![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
ছড়ার বই ঢামেরিক - একটি প্রাসঙ্গিক আলোচনা [ছড়ার ভাঁজপত্র তোতাপাখির বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত আমার একটি বই আলোচনা।]
ঢামেরিক বাংলা ভাষার ছড়া সাহিত্যে একটি নতুন সংযোজন। ঢামেরিক রচয়িতা রফিকুল হক শুধু শিশু সাহিত্যিক নন, শিশু সংগঠক হিসেবেও সম্যক খ্যাতিমান। এখানেই তাঁর পরিচিতি দাদুভাই হিসেবে। তিনি শিশু কিশোর সংগঠন ‘চাঁদের হাট’ এর প্রতিষ্ঠাতা। দেশের সাহিত্য, শিল্প ও সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে সফল মানুষ গড়ার কারিগর হিসেবে তাঁর অবস্থান মহীরুহের মত। ্ঢামেরিক এ লিমেরিক সংখ্যা ৪০টি। নিয়াজ চৌধুরী তুলি তাঁর নিপুন হাতে গড়েছেন প্রচ্ছদ। লিমেরিকের অর্থের সাথে মিল রেখে করেছেন অসাধারণ কিছু কারুকাজ যা বইটির সৌন্দর্যকে বাড়িয়েছে শতগুণ। যা পাঠক মাত্রই আকর্ষণ করবে।
ছড়াকার ঢাকার ঐতিহ্যবাহী গোঁফকে নিয়ে লিখেছেন ‘ঢাকাইয়া’ শিরোনামের প্রথম লিমেরিকটি । যা পুরান ঢাকার ঐতিহ্যকেই উপস্থাপন করে। যেমন- ‘খানদানি গোঁফ পাকাইয়া/ বলেন, আমি ঢাকাইয়া!/প্রাণের নহর/আমার শহর/সবাই দেখেন তাকাইয়া।’ অসাধারণ শব্দচয়ন ও ছন্দে এটি একটি সার্থক লিমেরিক হিসেবেই সামাদৃত। দ্বিতীয় ছড়াটিতে উত্তাল ছন্দে লেখক বিশাল ঢাকা শহরকে অথই সাগরের সাথে তুলনা করেছেন এভাবে- ‘নগর তো নয় অথই সাগর খুঁজে তো কেউ পায় না কুল।’ ‘মসজিদ নগরী’ শিরোনামের ছড়াটিতে ছড়াকার ঢাকার মসজিদের শহর বৈশিষ্ট্য নিয়ে লিখেছেন- ‘মসজিদ নগরীর কত বড় শান/পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের মধুর আযান।’ ‘বাহান্ন বাজার তিপ্পান্ন গলি/ হেঁটে ক্ষয় হয়ে যায় পাদুকার তলি’- কি কঠিন সত্যই না এই বয়ান! এখানেই রফিকুল হক দাদুভাইয়ের ছড়া সার্থক। যা পাঠকের মনকে পুলুকিত করে। ‘মামুর বাড়ি’, ‘দেখেছি ঢাকায়’, ‘ঢাকায় চক্কর’, এই ছড়াগুলো পাঠকের চাহিদা চিন্তা করে লিখা। এখানে পাঠককে প্রাঞ্জল ভাষায় লেখক পুরান ঢাকার দৈনন্দিন জীবন আচারকেই স্মরণ করিয়ে দেন।
‘টাকা হলেই’ ছড়াটিতে টাকার মাহাত্ম্য তুলে ধরেছেন -‘পয়সা হলে এই ঢাকাতে বাঘের চোখও পাবে/ হোটেল কিংবা রেস্তোঁরাতে ইচ্ছে মত খাবে/সুখের নিবাস বসন ভূষণ/আরাম আয়েশ নরম কুশন/টাকা হলেই মিলবে সবই যখন যেটা চাবে।’ অসাধারণ এক সত্যকে ছড়াকার এখানে দীর্ঘ অভিজ্ঞতার আলোকে শৈল্পিক হাতে বেধেঁছেন যা তাঁর পরিপক্কতাই প্রমাণ করে।
‘ছেকড়া গাড়ি’ ছড়ায় ছড়াকার পুরাণ ঢাকার নবাব পরিবারের কথা তুলে এনেছেন। এছাড়াও তাঁর ছড়ায় এসেছে পুরান ঢাকার সুপরিচিত খাদ্য বাকরখানির কথা। যা আমাদেরকেও পুরনো দিনে ফিরিয়ে নিয়ে যায়। যেমন- ‘খাস্তা খাবার বাকরখানি ফেমাস ছিল ঢাকার/ যেমন মজার স্বাদ ছিল তার তেমনি ছিল আকার।’ ‘নবাবী শান’ ছড়ায় লেখক ঢাকাবাসীর প্রিয় ঠুমরি গজল গানের কথা তুলে এনেছেন। সময়ের চাকা ছড়ায় রেসকোর্স ময়দানের কথাও উঠে এসেছে। যা পাঠককে ঢাকার পুরোনো ইতিহাসকে মনে করিয়ে দেয়। কালের সাক্ষী বুড়িগঙ্গা নদীকেও লেখক তার ছড়ার বিষয় করেছেন এভাবে - ‘বুড়িয়ে গেছে বুড়িগঙ্গা বাড়ছে বহর ঢাকার/চলছে নদীর বাটোয়ারা খেলটা অঢেল টাকার।’ বর্তমান সময়ে এই ছড়াটি কত প্রাসঙ্গিক তা সচেতন ব্যক্তি মাত্রই বুঝতে পারবেন।
বিশাল ঢাকার অভিশাপ যানজট কে চিহ্নিত করে লিখেছেন - ‘দালান কোঠার মস্ত নগর ঢাকা / যানজটে জান ওষ্ঠাগত বন্ধ গাড়ির চাকা।’ বিষয়ের বৈচিত্র তাঁর লিমেরিকগুলোকে প্রাণবন্ত করেছে। ‘ভুতের শহর,’ ‘সেলাম তোমায়,’ ‘মশার শহর,’ ‘লোডশেডিং’, ‘কারবালা,’ ‘বৃষ্টি হলেই,’ ‘হরতাল’ এই ছড়া গুলোতে লেখক ঢাকা শহরের নানান সমস্যাগুলোকে তুলে ধরে সমাজ সচেতনতার পরিচয় দিয়েছেন তেমনি একইসাথে দায়িত্বশীলতার পরিচয়ও দিয়েছেন। এছাড়া ‘ঈদের বাজার,’ ‘অন্য ছবি’ ছড়ায় ঢাকাবাসীর ঈদের চিত্র ফুটে উঠেছে।
‘টাটকা খবর’, ‘ফেনসিডিলের ফেন্সি,’ ‘পলিটিক্যাল কানেকশন,’ ‘হ্যাঁচকা টানে,’ ‘দিন দুপুরে,’ ‘হচ্ছেটা কি,’ ‘পীরের মাজার,’ ‘খুনখারাবি,’ ‘নিত্য খবর,’ ‘সওয়াল’ ও ‘নেই ভরসা’ ছড়ায় মুলত ঢাকার সন্ত্রাসী কর্মকা-ের উল্লেখ করেছেন। যা সারাদেশের বর্তমান অবস্থাকে তুলে ধরে। একজন লেখক একজন ভবিষৎ দ্রষ্টাও বটে, দাদুভাইয়ের এই ছড়াগুলোই তার উত্তম দৃষ্টান্ত। যেমন- ‘ঢাকায় এখন মাথার ওপর আকাশ ভেঙে পড়ে/ এক পলকের নেই ভরসা কখন মানুষ মরে।’ এই ছড়া গুলোতে লেখক তাঁর অসাধারণ সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টির কাজ করেছেন। যা প্রতিটি মানুষকে যেমনি বিষাদের কথা স্মরণ করিয়ে দেয় তেমনি সচেতনতাও সৃষ্টি করে। ‘ডেঙ্গু জর,’ ‘রাতের রানি,’ ‘গভীর রাতে,’ ‘বন্দিশালা,’ ‘ভুলের আস্তাকুঁড়ে’ ও ‘ঢাকাবাসী’ ছড়াগুলোতে অন্য এক চিত্র উঠে এসেছে। এখানে ছড়াকার সমাজকর্মীর ভূমিকায় উত্তীর্ন হয়েছেন।
রফিকুল হক দাদুভাই ছড়া বানান; ছড়া বানান হৃদয় দিয়ে। ছড়া লেখেন ছড়া কেটে। শব্দ, ছন্দ, বিষয়বস্তু ও আঙ্গিকের বৈচিত্র এবং আন্তরিকতার ক্ষেত্রে তাঁর তুলনা তিনি নিজেই। বাংলাদেশের সমকালীন সমাজচিত্র নিয়ে ছড়া লিখে যাঁরা কৃতিত্বের অধিকারি রফিকুল হক দাদুভাইয়ের অবস্থান তাঁদের মধ্যে অন্যতম।
ঢামেরিক ব্যতিক্রমধর্মী এক অসাধারণ সৃষ্টি হিসেবে পাঠক মহলে নন্দিত হয়েছে, এ আমরা দ্বিধাহীনভাবে বলতে পারি। গ্রন্থে সংকলিত ঢামেরিক বলে আখ্যায়িত তাঁর চমকপ্রদ লিমেরিকগুলোতে ঐতিহাসিক ঢাকা নগরীর অতীত, বর্তমান, ইতিহাস, ঐতিহ্য, দৈনন্দিন জীবনের সমস্যা ও সংকট ঢাকাবাসীর আনন্দ-বেদনা নিখুঁতভাবে চিত্রিত হয়েছে। এক কথায় বলতে গেলে, ঢামেরিক বাংলাদেশের রাজধানী আমাদের ‘প্রাণের নহর’ ঢাকা নগরীর একটি পরিপূর্ণ চালচিত্র।
অসাধারণ এক ছড়াকারের নাম রফিকুল হক দাদুভাই। তাঁর প্রতিটি কাজ যত্ন নিয়ে তিনি করে থাকেন; ‘ঢামেরিক’ গ্রন্থই তাঁর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তবে কিছু ছড়ায় বারবার একই অন্ত্যমিল না আসলে হয়তো পাঠকের মন আরো বৈচিত্রের স্বাদ পেতো বৈকি! যেমন- রাতের রানি, গভীর রাতে, ভুলের আস্তাকুঁড়ে সহ আরো কতগুলো ছড়ায় এমনটি লক্ষ্য করা যায়। অন্ত্যমিলের এসব টুকটাক সমস্যা থাকার পরেও ছড়াকারের নিষ্ঠার পরিচয় পাওয়া যায় তার ছড়ার বিষয় বিশ্লেষণে। এখানেই তিনি পার পেয়ে যান সবার থেকে। সর্বোপরি আমরা এই আপাদমস্তক ছড়াকারের দীর্ঘায়ু কামনা করছি।
©somewhere in net ltd.