![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
১.
প্রতিবারের মত এবার ও ঈদের নামাজ শেষ করে ইশরাক তার বন্ধুদের নিয়ে ঘুরতে বের হল। চারদিকে আনন্দের আমেজ। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা বেলুন আর বাঁশি হাতে এদিক ওদিক দৌড়াচ্ছে। মহিলারা শাড়ি পড়ে এ বাড়ি থেকে ও বাড়ি যাচ্ছে। একজন আরেকজনকে সেমাই খাওয়াচ্ছে। চায়ের দোকানে ঢাকা থেকে যারা এসেছে তারা আড্ডায় মেতে উঠেছে। তাদের শহুরে জীবনের কথা অনর্গল শুনিয়ে যাচ্ছে অর্ধশিক্ষিত কিংবা অশিক্ষিত গ্রামের মানুষদের। আর সব শেষে নিজের সম্মান রাখার জন্য চায়ের বিলটা ও তারাই দিচ্ছে। ইশরাকরা এসবের কাছে ও নেই। তারা স্কুলের সব বন্ধুরা মিলে সবাই সবার বাড়িতে যায়। পুরা গ্রাম ঘুরে বেড়ায়। স্কুল এর স্যারদের সাথে দেখা করে। আর ও কত কাজ তাদের। আজকে একটু বৃষ্টি হয়েছিল কিন্তু তারপর ও তারা ঘুরতে বেড়িয়েছে। বিকাল ঘনিয়ে এসেছে। সূর্যটা ও আস্তে আস্তে আপন ঘরে ফিরে যাচ্ছে। পুকুর পাড়ে হয়ত একটু পর পাখির কিচিরমিচির শুরু হবে। রাকিবের বাড়ি থেকে বের হয়ে সবাই এখন হোসেনদের বাড়ির দিকে হাটা শুরু করল। এমন সময় হঠাৎ ইশরাকের ফোনটা বেজে উঠল।
হাতে নিয়ে দেখল তার রুমমেটের নাম্বার থেকে ফোন এসেছে।
- কিরে, ঈদ কেমন করলি?
কিন্তু ওপাশ থেকে অপরিচিত একটা কন্ঠ শুনা গেল
- আপনি ইশরাক বলছেন?
-জ্বি
-আপনি কি এখন রাজবাড়ি সদর হাসপাতালে আসতে পারবেন?
-কেন?
- যার এই ফোনটা,তিনি বাসের সাথে এক্সিডেন্ট করেছেন। অবস্থা খুব একটা ভাল না। তার সাথে আর ও একজন আছেন, তিনি একটু সুস্থ আছেন।
-আচ্ছা, আমি আসছি।
ইশরাক দ্রুত সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেল বাড়িতে। কিছু টাকা পকেট এ নিয়ে সে বেড়িয়ে পড়ল।
ইশরাকের বাড়ি রাজবাড়ির পাংশা উপজেলায়। সেখান থেকে বেশি সময় লাগবে না।
ইশরাক ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ এ পড়ে। গত তিন বছর ধরে সে আর ফাহিম একই রুম এ থাকে। ফাহিম শুধু তার রুমমেটই না , ভাল একজন বন্ধু, ভাল একজন ভাই। কত স্মৃতি জড়িয়ে আছে তার সাথে। একবার ইশরাক এর অনেক জ্বর হয়েছিল। দুই দিন ধরে মাথায় পানি দিয়েছে, পাশে বসে রাত জেগেছে ফাহিম।
দুইজন মিলে ছুটির দিনগুলোতে ফরিদপুর এর বাহিরে ঘুরতে যেত। পুরাতন রাজার বাড়ি, পদ্মা নদীর পাড়, নদী গবেষণা কেন্দ্র, আর ও কত জায়গা। তারা ঘুরে আসার পর ফেসবুকে পোস্ট দিত, তারপর মেডিকেল এর সবাই সেটা দেখতে যেত।
দুই তিন দিন ছুটি হলেই ইশরাক চলে যেত বাড়িতে । ফাহিম কোথাও যেত না। হোস্টেল এ থাকত।অনেকদিন এর বন্ধ পেলে খুলনা যেত। বলত যে তার পরিচিত বন্ধু থাকে সেখানে।বাড়িতে ও কথা বলতে দেখা যেত না। জিজ্ঞেস করলে বলত, ফোন করিতো। তোরা দেখিস না।
বাড়ি থেকে কোন দিন টাকা নিতে ও দেখা যায় নাই। দুইটা টিউশনি করাত। সে টাকাই চলে যেত ভাল ভাবে।
সবসময় হাসি খুশি থাকত ফাহিম। কারো সাথে কোনদিন মন মালিন্য ও হয়নি।হোস্টেলের অনেকেই তাকে পছন্দ করত।
২.
রাজবাড়ি বড়পুল নেমে হেটেই সদর হাসপাতাল গেল ইশরাক। চারদিকে সন্ধ্যা নেমে এসেছে কিন্তু রাস্তার ল্যাম্প পোস্টের আলোতে বুজাই যায় না।ঈদের দিন হওয়ায় রাস্তায় অনেক ভীড়।
ইমার্জেন্সি রুমে এসে বলতেই তাকে ফাহিমের রুম এ নিয়ে গেল একজন। মেডিকেল ছাত্র পরিচয় দেওয়াতে একটু আলাদা সম্মান পেল সে। সার্জারি ইউনিটের প্রথম রুমটাতেই ফাহিমকে রাখা হয়েছে। সে রুম এ তার পাশেই অন্য একজন শোয়া। তার মাথায় ব্যান্ডেজ করা। ফাহিম সম্পুর্ন অজ্ঞান অবস্থায় আছে। স্যালাইন চলছে, ফাইলটা হাতে নিয়ে ইশরাক দেখল দুই ব্যাগ রক্ত দেওয়া হয়ে গেছে। পাশের বেডে যে শোয়া ছিল সে হয়ত ঘুমাচ্ছিল কিন্তু ইশরাক ঢোকার সাথে সাথে ঘুম ভেঙে গেল তার। এক পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ইশরাকের দিকে। ইশরাক তাকাতেই দৃষ্টি নিচে নামিয়ে ফেলল। তারপর ফাহিমের দিকে তাকাল। চোখ থেকে গড়িয়ে কয়েকফোটা পানি আস্তে আস্তে কানের নিচ দিয়ে নিচে পড়ে গেল।
ইশরাক এসে তার বেডেই বসল। পরিচয় দিল। সেই ছেলেটা ততক্ষণে মুখ খুলেছে কিন্তু কান্নার জন্য কথা বলতে পারছে না। অনেক কষ্টে তার নাম বলল। সে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। ফাহিমের অনেক ভাল বন্ধু। ছোট বেলা থেকে এক সাথেই মানুষ হয়েছে।
কিন্তু ইশরাক বুজতে পারল না তারা আজকে বাড়িতে থাকার কথা কিন্তু রাজবাড়ি কেন।
ছেলেটা আস্তে আস্তে উঠে বসেছে।
- আপনার বাসা কোথায়?
-ফাহিমের সাথেই
-আপনারা এখানে এসেছেন কেন?
এ কথার কোন উত্তর দিল না সে। চুপ করে বসে রইল।
-কিভাবে এক্সিডেন্ট হয়েছে বলেন দেখি
ছেলেটা অনেক আস্তে আস্তে বলল যে তারা এখানে ঈদের নামাজ পড়ে পাংশা যাওয়ার জন্য দাড়িয়েছিল। হঠাৎ একটা বাস এসে ধাক্কা মেরে যায়। ফাহিম সামনে থাকায় তার আঘাত বেশি লেগেছে।
-কিন্তু কেন আপনারা এখানে নামাজ পড়েছেন?
- আমাকে এক গ্লাস পানি দিবেন। বড় তেষ্টা
পেয়েছে।
ইশরাক বাহির হয়ে দোকান থেকে কিছু হালকা খাবার আর পানি নিয়ে আসল।ছেলেটা পানি খেয়ে ফাহিমের বেডে এসে বসল।
-ফাহিমের বাবা মা কে জানিয়েছেন? আপনার বাসায় জানিয়েছেন?
ইশরাকের প্রশ্নটা শুনে হালকা হাসি দিয়ে মূর্হতের মধ্যে তার মুখে মেঘ জমে গেছে। এই মনে হচ্ছে চোখ দিয়ে বৃষ্টি পড়বে। আর এইটার জন্যই সে মনে হয় প্রস্তুত ছিল।
কিছু একটা বলতে যাবে ছেলেটা এমন সময় ডিউটি ডাক্তার এসে ঢুকল। ইশরাক তার পরিচয় দিল।
-আসলে, তুমিতো মেডিকেল ছাত্র, সবই বুজ। ওর অনেক রক্ত বেড়িয়েছে। আমরা ২ ব্যাগ দিয়েছি কিন্তু রোগির অবস্থা যেকোন সময় খারাপ হতে পারে। সব সময় ভাইটাল সাইন গুলো দেখবা। সমস্যা হলে আমাকে ডাক দিবা।
কথা গুলো বলেই তিনি চলে গেলেন।
পাশ থেকেই ফাহিমের ফোনটা হাতে নিল ইশরাক।
প্যাটার্ণ লক সে জানত। খুলেই দেখল একটা মেসেজ এর সেন্ড অপশান ক্লিক করেছ কিন্তু পাঠাতে আর পারেনি, ইশরাক সেই মেসেজটা পড়া শুরু করল
" আসসালামু আলাইকুম। রুমমেট তোমার বাড়ি আসতেছি। তোমাকে সারপ্রাইজ দিব বলে আগে জানাইনি। ভাবতে পার ঈদের দিন আমি বাড়ির সবাইকে রেখে কেন তোমাদের বাড়ি যাব। আসলে আমার এ বন্ধুটি ছাড়া আমার আর কেউ নেই। অনেক ছোট থাকতে বাব মা মারা গেছেন। দুই বছর বয়স পর্যন্ত নানির কাছে ছিলাম কিন্তু নানি মারা যাবার পর আমাকে সবাই মিলে এতিম খানায় রেখে যায়। আমি যেন পরে ফিরে যেতে না পারি সে জন্য এতিমখানাতে ভুল ঠিকানা দিয়ে গেছে। আমার বাড়ি কোথায় আমি জানি না। এতিমখানায় আমি আর আনিস দুইজন এক সাথে থাকতাম। খুব ভাল বন্ধুত্ব আমাদের। তুমি যখন বাড়িতে কথা বলতে তখন আমি রুম থেকে বের হয়ে ছাদে চলে যেতাম। হয়ত দুই ফোটা চোখের জল ফেললে মনটা শান্তি পেত। তুমি যখন বাড়ি যাও, আমার ও খুব ইচ্ছা করত বাড়ি যেতে কিন্তু আমারতো সেই এতিমখানা ছাড়া আর কোন ঠিকানা নেই। তোমার সাথে তোমার বাড়িতে ঈদ করতে খুব ইচ্ছা করত কিন্তু লজ্জায় বলতে পারিনি। প্রতিটি ঈদের সময় তোমরা সবাই বাসায় চলে যেতে, আমি একা থাকতাম। তখন আনিস চলে আসত। ঈদের দিন ইচ্ছা করত মায়ের হাতের সেমাই খাব কিন্তু কি আর সেমাই খাওয়া,মাকেই কোনদিন দেখিনি। কোন একটা ঈদগাহে নামাজ পড়ে দুইজন মিলে ঘুরতাম। কিন্তু এবার খুব ইচ্ছা করছে তোমার সাথে ঈদ করব। আমার সাথে কিন্তু আনিস ও আসবে। রাগ করোনা। আমরা এখন বড়পুল আছি, পাংশার বাসে উঠব।
প্রতিদিন একজন মহিলা স্বপ্নে আমাকে ডাকে তার কাছে চলে যেতে, হয়ত তিনি আমার মা হবেন। যাহোক বাস আসতেছে, আমি উঠলাম। তুমি পাংশা বাস স্ট্যান্ড আস। "
আজ প্রায় তিরিশ বছর হল ইশরাক ডাক্তার হয়েছে।সময় পেলে আজ ও সে পাংশা বাস স্ট্যান্ড বসে থাকে কিন্তু ফাহিম আর ফিরে আসে না।
©somewhere in net ltd.