নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

উড়ো মনের খেরোখাতা

মাসুম মুনাওয়ার

কবি ছড়াকার সম্পাদক চিরকুট (দ্রোহ ও ভালোবাসার পত্র)

মাসুম মুনাওয়ার › বিস্তারিত পোস্টঃ

শহীদ কাদরীর কবিতা একটি পাঠ প্রতিক্রিয়া # মাসুম মুনাওয়ার

২০ শে জুন, ২০১৫ রাত ১:২২

গত তিন দিনে তিনটি বই পড়লাম। বা কথাটা এভাবে বলা যায়- গত তিন দিনে শহীদ কাদরীর তিনটি কবিতার বই পড়লাম। উত্তরাধিকার, তোমাকে অভিবাদন প্রিয়তমা ও কোথাও কোন ক্রন্দন নেই। প্রকাশকাল যথাক্রমে ১৯৬৭, ১৯৭৪ ও ১৯৭৮।
প্রকাশক মফিদুল হক সাহিত্য প্রকাশ থেকে ‘শহীদ কাদরীর কবিতা’ নামে তিনটি বই এক সাথে ১৯৯৩ সালে প্রথম প্রকাশ করেন। আমি ২০০৭ সালে প্রকাশিত বইটির তৃতীয় মুদ্রন পড়েছি। প্রকাশক মফিদুল হকের ১৯৯২ সালে লেখা প্রকাশকের নিবেদনের তথ্য মতে শহীদ কাদরীর তখন পর্যন্ত কবিতার বই এই তিনটিই। এরপর কোন কবিতার বা অন্য কোন বই বের হয়েছে কিনা আমি জানি না ( এটা আমার সীমাবদ্ধতা।)

[শহীদ কাদরী সেই বিরলপ্রজ কবি, যিনি দীর্ঘকাল যাবৎ স্বদেশ থেকে দূরে মার্কিন মুলুকে স্বেচ্ছা-নির্বাসনে রয়েছেন। এ যাবৎ তাঁর প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ সবেমাত্র তিনটি। এগুলো হলো- উত্তরাধিকার (১৯৬৭), তোমাকে অভিবাদন প্রিয়তমা (১৯৭৪) এবং কোথাও কোনো ক্রন্দন নেই (১৯৭৮)।
এ তিনটি কাব্যগ্রন্থের বাইরে তাঁর আর কোনো গ্রন্থের সন্ধান এখন পর্যন্ত আমরা পাইনি। দীর্ঘ দীর্ঘদিন যাবত তাঁর কোনো নতুন কবিতাও চোখে পড়েনি। হয়তো তিনি লেখালেখি ছেড়েই দিয়েছেন, নয়তো প্রকাশ করছেন না। কিন্তু তিনটি কাব্যগ্রন্থের মাধ্যমে তিনি যে আধুনিক মনন, বিশিষ্ট শিল্পবোধ এবং কাব্যভঙ্গির প্রকাশে যে গভীর জীবনবোধ, অন্তর্গত বিষাদ ও বৈরাগ্যের যোগ ঘটিয়েছেন তা অবশ্যই তাঁকে বাংলা কবিতার ময়দানে বিশেষভাবে চিহ্নিত করে।

অসাধারণ প্রতিভার অধিকারি এই কবি অনায়াসে নিত্য প্রয়োজনীয় সহজবোধ্য শব্দ দিয়ে তাঁর কবিতার সাজ শিল্প তৈরি করেছেন বা সাত রঙে কবিতাকে গড়েছেন। সাবলিল ভাষা, আমার মত তৃতীয় শ্রেণীর পাঠককেও মুগ্ধ করেছে। টুকটাক কবিতা লেখার কারণে বা সাহিত্যের প্রতি একটা আগ্রহ থাকার কারণে আমার কিছু সাহিত্যিক বন্ধু রয়েছে। সাহিত্য বন্ধুদের মুখ থেকে প্রায়ই শুনি – কবিতা আসলে বোঝার কিছু নেই ইহা উপলব্ধি করার বিষয়। আমি আসলে কবিতা বুঝতে চেষ্টা করি কিনা জানি না তবে একটা পরম তৃপ্তি খুঁজি। যেখানে আমার কোমল কবি মন কবিতা পড়ে একটু অশান্ত মনকে শান্ত করতে চায় বা অতৃপ্ত মনকে তৃপ্ত করতে চায়। যা আমার কবিতা অনুভূতিকে জাগিয়ে তুলবে। যার প্রেরণায় আমি চালিত হবো, যেখান থেকে আমি শক্তি সঞ্চয় করবো।

কবি শহীদ কাদরীর কবিতা পড়ে তাই আমার যে অনুভূতি হল- তা হল সুখের, আনন্দের এবং একসাথে প্রশান্তির। (তবে সব সময় যে এমন হয়েছে তাও পুরোপরি ঠিক নয়। কবিতা বা পাঠক ভেদে তা আলাদা হবে এটাই স্বাভাবিক।) কবি শহীদ কাদরী যতটুকু জানি স্বেচ্ছায় নির্বাসনে। কিন্তু কেন কবির এই অভিমান কবিতা গুলো পড়ার পর তা জানার আগ্রহ বেড়ে গেলো!

কবি শহীদ কাদরীর শব্দ ব্যবহারে এতো সচেতন যে তা সকল শ্রেণীর পাঠককের বোধগম্য বা নাগালের মধ্যে। এই কবি তার নিপুন হাতের দক্ষতায় এক একটি শব্দকে একজন দক্ষ শিল্পীর মত সুচিন্তিতভাবে সাজিয়েছেন। ফলে দেখা যায় একেকটা কবিতা একেক ধরনের দ্যোত্বনা তৈরি করেছে। আর একেকটা কবিতা তৈরি করেছে একেকটা কালোতীর্ন সুস্বজ্জিত ভাস্কর্য বা সৌধ। যার কাছে মানুষ আসবে প্রতিনিয়ত। কখনো বিষাদ বা তিক্ত হবে না বরং বারবার তার কাছে নতুন কিছু শক্তি পাবার প্রেরণা নিয়ে আসবে।

কয়েকটি প্রিয় কবিতা

তোমাকে অভিবাদন প্রিয়তমা

ভয় নেই
আমি এমন ব্যবস্থা করবো যাতে সেনাবাহিনী
গোলাপের গুচ্ছ কাঁধে নিয়ে
মার্চপাস্ট করে চলে যাবে
এবং স্যালুট করবে
কেবল তোমাকে প্রিয়তমা।

ভয় নেই, আমি এমন ব্যবস্থা করবো
বন-বাদাড় ডিঙ্গিয়ে
কাঁটা-তার, ব্যারিকেড পার হয়ে, অনেক রণাঙ্গনের স্মৃতি নিয়ে
আর্মার্ড-কারগুলো এসে দাঁড়াবে
ভায়োলিন বোঝাই করে
কেবল তোমার দোরগোড়ায় প্রিয়তমা।

ভয় নেই, আমি এমন ব্যবস্থা করবো-
বি-৫২ আর মিগ-২১গুলো
মাথার ওপর গোঁ-গোঁ করবে
ভয় নেই, আমি এমন ব্যবস্থা করবো
চকোলেট, টফি আর লজেন্সগুলো
প্যারাট্রুপারদের মতো ঝরে পড়বে
কেবল তোমার উঠোনে প্রিয়তমা।

ভয় নেই…আমি এমন ব্যবস্থা করবো
একজন কবি কমান্ড করবেন বঙ্গোপসাগরের সবগুলো রণতরী
এবং আসন্ন নির্বাচনে সমরমন্ত্রীর সঙ্গে প্রতিযোগিতায়
সবগুলো গণভোট পাবেন একজন প্রেমিক, প্রিয়তমা!

সংঘর্ষের সব সম্ভাবনা, ঠিক জেনো, শেষ হবে যাবে-
আমি এমন ব্যবস্থা করবো, একজন গায়ক
অনায়াসে বিরোধীদলের অধিনায়ক হয়ে যাবেন
সীমান্তের ট্রেঞ্চগুলোয় পাহারা দেবে সারাটা বৎসর
লাল নীল সোনালি মাছি-
ভালোবাসার চোরাচালান ছাড়া সবকিছু নিষিদ্ধ হয়ে যাবে, প্রিয়তমা।

ভয় নেই আমি এমন ব্যবস্থা করবো মুদ্রাস্ফীতি কমে গিয়ে বেড়ে যাবে
শিল্পোত্তীর্ণ কবিতার সংখ্যা প্রতিদিন
আমি এমন ব্যবস্থা করবো গণরোষের বদলে
গণচুম্বনের ভয়ে
হন্তারকের হাত থেকে পড়ে যাবে ছুরি, প্রিয়তমা।

ভয় নেই,
আমি এমন ব্যবস্থা করবো
শীতের পার্কের ওপর বসন্তের সংগোপন আক্রমণের মতো
অ্যাকর্ডিয়ান বাজাতে-বাজাতে বিপ্লবীরা দাঁড়াবে শহরে,

ভয় নেই, আমি এমন ব্যবস্থা করবো
স্টেটব্যাংকে গিয়ে
গোলাপ কিম্বা চন্দ্রমল্লিকা ভাঙালে অন্তত চার লক্ষ টাকা পাওয়া যাবে
একটি বেলফুল দিলে চারটি কার্ডিগান।
ভয় নেই, ভয় নেই
ভয় নেই,
আমি এমন ব্যবস্থা করবো
নৌ, বিমান আর পদাতিক বাহিনী
কেবল তোমাকেই চতুর্দিক থেকে ঘিরে-ঘিরে
নিশিদিন অভিবাদন করবে, প্রিয়তমা।

কোনো ক্রন্দন তৈরি হয় না

একটি মাছের অবসান ঘটে চিকন বটিতে,
রাত্রির উঠোনে তার আঁশ জ্যোৎস্নার মতো
হেলায়-ফেলায় পড়ে থাকে
কোথাও কোনো ক্রন্দন তৈরি হয় না,
কোথাও কোনো ক্রন্দন তৈরি হয় না;

কবরের রন্ধ্রে-রন্ধ্রে প্রবেশ করে প্রথম বসন্তের হাওয়া,
মৃতের চোখের কোটরের মধ্যে লাল ঠোঁট নিঃশব্দে ডুবিয়ে বসে আছে
একটা সবুজ টিয়ে,
ফুটপাতে শুয়ে থাকা ন্যাংটো ভিখিরির নাভিমূলে
হীরার কৌটোর মতো টলটল করছে শিশির
এবং পাখির প্রস্রাব;
সরল গ্রাম্যজন খরগোশ শিকার করে নিপুণ ফিরে আসে
পত্নীর ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে, চুল্লির লাল তাপে
একটি নরম শিশু খরগোশের মাংস দেখে আহ্লাদে লাফায়
সব রাঙা ঘাস স্মৃতির বাইরে পড়ে থাকে
বৃষ্টি ফিরিয়ে আনে তার
প্রথম সহজ রঙ হেলায়-ফেলায়

কোথাও কোনো ক্রন্দন তৈরি হয় না,
কোথাও কোনো ক্রন্দন তৈরি হয় না ।

টাকাগুলো কবে পাবো

টাকাগুলো কবে পাবো? সামনের শীতে?
আসন্ন গ্রীস্মে নয়?
তবে আর কবে! বৈশাখের ঝড়ের মতো
বিরূপ বাতাসে ঝরে পড়ছে অঝোরে
মণি মাণিক্যের মতো মূল্যবান চুলগুলো আমার এদিকে-
ওদিকে! এখনই মনি-অর্ডার না যদি পাঠাও হে সময়,
হে কাল, হে শিল্প,

তবে
কবে? আর কবে?
যখন পড়বে দাঁত, নড়বে দেহের ভিৎ ?
দ্যাখো দ্যাখো, মেঘের তালি-মারা নীল শার্ট প’রে
ফ্রিজিডেয়ার অথবা কোনো রেকর্ড প্লেয়ার ছাড়া
খামোকা হুল্লোড় করতে করতে যারা পৌঁছে যায়
দারুণ কার্পেটহীনভাবে কবিতার সোনালি তোরণে
সেই সব হা-ঘরে, উপোসী ও উল্লুকদের ভীড়ে
মিশে গিয়ে
আমিও হাসছি খুব বিশ্ববিজয়ীর মতো মুখ করে।
আমাকে দেখলে মনে হবে-
গোপন আয়ের ব্যবস্থা ঠিকই আছে।
-আছেই তো। অস্বীকার কখনো করেছি আমি
হে কাল, হে শিল্প?
ওরা জানে না এবং কোনোদিন জানবে না-
পার্কের নি:সঙ্গ বেঞ্চ,
রাতের টেবিল আর রজনীগন্ধার মতো কিছু শুভ্র সিগারেট ছাড়া
কেউ কোনোদিন জানবে না- ব্যক্তিগত ব্যাঙ্ক এক
আমারও রয়েছে! ‘রবীন্দ্র রচনাবলী’ নামক বিশাল
বাণিজ্যালয়ের সাথে যোগাযোগ আমিও রেখেছি।
তাছাড়া জীবনান্দ দাশ এবং সুধীন্দ্রনাথসহ
ওসামু দাজাই
আমাকে টাকা পয়সা নিয়মিতভাবে এখনও পাঠান
বলতে পারো এ ব্যবসা বিশ্বব্যাপী-
একবার শার্ল বোদলেয়ার প্রেরিত এক পিপে সুরা আমি
পেয়েছিলাম কৈশরে পা রেখে,
রিল্কে পাঠিয়েছিলেন কিছু শিল্পিত গোলাপ
(একজন প্রেমিকের কাছে আমি বিক্রি করেছি নির্ভয়ে)
এজরা পাউন্ড দিয়েছিলেন অনেক ডলার
রাশি রাশি থলে ভরা অসংখ্য ডলার
(ডলার দিয়ে কিনেছি রাতের আকাশ)
এবং একটি গ্রীক মুদ্রা
(সে গ্রীক মুদ্রাটি সেই রাতের আকাশে নিয়মিত জ্বলজ্বল করে)
অতএব কপর্দক-শূন্য আমি,কোনো পুণ্য নেই
আমার বিব্রত অস্তিত্বের কাছে
কেউ নয় ঋণী- এমন দারুণ কথা
কি করে যে বলি! যেদিকে তাকাই
পার্কে, পেভমেন্টে, আঁধারে, রাস্তায়
রেস্তোরায়ঁ, ছড়ানো ছিটানো
প্রজ্জ্বোল কবিতাগুলো চতুর্দিক থেকে উঠে এসে
দুটো নিরপরাধ নরম বই হয়ে ইতিমধ্যে
তোমাদের নোংরা অঙ্গুলির নীচে চলে গেলো,
এই কি যথেষ্ট নয়? এতেই কি লক্ষ লক্ষ টাকা
লেখা হলো না আমার নামে, পাওনা হলো না?
হে সময়, হে কাল, হে শিল্প. হে বান্ধববৃন্দ,
টাকাগুলো কবে পাবো, কবে, কবে, কবে?

[২০.৬.১৫]

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.