন্দাদের সামর্থ্যের দুর্বলতারযে চিত্র দেখা গেছে, তা অবিশ্বাস্য! তাদের অস্বচ্ছতারও যে ঘটনাগুলো ফুটে উঠেছে, তা-ও অস্বস্তিকর।
২.
গুলশান হত্যাকাণ্ডের বিভিন্ন ঘটনায় পুলিশ-র্যাবসহ বিভিন্ন বাহিনীর অদক্ষতার প্রমাণ মিলেছে। এ ঘটনার আগে বাবুল আক্তারের স্ত্রী মিতু হত্যার পর এ দেশে জঙ্গি দমনের নামে বিএনপি-জামায়াতের শত শত কর্মীসহ কয়েক হাজার মানুষকে নির্বিচারে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। অথচ পুলিশের খাতায় নাম থাকার পরও গুলশান হত্যাকাণ্ডের হোতা আসল জঙ্গিদের নাকি কখনোই খুঁজে পায়নি পুলিশ!
আমরা এখন জেনেছি গুলশানের জঙ্গি তরুণেরা নিখোঁজ ছিল কয়েক মাস ধরে, তাদের কারও কারও খোঁজ চেয়ে উদ্বিগ্ন অভিভাবকেরা পুলিশ-গোয়েন্দা সবার সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন। পুলিশ তবু কিছু করতে পারেনি। বরং দেশের সবচেয়ে বেশি নিরাপত্তাবলয়ের একটি এলাকায় এরা বহু প্রাণঘাতী অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে বিনা বাধায় ঢুকেছে, সেখানকারই একটি রেস্তোরাঁয় ঢুকে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালাতে পেরেছে। প্রশ্ন আসে এটি কি রাষ্ট্রীয় বাহিনীগুলোর সামর্থ্যের অভাবের জন্য? নাকি তাদের লক্ষ্যই ছিল ভিন্ন? জঙ্গি দমনের চেয়ে এতকাল তারা আসলে ব্যস্ত ছিল মূলত বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের দমনের কাজে?
গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় জঙ্গিদের যেভাবে পুলিশ প্রথম প্রতিরোধ করতে গিয়ে হতাহতের শিকার হয়েছে, তাতে কেউ কেউ বীরত্বের পরিচয় পেয়েছেন। হতে পারে। কিন্তু এর মধ্যে কি আল-কায়েদা বা আইএসের মাপের জঙ্গিদের সামর্থ্য ও চরিত্র সম্পর্কে এদের চূড়ান্ত অসচেতনতার পরিচয় নেই? ক্রসফায়ার বা গুমের অভিযোগে অভিযুক্ত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কি সত্যিকার সশস্ত্র জঙ্গি বা অপরাধীদের মোকাবিলার সামর্থ্য হারিয়ে ফেলেছে। কোনো কিছু যাচাই না করে পুলিশ প্রথমে আক্রমণকারীদের নাম বলেছিল ডন, রিপন, স্বপন ইত্যাদি। এই ধরনের কর্মকাণ্ড কি শুধুই অদক্ষতা, এর মধ্যে কি জনগণের কাছে সত্যি তথ্য দেওয়ার বিষয়ে নিদারুণ হেলাফেলার মনোভাব নেই? আবার অনেক ক্ষেত্রেই তথ্য গোপন করার মানসিকতার প্রমাণ মেলে।
গুলশানের ঘটনায় শাওন নামের একজন পালিয়ে বের হওয়া তরুণকে সন্দেহভাজন জঙ্গি হিসেবে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। তার পরিবার বলেছে, তিনি আসলে রেস্তোরাঁটির সহকারী বাবুর্চি ছিলেন। তার ওপর পুলিশের নির্যাতনের অভিযোগ আছে। চিকিৎসাধীন অবস্থায় গত শুক্রবার বিকেলে মারা গেছেন। তাঁর প্রকৃত পরিচয় ও মৃত্যুর কারণ অবশ্যই স্পষ্ট করতে হবে।
এর আগে কিছু ঘটনায় এমন অনেক সন্দেহভাজন ব্যক্তি (যেমন মিতু হত্যার আসামি ও ফায়েজুল্লাহ) রহস্যজনকভাবে মারা গেছেন, প্রকৃত ঘটনা জানার জন্য যাঁদের বেঁচে থাকা খুব প্রয়োজন ছিল। গুলশানের ঘটনায় তা আবার হয় কি না, সেই প্রশ্ন রয়েছে। প্রশ্ন আছে রহস্যজনক গতিবিধির একজন জিম্মি (প্রকৌশলী হাসনাত এ করিম) এবং জঙ্গি সন্দেহে গ্রেপ্তারকৃতদের নিয়ে শেষ পর্যন্ত কী করা হলো, তা নিয়ে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম আর পত্রিকার অনলাইন এডিশনে আরও বহু বিষয়ে মানুষ প্রশ্ন তুলছে, যার উত্তর পাওয়া যাচ্ছে না।
গুলশান ঘটনার পর শোলাকিয়ার ঘটনা ও আইএসের আরও আক্রমণের হুমকি এমনিতেই সমাজে প্রবল ভীতি সৃষ্টি করেছে। জঙ্গি মানেই মাদ্রাসার—এই সরলীকরণ থেকে সরে আসার সময় হয়েছে। আমরা দেখলাম সাম্প্রতিক ঘটনাগুলোতে আক্রমণকারী ও হুমকি প্রদানকারীদের অধিকাংশ আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত, সচ্ছল ও সমাজের সুবিধাভোগী পরিবারের সন্তান। সবকিছু মিলিয়ে বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে সরকারের অদক্ষতা ও অস্বচ্ছতার যে পরিচয় ফুটে উঠেছে, তা মানুষকে দিশেহারা করে ফেলার জন্য যথেষ্ট।
৩.
জঙ্গি আক্রমণ ও হুমকি মোকাবিলায় আরেকটি দুর্ভাবনার বিষয় হচ্ছে এ নিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা লাভের চেষ্টা। গুলশানের ঘটনার আগে এ দেশে ব্যক্তিপর্যায়ে বহু জঙ্গি আক্রমণের ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনার মধ্যে ২৭টিতে আইএস (ইসলামিক স্টেট) ও ৭টিতে একিউআইএস (আল-কায়েদার ভারতীয় উপমহাদেশ শাখা) দায় স্বীকার করে ইন্টারনেটে তাদের নিজস্ব ফোরামে বিবৃতি দিয়েছে। কিন্তু সরকার শুরু থেকেই বলে আসছে, এ দেশে আইএস বা আল-কায়েদা নেই। বরং প্রায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে কোনো তদন্ত ছাড়াই সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে এ জন্য বিএনপি-জামায়াতকে দায়ী করা হয়েছে। কখনো এ জন্য দেশি জঙ্গিগোষ্ঠীগুলোকে দায়ী করা হলেও এর পেছনে বিএনপি-জামায়াতের ইন্ধনের কথা বলা হয়েছে।
হতে পারে সরকারের এসব অভিযোগ কোনো কোনো ক্ষেত্রে হয়তো সঠিক ছিল। কিন্তু যেসব ঘটনায় তাদের সংশ্লিষ্টতা নেই, সেগুলোতে পুলিশ তাদের টার্গেট করেনি, এর কোনো নিশ্চয়তা আছে কি? বাংলাদেশে পুলিশ বিভাগ যেভাবে দলীয়করণের শিকার হয়েছে, যেভাবে এর হর্তাকর্তাদের মুখে রাজনৈতিক বক্তব্য শোনা যায়, তাতে এটিই তো হওয়ার কথা। গুলশান ঘটনার পর প্রধানমন্ত্রী সরাসরি বিএনপি-জামায়াতকে দায়ী করেননি। কিন্তু অন্তত তিনজন শীর্ষ নেতা এ ঘটনায় আইএস জড়িত থাকার প্রায় অকাট্য প্রমাণ (বিশেষ করে আইএসের ওয়েব পেজের তাৎক্ষণিক আপডেট) থাকার পরও এ জন্য বিএনপি-জামায়াতকেই দায়ী করেছেন।
সরকারকে বুঝতে হবে গুলশান ঘটনার পর অকাট্য প্রমাণ না দিলে এসব বিশ্বাস করার পরিস্থিতি আর নেই। বিশ্ব গণমাধ্যম বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের ভয়াবহ উত্থানের জন্য এই বিভক্তির রাজনীতি ও সরকারের ব্যর্থতাকে দায়ী করছে। বিএনপির নেত্রী তবু জঙ্গিবাদ দূরীকরণে জাতীয় ঐক্যের আহ্বান জানিয়েছেন। এত বড় সন্ত্রাসী ঘটনার পরও সরকার সে রকম কোনো উদ্যোগ নেয়নি। বরং প্রমাণ ছাড়া একতরফা অভিযোগ অব্যাহত রেখে সরকার ও তার জোটসঙ্গীরা জনগণকে আরও হতাশার দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
৪.
গুলশান ঘটনার পর সরকার জঙ্গিবাদ দূরীকরণে প্রতিবেশী বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্রের সহযোগিতা নেওয়ার কথা বলেছে। কিন্তু জঙ্গি দমনের কাজে আমাদের বরং প্রথমে নিজেদের সামর্থ্য ও শক্তিমত্তা সঠিকভাবে ব্যবহার করার দিকে নজর দেওয়া দরকার। জাতীয় ঐক্যের উদ্যোগ নিয়ে জনগণের মধ্যে নতুন আশাবাদ তৈরি করতে হবে। নিয়মতান্ত্রিকভাবে সরকারের বিরোধিতার রাজনীতি করার, ভিন্নমত পোষণের ও ন্যায়বিচার পাওয়ার পরিস্থিতি দেশে তৈরি করতে হবে। ইসলাম, হিন্দু, খ্রিষ্টানসহ সব ধর্মের প্রতি অবমাননাকর ও আক্রমণাত্মক বক্তব্য কঠোরভাবে দমন করতে হবে, সব ধর্মের অনুসারীদের প্রতি বৈষম্য পরিহার করতে হবে। জঙ্গিবাদ নিয়ে গভীর গবেষণার ভিত্তিতে উপযুক্ত পদক্ষেপ নিতে হবে।
৫.
আগের বিএনপি সরকারের চরম ব্যর্থতা এ দেশে ধর্মীয় জঙ্গিবাদের প্রসারের পেছনে কাজ করেছে। বিএনপি সরকার অনেক পরে জঙ্গিনেতাদের গ্রেপ্তার করেছিল এবং জঙ্গি দমন আইন করেছিল। তত দিনে দেশের বহু ক্ষতি হয়েছিল। আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় এখন জঙ্গিবাদের চরিত্র ও সামর্থ্যের ভয়াবহতা অনেক বেশি। এখন এর প্রতিকার আমরা না করতে পারলে বাংলাদেশের সমাজ, জীবন, অর্থনীতি আর নিরাপত্তা মারাত্মকভাবে বিপন্ন হবে। বাংলাদেশে বিভিন্ন বিদেশি শক্তির হস্তক্ষেপ আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে যাবে। যে বাংলাদেশটাকে আমরা ভালোবাসি, তা কুৎসিতভাবে বদলে যাবে। আমাদের কারোরই তা কাম্য হওয়া উচিত নয়।
মূল লেখকঃ আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
সূত্রঃ Click This Link
©somewhere in net ltd.