![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
ভূমিকা
বাঙলা কবিতা ভুবনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পরবর্তীকালে—কাজী নজরুল ইসলামের কথা স্মরণে রেখে বলা যায়—সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত নাম জীবনানন্দ দাশ। তিনি রবীন্দ্রোত্তর বাঙলা কবিতার সবচেয়ে পাঠকপ্রিয় কবিও বটে। সাহিত্যসমালোচনায় একটি প্রচলিত ধারণা হলো পাঠকপ্রিয়তা সাহিত্যের উৎকর্ষ বিচারে খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ নয়। এমন ধারণা মেনে নিয়েও বলা যায় সাহিত্যের মূল লক্ষ্য হলো পাঠক, তাই কোনো সাহিত্য পাঠকের নিকট গ্রহণযোগ্য না হলে সাহিত্যস্রষ্টার উদ্দেশ্য ব্যহত হতে বাধ্য। পাঠকপ্রিয়তার অর্থ সাহিত্য তার অভীষ্ট লক্ষ্য অর্থাৎ পাঠকের নিকট পৌঁছাতে সক্ষম হয়েছে। তাই সাহিত্যবিচারে পাঠকপ্রিয়তা একটি গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক হতে পারে। একথা কবিতাসহ সাহিত্যের প্রতিটি শাখা সম্পর্কে সমান সত্য। কবিতা কবির হৃদয়গত ভাবোচ্ছ্বাসের স্বতঃস্ফূর্ত ও শিল্পিত বহিঃপ্রকাশ। এই ভাবোচ্ছ্বাস যখন পাঠক হৃদয়ের ভাবলোকের সঙ্গে মিশে একাকার হয় যায় তখনই একটি কবিতা সার্থক হয়ে ওঠে। কবি ও পাঠকের ভাবলোকের মিলনে যে আনন্দস্ফূলিঙ্গের সৃষ্টি হয় তার মধ্যেই নিহিত থাকে কবিতার প্রকৃত সৌন্দর্য এই সৌন্দর্য সৃষ্টিতে জীবনানন্দ দাশ শতভাগ সফল, এমন মন্তব্য অযৌক্তিক হবে না। তাই মৃত্যুর ছয় দশক পরেও পাঠক-সমালোচক মহলে শ্রদ্ধার সঙ্গে উচ্চারিত নাম জীবনানন্দ দাশ। আজ কারো অজানা নয় তাঁর এই খ্যাতির একটি বড় অংশ এসেছে মৃত্যুর পর। জীবদ্দশায় নিভৃতচারী এই কবির সৃষ্টিকর্মের একটা বড় অংশ ছিল অপ্রকাশিত, কিন্ত যতটুকু সেসময় প্রকাশিত হয়েছে তা বন্ধু মহলে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা লাভ করলেও বন্ধু বলয়ের বাইরে থেকে পেয়েছে তীব্র বিদ্রূপ ও গঞ্জনা। এক্ষেত্রে পুরোভাগে ছিলেন সজনীকান্ত দাস ও তাঁরশনিবারের চিঠি । আমাদেরে বর্তমান আলোচনার উদ্দেশ্যশনিবারের চিঠিতে জীবনানন্দ দাশ প্রসঙ্গ।
প্রেক্ষাপট
উনিশ চব্বিশ খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাসে শনিবারের চিঠি যোগানন্দ দাসের সম্পাদনায় সাপ্তাহিক পত্রিকা হিসেবে যাত্রা শুরু করে এবং উনিশ পঁচিশের ফেব্রুয়ারিতে বন্ধ হয়ে যায়। উনিশ সাতাশ সালের অক্টোবরে তা আবার মাসিক পত্রিকা হিসেবে নতুন উদ্যমে যাত্রা শুরু করে। শনিবারের চিঠির নবপর্যায়ে যোগানন্দ দাস সম্পাদক ও সজনীকান্ত দাস সহকারী সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। চার মাস পর যোগানন্দের স্থলাভিষিক্ত হন নীরোদ চন্দ্র চৌধুরী তাঁর দায়িত্ব গ্রহণের আট মাস পর অর্থাৎ উনিশ আটাশ সালের সেপ্টেম্বর মাসে পত্রিকাটির সম্পাদনা ও প্রকাশনার সার্বিক দায়িত্ব এসে পড়ে সজনীকান্ত দাসের ওপর। এসময় থেকে পত্রিকাটি সজনীকান্তের ব্যক্তিত্বের সমার্থক হয়ে ওঠে। সম্পাদকের সৃষ্টিশীলতা ও কর্মোদ্যোগ শনিবারের চিঠিকে প্রথম সারির বাঙলা পত্রিকার মর্যাদা এনে দেয়।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর গোকুল নাগ সম্পাদিত কল্লোল পত্রিকাকে কেন্দ্র করে বাঙলা সাহিত্যে একটি পালাবদল শুরু হয়। পাশ্চাত্য শিক্ষা ও সাহিত্য প্রভাবিত এই পরিবর্তনের বিষয়টিকে জন্মলগ্ন থেকে শনিবারের চিঠি বাঁকা চোখে দেখে এসেছে। পত্রিকাটি নবপর্যায়ের চতুর্থ সংখ্যা থেকে এধারার সাহিত্যের বিরুদ্ধে প্রচারণার জন্য ‘মণিমুক্তা’ নামে একটি বিভাগ চালু করা হয়। এই বিভাগে সাধারণত অন্য পত্রিকায় প্রকাশিত সাহিত্যের—শনিবারের চিঠির দৃষ্টিতে যা আপত্তিকর বলে বিবেচিত—নির্বাচিত অংশ সরাসরি তুলে ধরা হতো। ‘মণিমুক্তা’র পাশাপাশি ১৯২৮ সাল থেকে ‘সংবাদ সাহিত্য’ নামে আরো একটি বিভাগ চালু করা হয়। শনিবারের চিঠির এই সম্পাদকীয় বিভাগটিতে সম্পাদক সজনীকান্ত দাস আধুনিক সাহিত্যের কঠোর ও সরস সমালোচনা স্থান পেতো। আধুনিক সাহিত্যের প্রতি এই মনোভঙির কল্যাণে শনিবারের চিঠি অতিদ্রুত আধুনিক সাহিত্য বিরোধীদের মুখপত্রে পরিণিত হয়। অশ্লীলতা, পাশ্চাত্য প্রভাব, প্রথাবিরুদ্ধ শব্দ প্রয়োগ প্রভৃতির বিরুদ্ধে সজনীকান্ত দাসের পত্রিকা শেষ দিন পর্যন্ত যুদ্ধ করেছে এবং এক্ষেত্রে যুদ্ধের রীতিনীতিও প্রায়ই লঙ্ঘিত হয়। সজনীকান্তের সেই যুদ্ধ ছিল বিবর্তনের ধর্মের বিরুদ্ধে । কালের পরিক্রমায় জীবন-জগৎ বিবর্তিত হয়, বিবর্তিত হয় মানুষের সমাজ, প্রতিবেশ, জীবনাচরণ ও জীবন সংগ্রাম। সঙ্গত কারণে শিল্প-সাহিত্যেও এসে লাগে সে বিবর্তনের ঢেউ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তীকালে এই পরিবর্তন বিশ্বব্যাপী খুব দ্রুত ছড়িয়ে যায়। বাঙলাদেশে এই ঢেউ আদৌও এসে লেগেছে কিনা? নাকি এদেশের নবাগত কবি-সাহিত্যিকরা সেই পরিবর্তনকে শুধু চমক সৃষ্টির মানসে নিজেদের সাহিত্যেকর্মে আমদানি করেছেন ? তা নিয়ে বহু বিতর্ক হয়েছে, এবিষয়ে নতুন কিছু বলার নেই। তবে একথা নিঃসন্দেহে বলা যায়–দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মনোলোকে পাশ্চাত্য এই পরিবর্তন রেখাপাত না করলেও, তা কবি-সাহিত্যিকদের মনে—কৃত্রিম হলেও —সুগভীর চিহ্ন রেখে যায়। ফলে কবিতার বিষয় ও আঙ্গিকে পরিবর্তন সূচিত হয়।
জীবনানন্দসহ এ-যুগের প্রায় সকল অধুনিক কবি-সাহিত্যিক বিশ্বাস করতেন মানুষ ও তার প্রতিবেশ-পরিমণ্ডল নিয়েই কবিতা, তাই সেই মানুষ ও তার প্রতিবেশে পরিবর্তন আসলে কবিতায় পরিবর্তন আসতে বাধ্য। সজনীকান্ত দাসের আপত্তি এখানেই—তাঁর বিশ্বাস আধুনিক কবি সম্প্রদায় কথিত পরিবর্তন প্রকৃত অর্থে মেকি ও সার্বিকভাবে পাশ্চাত্যের অন্ধ-অক্ষম অনুকরণ, বাস্তবতার সঙ্গে তার কোনো যোগসূত্র নেই। এই অনুকরণ প্রবণতা ছাড়াও অপ্রচলিত উপমা ও তথাকথিত অসাহিত্যিক শব্দ প্রয়োগকে সজনীকান্ত দাস বা তার অনুসারীরা সহজে গ্রহণ করেন নি । তাদের নিকট এধরনের প্রয়োগ ছিল সম্পূর্ণ রূপে উৎকট-কৃত্রিমভাবে স্বাতন্ত্র্য প্রদর্শনের প্রচেষ্টা। আধুনিক সাহিত্যের প্রতি তাদের সবচেয়ে বড় যে-অভিযোগটি তারা উত্থাপন করে তা হলো অশ্লীলতার। এই একটি বিষয়ে শনিবারের চিঠি শিল্প বা শিল্পীর দাবি অনুধাবনে ব্যর্থ হলেও সাধারণের দাবির সমান্তরালে উপস্থিত হতে পেরেছিল। অশ্লীলতা, পাশ্চাত্যের অন্ধ অনুকরণ ও ঐতিহ্যগত কাব্যিক শব্দের প্রতি বিমুখতা এই তিন বৈশিষ্ট্যের কারণে আধুনিক সাহিত্যকে শনিমণ্ডল ‘অতিআধুনিক’ সাহিত্য হিসেবে চিহ্নিত করেন। এই অভিধাটি শনিমণ্ডল ব্যবহার করতেন মূলত ব্যঙ্গার্থে।
সজনীকান্ত দাস ও তাঁর পত্রিকা আধুনিকদের এই চিরন্ত ভাঙ্গার প্রবণতার বিরোধিতা করেছেন তীব্রভাবে। শনিবারের চিঠির এই দৃষ্টিভঙি কালের স্রোতে আজ অসাড় বস্তুতে পরিণত হয়েছে। সমকালেও যে তা সর্বজনগ্রাহ্য ছিল এমন নয়, বরং নিজ গোষ্ঠীর বাইরে সেই দৃষ্টিভঙির প্রভাব ছিল অত্যন্ত ক্ষীণ। বিস্তর লেখালেখির পরেও আধুনিক সাহিত্য সম্বন্ধে সাধারণ পাঠকের মনে বিরূপ ভাবের সৃষ্টি না হওয়ায় সজনীকান্ত যথেষ্ট হতাশ ছিলেন। এ-সম্পর্কে ১৩৪৫ সালের ফাল্গুন মাসে প্রকাশিত শনিবারের চিঠির ‘সংবাদ সাহিত্য’ কলামে লিখেছেন:
মনে হইতেছে, বাংলা দেশের এক শ্রেণীর পাঠক নিশ্চয়ই “সজ্ঞানে” নাই-এই সব লেখা যখন রচিত ও মুদ্রিত হইতেছে, ইহার পাঠকও নিশ্চয়ই আছে এবং তাঁহারা এই ‘হ য ব র ল’র মধ্যে একটা অর্থ নিশ্চয়ই খুঁজিয়া পাইতেছেন। আমরা বৃথাই বকিয়া মরিতেছি।
হতাশ হলেও তিনি নিজ অবস্থান পরিবর্তন বা আধুনিক সাহিত্য নিয়ে ‘‘ঘাঁটাঘাঁটি’’ বন্ধ করেননি। যদিও তিনি উদ্ধৃত কলামেই এমন প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। সজনীকান্তের এই হতাশাপূর্ণ মনোভাব থেকে আরো একটি বিষয় পরিষ্কার হয়— আধুনিক সাহিত্য সে-সময় তার নিজ বৈশিষ্ট্য সমুন্নত রেখে পাঠকের সংখ্যা ক্রমশ বৃদ্ধি করে যাচ্ছিল। সাহিত্যের এই নতুন-পুরাতনের দ্বন্দ্ব শেষ পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আদালত গিয়ে গড়ায়, কিন্তু সেখানেও কোনো মীমাংসা সম্ভব হয়নি। জীবনানন্দ দাশ তাঁর কাব্য জীবন শুরু করেছেন কাজী নজরুল ইসলামকে আদর্শ করে। কাজী নজরুল ইসলাম, সত্যেনন্দ্রনাথ দত্ত ও মোহিতলাল মজুমদারদের হাতে বাঙলা কবিতার জগতে রবীন্দ্রপ্রভাব মুক্ত একটি নতুন ধারার সূত্রপাত হয়। এই নতুন ধারার পথিকৃৎ কবিদের গুরুপদে বরণ প্রমাণ করে জীবনানন্দ কবিজীবনের একেবারে শুরু থেকেই নতুন কাব্যভাষা অনুসন্ধান করেছেন । এই নতুন পথ অন্বেষণের প্রচেষ্টা তাঁর কবিতার ভাব-ভাষা-ছন্দ-উপমা-চিত্রকল্পে নিয়ে আসে এক অভূতপূর্ব নতুনত্ব। যার সুর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বা বুদ্ধদেব বসুর মতো অন্তর্দৃষ্টি সম্পন্ন কাব্যরসিক ছাড়া সাধারণ পাঠকের নিকট বৈসাদৃশ্যপূর্ণ মনে হয়। এদলের পুরোধা ছিলেন শনিবারের চিঠির সজনীকান্ত দাস। জীবনানন্দ প্রযুক্ত নতুন কাব্যভাষাকে তিনি গণ্য করেছেন প্রথাগত বাঙলা কাব্য ধারার বিকৃতি হিসেবে এবং স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে আক্রমণ করেছেন।
পর্ব-১ সমাপ্ত
২| ২৫ শে নভেম্বর, ২০১৯ রাত ৯:০১
কৌটিল্যা বলেছেন: ধন্যবাদ। পরবর্তী পর্বে হয়তো কিছু পেতে পারেন। কাব্য বিশ্লেষণের সময়।
©somewhere in net ltd.
১|
২৫ শে নভেম্বর, ২০১৯ বিকাল ৫:৫৮
রাজীব নুর বলেছেন: পোষ্টে নতুন কিছু নেই।