![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
দু,টি নদীর মিলন স্থল। বন্ধনে বেধে রাখতে পছন্দ করি। আর কিছু বলার নেই আমার।
'' এই বৃষ্টিতে মনে হইতাছে ছাতাটা আর ঠিকব না।" কেমন অনুযোগ মাখা শব্দ উৎচারিত হয় রহমান মিয়ার মুখে। স্ত্রীর হাত থেকে নেয়া ছাতাটার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন তিনি। বেশ কয়েকটা সিক ভেঙে গেছে ছাতাটার। এখন আর আগের মত প্রসারিত হয় না। বৃষ্টির হাত থেকে আর আগের মত আগলে রাখে না। মেলে ধরলে অনেকটা কুচকে যায়, ঠিক আশি পেরিয়ে উঠা বুড়োদের মত। তার বয়সটাও কুচকে যাওয়া বুড়োদের মতই। আশি না হলেও কুচকে যাওয়া কালো চামড়া আর যৌবনে ভারি ভারি ওজনের মাল টানার কারনে আজ অনেকটা বেকে গেছেন তিনি। আগের মত আর সোজা হয়ে হাটতে পারেন না। দু'হাটুতে বর দিয়ে হাটতে হয়। মাঝে মাঝে লাটির সাহায্যের প্রয়োজন পড়ে। বেকে বেকে চলাতে আজকাল কোমরটা খুব ব্যাথা হয়ে থাকে। মাটিতে পা ফেলতে ইচ্ছে হয় না। যৌবনে কত মাইলের পর মাইল হেটে বেড়িয়েছেন। বয়স হয়েছে এখন। ধীরে ধীরে সব কিছু যেন থেমে যাচ্ছে। পৃথিবীর সব কিছুই যেন তাকে ফেলে রেখে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। স্বপ্ন দেখেছিলেন একদিন হয়তো আরাম কেদারায় বসে জিবনের বাকিটা সময় কাটিয়ে দেবেন। স্বপ্ন গুলো তার স্বপ্ন রয়ে গেল। আরাম কেদারায় বসে থাকার সৌভাগ্য আর হয় না। জিবিকার সন্ধানে বের হতে হয়। চৈত্রের প্রখর রৌদ্র হউক বা আষাঢ়ের বাধ ভাঙা বৃষ্টি হউক, কাধে জোড়াতালি দেয়া জালটা ফেলে তাকে রওয়ানা হতে হয় হাওড়া নদীর পানে।
তার বাড়ি থেকে হাওড়া নদীর দুরত্ব প্রায় আট কিলো। এত টুকু পথ হেটেই পাড়ি দেন। হাটতে হাটতে যখন পায়ে ব্যাথা ধরে যায় তখন হয়তো কোনো এক গাছ তলায় বিশ্রাম নেন। বিরতি নিয়ে নিয়ে নিত্য দিনের যাওয়া আসা। খুব ভোরে রওয়ানা হতে হয় তাকে। যত দ্রুত সম্ভব না পৌছালে ভাল ভাল যায়গা গুলো হাত ছাড়া হয়ে যায় অন্য মাঝিদে দখলে। বাধ্য হয়ে সেদিন হয়তো অল্প বা শুন্য হাতে ফিরতে হয়। নদীতে আজকাল আর আগের মত মাছ পাওয়া যায় না। যা পান তাতে দু'জনের সংসারটায় টানা-হেছড়া করেই চলে। বাজারে মাছের দাম ছড়া। কিন্তু জলের বাস করা মাছের সংখ্যাটা আজকাল কমে গেছে অনেকটা। ভিক্ষে দেয়ার মত তার জালে মাছ দিয়ে যান জলের দেবতা। একসময় ছিল যখন মাছের অভাব হত না। প্রচুর মাছ ঢেলে দিয়ে যেত জলের দেবতা। তখন অভাব আসত না এই সংসারে। কিন্তু রহমান মিয়ার জীবন পালটে গেছে। বয়সের সাথে প্রকৃতির নিষ্টুরতা বেড়ে গেছে। জলের দেবতার আর আগের মত মাছ দিয়ে যায় না। তার দানের পরিমান কমে গেছে। পৃথিবীতে মানুষের সংখ্যা বেড়ে গেছে। জলের দেবতার দানের পরিমাণ কমে এসেছে।
"পিয়াইজ আর লবন নিয়া আইয়েন। চাইলে আইজকার দিনটাই যাইব", জোলেখা নিত্য দিন বাজার করার ব্যাগটা হাতে নিয়ে গড় গড় করে বলে যেতে লাগল বাজারে ফর্দ গুলো। " কেরোসিন নাই, না নিয়া আইলে আইজকা অন্ধকারেই কাটাইতে হইব।" স্ত্রীর দিকে দৃষ্টি ফেরান তিনি। জোলেখার কথা গুলো স্রেফ উৎপাতের মতই তার কানে এসে শোনায়। বাইরে বের হওয়ার সাথে সাথে এটা নেই ওটা নেই বলে বিশাল ফর্দ কানে ঢোকিয়ে দেয়া জোলেখার নিত্য দিনের অভ্যাস। কোথা থেকে আসবে সেগুলো সেদিক নিয়ে মাথা ব্যাথা নাই তার। একটু ভুরু কুচকে উঠে রহমান মিয়ার। বেশ কয়েকদিন ধরে লক্ষ করছেন তার রুগা স্ত্রীটা বেশ স্ব্যাস্তবতী হয়ে গেছে। গালের কুচকানো চামড়া গুলো ফুলে ফেফে অনেকটা ঝুলে পড়েছে। মনে হচ্ছে বৃদ্ব বুড়িটা কেমন যেন যৌবনের দিকে যাত্রা করছে। কত হবে জোলেখার বয়স? চিন্তার বাজ পড়ে তার কপালে। যখন বিয়ে করেছিলেন তখন জোলেখার ছিল তার পাচ বছরের ছোট। আজ তিনি আটাত্তরে এসে পড়েছেন, জোলেখাও সত্তর পাড়ি দিয়ে ফেলেছে। কিন্তু অভ্যাসটা আজো রয়ে গেছে। বাজারের সব ফর্দ গুলো কখনো আসবেনা জেনেও বলে যায় সে। সে জানে, মাছ যা পাওয়া যায় তা দিয়ে ঘরের চাল আনতে চলে যায় পুরোটা। আর অন্য কিছু নিয়ে আসা দুরের কথা।
গত দু'দিন ধরে কোমরের ব্যাথাটা খুব বেড়ে গেছে। হাটতে গেলে কেমন যেন। চাবুকের মত আঘাত করে উঠে। একটা টুল টেনে বসে পড়েন তিনি। শরীরের যা অবস্থা আজকে বের হতে পারবেন বলে মনে হচ্ছে না। পায়ের ক্ষতটা খুব বেড়ে গেছে। দিনে দিনে শরীর কেমন নিস্তেজ হয়ে আসছে। সময় ফুড়িয়ে আসছে অতচ আজরাইল আসার এখনো কোনো খবর নেই। একটা আক্ষেপের নিঃশ্বাষ ফেলেন তিনি। প্রকৃতি বড়ই নিষ্টুর, দুর্বল লোকদের সাথে তার নিষ্টুরতার পরিমাণ বেশিই হয়।
"যাইবা না আইজকা?", তিক্ত শোনায় জোলেখার কন্ঠ। মেজাজ তিক্ত হয়ে উঠে রহমান মিয়ার। স্ত্রীর কতা-বার্তা আজকাল তার কাছে অসহ্য লাগে। ভাবেন, উত্তরে কঠিন করে জবাব দিবেন। নিজেকে সামলে নেন তিনি। শান্ত ভাবেই বলেন-
"পা টার ঘা বাইড়া গেছে বউ।"
" তাইলে থাক, আইজকা আর যাওনের দরকার নাই। খুব বৃষ্টি-বাদল হইতাছে, " স্ত্রীর নরম মোলায়েম মাখা কন্ঠ।
" জমির মাঝি মনে হয় নাও টা দিব না।" দীর্ঘ একটা নিঃশ্বাষ বেরিয়ে আসে তার ভেতর থেকে। বহুদিন যাবত ধরেই জমির মাঝির নাও দিয়ে মাছ ধরে আসছেন তিনি। প্রতি সপ্তাহ তিন শত টাকা নৌকার ভাড়া দিতে হয়। টানা বৃষ্টিতে নদীর অবস্থা খারাফ। মাছ পাওয়া যায় না। দু সপ্তাহের ভাড়া জমে আছে। জমির মাঝি বলে দিয়েছে, ভাড়ার পরিশোধ না করলে নাও দিবে না।
জোলেখা তার পায়ের সামনে এসে দাঁড়ায়। হাতে হাবিজাবি ঔষধি লতাপাতা দিয়ে মসলা বানানো কৌটা। তার পা'টা টেনে নিয়ে ঘায়ের উপর মসলাটা মেখে দিয়ে একটা ছেড়া কাপড় দিয়ে মুখটা বন্দ করে দেয়। ক্ষতটার যন্ত্রণা কিছুটা কমে আসে।
" না দিলে নাই। যাওনে দরকার নাই। বাচুম আর কয়দিন, মাইনষের বাড়ি কাম-কাজ কইরা চলুমনে।" একটা পিড়া টেনে বসতে বসতে কথা গুলো বলে যায় জোলেখা।
" এই আষাঢ় মাসটা যদি বউ আমাগো জিবনের শেষ আষাঢ় মাস হইত!", কন্ঠটা কেপে উঠে তার, চুখটা ভিজে উঠে। " কষ্ট ত জিবনে কম করি নাই। আল্লা আমাগোর দিকে তাকাইল না"। বাহিরের বৃষ্টি স্নাত গাছ গুলোর দিকে তাকান তিনি। ঝম ঝম করে পড়া বৃষ্টির সাথে তাল মিলিয়ে তার চুখ দিয়ে পড়তে থাকে বেদনার পানি।" পোড়া কপাল আমাগোরই, মরনের পর কবরে মাটি দেওনের একটা লোক আল্লায় দিল না"। কান্নায় ভেঙে পড়েন রহমান মিয়া। হাউমাউ করে আজ কাদতে ইচ্ছে করছে তার। বহু দিন ধরে কাদা হয়নি। প্রতিক্ষার প্রহর যেন শেষ হয়ে যাচ্ছে। চূখের বাধ যেন আজ ভেঙে পড়েছে। বৃষ্টিতে স্নাত গাছ গুলো আজ তাল মিলিয়ে যাচ্ছে তার কান্নার সাথে। গর্জে উঠা আকাশের মেঘে গর্জন গুলো যেন উপহাস করে যাচ্ছে এই জির্ন পরিবারের সাথে। কেউ ফিরে তাকাচ্ছে না, স্বয়ং সৃষ্টি কর্তাও না। কুড়ের ঘরটা এক পাশে অনেকটা হেলে পড়েছে। মাকড়শা গুলো ঝাল বেধে বেধে দখল করে ফেলেছে ঘরের এপাশ থেকে ওপাশ। সব কিছুই যেন তার ভেঙে পড়ছে। কোন কিছুই আর ঠিক হবে না।
পৃথিবীতে নিজের শুক্রানো কে টিকিয়ে রাখার জন্য চেষ্টার কোনো কমতি করননি। কত কবিরাজের কবিরাজি করিয়েছেন। মাজারের পর মাজারে গিয়ে প্রার্থনা করে এসেছেন। কিন্তু আজ সব কিছুই ব্যার্থ। সৃষ্টি কর্তা তকাননি তার দিকে। তার বংশকে টিকিয়ে রাখার প্রয়োজন বোধ করেননি। কেউ তাকায়নি তাদের দিকে। উপহাস করে গেছে সবাই। স্ত্রীকে বন্দা বলেছে, তাকে পুরুষত্বহীন বলেছে, ব্যার্থতা কোথায় তা কেউ খুজে দেখেনি। জিবনের শেষ প্রান্তে আজ চলে এসেছেন। বেশিদিন হয়ত আর বাচবেন না। আক্ষেপটা থেকেই গেল, এই পৃথিবীতে তাকে বাবা বলে ডাকার কেউ রেখে যেতে পারলেন না।
মানুষ বেচে থাকে আশায়। কিন্তু যখন আশার ভরসা হারিয়ে ফেলে তখন জীবন হয়ে যায় পাথরের মত। সে বেচে থাকে ঠিকি, কিন্তু সেই বেচে থাকাটা শুধু বেচে থাকার জন্য। তার সমস্ত আশা শেষে আজ নিঃশ্ব। ভরসার কোনো খড়কোটা নেই তার পৃথিবীতে। বেচে থাকারো সময় ফুড়িয়ে এসেছে। চুখ গুলো আর আগের মত দেখতে পায় না, সব কিছু গোলা গোলা লাগে। হাতটা আর আগের মত চলে না, কেমন যেন ভারি ভারি হয়ে থাকে সব সময়। জোলেখা বলতে গেলে শয্যাশায়ী। এখন খুব বেশি একটা হাটতে পারে না। বলতে গেলে, ঘরে শুয়ে শুয়েই তার জীবন চলছে। এই বয়সে তো আর অন্যের ঘরে কাজে পাঠানো যায় না। তাকেই বের হতে হবে কাজের সন্ধ্যানে। জমির মাঝির নৌকা না দিলে অন্য কোনো উপায় খুজতে হবে। মকবুল মিয়ার কাছে যাওয়া যেতে পারে। মকবুল মিয়া দান খয়রাত করেন অনেক। বিপদে আজ পর্যন্ত কাউকে খালি হাতে ফেরান নাই, হয়ত তাকেও ফেরাবেন না।
আকাশ বিকট বিকট শব্দে ফেটে পড়ছে। ভুরু কুচকান রহমান মিয়া। একটা বিকট সব্দে চমকে উঠে পুরো বাড়িটা। জোলেখা ভয় পেয়ে লাফ দিয়ে উঠে তার কাছে এসে বসে। বাজ পড়েছে বোধ হয়। পড়ুক বাজ, বেলা অনেক হয়েছে। বসে থাকলে চলবেনা। পিট টান টান করে বসা থেকে উঠে পড়েন তিনি। হাতের ছাতাটা মেলে ধরেন দেখেন, ঠিক আছে কিনা। একটা সিক সম্পুর্ন ভেঙে গিয়েছে। ভেঙে পড়া দিকটা অনেকটা হেলে পড়েছে। কয়েকটা দিক ফোটা ফোটা হয়ে গেছে। সমস্যা নেই তাতে। কোনো মতে মাথাটা বাচাতে পারলেই হয়।
" আইজকা যাওনের দরকার নাই।"
কোনো উত্তর দেননা তিনি। ক্ষুধা আসে যখন আবেগ হার মানে ক্ষুধার কাছে। স্ত্রীর আবেগের বাধাকে অগ্রাহ্য করেই বের হন তিনি। কাধে তুলে নেন পুরনো সেই জালটা। ভাঙা ছাতাটা এক হাত দিয়ে মেলে ধরেন মাথার উপর। যাত্রা করেন হাওড়া নদীর পানে। পেছনে পড়ে থাকে একটি হেলে পড়া কুড়ের ঘর আর একজন বৃদ্বা প্রহরি।
কাদা মেড়ে মেড়ে তার পা দুটো এগিয়ে যাচ্ছে নদীর দিকে। মকবুল মিয়া আর জমির মাঝির বাড়িটা নদীর পাশেই। জোরে কদম চালান রহমান মিয়া। টপ টপ করে পড়া বৃষ্টির পানি ভিজিয়ে দিয়ে যাচ্ছে তার ছাতাটা। ফাকে ফাকে কয়েক ফোটা এসে পড়ছে তার মাথায়। আকাশ অনবরত গর্জন করেই যাচ্ছে। সৃষ্টি কর্তা ক্ষেপে গেছেন বোধ হয়। চপ চপ করে শব্দ হচ্ছে তার প্রতিটা কদমে। সব কিছুকে পেছনে ফেলে দ্রুত হাটতে থাকেন তিনি। আজ কোথাও বিরতি নিবেন না। না কোনো গাছ তলায় না কারো বাড়িতে। হাটতে থাকেন তিনি। হাটার গতি কমে যায়। ক্লান্ত বোধ করেন রহমান মিয়া। অন্ধকার হয়ে উঠে তার চতুর দিক। এক সময় তার হাতের ছাতাটা পড়ে যায়। কাধে জালটা আছে কিনা ঠিক ঠাহর করতে পারেন না। মাটিতে পড়ে যান তিনি। চিৎকার কর ডেকে যান জোলেখাকে। তার চিৎকার গুলো মিশে যায় মেঘে গর্জনের সাথে। মাটি গুলো যেন দ্রুত সরে যেতে থাকে। তাকে ভাসিয়ে দিয়ে যাচ্ছে মহা শুন্যে। তিনি কিছু একটা আকড়ে ধরার চেষ্টা করেন। সব কিছুই যেন ফসকে যাচ্ছে হাত থেকে। দূরে সরে যাচ্ছে সব কিছু। যেন বিদায় জানাচ্ছে তাকে নতুন এক অধ্যায়ে এই পৃথিবীর সমস্ত গ্লানি থেকে মুক্তি দিয়ে। দূর থেকে ক্ষিন একটা আওয়াজ ভেসে আসে- বিদায় রহমান সাহেব।
©somewhere in net ltd.