নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আনন্দের জন্য লেখা

MMohin

মহিউদ্দিন

MMohin › বিস্তারিত পোস্টঃ

বাবার স্মৃতি

২৪ শে জুন, ২০১৬ ভোর ৪:৩৯

১..

সন্ধ্যায় ফোন দিয়ে সিট বুকিং করে রাখায় ৫.৪০ এর বাসে এসেই তার সিট পেল জামিল । বুকিং না দিয়ে রাখলে সিট পাওয়াই দুষ্কর এ সময়ে। গরমকাল হওয়ায় চারদিকে ভোরের আলো অনেক আগেই ফুটে গেছে। রাস্তায় দু'একটি অটো কিংবা মোটর রিকশা আছে। অনেকটা রাস্তাই ফাকা।তার সিটে বসেই পাশের জানাল খুলে দিল। এক ঝাপটা বাতাস এসে শার্টের কলার আর মাথার চুল গুলো এলোমেলো করে দিয়ে গেল। ড্রাইবার ততক্ষণে ইঞ্জিন স্টার্ট করেছে। বাস পুরাতন বাস স্ট্যান্ড থেকে ঢাকার রাস্তায় সাঁইসাঁই করে ছুটে চলল। সকালের বাস হওয়াতে অনেকেই ঘুমিয়ে পড়েছে কিন্তু জামিল প্রতিবার বাসে উঠেই মাকে ফোন দিয়ে দেয়, আজকে ও তাই করল। ফোনটা রেখে ফেসবুকে লগিন করল। তার নিউজফিড এ একই রকম স্ট্যাটাস এ ভরে গেছে। সবাই বাবার সাথে সেলফি দিচ্ছে, কেউ বা গ্রুপ ফটো দিচ্ছে, কেউ বা বাবাকে নিয়ে কবিতা লিখেছে। বাবাকে ভালবাসে সেটা বুজানোর জন্য আর ও কত কি। আর ফেসবুক ভাল লাগছে না , তাই লগ আউট করে মোবাইলটা পকেট এ রেখে দিল। এক দৃষ্টিতে জানালা দিয়ে বাহিরে তাকিয়ে থাকল।মাঠের মাঝখন দিয়ে হাইওয়ে চলে গেছে। তার পাশেই জমি গুলোতে ছোট ছোট পাট গাছ উঠেছে, বাতাসে সে গুলো হেলে দুলে বেড়াচ্ছে। আইলে একটি গরু বাধা, দু'টি বাছুর চেষ্টা করছে কে আগে দুধ খাবে। পাশের একটি পাটক্ষেতে কয়েকজন কৃষক মাঝখান থেকে পাট গাছ তুলে তুলে পাতলা করে দিচ্ছে যেন বাকি গুলো বড় হলে মোটা হয়। ক্লাস টু বা থ্রিতে যখন পড়ত তখন বাবার সাথে সে ও মাঠে যেত। ছোট্ট একটা পাট ক্ষেত তাদের ও ছিল। যে গাছ গুলো আগাছা হিসেবে উঠানো হত সেগুলো বাবা সুন্দর করে আটি করে বেধে দিয়ে তার মাথায় উঠিয়ে দিত আর বলত, " তোর মা'রে কইছ সুন্দর কইরা রসুন দিয়া ভাজি করত। আমি দুপুরে আইয়া যেন পাই। "পাঠ শাক মাথায় নিয়ে লাফাতে লাফাতে বাড়ি চলে যেত। বাবা যখন বাড়ি ফিরত, তখন মা প্লেট এ সাদা ভাত আর পাঠ শাক দিয়ে তাকে আর তার বাবাকে ভাত দিতেন। বাবা কাঁচা মরিচ দিয়ে কচ কচ করে খেতেন, সেই শব্দ আজ ও যেন জামিলের কানে বাজে। পকেটে মোবাইলটা বেজে উঠতেই ধ্যান ভাঙল তার।

- হ্যালো, কিরে ফাহিম। এত সকালে ফোন?

- দোস্ত, আমি হাসপাতালে আসছি। তিন নাম্বার বেড এর রোগীর ফাইলে সকালের ডোজ লেখা নাই, স্যার কি দিতে বলছিল?

-স্যার তো গতকাল রাত পর্যন্ত দিতে বলছিল, এ জন্য সকালের ডোজ আমি লিখি নাই।স্যার একটু পর রাউন্ড এ আসবে। তখন জিজ্ঞেস করিস।

ফোনটা রেখে সিটটা একটু পিছনে নামিয়ে দিয়ে হেলান দিয়ে বসে পড়ল। মাত্র ধামরাই এসেছে। আকশে তখন একটুকরা মেঘ সকালের যৌবনদীপ্ত সূর্যের সাথে লুকোচুরি খেলে চলেছে।প্রতিবছর এই দিনটাতে যতই কাজ থাকুক, তা রেখে বাড়িতে যায়। ইন্টার্নশিপ এর সময় অনেক চাপ থাকে, তারপর ও স্যারকে ম্যানেজ করে বাড়িতে যাচ্ছে সে।

গাবতলি এসে নেমে পড়ল। সেখান থেকে তার যাত্রা সায়েদাবাদ বাস স্ট্যান্ড। মাত্র সাড়ে নয়টা বাজে। এখন লোকাল বাসে উঠার জন্য নিয়মিত সংগ্রাম করা লাগে কারণ এই সময়টাতে সবাই অফিস যায়।কিন্তু গাবতলিতে বাস খালিই থাকে। আট নাম্বার বাসে উঠে জানালার পাশে বসল। ফরিদপুর থেকে আসতে যে কষ্ট হয়েছে, তার থেকে আর ও বেশি কষ্ট এখানে হবে। চাপাচাপি, ধাক্কা দেওয়া, কে কাকে আগে ঠেলে ভিতরে উঠবে, ভাড়া নিয়ে তর্ক করা, এসব ঢাকার লোকাল বাসের নিয়মিত চিত্র। সে সব দিকে খেয়াল না করে এক দৃষ্টিতে বাহিরের ব্যস্ত রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছে । রাস্তার পাশে কেউ হয়ত তার ফুটপাতের দোকান খুলে সাজাচ্ছে। ছোট ছোট বাচ্চারা মায়ের হাত ধরে স্কুলে যাচ্ছে। বেশি জ্যাম থাকায় কেউ বা বাস থেকে নেমে হেটে অফিসের দিকে যাচ্ছে। এই সব দেখতে দেখতে এক সময় সায়েদাবাদ এসে পড়ল।মোবাইলটা হাতে নিয়ে দেখল মায়ের ২টা কল। আর ততক্ষণে ১১.২৫ বেজে গেছে। তাদের এলাকার বাসটা ছেড়ে দিবে দিবে এমন অবস্থা, ড্রাইবার এক হাত দুই হাত করে বাসটাকে স্ট্যান্ড থেকে বের করছে। হেল্পার চিৎকার করেই চলছে "এই হোমনা , গেল গা, ছাইড়া দিল, হোমনা,এই দিকে।"
মোবাইলটা হাতে রেখেই এক দৌড়ে এসে বাসে উঠল জামিল। ভাগ্যিস,এখন ও জানালার পাশে একটি সিট খালি আছে, এসেই সেটাতে বসল। জানালাটা খোলাই ছিল। পকেটের টিস্যু বের করে মুখের ঘাম মুছে নিল। তারপর মা'কে ফোন দিল।
" মা, আমি সায়েদাবাদ এসে বাসে উঠছি। হাফেজ কাকারে বলেন তিনটার দিকে আসতে, আর মসজিদের ইমাম সাহেবকে ও বলেন আসতে।" কথাটা বলেই আবার সময় কাটানোর জন্য ফেসবুকে লগিন করল সে। একই অবস্থা, বাবাকে নিয়েই সবার লেখা। তার মধ্যে কয়েকজনের স্ট্যাটাস তার অবস্থার সাথে অনেকটা মিলে। সে গুলোতে লাইক দিতে লাগল। সবাই ছোট বেলায় বাবার কোলে আছে এমন ছবি দিচ্ছে। কিন্তু জামিলের কোন ছবিই নেই বাবার সাথে। গ্রামের ছেলে সে, অনেক দুরের বাজারে একটা স্টুডিও ছিল। কিন্তু কোনদিন ছবি তোলা হয় নি। সারাদিন মাঠে কাজ করে সন্ধ্যায় বাড়িতে আসত তার বাবা। বাবার কোলে উঠেছে কিনা মনে সেটাও মনে নেই। তবে প্রথম যেবার স্কুল এ ভর্তি হতে গিয়েছিল সেটা কিছু মনে আছে। একা সে স্কুলে ভর্তি হবে না, বাবাকে যেতেই হবে কারণ বাড়ির অন্যান্য যারা স্কুলে যায় তাদের কাছে শুনেছিল স্যাররা অনেক মারে। সেদিন আর স্কুলে যাওয়া হল না কারন বাবা তখন মাঠে চলে গেছে। পরেরদিন মাঠের কাজ ফেলে তাকে স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছিল। রাস্তায় বড় ট্রাক দেখে ভয় পেয়েছিল, আর তখন একবার তার বাবা কোলে নিয়েছিল। ক্লাস এইটে যখন বৃত্তি পায় তখন বাবা অনেকক্ষণ বুকে জড়িয়ে রেখেছিল তাকে। বাবার গরম অশ্রু তার কাঁধ ভিজিয়ে দিয়েছিল। আর বলছিল, "আমি তোরে মানুষের মত মানুষ করুম বাবা।" বাড়ির সবাইকে সেদিন মিষ্টি দিয়েছিল তার বাবা।

আবার ও ফোনটা বেজে উঠল।
-হ্যা, মা বলেন
- হুজুরদের কোথায় বসতে বলব?
- আমার আর বেশি টাইম লাগবে না , ঈদগাহের মাঠেই বসতে বলেন।

২.

জানালা দিয়ে ঠান্ডা বাতাস আসছে ক্রমাগত, আর তাতেই একটু তন্দ্রা লেগে আসছিল জামিলের। সামনের সিটে বসে একটি পাঁচ কি সাড়ে পাঁচ বছরের মেয়ে হঠাৎ চিৎকার দিয়ে উঠায় তন্দ্রা ভাব কেটে গেল তার।

-তোমার সাথে আমি কথা বলব না বাবা। কাল তুমি আমাকে আনতে স্কুলে গেলে না কেন।তুমি যাওনি, এ জন্য আমি গিফট কিনতে পারিনি। আজকে জান না ফাদার্স ডে। তুমি আমাকে বাস থেকে নেমে টাকা দিবা, আমি তোমাকে গিফট দেব।

মেয়েটির বাবা তখন হাসি মুখে বলল "আচ্ছা মা।"

আমি যখন কলেজ এ পড়তাম, ঢাকার ভাল একটি কলেজে; আমার সাথের বন্ধুদের বাবা কিংবা মা এসে নিয়ে যেত আর আমি তখন সে দিকে তাকিয়ে মনটা খারাপ করে মেসে চলে যেতাম। একবার অনেক চেষ্টা করেছি ফাদার্সডেতে বাবাকে বলার কিন্তু লজ্জায় পারিনি। তারপর ও অনেক চেষ্টা করেছি, তাও বলতে পারিনি। কথা গুলো মনে করে একটু হাসল জামিল।

বাস স্ট্যান্ড এ যখন নামল তখন প্রায় দুইটা বেজে গেছে। কলেজ এ পড়ার সময় বাবা এসে বসে থাকত নিতে কিন্তু এখন আর আসে না, নিজের দুনিয়া নিয়ে নিজেই ব্যস্ত আছে। একটা পরিচিত রিকশা দেখে উঠে পড়ল। যখন মেডিকেল এ ভর্তি হয়ে প্রথম বাড়ি আসে তখন তার বাবা প্রায় দশ বার জন মানুষ নিয়ে তাকে নিতে এসেছিল কারন সেই তার গ্রামের প্রথম ডাক্তার। বাবাকে কেউ নাম ধরে ডাকলে খুব রাগ করত, বলত আমাকে ডাক্তারের বাবা ডাকবি। কিন্তু আজকে সে একাই বাড়ি যাচ্ছে।
এইত মাত্র পনের বিশ মিনিট পর সে তার বাবার কাছে যাবে, এত চিন্তা কিসের।

রিকশাটা এসে একটা ঈদগাহের সামনে থামল। কয়েকজন হুজুর সেখানে বসে কুরআন পড়ছেন। ঈদগাহের উত্তর দেওয়ালের পাশেই একটি কবরস্থান। জামিল রিকশা থেকে নেমে জুতা খুলে মাঝ সারির একটি কবরের পাশে এসে দাড়াল। বাঁশের বেড়াগুলোতে শেওলা জমে গেছে। অনেক লতা গাছ কবরটাকে ঘিরে ফেলেছে। সে বাড়িতে আসলে নিয়মিত পরিষ্কার করে। কিন্তু আজকে তিনমাস আসতে পারে না, সে জন্য এমন অবস্থা। আজ থেকে তিনবছর আগে এই দিনটা তে তার বাবা তাকে রেখে চলে যায় না ফেরার দেশে। সে তখন মেডিকেল থার্ড ইয়ার এ পড়ে। ওয়ার্ড ফাইনাল দিয়ে মাত্র রুম এ এসেছে। পরীক্ষার কারনে মোবাইল নেয়নি। আজকে সে তার বাবাকে বলবেই যেভাবে হোক হ্যাপি ফাদার্সডে। মোবাইলটা হাতে নিতেই দেখে মামার নাম্বার থেকে একুশটি কল এসেছে। হঠাৎ করে তার পেটে মোচর দিল। কল ব্যাক করতেই শুনে তার বাবা আর ও দুই ঘন্টা আগে হার্ট আ্যটাক এ মারা গেছে। ফরিদপুর থেকে আসতে ছয় সাত ঘন্টা লাগে। যখন সে বাড়ি আসে তখন বাবাকে জানাজা দিতে নিয়ে গেছে। সেই যে শেষ দেখেছিল, আর কোনদিন দেখেনি। ঘরে অনেক বাবার ছবি খুজেছে কিন্তু কোন ছবিই ছিল না। তারপর থেকে এইদিনটা সে একবার হলে ও এসে বাবার কবর দেখে যায় আর হাফেজ কাকাকে দিয়ে কুরআন খতম করায়।

কাঁধে হাতের স্পর্শ পেয়ে পিছনে তাকায় জামিল। হাফেজ কাকা এসে তার পিছু দাড়িয়েছেন।

-বাবা, এসো। তোমার জন্য এতক্ষন দোয়া করিনি।

এক হাতে চোখের পানি মুছে আকশের দিকে তাকিয়ে কান্না কন্ঠে বলতে লাগল,' রাব্বির হাম হুমা কামা রাব্বা ইয়ানিস সগিরা। '

মেঘের খন্ড গুলো এখন আর নেই। সূর্যের আলোতে তার চোখের পানির প্রতিটি ফোটা চিক চিক করে চলেছে।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.